পথে চলে যেতে যেতে কোথায় কখন… এক ব্যক্তিগত পথচারণা


  • December 19, 2019
  • (0 Comments)
  • 1586 Views

শেষ কবে এমন স্বতঃস্ফূর্ত, আবেগে প্রাণঢালা, যৌবনের রঙে রাঙানো রাজনৈতিক মিছিল কলকাতা দেখেছে তা স্মরণ করতে চাইলাম। ব্যর্থ হলাম। লিখেছেন দেবাশিস আইচ

 

যৌবন মদে মত্ত। চুম্বকে এই হল শুক্রবারের ‘নো এনআরসি মুভমেন্ট-এর মিছিল-চিত্র।  পাশের মানুষ মনে করিয়ে দিলেন নন্দীগ্রামে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্বজ্জনদের ডাকা নাগরিকদের মিছিলের কথা। না, মনে ধরল না। ধারে ও ভারে ১৪ নভেম্বরের  সে মিছিল প্রকৃতই তুলনাহীন। কিন্তু, সে ছিল বিশিষ্টজনদের, পশ্চিমবঙ্গের ‘হুজ অ্যান্ড হু’দের ডাকে। সে কলকাতা কাঁপানো মিছিলে বামফ্রন্ট ব্যতীত নানা বামপন্থীগোষ্ঠী, তৃণমূল কংগ্রেসের পূর্ণ সমর্থন ছিল। শুক্রবারের মিছিলে কোথায় বিদ্বজ্জন? কোথায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব? নন্দীগ্রামের মিছিলে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন যে অপর্ণা সেন, কৌশিক সেনরা, শুক্রবারের মিছিলে তাঁরা গুটি গুটি কয়েক-পা হেঁটে গেলেন অন্য আর এক পরিবর্তকামী আম-নাগরিকদের ডাক শুনে।

 

 

প্রকৃতই নো এনআরসি মুভমেন্ট সমাজমাধ্যমকে আধার করেই গড়ে ওঠা। প্রকৃতই সেলিব্রিটিহীন, মঞ্চপ্রিয়, আদেশনির্দেশবাদী নেতাহীন এক প্রাকৃতিক স্রোত যেন। গ্রামগঞ্জে, শহরেনগর  আবাসের কোথাও কোন পাতালগর্ভে থাকা এক অ্যাকুয়াফায়ার কোন এক সৃষ্টির উদ্দাম আনন্দে হঠাৎই যেন উল্লাসে ফেটে পড়েছে মর্ত্যের বুকে। কলকাতার রাজপথে। কলকাতাই বলব কেন, জামিয়া মিলিয়া, আলিগড় তো ভারতকে ছিনিয়ে নেওয়ার নিশান তুলে ধরল। এই সেই নিশান। এই সেই মহাকাব্য। মেদিনীর বুকে তেমন করে তির বিঁধে দিতে পারলে আজও ফোয়ারার মতো উপচিয়ে ওঠে তৃষ্ণার জল!

 

 

না, এমন রাজনৈতিক মিছিল কলকাতা কখনও দেখেনি। এমন বৈচিত্র্যে ভরা মানুষের ঢ্ল।  না, আমি কিংবা আমাদের বহু বন্ধু অনেকেই জীবনে কখনও জাতীয় পতাকা শোভিত মিছিলে  হাঁটিনি, হাঁটেননি। নো এনআরসি মুভমেন্টএর এডমিনদেরও অনেকের সম্পর্কেই একথা বলা যায় (ব্রহ্মা জানে) বোরখা পরা সম্ভান্ত্র গৃহবধূহিজাব জড়ানো তরুণীর সঙ্গে কখনও মিছিলে হাঁটিনি। এলজিবিটিদের সঙ্গে হেঁটেছি।হোক কলরবহেঁটেছে। যুগের কথা বলছি কিন্তু এমন মিছিলে কী হেঁটেছি যা এই শহরের মতো খণ্ড খণ্ড নানা মহল্লার এক মোজেইক – এক উপলচিত্রণ। হ্যাঁ, তাই মনে হল তো। হেঁটেছি, হেঁটেছিলাম একই গৎবাঁধা, কিন্তু বাক্যে বৈচিত্র্য পিয়াসি, বড় এককঅনন্য এবং নির্ধারণকারীদের ভিড়ে। কত জন্ম জন্ম ধরে। এই শহরে। এই আমূল সর্বধর্মবর্ণ অর্বাচীন মহানগরে। যে তথাথিত রেনেসাঁর এক ব্যক্তিও এই নগরের আদি পুরুষ নয়। না, কেউ নয়

