কী ‘উন্নয়ন’, কী তার ‘বিকল্প’, সবটাই নির্ধারণ এবং নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজি। সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসা এক প্রাকৃতিক ব্যবস্থা যে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে তার মূল কারণ পুঁজিবৃদ্ধির মানুষী প্রক্রিয়াটিকে আটকানো যায়নি। লিখেছেন সৌমিত্র ঘোষ।
“উন্নত” যেহেতু হতেই হবে, সেই উন্নয়নের মূল্যে আরো বেশি করে কার্বন-গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মিশতে থাকে। গাছ কেটে, কৃষিজমি-অরণ্য-জলা নষ্ট করে নতুন নগরকেন্দ্রগুলি গড়ে ওঠে, রাস্তা তৈরি হয়, প্রচুর নতুন গাড়ি সেই রাস্তায় নামে। এ সবের কারণে, আর নতুন শিল্প তৈরি করতে গিয়ে, যে শক্তির দরকার তা আসে মূলত তেল আর কয়লা থেকে, যা পোড়ানো মানেই ভূমণ্ডলে সঞ্চিত কার্বন গ্যাস বাইরে আসা। অন্যদিকে, কৃষিজমি আর অরণ্যে জমে থাকা কার্বনও বাইরে আসে, এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলির উপর নির্ভরশীল মানুষেরা উন্নয়নের উদ্বাস্তু হয়ে যখন শহরাঞ্চলে ভিড় করেন, তাঁদের শক্তি-ব্যবহারের পরিমানও আগের চাইতে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। উন্নয়নের সামগ্রিক প্রক্রিয়াটা, চক্রবৃদ্ধিহারে, কার্বন গ্যাস ছাড়া বাড়িয়েই চলে।
ভারতীয় রাষ্ট্র প্রদত্ত জলবায়ু সঙ্কটের এক নম্বর সমাধান, ‘পরিবেশ-বান্ধব’ কয়লা উৎপাদন বাড়ানো, কয়লা পুড়িয়ে তাপবিদ্যুৎ তৈরি। দু নম্বর সমাধান, কর্পোরেট মালিকানাধীন ‘সাফ’ শক্তির উৎপাদন, যার মধ্যে বনজঙ্গল ঘরগেরস্তি চাষজমি গ্রামশহর ডুবিয়ে বিস্তর মানুষ না-মানুষ প্রাণী উচ্ছেদ করে বড় বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বিধ্বংসী পরমাণুবিদ্যুৎ, সুজলনের হাওয়াবিদ্যুৎ, আদানির সৌরবিদ্যুৎ ইত্যাদি। বাকি থাকলো জঙ্গল, মানে তিন নম্বর সমাধান। যেহেতু জঙ্গল নিয়ে খাসা ব্যাবসা করা যায়, এবং এই দ্যাখো আমাদের দেশে কত বন, সবুজ গাছপালা, যারা অক্সিজেন ছাড়ে এবং বলাই বাহুল্য, কার্বন ডাই-অক্সাইড খায়, এসব বলেটলে প্রচুর তথাকথিত পুঁজি ও শক্তি-নিবিড় (energy and capital intensive–অর্থাৎ কিনা প্রচুর পুঁজি ও তেল/কয়লা পোড়ানো শক্তি খায় এমন) উন্নয়ন কাজ করা যায়, ভারত সরকার গত প্রায় দু’দশক ধরে বাকি বিশ্বকে বন দেখিয়ে আসছে। গোদা বক্তব্যটা এইরকম, ভারতবর্ষের বন হচ্ছে ‘নেট কার্বন সিঙ্ক’, মানে ওই বনে কার্বন জমা হয়, জমা থাকে। সরকার উবাচ, ২০১৪-র যে কার্বন গ্যাস ছাড়ার পরিমাণ ২০০.