“আমরা বেশিরভাগই গৃহবধূ। তবু বুঝতে পেরেছি আর ঘরে বসে থাকা যাবে না। এই আইন আটকাতে এছাড়া উপায় নেই। আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা ডিটেনশন ক্যাম্পে যাব না সংবিধান বাঁচাব।” পার্কসার্কাস ময়দানে লড়াইয়ের ডাক শুনল গ্রাউন্ডজিরো।
— দেশ বলতে কী বোঝেন?
— দেশ মতলব জমিন। আমি, আমরা যেখানে থাকি সেটাই আমার দেশ। কেন কেউ আমাদের উঠিয়ে দেবে সেখান থেকে? এই দেশ তো আমাদের সবার। কাগজ দেখাতে বললেই দেখাতে হবে। যাদের কাগজ হারিয়ে গেছে তারা কী করবে? — কাশ্মীরের কথা জানেন? — শুনেছি। কভি গয়ি নেহি। ওখানে আপেল হয়!
— দিল্লির কথা জানেন?
— হাঁ, হাঁ। আমি মোবাইলে দেখেছি। ওইটুকু ছেলেমেয়েগুলোকে কেমন করে মারছিল! চোখে পানি এসে গেছে আমার। খুব মায়া লাগছিল। ওরাও তো কারও না কারওর বাচ্চা। খুব না-ইনসাফি করেছে। এই নরেন মোদি, অমিত শা খুব খারাপ লোক। গরিবদের কথা না ভাবলে তারা তোমাদের কেন রাখবে মাথায় করে? ওদের দেখবে কেউ ক্ষমা করবে না। উপরওয়ালা মাফ করবে না।
কথাগুলো বলছিলেন কলকাতার পার্কসার্কাস ময়দানে দাঁড়িয়ে জমিলা বিবি। এসেছেন সেখানে মূলত মুসলমান মহিলাদের এনআরসি, সিএএ বিরোধী অবস্থান বিক্ষোভের পাশে থাকতে। যা হঠাৎই শুরু হয় ৭ জানুয়ারি দুপুর থেকে। সন্ধ্যার মুখে সেখানে পৌঁছে দেখা গেল প্রায় শ’খানেক মহিলা, পুরুষ উপস্থিত। অবস্থান বিক্ষোভ করছেন মূলত নানা বয়সি মহিলারা। পড়ুয়া থেকে গৃহবধূ, চাকুরিজীবী থেকে পড়শি আছেন সকলেই। আর জমায়েত করেছেন একটা সম্মিলিত ক্ষোভ ও জোট বাঁধার তাগিদের জায়গা থেকে।
পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজ এলাকার চেনা-পরিচিত, অপরিচিত মহিলারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পেরেছেন নানাভাবে। তারপর থেকে, বিশেষত ক্রমাগত দেশ জুড়ে ছাত্রছাত্রীদের উপর হতে থাকা আক্রমণের ঘটনায় তাঁরা স্থির করেন যে আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। এই ন্যক্কারজনক আইনকে রদ করার জন্য পথে নামতেই হবে এবং প্রয়োজনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভের পথেই যেতে হবে। অনেকটা আবেগ আর সাহসে ভর করে তাই সমাজ, পরিবারের রক্ষণশীলতার নিগড় ভেঙে আজ এই মহিলারা কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে এসে উপস্থিত হয়েছেন। রাতের শহরেও তাঁদের সতর্ক চোখগুলি জেগে থাকতে রাজি। রাত বাড়লে যাবেন বাড়িতে, স্বামী-সন্তানের খাবার ব্যবস্থা করবেন। প্রয়োজনে আবার ফিরে আসবেন। এভাবে ধর্নায় বসা, বাড়ির বাইরে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা অধিকাংশেরই প্রথম। তবু উদ্যমে কোনও ঘাটতি নেই। কারণ?