 

 

এই মিছিলের বর্শামুখ আমূল একাধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে তার সঙ্গে ঢের দর্শনদূর। তবু মনে হয় তারা যেন অন্য এক জুরাসিক যুগের মানুষ। আজ এই মিছিলের ল্যাজা থেকে মুড়ো পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাই অন্য বৈচিত্র্য, মিছিলের ঐক্যে এক। ১৯০৫ রবীন্দ্রনাথ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁকে মুসলমান খুঁজতে হয়েছে। ২০১৯ নরেন্দ্র মোদী সার্থক। মুসলমান মুসলমান বলেই পোড়া দেশে ঢের বেশি ভারতীয়। তাঁরা উজাড় করে এসেছেন। দেশ জুড়ে দেশকেই প্রতিষ্ঠার লড়াই তো আজ ভারতের মুসলমানের কাঁধে চাপিয়ে দিলাম। আদিবাসীর কাঁধে। দলিতের কাঁধে। ঢের হল বাঙালি হিন্দু উচ্চবিত্তের বামপন্থা, ঢের হল নকশালি নকশালি খেলাধূলা

 

 

যে তরুণের সঙ্গে আমি হাঁটছি, মিছিলের প্রাকমুহূর্তে সে বদ্যি সৌত্রক রায় এক ফাঁকে জানিয়ে গেল এই হল সোহেল আমার স্কুলের বন্ধু। সোহেলের হাতে জাতীয় পতাকা, সৌত্রকের হাতে প্ল্যাকার্ডনো সিএএ পিতৃপরিচয়ে জানি সৌত্রক বর্ধমানের সিংহবাহিনী পরিবারের বংশধর। আত্মীয়তাসূত্রে হাটখোলা দত্তদেরও। সোহেলের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হল না। তবে, একটি বিষয়ে নিশ্চিত হিন্দুমুসলমানের আটশো বছরের সমন্বয়ী সংস্কৃতির একজন। কলকাতা দাঙ্গা, দেশভাগ যে মুসলমানদের পাকিস্তানে পাঠাতে পারেনি। দ্বিজাতিতত্ত্বে ভাগ করতে ব্যর্থ হয়েছে সোহেল তাদের প্রতিনিধি। ৩০ শতাংশ বাঙালি মুসলমান, ১৪ শতাংশ ভারতীয় মুসলমানের প্রতিনিধি। সোহেলরা তোঘটি‘, যেমন সৌত্রক। এমন আশ্চর্য মিছিলে হাঁটতে হবে ভাবিনি

 

 

আর কেন্দ্রীয় স্লোগানআজাদি আর আজাদি এই কাশ্মীরের হৃদয়ের ধ্বনি কাশ্মীরউদ্ভূত স্লোগান, কারাগারকাশ্মীর পেরিয়ে আজওরে ভাঙ ভাঙ কারা/ আঘাতে আঘাতে করডাক দিয়ে, আসমুদ্রহিমাচল স্লোগানে স্লোগানে ভারতের বন্ধন দিল ঘুচিয়ে

 

আজাদে আজাদে তব বন্ধন যাক ঘুচে 

 

লেখক সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।

 

 

Share this
Leave a Comment