“এই আন্দোলন থেকে অ–রাষ্ট্র সামাজিক ক্ষমতার এক নির্মাণপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেকারণেই রাজনৈতিক প্রশ্নগুলিকে আন্দোলনের অংশ করে তোলা বেশি দরকার, তা আন্দোলনের দায়িত্বও বটে।” লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ।
২০১৯-এ বিজেপি অশ্লীল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভোটে জেতার পর থেকে আমাদের তাড়া করছিল সন্ত্রাস–গরিষ্ঠের ক্ষমতার ঔদ্ধত্যের, সংখ্যার চোখরাঙানির, নিশ্ছিদ্র নিরন্ধ্র বিরোধশূন্য একদলীয়তার, সর্বোপরি রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রবাদীদের পেশিশক্তির। এ সন্ত্রাস সর্বগ্রাসী ও অমোঘ, তার আধিপত্যের নিরেট প্রাচীরে চিড় ধরানো যায় না, এরকম মনে হচ্ছিল। পাঁচ মাস ধরে কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, প্রায় প্রতিবাদহীন বর্বরতায়, অনায়াস মসৃণতায় দেশের সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করা হল সংসদের নিরাপদ ঘেরাটোপে, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় মূক দর্শকমাত্র, প্রধান বিরোধী দলেরা ক্ষমতাহীন নিষ্প্রভ, বাকি মানুষ সন্ত্রস্ত। কয়েক মাসের মধ্যে পরপর অর্ডিন্যান্স আর আইন, রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার, শ্রমজীবী অন্যবর্গীয় মানুষের অধিকার হননের, সন্ত্রাস তীব্রতর করে তোলার।
মাস খানেক আগে সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সদর্প পৃথুলতায় পাস করালেন অমিত শাহ, তাঁর বা তাঁদের দলের হাবভাবে মনে হচ্ছিল না, আদৌ তাঁদের শঙ্কার কোনো কারণ আছে। এই আইন হল, দ্রুত দেশ জুড়ে এনাআরসি হবে, খুঁজে খুঁজে বার করা হবে ঘুসপেটিয়া উইপোকাদের, রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে কে দেশে থাকবে কে নয়, কার কী পোষাক, কী খাদ্য, কী ধর্ম, তার চুলচেরা বিচার করে। এটা যে হবেই, রাষ্ট্রশাসনের এই চূড়ান্ত উদগ্র প্রকাশ যে দেশের মানুষের ভবিতব্য, এ থেকে যে পরিত্রাণ নেই, সে বিষয়ে শাসকপক্ষ নিঃসংশয়, অ-শাসক রাজনৈতিক দলও তাই, বাকি শাসিত প্রজাবর্গের কথা বাহুল্যমাত্র, তাঁরা সরকারি কাগজের সন্ধানে সকালসন্ধ্যা লাইনে দাঁড়িয়ে। রাষ্ট্রশাসক ও তাঁর শাসনবিধি, অর্থাৎ আইনকানুন আদতে ঐশ্বরিক, আইনের শাসন আদতে ঈশ্বরের ইচ্ছার অনুবর্তী, ইতিহাস এখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে, বহুকাল আগে জার্মান দার্শনিক হেগেল এমন বলেছিলেন, জানা যায়। হেগেলের পরবর্তী সিদ্ধান্ত ছিল, আইনের শাসনের বাস্তবতা প্রশ্নাতীত, সেকারণে তা ন্যায্য ও যৌক্তিক। হেগেলের বক্তব্য কেটে তরুণ মার্ক্স যা বলেছিলেন তা আমাদের অনেকেরই জানা, ইতিহাস শেষ হয় না, মানুষ, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষ সচেতন উদ্যোগে রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রশাসনের ইতিহাসকে নিজেদের ইতিহাস দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেন।
