‘উই দ্য ডিসএবেলড পিপল অফ বেঙ্গল’এই পরিচিতি নিয়েই বেশ কয়েক জন প্রতিবন্ধী মানুষ প্রজাতন্ত্র দিবসে একত্রিত হয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতার এক ব্যস্ত বাস টার্মিনাস-এর পাশে। এই জমায়েতের ব্যানার-এ জ্বলজ্বল করছিল ‘নো টু সিএএ এনপিআর এনআরসি’। সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।
প্রতিবাদের ভাষা বেছে নেওয়া আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে বড় জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক বছরের প্রজাতন্ত্র দিবসের থেকে তাই ২০২০ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসটি সর্ব অর্থেই এদেশে আলাদা হয়ে থাকবে। মাত্রই কয়েক দিন আগে প্রকাশিত বিশ্ব জুড়ে চলা গণতন্ত্রের সমীক্ষায় ভারতবর্ষের স্থান পঞ্চাশেরও নীচে নেমে গেছে। এই লজ্জা মাথায় নিয়েই আমাদের মেনে নিতে হয় ৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবসে এদেশে সম্মানীয় অতিথি হয়ে আসেন ব্রাজিলের নারীবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বেষী, প্রকৃতি ধ্বংসকারী রাষ্ট্রপতি। অবশ্য ফ্যাসীবাদী শক্তিরা যে এভাবেই হাত মেলায় তার শিক্ষা আমরা ইতিহাসেই পেয়েছি। তাই দেশের প্রতিটি প্রান্তে যখন সাধারণ মানুষের আন্দোলন ক্রমেই জোট বাঁধতে থাকে তখন প্রজাতন্ত্র দিবসটিকেও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির সদম্ভ কুচকাওয়াজের বাইরে আক্ষরিকভাবেই প্রজাতান্ত্রিক করে তোলার দায়িত্ব নিতে হয় বৈ কি।
সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা প্রতিবাদী কর্মসূচীর মাঝে কলকাতা সাক্ষী থাকল এমন এক সম্মিলীত প্রয়াসের যেখানে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ বহুদিন পর্যন্ত মনে থাকবে শুধু এই কারণে যে তা বাংলায় যখন পড়া হচ্ছে শহরের এক ব্যস্ত বাস টার্মিনাস-এর পাশে তখন একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ তা পড়ছেন ব্রেইল-এর অক্ষরে আর তাঁর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন উপস্থিত মানুষেরা। এমন ঘটনার সাক্ষী এ শহর খুব বেশি হয় না। ‘উই দ্য ডিসএবেলড পিপল অফ বেঙ্গল’ এই পরিচিতি নিয়েই বেশ কয়েক জন প্রতিবন্ধী মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতার এই বাস টার্মিনাস-এ। পথচলতি মানুষদের কৌতুহলী দৃষ্টির মাঝেই বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা এবং তাঁদের সঙ্গে থাকা পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা স্পষ্ট করে দিলেন আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে প্রজাতন্ত্র দিবসের উদ্যাপনও প্রতিরোধের বার্তা দিতে পারে। এই জমায়েতের ব্যানার-এ জ্বলজ্বল করছিল ‘নো টু সিএএ এনপিআর এনআরসি’। যে মানুষগুলি এই অগণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারবিরোধী আইনগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন তাদের মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষেরা থাকবেন শুরুর দিকেই। অথচ কী আশ্চর্য কৌশলে সরকার এই সমস্ত আলোচনায় প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের উল্লেখটুকু পর্যন্ত করছেন না।
এদিনের জমায়েতের শুরু থেকেই বারবার উল্লেখ করা হচ্ছিল প্রজাতন্ত্র দিবসে এমন এক ভারতবর্ষের জন্য শপথ নেওয়া হচ্ছে যেখানে কোনও কিছুর ভিত্তিতেই কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। কাওকে তার নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠতে হবে না। জমায়েতে উপস্থিত দীর্ঘদিনের প্রতিবন্ধী অধিকার ও লিঙ্গবৈষম্যবিরোধী অধিকার আন্দোলনের কর্মী শম্পা সেনগুপ্ত যেমন বললেন, “এই জমায়েতে উপস্থিত কারওর নাম আলাদা করে বলা হচ্ছে না। জানা যাচ্ছে না কে কোন্ ধর্মের মানুষ। সবাই একত্রিত হয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ হচ্ছে, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র রক্ষার শপথ নেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশটিও যেন তেমনই থাকে, যেখানে ধর্মের পরিচয়ের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হবে না।”