৬ কোটি টন, তার মধ্যে ভূমি-ব্যবহার, ভূমি-ব্যবহারের পরিবর্তন ও বন-সংক্রান্ত কাজ (Land Use, Land-Use Change and Forestry–LULUCF) থেকে গ্যাস বেরুনোর হিসেব ছিলো না। ছিলো না তার কারণ ওই ক্ষেত্র (LULUCF) থেকে যা কার্বন বেরিয়েছে, জমা হয়েছে তার চাইতে অনেক বেশি। অর্থাৎ খরচের চেয়ে জমা বেশি, অর্থাৎ ‘নেট সিঙ্ক’। কেমন সিঙ্ক? উন্নয়নের মহাযজ্ঞে যে ঘি (কয়লা, তেল) পুড়েছে, পুড়ে যে দেশপ্রেমিক কার্বন বায়ুমন্ডলে জমা হয়েছে, তার নিদেন পক্ষে ১২ ভাগ টেনে নিয়েছে দেশের বন ও গাছপালা। কি কল দেখুন। ২০১০-১৪ সময়পর্বে ভারতের কার্বন গ্যাস ছাড়ার পরিমাণ বাড়ছে ১৮ শতাংশ। তার মধ্যে ১২ শতাংশই যদি বনরূপী সিঙ্ক শুষে নেয়, রইল বাকি ছয়। এটা ২০১৪-র হিসেব। পরবর্তী হিসেবে দেখা যাবে কার্বন জমা ও খরচ বরাব্বর হয়ে গ্যাছে, অর্থাৎ যেটুকু কার্বন গ্যাস ভারত ছেড়ে থাকতো, তাও ছাড়ছে না, অথচ চমৎকার কী চমৎকার, উন্নয়ন চলিতেছে, মানে হাইহাই রবে কয়লা/তেল পুড়ছে। ভারতের বনে কার্বন জমা হওয়ার গল্পের পিছনে যে আখাম্বা ঢপবাজি কিলবিল করছে, তা নিয়ে মেলা লেখাপত্তর আছে — বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতেরা নানা হিসেব দিয়ে দেখিয়েছেন, যে পদ্ধতিক্রম এবং তথ্যভিত্তি অনুসরণ করে বনে কার্বন জমা পড়ার ও জমা থাকার অঙ্ক করা হয়, তাতে বিস্তর গ্যাঁজাগল্প আছে। এক তো কোন ধরণের বন কী কী প্রাকৃতিক পরিবেশে ও অবস্থায় ঠিক কতটা কার্বন ধারণ করতে পারে, তার কোন সর্বজনগ্রাহ্য ফরমুলা নেই। তায়, দেশজুড়ে যে দেদার বন-কাটাই বা বনধ্বংস চলছে, তার ফলে ঠিক কতটা কার্বন বাইরে এসে বায়ুমণ্ডলে জমা পড়ছে, তারও ঠিকানা নেই। বনকে নেট সিঙ্ক বানাতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও পদ্ধতিক্রমকে নেহাতই নির্বিচারে উলটপালট করা হয়েছে, তার তুলনা এই বিশ্বজোড়া ঢপবাজারেও মেলা ভার।
ভারতবর্ষের বনবাসী আদিবাসীরা যখন বনধ্বংসের বিরুদ্ধে সাধ্যমতো লড়ছেন, রাষ্ট্র ও তার সহযোগী কর্পোরেটকুল বন-সাফাই অভিযানে নেমেছেন। সুসংগঠিত রাষ্ট্র-অনুমোদিত বনধ্বংসের প্রক্রিয়ায় ১৯৮০ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে ১৫ লক্ষ হেক্টর (১৫ হাজার বর্গকিমি) জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে গেছে, তার মধ্যে ৫ লক্ষই বিভিন্ন খনিখাদানের জন্য। এই হিসেব ভারত সরকারের। ২০১৫ থেকে ২০১৮-র মধ্যে ২০ হাজার হেক্টরেরও বেশি ঘন প্রাকৃতিক জঙ্গল সাফাই-এর জন্য সরকারি ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বন অধিকার আইন মোতাবেক, প্রতি বন-সাফাই এর ছাড়পত্র দেবার আগে, ওই বন-এলাকা ব্যবহারকারী বনবাসী-আদিবাসীদের গ্রামসভার লিখিত অনুমতিপত্র থাকা প্রয়োজন। ভয় দেখিয়ে, ছলচাতুরি করে ও সইসাবুদ জাল করে গ্রামসভার ছাড়পত্র তৈরি করা হচ্ছে, উদাহরণস্বরূপ, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে ঠুড়গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বন-সাফাই ছাড়পত্র বা ফরেস্ট ক্লিয়ারেন্স। স্থানীয় মানুষদের