গত এক মাস ধরে ভারতবর্ষের সর্বত্র, বিশেষত শহরাঞ্চলে যে গণ-প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে, তা দেখে এই পুরোনো কথাগুলো স্মরণে এল। নিষ্প্রতিবাদ নির্বিরোধ এক সর্বগ্রাসী সর্বব্যাপী ক্ষমতাবৃত্ত, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে মোদি-শা ও তৎশাসিত রাষ্ট্রের প্রবল বোলবোলা, কোথাও মাছি গলবার জো নেই। শাসনের ইতিহাস, শাসকের ন্যায়, রাষ্ট্রের বাস্তব, যাকে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। মুহূর্তে সব বদলে গ্যালো, কোথাও নিঃশব্দে কোথাও হইহই করে লোকে রাস্তায় নেমে পড়লেন, আক্ষরিক অর্থেই আবালবৃদ্ধবনিতা। রাস্তা ভরে উঠল আজাদি চিৎকারে, মানুষ, যাঁদের রাষ্ট্রের সামনে নতজানু দয়াভিক্ষা করার কথা, তাঁরা সমবেত কলরবে বলে উঠলেন, মানি না, রাষ্ট্র তোমার শাসন মানি না, সিএএ এনআরসি চলবে না, হাম কাগজ নহি দিখায়েঙ্গে। এখনো লোকে পথে আছেন, পথে নামছেন, প্রতিবাদ চলছে।
অর্থাৎ ইতিহাস ভাঙছে, ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। পিতৃতন্ত্র ও রক্ষণশীলতার ঐতিহাসিক বেড়া ভেঙে পথে নেমে আসছেন ভারতের মুসলমান সমাজের মহিলারা। পণ্য সংস্কৃতি, বাজার অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য ছেড়ে প্রতিবাদে নামছেন অভিজাত, কুলীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা, যাঁরা সচরাচর এসব গোলমেলে ব্যাপারে জড়াতেন না। সিএএ এনআরসি ও বিজেপি- আর এস এসের রাষ্ট্র্ববাদী হিন্দুত্ব ও হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রবাদের বিপক্ষে আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন জাতবর্ণধর্মশ্রেণি নির্বিশেষে আমনাগরিক, তাঁদের হাতে তিরঙ্গা পতাকা, মুখে জনগণমন, ভারতীয় সংবিধানের চরণ। ভারতবর্ষে এখন যা ঘটছে, সেরকম বা তার চাইতেও আড়েবহরে বড় বিক্ষোভ আন্দোলন ২০১৯ জুড়ে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে উচ্চকিত, কোথাও স্বৈরাচারী শাসকের, কোথাও সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে।
ইতিহাস শেষ হয় না, নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। আশা হারানোর কিছু নেই, অত্যাচার যত তীব্র হবে, প্রতিবাদও বাড়বে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে, যাবতীয় সঞ্চিত দরকচা-মারা আধসেদ্ধ সিনিসিজম ঢোঁক গিলে হজম করে বর্তমান লেখকও মনে করে, আলবাত, ওদের বাঁধন যত শক্ত হবে মোদের বাঁধন টুটবে। তবে কিনা, ঘরপোড়া গরুরা সিঁদুরে মেঘ দেখলে ঘাবড়ায়, আর ইতিহাস ব্যাপারটা সাতিশয় গন্ডগোলের, কোথায় কোন ইতিহাস শেষ হয় আর শুরু হয়, তা ঠাওর করা রীতিমতো মুশকিল। যাঁরা পথে আছেন, পথে থাকবেন, প্রতিদিন নতুন পুরোনো গান কবিতা ছবি পোস্টারে প্রতিবাদ যৌথগুলিকে আনন্দময় কলরবমুখর করে তুলছেন যাঁরা, তাঁদের সাহস ও আবেগের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও সমর্থন জানিয়ে গুটি কয়েক কথা বলি। আন্দোলন চলাকালীন তার সমালোচনা করা যায় না যাঁরা মনে করেন, তাঁরা না শুনতেই পারেন, কিন্তু এসব কথা বলার, শোনার, আলোচনার সুবর্ণ সময় এটিই। যে অবস্থায় আমরা আছি, সেটি একাধারে সম্ভাবনার ও প্রতিক্রিয়ার, বদলের ও স্থিতাবস্থার। বাস্তবকে অতীত ভবিষ্যতের নিরিখে দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছনোটা বুনিয়াদি কাজ, অন্তত যাঁরা নিজেদের বামপন্থী বলে মনে করেন তাঁদের তো বটেই। আঁকাড়া আশাবাদ ও নিষ্প্রশ্ন আবেগের হল্লার দুস্তর পারাবার পেরিয়ে রাজনৈতিক যুক্তির অর্থাৎ ক্রিটিক্যালিটির কঠিন ভূমিতে পা রাখাটা সেকারণে দরকার।