এরপর সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করা হয় ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়। বাংলায় তা পড়া হয় ব্রেইল-এর মাধ্যমে। এই প্রস্তাবনা পাঠ ও পুরো জমায়েতের প্রতিটি বক্তব্য একজন সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ইন্টারপ্রেটার সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ-এ অনুবাদ করছিলেন। এক দেশ হলেও ব্রেইল থেকে সাইন – প্রতিটি ভাষাই যে এ দেশে নাগরিকের স্বর ও মুক্তচিন্তা প্রকাশের মাধ্যম তা প্রজাতন্ত্র দিবসের এই জমায়েতেই স্পষ্ট হয়ে গেল।
প্রস্তাবনা পাঠের পর কবিতায়, গানে, বক্তব্যে, বাদ্যযন্ত্রে বারেবারে উঠে এল দেশের গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার রক্ষার বিষয়টি। সেখানে মিলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে ফৈজ আহমেদ ফৈজ, কৈফি আজমি থেকে শঙ্খ ঘোষ থেকে বরুণ গ্রোভার। ফ্যাসিজমের বিরূদ্ধে, রাষ্ট্রশক্তির বিরূদ্ধে প্রতিবন্ধী মানুষদের লড়াইও যে কোনওভাবেই থেমে নেই তাই প্রতিটি শব্দে বুঝিয়ে দিলেন এদিন অংশগ্রহণকারীরা। কেন এ বছরের ২৬শে জানুয়ারি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল প্রশ্ন রেখেছিলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্র সোমেন দত্ত ও মনজিৎ কুমার রামের কাছে। তারা দু’জনেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। সোমেন বললেন, “দেশজোড়া আন্দোলনের বাতাবরণ চারদিকে রয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, এনআরসি ইত্যাদি নিয়ে রাজ্যসভায় আলোচনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, বিভিন্ন জনসভায় বারবার এগুলি নিয়ে কথা বলা ও সিএএতে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা নিয়ে যে আবহ তৈরি হয়েছে সেখানে এ বছরের প্রজাতন্ত্র দিবস অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এখন আমরা জানি বিভিন্ন আন্দোলনে সংবিধান পাঠ ও আমাদের জীবন, জাতীয় জীবনে সংবিধানের বিভিন্ন সূত্রগুলির গুরুত্ব কতখানি তা নিয়ে আলোচনা অনেকটা বেড়েছে, ফলে প্রজাতন্ত্র দিবস তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।” মনজিৎ যোগ করলেন, “সেইজন্যই আমাদেরও কিছু বলার ছিল। কারণ আমরা নিজেদের বিশেষ মার্জিনালাইজড কমিউনিটি বলে দাবি করি। আমাদের প্রতিবন্ধকতা আছে, সমাজও আমাদের একরকমভাবে দেখে। সিএএ বা এনআরসি হলে আমাদের যে সমস্যা হবে, ধরুন, একজন কেয়ার গিভার আছেন, তার ছেলে নাগরিকত্ব পেলেন, তিনিও পেলেন না। তাহলে তারা দু’জন তো আলাদা হয়ে গেলেন। তাহলে সেই কেয়ার গিভার বা ছেলেটি তাদের কি হবে? তারা দু’জনে কি নাগরিক রইলেন? মানুষ হিসাবে যে মানবিকতা পাওয়ার কথা তা কি পেলেন? যেকোনওরকম কাগজ দেখাতে গেলে আমাদের মতো দৃষ্টিহীনদের তো সাহায্য নিতেই হয় কারওর না কারওর। এবার আমি এই সমস্যা নিয়ে ছোটাছুটি করব কোথায়? কার কাছে যাব? কোথায় দেখাব?” কথার সূত্র ধরে সোমেন বললেন, “আসামে এনআরসি-এর যেসব ঘটনার কথা আমরা জানছি তাতে শুনেছি কীভাবে উৎকোচ দেওয়া ও নেওয়া হয়েছে। যেকোনও সরকারি প্রক্রিয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে আমরা জানি। এনআরসি-র মতো কোনও জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী সরকারি প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রতিবন্ধী মানুষেরা। তারা সবচেয়ে মার্জিনাল, সবচেয়ে ভালনারেবল কমিউনিটি।”