প্রায় কিছুই না জানিয়ে পঞ্চায়েতকে ব্যবহার করে জেলা প্রশাসন গ্রামসভার অনুমতিপত্র তৈরি করে, তদনুযায়ী ভারত সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রক ফরেস্ট ক্লিয়ারেন্স দেয়। কলকাতা হাইকোর্ট-এর একটি বেঞ্চ ফরেস্ট ক্লিয়ারেন্সকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে। ঠুড়গা ব্যতিক্রম, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামসভার জাল চিঠির ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে, এবং বন কাটা পড়ছে। যেসব বন এলাকায় খনিখাদান হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো, সেখানেও ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে, যথা ছত্তিশগড়ের সরগুজা জেলার হাসদেও আনন্দ বন।
সরকার-অনুমোদিত সংগঠিত বনধ্বংসের ফলে যে কার্বন বাইরে আসে, সে হিসেব দেশের মোট কার্বন গ্যাস ছাড়ার হিসেবের মধ্যে ধরা হয় না। কয়লা তোলা ও পোড়ানো চলতেই থাকে। কয়লা-সহ খনিখাদান, বড় বাঁধ ও রাস্তা, সেনাছাউনি ইত্যাদি উন্নয়নকর্মের প্রয়োজনে বন-সাফাইও চলতেই থাকে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন গ্যাসের পরিমাণ বাড়তেই থাকে–সাম্প্রতিকতম এক হিসেবে (বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার হিসেব —https://www.bbc.co.uk/news/science-environment-49773869), ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গোটা পৃথিবীর কার্বন গ্যাস ছাড়ার পরিমাণ বেড়েছে ২০ শতাংশ মতো। উষ্ণায়ন বাড়তে থাকে, জলবায়ু ওলটপালট হয়ে যায়। ভারতবর্ষের সর্বত্র জলবায়ু বদলের ব্যাপারটা এতটাই প্রকট যে রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারের চাঁইদেরও বলতে হচ্ছে, ক্লাইমেট চেঞ্জ হে বাপুসকল, কারুর কিচ্ছু করার নেই। যা চলার, চলতেই থাকে অবশ্য। ২০১৯-এর কথাই ধরুন। উত্তরপ্রদেশে-মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ ছাড়িয়ে তেলেঙ্গানা-অন্ধ্রপ্রদেশ-তামিলনাড, খরা চলছে তো চলছেই। খরার পিঠে পিঠেই বন্যা, অতিবৃষ্টি, ধস, ভূমিক্ষয়। গুজরাত, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, কেরালা। কেরালায় পরপর দুবার বিধ্বংসী বন্যা। কত মানুষের ঘরবাড়ি জমিজিরেত ধুয়েমুছে গেল, বন্যা ও খরার ধাক্কায় কত মানুষ ঘর ছাড়ছেন, তার সঠিক হিসেব নেই। জর্মনওয়াচ নামের এক সংস্থা প্রকাশিত ২০১৯-এর এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে, খরা, তাপপ্রবাহ, বন্যা, অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মারা গিয়েছেন ৭৩,২১২ জন, বছরপিছু গড়ে ৩,৬৬০ জন করে।
হিমালয়ে নিয়ম করে দাবানল, হিমবাহ পিছু হটছে। উঠে আসছে সমুদ্রের জলস্তর। কী করা যাবে, ক্লাইমেট চেঞ্জ। কিছু করার নেই, সুতরাং আমাদের সরকার নিয়ম করে কয়লাখাদানের জন্য বন কাটবেন, লোককে ভিটেছাড়া করবেন। বড় বাঁধ হবে। পরমাণুবিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। আদানি আদি কোম্পানি এক হাতে কয়লা অন্য হাতে সৌরতাপ নেবেন। শুধু কেন্দ্র কেন? উন্নয়ন হেন মহাকাজে সব শিয়ালের এক রা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বীরভূম-ঝাড়খণ্ডের সীমান্তে আদিবাসীদের জমি নিয়ে, বন নষ্ট করে, কয়লাখাদান খুঁড়তে বদ্ধপরিকর। কিসের উষ্ণায়ন? রাজ্যের পূর্বতন শাসক, একদা বামপন্থী, সিপিআইএম দলের তামাম নেতা গত দশ বছর ধরে কেঁদেই যাচ্ছেন সিঙ্গুর গেল, টাটা গেল, মোটর গাড়ির কারখানা গেল। মোটর গাড়ির উৎপাদন বাড়া মানে বেশি তেলপোড়া, বেশি কার্বন গ্যাস ছাড়া। তাতে কি এলোগ্যালো? উন্নয়ন হবে না?
রাজনীতির মূল বিষয়টা নানাভাবে গুলিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। যাবতীয় সরকারি বেসরকারি প্রচার আপনার-আমার এবং আপনাদের-আমাদের সন্তান-সন্ততিকে এ বিষয়ে কর্তব্য করণীয় বলে দেয়। এ জাতীয় নীতিজ্ঞান বা সারমন অনেক। বেশি করে গাছ লাগান, নতুন সিএফএল বাল্ব ব্যবহার করুন যাতে বিদ্যুৎ কম পোড়ে, কম ভোগ করুন, কম গাড়ি চড়ুন ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে, চাষজমি নষ্ট করে নতুন নতুন গাড়ি কারখানা হোক, দৈত্যাকার মলগুলি আপনার বাড়ির সামনের আকাশ ছিন্নভিন্ন করে হাজার হাজার মানুষের জীবিকা ধ্বংস করুক, শিল্পবিস্তারের নামে কয়লার গুঁড়ো আর ছাই মানুষের ফুসফুস ছেয়ে দিক, বিষিয়ে যাক জল। উন্নয়ন-প্রক্রিয়া অমোঘ এবং প্রশ্নাতীত।
কী উন্নয়ন, কী তার ‘বিকল্প’, সবটাই নির্ধারণ এবং নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজি। সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসা এক প্রাকৃতিক ব্যবস্থা যে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে তার মূল কারণ পুঁজিবৃদ্ধির মানুষী প্রক্রিয়াটিকে আটকানো যায়নি। প্রথমে ব্যক্তি, পরে কোম্পানিকুল, এবং বর্তমানে কর্পোরেশন-নিয়ন্ত্রিত পুঁজি প্রায় বিনা বাধায় পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করেছে। পুঁজি যেহেতু পুঁজি বাড়ানোর কাজটাই শুধু ঠিকভাবে করতে পারে, লুঠের নৈতিকতা, বা পরিবেশধ্বংস, জলবায়ু-পরিবর্তন, উচ্ছেদ ইত্যাদি বিষয়গুলো পুঁজিবাদ বা পুঁজিবান্ধব রাষ্ট্রের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ থাকে না।
ঠিক এ কারণেই কিয়োটো, কোপেনহাগেন কী পারি, বা জলবায়ু-পরিবর্তনের সমাধানের জন্য সব আর্ন্তজাতিক উদ্যোগ, শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে। পুঁজিকে যেহেতু বাড়তেই হবে, উন্নয়ন বা শিল্পসভ্যতার বর্তমান চেহারার বদল সম্ভব নয়, সম্ভব নয় কয়লা বা খনিজ তেল পোড়ানো বন্ধ বা কম করা। অথচ কয়লা বা তেল জাতীয় জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো কম না-করলে, কার্বন গ্যাস ছাড়াও কম করা যায় না।