আন্দোলন প্রসঙ্গে: কিছু রাজনৈতিক প্রশ্ন
সিএএ-এনআরসি নিয়ে যে চলমান গণ-আন্দোলনের কথা হচ্ছে, তার কিছু বিশেষ চরিত্রলক্ষণ আছে। মুসলমান সমাজভুক্ত মহিলাদের ও ছাত্রদের অংশগ্রহণের বিষয়ে আগে বলা হয়েছে। এ ভিন্ন, এই আন্দোলনের অনেকটাই দলহীন নেতাহীন নাগরিক আন্দোলন, আমাদের দেশে এধরণের প্রক্রিয়া আগে বিশেষ দেখা যায়নি। অনেকেই বলছেন, এই আন্দোলন থেকে ভিন্নগোত্রের এক জাতীয়তাবাদী ঐক্য, আকাঙ্খা বা প্রত্যাশা দানা বাঁধছে, প্রকাশিত হচ্ছে, যা শা-মোদি বিজেপি-আর এসএস-এর বিভাজনকামী ও মারকুটে জাতীয়তাবাদ থেকে সম্পূর্ণত আলাদা, যা অন্য এক উদার গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের প্রতিফলন, যে ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিকতা বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্বিষ্ট ছিল। এই বিষয়টিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
যা বলা হচ্ছে, এবং হয়তো যা আন্দোলনরত জনসমষ্টির অনেকেই ভাবছেন, শা-মোদি বিজেপি আর এস এস-এর তরফে যে জাতীয়তাবাদের কথা, জাতির কথা দিবারাত্র প্রচারিত হচ্ছে, তা আসলে বিকার, বিকৃতি। ভারতবর্ষ এরকম ছিল না, ভারতবর্ষের সংবিধান এই বিকৃতিকে সমর্থন করে না। এই ভাবনা অন্যায্য বা অন্যায় নয়। স্বাধীনতালাভের পর থেকে সত্তর বছর অতিক্রান্ত, প্রাক-স্বাধীনতা সময়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের ভৌগোলিক রাজনৈতিক চেহারা লোকে ভুলতে বসেছে। বিজেপি আর এস এস-এর মূল রাজনৈতিক প্রকল্প অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতবর্ষের চেহারাটা তাঁদের মতো করে জনসমক্ষে আনা। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করার পরবর্তী সময়ে ভারত সরকার যে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, তাতে শুধু পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর নয়, এমন সব এলাকা ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা বহুদিন যাবৎ পাকিস্তান, চীন এমনকী নেপালের অংশ। ভারতবর্ষ বলতে, দেশ বলতে, নেশান অর্থে জাতি বলতে, বর্তমান বিজেপি সরকার যা বোঝে তার সমস্তটাই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সামরিক রাজনৈতিক আধিপত্যের সমার্থক। আরো বড়, আরো শক্তিশালী, ঐতিহাসিক এক ভারতবর্ষের যে ছবি বিজেপি আর এস এস সাধারণ্যে তুলে ধরে, ব্রিটিশ ভারতবর্ষের আগে পরে তা কার্যত কোথাও ছিল না। সুতরাং বিজেপির রাষ্ট্রকল্পনা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকল্পনার অনুবর্তী, বোঝাই যায়। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের পক্ষে বিজেপির নিরবচ্ছিন্ন প্রচারের বিরুদ্ধে যে জনমত গড়ে উঠছে — প্রশ্ন, সেখানে যে রাষ্ট্রকল্পনা বা রাষ্ট্রের ছবি আছে, তা কি মূলগতভাবে বিজেপি আর এস এসের রাষ্ট্রকল্পনা থেকে ভিন্নতর কিছু? পাকিস্তান চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে বিবাদ, যুদ্ধ, কাশ্মীরে নিরন্তর অন্যায় দমনপীড়ন, এর কোনটাই তো বিজেপি সরকারের আমলে শুরু হয়নি। রাষ্ট্রের সঙ্গে দেশ আর নেশানকে মিলিয়ে দেশভক্তির যে বিষমসালা সঙ্ঘপরিবার অহোরাত্র লোকের কানে ঢালছে, অ-বিজেপি সরকারের আমলে তা কি অন্যরকম কিছু ছিল? মামলাটি তলিয়ে বোঝা দরকার। ভারত এরকম নয়, ভারতের একটি ভালো ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান আছে, শা-মোদির দানো তাড়িয়ে কংগ্রেসের বা ঐরকম কারুর অ-বিজেপি সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে গোল মিটে যাবে, এরকম একটা ভাবনা জোরদার হচ্ছে। অর্থাৎ খারাপ রাষ্ট্রের জায়গায় ভালো রাষ্ট্র, যে সংবিধানকে মর্যাদা দেবে, সিএএ-এনআরসি করবে না, মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু দেখলে রে রে বলে তেড়ে যাবে না। যে আন্দোলন প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে, তাতে এই ভালো-খারাপ রাষ্ট্রের ব্যাপারটা পুরোদস্তুর বিদ্যমান। দিল্লিতে বিজেপির পুলিশ, সে ছাত্রদের পিটিয়ে লাট করে দিল। কলকাতায় তৃণমূলের পুলিশ, লাঠিচার্জ করে তারা ছাত্রদের কাছে ক্ষমা চাইছে। মহারাষ্ট্রের মুম্বাইতে আন্দোলনরত ছাত্রদের নামে কেস দেওয়া হল, অথচ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীরা বলছেন, ছাত্রদের কারুর কিছু হবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মধ্যেই অন্য রাষ্ট্র মিশে আছে, বিজেপির খারাপ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে দিচ্ছে অ-বিজেপির ভালো রাষ্ট্র। কেরালায় সিপিএমের বিজয়ন, বাংলায় মমতা, মহারাষ্ট্রে এমনকী শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে, সবাই সমস্বরে বলছেন, এনআরসি হবে না, ছাত্র পেটানো বিজেপি নিপাত যাক।
মুস্কিল এই যে রাষ্ট্র হচ্ছে রাষ্ট্র, তার ভালো খারাপ হয় না। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, বিশেষত জাতিরাষ্ট্র ব্যাপারটাই কাঁঠালের আমসত্ব, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা নিজেদের প্রয়োজনে সে রাষ্ট্রের খোলনলচে তৈরি করেছিলেন–ক্ষমতাবান আমলাশাহি, ভয়ঙ্কর সব আইন, বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ, মিলিটারি। ব্রিটিশ গ্যাছে, কিন্তু রাষ্ট্র থেকে গেছে, ভোটে সরকার বদলায়, রাষ্ট্র বদলায় না, বিশেষত রাষ্ট্রকাঠামো ও রাষ্ট্রের অন্তঃস্থল, যেটাকে এক কথায় ইদানীং ডিপ ষ্টেট বলা হয়। সমাজবদলের আন্দোলন যাঁরা করেন সেই বামপন্থীদের মননে অন্তত এটা থাকা দরকার, রাষ্ট্র সহনশীল ও জনদরদি হয়ে উঠবে, এটা স্রেফ বাজে গপ্পো। এবং ক্ষতিকর। জেএনইউতে ভরা মিডিয়ার সামনে সঙ্ঘপন্থী গুন্ডারা ঢুকে ছাত্রদের বেধড়ক মারল, ভাঙচুর করল, পুলিশ কিছু বলল না। তার আগে যাদবপুরে একইরকম ভাঙচুর হল। যে ছাত্রশিক্ষকেরা মার খেলেন, তাঁদের সমর্থনে যাঁরা পথে নামলেন, নামছেন, তাঁরা একবারও নিজেদের প্রশ্ন করলেন না, পুলিশ কেন সরকার বিরোধী সঙ্ঘ বিরোধী ছাত্রদের পক্ষে কাজ করবে? এই প্রশ্ন তোলা হল না, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রমিছিলে গড়ে হাজার দেড় হাজার ছাত্র উপস্থিত থাকেন, সেখানে একশো দেড়শো গুন্ডা ঢুকে বিনাবাধায় তাণ্ডব করে কী করে? বিশেষত আগে থেকেই যেখানে খবর ছিল হামলা হতে পারে, ছাত্ররা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেননি কেন? বামপন্থীরা এই হামলায় বিমূঢ় বিহ্বল, কি করে জেএনইউ এর মতো জায়গায় এরকম কাণ্ড ঘটতে পারে, তাঁরা বুঝে পাচ্ছেন না। কেন? পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে অথবা অনুপস্থিত, গুন্ডারা শিক্ষাঙ্গনে ঢুকে ছাত্র পেটাচ্ছে, এ ঘটনা কি আগে ঘটেনি? সত্তরের পুরো সময়টার কথা ভাবুন, তার পরের কথাও, বিশেষত বাংলায়। পুলিশ কবে কোনকালে ছাত্রবন্ধুর ভূমিকা পালন করেছে? সত্তরের নব-কংগ্রেসি পুলিশ, তৎপরবর্তী বাম পুলিশ, হালের টিএমসি পুলিশ? একের পর এক ঘটনার কথা বলা যায়, মনে করা যায়। একসময় ছাত্র রাজনীতি যাঁরা করতেন, বিশেষত বামপন্থী ছাত্র রাজনীতি, তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে পুলিশ ও গুন্ডাদের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি নিতে হত, সে প্রস্তুতি ছিল রাজনৈতিক শিক্ষার অঙ্গ। মাঠের লড়াইয়ের অন্যান্য শিক্ষার মতো, সে শিক্ষাও এখন বিস্মৃত, হামলা হলে এখন প্রতিরোধের জন্য রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। এটা কি কাম্য ছিল?
আন্দোলনের রাজনীতি
যে আন্দোলন এখন শাসকদের ভয় পাইয়ে দিচ্ছে সেখান থেকে দুটি মূল রাজনৈতিক দাবি উঠছে। এক, আজাদি, অর্থাৎ স্বাধীনতা, অর্থাৎ স্ব-অধীনতা। এই স্ব-এর ধারণাটি ভারতবর্ষে গড়ে ওঠে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অপরের সাপেক্ষে, বিরুদ্ধতায়। সে কথা আবার মনে করা দরকার। দুই, কাগজ নহি দিখায়েঙ্গে। অর্থাৎ, আমি দেশে থাকব কি থাকব না তা রাষ্ট্রের দেওয়া কাগজ দিয়ে প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত হবে না। নাগরিকত্ব বিষয়টি আমার রক্তের মতো, আমি যে ভূমিতে বাস করি, যে মাটি কর্ষণ করি, যে জলে মাছ ধরি, যে বন থেকে খাদ্য আহরণ করি, যে শহরে কাজ করতে যাই, তা, তার সবটাই আমার দেশ। রাষ্ট্র এসে আমাকে বলে দেবে না কোনটা দেশ কোনটা নয়। রাষ্ট্রের সেই অধিকার নেই। আমি বা আমরা আজাদি অর্থাৎ স্ব-অধীনতা চাইছি, রাষ্ট্রের নয়। দেশের সংবিধান যদি আমার সেই স্বাধীনতার কথা বলে, আমরা তার পক্ষে। কিন্তু রাষ্ট্র সেক্ষেত্রে সংবিধানের রক্ষক হতে পারে না। আমাদের আন্দোলন, দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী আন্দোলন রাষ্ট্রকে ধাক্কা মারতে পারে, তার দমনক্ষমতাকে দুর্বল করে দিতে পারে।
আজকের সময়ে, এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে, রাষ্ট্রবিরোধিতার মূল রাজনৈতিক স্লোগানকে সবাই মিলে সামনে আনতে হবে। সবাই বলতে রাষ্ট্রবাদীদের কথা বলা হচ্ছে না। নেতৃত্ব যদি তাদের হাতে থাকে, এই আন্দোলন থেকে সরকার বদল ঘটতে পারে, যেমন আগেও ঘটেছে। কিন্তু রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রক্ষমতাকে সার্বিক বিরুদ্ধতার মুখে দাঁড় করানো যাবে না, জোর দিয়ে বলা যাবে না দেশ আর রাষ্ট্র এক নয়। এই আন্দোলন থেকে অ-রাষ্ট্র সামাজিক ক্ষমতার এক নির্মাণপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেকারণেই রাজনৈতিক প্রশ্নগুলিকে আন্দোলনের অংশ করে তোলা বেশি দরকার, তা আন্দোলনের দায়িত্বও বটে।
The author Soumitra Ghosh is a social and environmental activist.