“দেশ বাঁচাতে এসেছি আমরা। এখন আমরা যদি চুপ করে থাকি, তাহলে তো লজ্জার শেষ থাকবে না। এই সরকার গণতন্ত্রবিরোধী, দেশের মানুষকে ধর্মের নামে ভাগ করে দিচ্ছে। এই কালা কানুন আমরা মানছি না। আর সরকার যতক্ষণ না প্রত্যাহার করছে আমরা উঠবও না।” দৃঢ় কন্ঠে জানিয়ে দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লুবনা। এখনও পর্যন্ত এনআরসি, সিএএ বিরোধী সব মিছিলে কলকাতায় পা মেলানো তরুণ শদাত, সোয়েবরা জোর গলায় সমর্থন করে বললেন, “আজ এই মহিলারা অবস্থানে বসলেন। আমরা যেকোনও মূল্যে এঁদের পাশে আছি। একজোট হয়ে লড়ব সবাই।”
যখন এই অবস্থান বিক্ষোভ শুরু হয় পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয় যে আগে থেকে অনুমতি না নেওয়ার কারণে অবস্থানকারীদের উঠে যেতে হতে পারে। কলকাতা পুলিশের বেশ কিছু অফিসার (মহিলা পুলিশকর্মী-সহ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তবে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনার পরে স্থির হয়ে তাঁরা উঠে যাবেন না, তবে নিয়ম মেনে চিঠি পাঠানো ইত্যাদি তৎক্ষণাৎ শুরু করবেন। সেই মতো সেখানেই চিঠির বয়ান লিখে সই সংগ্রহও করা হয়। তবে ‘দিল দিয়া হ্যায় জাঁ ভি দেঙ্গে’ থেকে ‘জনগণমন’ — গানের মধ্যে দিয়ে তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন বিভেদের রাজনীতি তাঁরা কিছুতেই মানবেন না।
যেমন বললেন স্থানীয় ওয়াসিম আখতার, মহঃ আরহাম, “আমাদের দেশটা একটা গুলদস্তার মতো। সেখান থেকে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান কাউকে সরিয়ে নিলেই খারাপ দেখাবে। এই বিভেদ আমরা কিছুতেই হতে দেব না। আমাদের পরিবারের মহিলারা, প্রতিবেশীরা এই অবস্থান বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন। আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আমরা সবরকম ভাবে তাঁদের পাশে আছি।”
স্থানীয় মানুষেরা ধীরে ধীরে জমা হতে শুরু করছিলেন। অবস্থানে বসা মহিলাদের যাতে কোনও সমস্যা না হয়, নজর রাখতে শুরু করছিলেন। জল থেকে কাছাকাছি শৌচালয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা সবেতেই তাঁরা প্রকৃত সহযোদ্ধা, সহ- নাগরিকের মতো দায়িত্ব নিয়ে পাশে থাকতে শুরু করেছিলেন। যে স্থায়ী ছাউনির নীচে মহিলারা বসেছেন তার পাশে হাতে হাত ধরে ব্যারিকেড করতেও দেখা গেল তরুণদের। পৌঁছে গিয়েছিলেন কলকাতায় এনআরসি, সিএএ বিরোধী মিছিলের পরিচিত মুখ বহু কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা, পাশে থাকার আশ্বাস নিয়ে।
আসমত জমিল একটি সংস্থা চালান, আজজুমার (আঞ্জুমান?) নামে, যার অর্থ একজোট হওয়া, একতা। সেই সংস্থা থেকে বহু মহিলা বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন। আসমত স্পষ্ট জানালেন, “ইয়ে হিন্দুস্তান হমারা নেহি হ্যায় কেয়া? কেয়া চল রহা হ্যায় দেশ মে। স্টুডেন্টস্ হামারে দেশ কে ফিউচার হ্যায়। ইন্ডিপেন্ডেন্স পেয়েছি আমরা কত কষ্ট করে। আমরা কি এই ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলাম? আমরা বেশিরভাগই গৃহবধূ। তবু বুঝতে পেরেছি আর ঘরে বসে থাকা যাবে না। এই আইন আটকাতে এছাড়া উপায় নেই। আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা ডিটেনশন ক্যাম্পে যাব না সংবিধান বাঁচাব। দিল্লিতে পুলিশ পুরোপুরি বিজেপি-র অধীন। কিন্তু আমাদের পুলিশ আমার বিশ্বাস আমাদের পাশে থাকবে। দিদি (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়)-র উপরে আমাদের পুরো বিশ্বাস আছে। তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। আমরা কোনও দলীয় রাজনীতির মধ্যে নেই। আমরা আমজনতা এবং এনআরসি, সিএএ-এর বিরূদ্ধে শান্তিপূর্ণ অবস্থান চালাব।”
লোলচর্ম বৃদ্ধা রোশন আরা বিয়ের পর বিহার থেকে কলকাতায় এসেছেন আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে। ক্লাস এইট অবধি পড়েছেন। দেশের বর্তমান সরকারের প্রতি রাগ বেরিয়ে আসছিল প্রতিটি শব্দে। “তাবাহ্ কর দিয়া দেশ কো। ইস সে পহেলে সব কুছ তো ঠিক চল রহা থা। জব সে ইয়ে লোগ আয়ে হ্যায় হিংসা হি হিংসা হ্যায় চারও উওর। ইন কো শরম্ নেহি আতি? বিলকুল বেশরম হ্যায়। ছি ছি। আগর কোয়ি অউর হোতা ইস্তফা দে দি হোতি। বিবি কো ছোড় দিয়া, জো অউরত কো সম্মান না দে সাকে, সংসার নেহি সমঝে, উও দেশ কো কেয়া সমঝেগা! শুধু দেশের টাকায় বিদেশে ঘুরছে। সব দেশে সেটিং করছে আর নিজের দেশটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। অ্যায়সে নেহি তবহা হোনে দেঙ্গে ইস দেশ কো।”
— নিজের কাগজ দেখাবেন?
— ধরো আমার কাগজ আছে, আমি দেখালাম। যার নেই, কত কারণ থাকতে পারে, গরীব মানুষ, জমি-জায়গা নেই, অন্য রাজ্য থেকে এসেছে, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, আগেকার দিনে কাগজপত্তর থাকতও না, তারা সব কোথায় যাবে? এমন করে কাউকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া যায় না কি!
রোশন আরা এই ধর্নায় বসা মহিলাদের পাশে দাঁড়ানোর শপথ নিয়েই ঘুরে গেলেন প্রথম দিনের পার্ক সার্কাস ময়দান। হাসি মুখে জমায়েতে যোগ দিলেন এক হাই মাদ্রাসার শিক্ষিকা হামিদা বানু। ছোট সন্তান রেখে আসায় বাড়ি ফিরতে হবে। তবে সময় পেলেই আসবেন। জমায়েতের খবর পেয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ ‘নো এন আর সি মুভমেন্ট’ থেকে। বললেন, “পুরোই ফ্যাসিবাদ চলছে। এছাড়া আর উপায় নেই। সবরকম প্রতিবাদ জোরদার করতে হবে।”
ময়দান থেকে ফিরছি যখন কানে এল এক তরুণ বন্ধুকে বলছেন, “মারেঙ্গে তো হটেঙ্গে নেহি। ফির সে আকর বৈঠেঙ্গে।” তাদের সঙ্গে কথা বলা গেল। মহ: আজহার বললেন, “মনে হচ্ছে আজাদির দ্বিতীয় লড়াই শুরু করলেন এই মা, দিদিরা। আশা করছি এই শান্তিপূর্ণ অবস্থানে কোনও সমস্যা হবে না। সরকার, পুলিশ আমাদের পাশে থাকবে। কোনও রকমভাবেই আমরা এদের পাশ থেকে সরব না। সবরকমভাবে পাশে আছি।” যার কথা শুনে থমকেছিলাম সেই সৈয়দ রেয়াজকে জিজ্ঞেস করলাম সাহস পাচ্ছেন কোথা থেকে? শান্ত হেসে বললেন, “উপরওয়ালা ছোড় কে কিসি সে নেহি ডরতে। অউর ইয়ে তো দেশ কো বাঁচানে কি লড়াই হ্যায়।”
এই অবস্থান বিক্ষোভের ভবিষ্যত কী, কতদিন স্থায়ী হচ্ছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে তার স্বতন্ত্রতা নিয়েই এক নতুন লড়াইয়ের সূচনা করলেন কলকাতার মুসলমান সম্প্রদায়ের এক ঝাঁক মহিলারা।
(লিখেছেন লাবণী জঙ্গী, সুদর্শনা চক্রবর্তী ও নন্দিনী ধর। )