এমতাবস্থায়, কী করণীয়? এমন কিছু করা যাতে পুঁজিও বাড়ে অথচ কার্বন গ্যাসও বাড়ে না। সুতরাং বাজার, এবং আরো বাজার, যেখানে পৃথিবীর হাওয়া-মাটি-জল সমস্ত অর্থেই পণ্য হয়ে ওঠে, হাওয়ায়, বা উদ্ভিদে কার্বন জমা হবে, না হবে না, তা নিয়ে শেয়ারবাজারে জুয়া খেলা হয়। ঠিক যে যে কর্পোরেশানগুলো সবচাইতে বেশি দূষণ ঘটায়, যারা জলবায়ু-পরিবর্তনের জন্য সবচাইতে বেশি দায়ী, তারাই এই বাজার থেকে সবচাইতে বেশি মুনাফা তোলে।
জলবায়ু–ধর্মঘট, প্রতিবাদের রাজনীতি ও আমরা
জলবায়ু-ন্যায় বা ক্লাইমেট জাস্টিস -এর দাবিতে গত তিন দশক ধরে পৃথিবীতে অসংখ্য প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। ইউরোপে, বিশেষত শিল্পোন্নত পশ্চিম ইউরোপে, এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে প্রধান বামঘেঁষা রাজনৈতিক দলেদের অধিকাংশ ও গ্রিন পার্টির লোকজন এইসব মিছিলে হেঁটেছেন। রাজনৈতিক দল ভিন্ন, বহু সামাজিক আন্দোলন ও ছোটবড় এনজিও ও সামাজিক সংস্থা জলবায়ু ন্যায়-আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। সুইডেনের স্কুলপড়ুয়া গ্রেটা থুনবার্গ-এর আহ্বান, ২০১৮ থেকে শুরু করে হালের জলবায়ু-ধর্মঘট, মোটামুটি এই পরম্পরায়। যা ঘটেছে, তার সবটা এক রকমের নয়। কিছু নিছকই অনুষ্ঠান বা ইভেন্ট, একদিনের মিছিল, সম্মেলন, ধরনা, যার বেশির ভাগটাই বাৎসরিক কপ এবং শীর্ষ বৈঠককে কেন্দ্র করে। কিছুটা বিভিন্ন দেশের সরকারি নীতিতে পরিবর্তন দাবি করে, রাষ্ট্রকে আরো পরিবেশ-সংবেদী করে তোলার আপাত চেষ্টায়। কিছু আবার সরাসরি রাস্তার লড়াই, যথা কয়লাখনি বা তেলখনির বিরুদ্ধে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে তেল নিয়ে যাবার জন্য বানানো পাইপলাইনের বিরুদ্ধে, প্রাকৃতিক বন বা ঘাসজমি নষ্ট করে সেখানে কার্বন জমা করবার জন্য দ্রুত-বাড়ের গাছ লাগানোর প্রকল্পের বিরুদ্ধে। জলবায়ু-আন্দোলন বলতে কোনো এক ধরণের আন্দোলনের কথা বলা যায় না। কপ ও শীর্ষবৈঠক কেন্দ্রিক যে সব প্রতিবাদ, তার বেশিরভাগের উদ্যোক্তা ছিলেন এনজিও-রা, যদিও বেশ কিছু জায়গায় সামাজিক আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়নেরা অংশ নেন। সরকারি নীতি বদলের লক্ষ্যে কাজ করেছেন প্রধানত গ্রিন দলের লোকেরা। রাস্তার লড়াই-এর নেতৃত্ব সামাজিক আন্দোলনের হাতে থেকেছে, যদিও বহু জায়গায় এনজিও-রাও যুক্ত ছিলেন।
এই বিভিন্নধর্মী প্রতিবাদ আন্দোলন থেকে জলবায়ু-রাজনীতির কি অন্য কোন চেহারা তৈরি হয়ে উঠছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক জলবায়ু-রাজনীতির চাইতে অন্যরকম? এককথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। ১৯৯২-এর রিও বৈঠক থেকে শুরু করে ১৯৯৭ এর কিয়োটো সন্ধি হয়ে ২০১৫-র পারি বৈঠক পর্যন্ত জলবায়ু-রাজনীতি বলতে যা চলেছে তা স্থিতাবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার, রাষ্ট্রপুঁজির নিওলিবারল যুগলবন্দিকে একমাত্র সম্ভাব্য বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মরিয়া চেষ্টা। জলবায়ু-ন্যায়ের কথা বলে আন্দোলনে নেমেছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই জলবায়ু-বদলের সমাধানের নামে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে একাধারে সামরিক জাতিরাষ্ট্র ও কর্পোরেটপুঁজির মধ্যে বেটে ও বেচে দেবার যে ধান্দা, তাকে সমর্থন করেন, কার্বন বাণিজ্যের সমর্থক হয়ে পড়েন। বাকিরা দাবি করতে থাকেন, কার্বন গ্যাস বেশি ছাড়ে এমন সব কাজের ওপর প্রচুর ট্যাক্স চাপানো হোক। আর একটা দাবি, জলবায়ু-বদলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রধানত দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর গরিব মানুষদের পুনর্বাসন ও ত্রাণের জন্য উত্তর গোলার্ধের ধনী দেশেরা প্রচুর টাকা দিক। টাকা দেওয়া হোক, দক্ষিণ গোলার্ধের দেশে সাফ-প্রযুক্তির শক্তি উৎপাদনের জন্য, বা এমন প্রযুক্তির জন্য যাতে কার্বন ছাড়ার পরিমাণ কমে। দক্ষিণ গোলার্ধের দেশে বন, বিশেষত, ক্রান্তিমণ্ডলীয় বন বাঁচিয়ে রাখার জন্যও টাকা দেওয়া হোক। এই সব কথা এখনো বলা হচ্ছে। বামপন্থীরাও বলছেন। কার্বন বাণিজ্যের সমর্থনে জলবায়ু-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এমন কেউ বড় একটা কিছু বলছেন না ঠিকই, কিন্তু পুঁজিবাদী জাতিরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার খানিক ফেরবদল করে, স্রেফ টাকা বিলি কী খরচা করে ব্যবস্থার মধ্যেই জলবায়ু-সঙ্কটের সমাধান হবে, এ কথা বলে যাচ্ছেন অনেকেই। যদিও হালের জলবায়ু-ধর্মঘটে কার্বন-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান উঠেছে, এ প্রশ্নের উত্তর নেই, কার্বন পুঁজির জায়গায় না-কার্বন পুঁজি হলে কি ফারাকটা হতো? পুঁজির বা রাষ্ট্রের পক্ষে, রাষ্ট্রপুঁজির পক্ষে পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠা কি আদৌ সম্ভব? আরো যা গুরুতর দাবি উঠছে, জলবায়ু জরুরি অবস্থা জারি করো। কে করবে? না রাষ্ট্রসঙ্ঘ। রাষ্ট্রসঙ্ঘ কী? না বিশ্বের জাতিরাষ্ট্রগুলির মিলিত একটা পাঁচমিশেলি সংস্থা, বস্তুত যে ক্ষমতাহীন, সামরিক শক্তিধর জাতিরাষ্ট্রের চৌহদ্দির মধ্যে কোন রাষ্ট্র কতটা কয়লা আর তেল তুলছে বা পোড়াচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য বা সামর্থ্য তার নেই। নেই কেননা জাতিরাষ্ট্রের পুরো ধারনা ও প্রকল্পটাই সামরিক, সামরিক ক্ষমতার মাধ্যমে পুঁজিবাদী স্থিতাবস্থাকে টিকিয়ে রাখা তার প্রধান কাজ। না জাতিরাষ্ট্র না রাষ্ট্রসঙ্ঘ কারুর সাধ্য নেই পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা, ও প্রকৃতি লুঠের পুঁজিবাদী ও ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যকে ধাক্কা দেবার।
জলবায়ু-সঙ্কট নিয়ে রাস্তায় নেমে ক্ষমতাধর কোম্পানি ও সামরিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়ছেন যে আন্দোলনরত মানুষ, তারা এই ধাক্কাটাই দিচ্ছেন। ধাক্কা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে সামরিক জাতিরাষ্ট্রের চৌহদ্দিতে আটকে ফেলার বিরুদ্ধে। ধাক্কা সেই পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিকরণের প্রক্রিয়ায়, যেখানে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাগুলি হয়ে ওঠে মুনাফাবৃদ্ধির কল। ধাক্কা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, যার দ্বারা আদিবাসীদের, কৃষকদের, মৎস্যজীবীদের, হস্তশিল্পীদের উচ্ছেদ হতে হয় তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধির প্রয়োজনে। রাষ্ট্র ও পুঁজির আধিপত্যকে প্রশ্ন না করা গেলে জলবায়ু-সঙ্কটের সমাধান সম্ভব নয়। রাষ্ট্র ও পুঁজির প্রভাবের আওতা থেকে না বেরুতে পারলে, প্রশ্ন করাও যাবে না।
সরাসরি জলবায়ু বদল প্রসঙ্গে বা জলবায়ু-ন্যায়ের দাবি দিয়ে ভারতবর্ষে কোনোরকম উল্লেখযোগ্য আন্দোলন হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এই লেখকের অন্তত জানা নেই, ভারতের ছোটবড় বিপ্লবী, সংশোধনবাদী, সংসদীয়, অসংদীয় অসংখ্য অগুন্তি দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে কারুর জলবায়ু-রাজনীতি নিয়ে এমন কোনো ব্যাখ্যা বা প্রস্তাবনা আছে কিনা, যা ভারতীয় রাষ্ট্রের ব্যাখ্যার থেকে আলাদা।পৃথিবী, দেশ, রাজ্য ভাঙচুর হয়ে যাচ্ছে জলবায়ু-বদলের অভিঘাতে, কোথাকার মানুষ কোথায় যাচ্ছেন তার কে হিসেব রাখে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টালমাটাল, কিন্তু আমাদের বামপন্থীরা অবিচল, তাঁরা চোখ-কান-নাক বন্ধ রেখে নিজ নিজ দোকান বাঁচাবেন। বড়জোর, ফেসবুকে সাঁই সাঁই ছবির বন্যা বইলে, রাস্তায় নেমে মিছিল করবেন, পোস্ট দেবেন। যারা মাঠে-ময়দানে দিবারাত্র লড়ছেন জলবায়ু-সঙ্কটের সঙ্গে, রাষ্ট্রপুঁজির আধিপত্যকে প্রশ্ন করছেন, তাঁদের সঙ্গে আমাদের বামপন্থীদের যোগাযোগ তৈরি হবে না তবুও, কিছুতে হবে না?
লেখক সামাজিক ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী।
Cover Image : Climate protesters demonstrate in London, Friday, Sept. 20, 2019. (AP Photo/Frank Augstein)
এটাও পড়ুন আমাজনে আগুন, গ্রেটা থুনবার্গ, জলবায়ু সঙ্কট ও জলবায়ু রাজনীতি
Also read Climate Change in India and the State’s Response