সোমেন, মনজিৎ দু’জনেই মনে করছেন নাগরিকত্ব প্রমাণ শুধু নয়, নাগরিক কি নাগরিক নন সেই বোধটিও অনেক প্রতিবন্ধী মানুষের তৈরি হয়নি। যেমন বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের কোনও ডিক্লারেশনই গ্রহণ করা হয় না। তাঁরা জানালেন, এখন এমন আইন আছে যে কোনও ফর্ম-এ মানসিকভাবে অসুস্থ কলামটি যদি পূর্ণ করা হয় তাহলে তার আর পরবর্তী কোনও ডিক্লারেশন গ্রহণই করা হয় না। ফলে প্রশ্ন ওঠে সেই মানুষটি তার নাগরিকের অধিকার, মানবাধিকার কী করে রক্ষা করবেন! এই কথাবার্তাতেই তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম সিএএ, এনপিআর, এনআরসি বিরোধী আন্দোলনগুলিতে আরও বেশি সংখ্যক প্রতিবন্ধী মানুষদের উপস্থিতি চোখে পড়ছে না কেন? মনজিৎ জানালেন, “আসলে এতদিন পর্যন্ত প্রতিবন্ধীরা যে নাগরিক সেই কথাটাই বলা হত না। গত ১০, ২০, ৩০ বছর ধরে আমরা বাইরে, রাস্তাঘাটে, সমাজে বেরচ্ছি। ফলে মানুষের ধারণাই তৈরি হয়নি যে আমরা প্রতিবাদ করতে পারি, একটা কোনও রাজনৈতিক আইনের বিরূদ্ধে আমাদের বক্তব্য থাকতে পারে অথবা আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা বা সাংস্কৃতিক বোধ থাকতে পারে। ফলে তারা ভাবতে পারেন না যে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ সিএএ এনআরসি-এর বিরূদ্ধে কথা বলতে পারেন, হয়তো তাই ইনক্লুশন-এর কথাও ভাবেন না।” সোমেন জুড়লেন, “দেখুন একটা সত্যি কথা হল ফিজিকাল এনভায়রনমেন্ট আমাদের এখানে বেরিয়ার ফ্রি নয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় বাস্তবে যেখানে ফুটপাথই নেই সেখানে কী করে অ্যাকসেসিবল ফুটপাথ দাবি করব? এটাই আমাদের দেশের বাস্তবতা। কোনও মানুষই নিরাপদ বোধ করছেন না। যার নামে হুসেন রয়েছে, মহম্মদ রয়েছে তিনিও নিরাপদ বোধ করছেন না, যিনি মহিলা তিনিও রাত্রে নিরাপদ বোধ করছেন না, আমি প্রতিবন্ধী মানুষ আমি তো আরওই নিজেকে নিরাপদ বোধ করব না। কিন্তু এরকম অবস্থায় দাঁড়িয়েও প্রতিবন্ধী মানুষেরা যেখানে পেরেছেন প্রতিবাদে, আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। প্রশাসন একদিকে প্রতিবন্ধী মানুষদের দিব্যাঙ্গ বলে অন্যদিকে কোনও প্রতিবাদে শামিল হলে তাদের উপরেও সাধারণ মানুষের মতোই বর্বর আক্রমণ করে।” তাঁরা মনে করছেন রাস্তার আন্দোলনই সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে আসে। প্রতিবাদ আর প্রশাসনের দমননীতি সমতা তৈরি করে দেয়।
একজন অভিভাবক যেমন বলছিলেন তাঁর প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্তরে নানাবিধ কাগজ তৈরির জন্য ছুটোছুটি করতে করতেই নাভিশ্বাস উঠে যায়। আবার যদি নাগরিকত্ব প্রমাণের কাগজ জোগাড়ের জন্যও ব্যতিব্যস্ত হতে হয় তা প্রায় অসম্ভব এক কাজ, ফলে তাঁর দৃঢ় বক্তব্য, “হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে।” প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য বিশেষ পোশাকের ক্লোদিং লাইন রয়েছে সৌমিতা বসু’র। তাঁর মন্তব্য, “অন্তত আমার লাইফ টাইম-এ আজকের সময়ের আগে কখনও মনে হয় আমার দেশের সংবিধান বিপদের মধ্যে রয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে সেটা যেন আরও বেশি করে মনে হচ্ছে। প্রজাতন্ত্র দিবসে সংবিধানকে বাঁচানোর জন্যই আজকে এখানে আসা। এখানে আসার আগে তাই আলাদা করে কোনও প্রস্তুতি নিতে হয়নি। এত মাস ধরে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কোনও না কোনওভাবে একটা বাধা আসছে, যেটা প্রশাসন থেকে আসছে। যা আমাদের রোজকার অভিজ্ঞতায় দেখতে পারছি, তার থেকে বেশি ভাবনা আর কি-ই হতে পারে।” তিনি মনে করছেন আমরা একটা নতুন স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, আবার এটি একটি নারীবাদী আন্দোলনও। ইতিহাসের কথা টেনে বলেন যেখানে যখনই মহিলারা আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছেন সমতা সেখানে স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ফলে এখন আর প্রতিবন্ধী মানুষ, মহিলা, ছোট, বড় এরকম কোনও বিভাজনের জায়গা নেই। শান্ত, স্থির গলায় সৌমিতা বললেন, “পিপল আর পাওয়ার-এর মধ্যে লড়াইয়ের কথা আমরা জানি, কিন্তু এখন চারদিকে জোটবদ্ধ লড়াই দেখে মনে হচ্ছে – পাওয়ার অফ পিপল -এর ক্ষমতা ক্রমেই পিপল ইন পাওয়ার-এর থেকে বাড়ছে।”
হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে থেকে আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি, আমরা করব জয় থেকে হাম দেখেঙ্গে – এই জমায়েত থেকে উঠে এল একটিই কথা, কোনও বিভাজন নয় – ‘এই দেশের জল, হাওয়া, মাটি আমার পরিচয়, কোনও কাগজ দেখানোর প্রয়োজন নেই।’
প্রতিবেদক ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক।