বাউল-ফকির, মাজারপন্থীদের হয়ে আমাদের কেন সোচ্চার হওয়া? আমরা যদি সংখ্যালঘুদের প্রতি হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হই, খুব সহজাত কারণেই তাহলে আমাদের সংখ্যালঘুর মধ্যেও সংখ্যালঘু এই অংশের হয়ে আমাদের কথা বলা প্রয়োজন। মুর্শিদাবাদের হুলাসপুর ঘুরে এসে লিখছেন লাবনী জঙ্গী ।
১
মুর্শিদাবাদের ডাঙাপাড়া গ্রামপঞ্চায়েতের অন্তর্গত হুলাসপুর গ্রামে একটি প্রাচীন মাজার ভেঙে ঈদগাহ বানানো হয়েছে। এই প্রাচীন মাজারটি ছিল বদরপীর সাহেবের। লোকমুখে শোনা বদরপীর এই গ্রামে কয়েকশো বছর আগে এসেছিলেন। এবং এই অঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে লোকমুখে প্রচার হয় যে, তিনি অনেক রোগব্যাধি সারাতে জানেন। পরবর্তী সময়ে এই প্রাচীন মাজারটি এই প্রান্তিক অঞ্চলে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এখানে এসে মানত করে কিছু রোগব্যাধি থেকে মুক্ত হয়েছেন এমন বিশ্বাসের কথা আজও অনেকে বলেন। সময়ের সাথে এই মাজারে মহরম মাসের কোনো একটি সময়ে বাৎসরিক উরস অনুষ্ঠিত হত বলে জানা যায়। এই সময়ে স্থানীয় হিন্দু মুসলমান একত্রিত হয়ে মাজারে আসতেন শিন্নি চড়াতেন, মানত করতেন।
২৫ জুলাই মাজারটিকে ভাঙা হয় এবং স্বল্প সংখ্যক হিন্দু ও মুসলমান এর বিরোধিতা করলেও তাঁরা মাজারটি রক্ষা করতে অসমর্থ হন। কারণ মাজারটি শুধু মুসলমান মৌলবাদীরাই ভাঙেনি, তাঁদের সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতাবলীরা সহায়ক হিসাবে ছিল। যারা মাজারটি ভাঙার কাজে গ্রামবাসীকে প্রণোদিত করেন তাঁরা সরকারি ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক শক্তির সম্পূর্ণ মদত পেয়েছেন বলে অভিযোগ।
১২ অগস্ট এখানে একটি নতুন ঈদগাহ নির্মাণ করে নামাজ পড়া হয়। এবং জায়গাটিকে ঘিরে দেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে মাজারটির রক্ষণাবেক্ষণের সাথে যুক্ত পাশের গ্রামে বসবাসকারী খাদেম পরিবারটি মাজারটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশাসনিক সাহায্য চাইলেও প্রশাসন একপ্রকার নিষ্ক্রিয় থাকে। এর আগেই ২৫ জুলাই মহম্মদ আশিক আহমেদ (খাদেম পরিবার) কোর্ট থেকে ১৪৪ ধারা জারি করবার অনুমতি আনলেও সেখানে নতুন ঈদগাহ নির্মাণ করে ১২ তারিখ ইদের দিন রাজনৈতিক মৌলবাদের বাহুবল দেখিয়ে ঈদের নামাজ পড়া হয়। এই কর্মকাণ্ডে যাদের মধ্যে নাম উঠে আসে, তারা ওই এলাকার নির্দিষ্ট মৌলবাদী মুসলমানের তুলনায় অনেক বেশি ‘তৃণমূল সমর্থক গুন্ডা’পরিচয়ের সাথেই সংপৃক্ত।
ঘটনাটি জানতে পেরে আমরা চার জনের একটি দল হুলাসপুরে যাই ২৯ অগস্ট। ‘আমরা একটি সচেতন প্রয়াসের’ পক্ষ থেকে মহম্মদ ফারুকউল ইসলাম এবং একটি ভিডিও ডকুমেন্টেশনের জন্য শুভাশিস গুণ, কুণাল চক্রবর্তী ও আমি। আঞ্চলিক পীরপন্থী মানুষ, সাধারণ মানুষ এবং ওই অঞ্চলের তৃণমূল সমর্থিত শরিয়তপন্থীদের সাথে কথা বলে এই ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে চাই।
আশিক আহমেদ (মাজারের খাদেম পরিবারের সদস্য) তিনি আমাদের পুরনো বদরপিরের নামাঙ্কিত জমির দলিল দেখান। যা আশিক আহমেদের পূর্বপুরুষেরা মাজারের জন্য বদরপিরের নামে দান করেছিলেন। ওই অঞ্চলের আরও পীরপন্থী বাউল-ফকির মুসলমান মানুষেরা জানান কীভাবে গ্রামীণ স্তরে এখানে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু শরিয়তপন্থীরা তাঁদের উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক আক্রোশ নামিয়ে আনেন। কীভাবে একটি গ্রামে পাঁচ দশটা সংখ্যালঘু বাউল-ফকির মুসলমান পরিবারকে ধর্মের নামে একঘরে করে রাখা হয়। মসজিদে নামাজ পড়বার জন্য জোর করা হয়। আর বাউল-ফকিরদের সংখ্যা এক একটি গ্রাম নিরিখে হাতে গোনা। ফলত এই জবরদস্তি ও নিপীড়নের কথাগুলো প্রথম সারির খবর হয়ে ওঠে না। বা খবরের পর্যায়েই ফেলা হয় না। আর রাজনৈতিকভাবেও এই নিপীড়নের কথা আবছা থাকে। কারণ ভোটের নিরিখে এই মানুষেরা সংখ্যায় নগণ্য।
হুলাসপুরের এবং ওই অঞ্চলের বাউল-ফকিরদের সাথে কথা বলার পর আমরা যাই মাজারের সামনে। সেখানে ৭-৮ জন মহিলা গল্প করছিলেন। আমরা জিজ্ঞাসা করি, এখানে কি একটি মাজার ছিল? সে বিষয়ে আপনারা কিছু জানেন? উত্তর আসে, ‘হ্যাঁ ছিল তো মাজার, এখন আর নাই, ভাঙে দিসে মাজার। ‘আমরা প্রশ্ন করি কার মাজার ছিল কেমন ছিল? ওঁরা জানান বদরপীরের মাজার ছিল, লোকে মহরম মাসে মানত-টানত করতো; আমরাও করতাম। এই কথাগুলো সবে শুরু হয়েছিল, এমন সময় একটি যুবক এসে ওঁদের চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘কিসু জানো তুমরা, এখানে কুনো মাজার ছিল না।’ মহিলারা অনেকে চুপ করে যান, ও অনেকে চলে যন। এক বয়স্ক মহিলার সাথে যুবকটির কথা কাটাকাটি শুরু হয়, যুবকটি বলেন, ‘তুমরা কিছু জানো না, কিছু বলবা না। যিনারা এই বিষয়ে জানে তাদের ডেকি আনচি। ‘ওই বিশেষ লোকটি আসবার আগের মুহূর্তে আমরা ওখানে জড়ো হওয়া মানুষের সাথে কথা বলি। তাঁরাও দোনামনা স্বরে জানান তাঁরা শুনেছেন এখানে মাজার ছিল, অনেকে মানত-টানত করতোও।
এই কথাগুলো চলতে চলতে একজন লোক আসেন স্বাস্থ্যবান চেহারার, স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি পড়ে গলাতে গামছা জড়িয়ে। তাকে দেখে মূলত তৃণমূলের স্থানীয় নেতা মনে হল। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘ওসব মাজার-টাজার কী? এখানে ওসব ছিল না। আপনারা কারা? এখানে বহু বছর ধরে ঈদগাহ, এটা কোন মাজার নই। আপনাদের এখানে কে নিয়ে এসছে? আপনারা ফিরে যান; এলাকা কিন্তু ভালো নয়।’
এই কথাগুলো চলাকালীন ফারুককে ঈদগাহে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় একজন ভাঙা মাজারের জায়গাটি দেখাতে গেলে লোকটি মারমুখী হয়ে চিৎকার করে তেড়ে আসেন, ঈদগাহ থেকে বেরতে নির্দেশ দেন। এবং বলেন ‘আর কোনদিন যদি এদিকে দেখা যায় মাটিতে পুঁতে দেব। মাজারের মতোই চিহ্ন থাকবে না।’ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে আমরা ওখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হই। মসজিদে বা আঞ্চলিক হিন্দুদের সাথে কথা বলার সুযোগ হারাই।
এই ঘটনাটির বিষয়ে কথা বলতে আমরা লালবাগ থানাতে যাই। সেখানে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর মেজোবাবু আমাদের সাথে কথা বলেন। জানান ঘটনাটি নিয়ে এক পক্ষ সিদ্দিকুল্লার (রাজ্যের মন্ত্রী) কাছে গেছেন। তিনি আরও জানান এই ঘটনাটি সম্পত্তিগত দ্বন্দ্ব বলে মনে করা হচ্ছে। তাই দুই পক্ষকে নিয়ে মীমাংসার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে প্রশাসন থেকে। কথার মধ্যে তিনি এটাও বলেন, ওখানে আমরা গিয়ে মাজার দেখিনি, ঈদগাহই দেখেছি। আর এলাকাবাসীর বড় অংশের সমর্থন ঈদগাহের প্রতি। আমরা বাইরে থেকে গিয়ে ওখানে কী করতে পারি?
২
এই ঘটনাটির পর ওই এলাকার বাউল-ফকির সংগঠনের উপর রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পন্ন শরিয়তপন্থীদের দিক থেকে চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। প্রশাসন সালিশি ও মীমাংসাতে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার কথা বলে যা মূলত শরিয়তপন্থীদের দিকেই যাবে সংখ্যাগত কারণে। আর আমি আটকে যাই এই ঘটনাটা লিখতে। কাদের বিরুদ্ধে লিখব? যে দেশে সংখ্যালঘু মুসলমান, দলিত লিঞ্চ হয়ে খুন হয়ে যায় প্রতিদিনের খবরে; তেমন এক সর্বগ্রাসী মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদের কলম হয়ে না-যায়, সামান্য অসচেতনতার ফলে। এই গ্রামের অর্ধেকের বেশি মানুষ বিদেশ বিভুঁইয়ে কাজের জন্য রক্ত পানি করে। একটু ভালো থাকার সন্ধানে এই প্রান্তিক গ্রামের মানুষেরা নিজেরাও এক বিশাল নিপীড়নের মধ্যে জীবনযাপন করেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা তলানিতে। এ গ্রামের সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ, যাঁরা এই ঘটনাটিতে প্রত্যক্ষ নিপীড়ক না-হলেও কেন জানি না শরিয়ত মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে থাকেন, বা শরিয়ত মৌলবাদের ক্ষমতার আস্ফালনের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন না।
আমরাও কি মুখ খুলি? আমি বহুবছর ধরে গ্রামে ঘুরে ঘুরে অসংখ্য এমন মাজারের ঈদগাহ হয়ে ওঠার ঘটনা জেনেছি, ডকুমেন্ট করেছি। গত পাঁচ বছরে স্পষ্ট হতে দেখেছি মাজার কীভাবে মুসলমানের সম্পত্তি হয়ে ওঠে, তারপর শরিয়ত নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। এই বিবর্তন আসলে হিন্দুতবাদকে কতটা শক্তিশালী করে সেটা বছর দুয়েক আগে বেলপুকুর পঞ্চায়েতের পোলতা গ্রামে সরকারি অনুদানে পীরস্থানের জমি কবরস্থান হিসাবে পাঁচিল দেওয়া নিয়ে যে সাম্প্রদায়িক বিবাদ তৈরি হয়, সে ঘটনাটি জানলে জানা যায়। আজও ওই এলাকাটি ঘিরে পার্শ্ববর্তী হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা পরিস্থিতিকে অস্বীকার করা যায় না। গ্রামাঞ্চলে একদিকে জোর কদমে চলছে ধর্মীয় হিন্দুত্বের প্রচার। অন্যদিকে জামাত ও চেল্লার নামে এক অংশের শরিয়তপন্থীদের গ্রামে গ্রামে প্রচারগুলো এক নতুন ‘ধর্মীয় রাজনীতির’ প্রেক্ষাপট তৈরি করছে। যেখানে উভয়পক্ষের মৌলবাদের হাতে গ্রামগুলো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ক্রমে যেন বারুদের স্তূপ গড়ে উঠেছে সহজ মাটির নীচে। একটু হিংসার আগুন পেলেই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে।
৩
বাউল-ফকির, মাজারপন্থীদের হয়ে আমাদের কেন সোচ্চার হওয়া? আমরা যদি সংখ্যালঘুদের প্রতি হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হই, খুব সহজাত কারণেই তাহলে আমাদের সংখ্যালঘুর মধ্যেও সংখ্যালঘু এই অংশের কথা বলা প্রয়োজন। এছাড়াও ইতালীয় মার্ক্সবাদী রাজনীতিক গ্রামশি যে ‘অরগানিক বুদ্ধিজীবীর’ কথা বলেন, বাউল-ফকিরদের একটা বড় অংশ আমাদের এই গ্রামাঞ্চলের সেই অরগানিক বুদ্ধিজীবী। যাঁরা “প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বের আওতা থেকে মুক্ত, স্বাধীন চিন্তাশীল মানুষ; যে দরকারে সংখ্যাগুরুর মতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও তাঁর বিশ্বাসমত সত্যভাষণের সাহস ও স্পর্ধা রাখেন”। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা, ১৯৮৯ মুর্শিদাবাদের কাটরা মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে রাজ্যে যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প তৈরি হয়; সেই সময়ে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা পর্যন্ত বাউল-ফকির সম্প্রদায় সম্প্রীতি আর মানব প্রেমের গান গাইতে গাইতে হেঁটে আসেন। বাউল-ফকির সম্প্রদায়ের এই ৩০০০ সদস্যবিশিষ্ট সংগঠনটি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ক্ষয়িষ্ণু। রাজ্যের দেওয়া সরকারি সামান্য ভাতাতে সরকারি প্রকল্পের গান বাঁধতে হয় বেশি। এছাড়াও চরম দারিদ্র ও ভোগবাদের আস্ফালনে অনেক কিছুই ক্ষয়ের পথে। আমরা যদি লক্ষ করি ২০১৪তে মোদী ক্ষমতায় আসার পর সুফি সম্মেলনের সেই জাঁকজমক ও সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা। এরপর আমরা খোঁজ রাখিনি সুফিবাদের, বৈষ্ণববাদের জায়গাগুলো কীভাবে কেন্দ্রীয় মৌলবাদ কামড়ে ছিঁড়ে টুকরো করে চলেছে। রাজনৈতিক মৌলবাদ যত সক্রিয় হবে, সমাজে সমন্বয়ের এই জায়গাগুলো প্ল্যানমাফিক ধ্বংস করা হবে। আর রাষ্ট্রক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী দলগুলো বরাবর চাইবে সমন্বয়ের জায়গাগুলো নষ্ট করতে। অরগানিক ইন্টেলেকচুয়ালদের নিয়ন্ত্রিত করতে বা ভাতা দিয়ে পুষতে।
এই নিয়ন্ত্রণ, আগ্রাসন আজকের নয় – এটা ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য। বহুকাল ধরে চলছে।
৪
আমরা কবি জসিমুদ্দিনের একমাত্র উপন্যাস “বোবাকাহিনী” যা কবি “দুই বাংলার মেহনতি মানুষের জন্য” উৎসর্গ করেন (১৩৪৭, অগ্রাহায়নে) সেখানকার অল্প কিছু অংশ আরেকবার একসাথে পড়তে পারি। কেন আমাদের এই অংশটুকু নতুনভাবে পড়া দরকার? আজকের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়েও এই বাংলার প্রান্তিক মেহনতি মানুষের জীবনে বদল বিশেষ ঘটেনি। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্তরে নিষ্পেষিত হওয়া মানুষগুলোর এক বড় অংশ ভাবেন এই জগতে যখন দোজখ দেখছেন মৃত্যুর পরের জগতে বেহেস্ত মিলে যায়। এই বেহেস্তে বাঁচার আকাঙ্ক্ষাটুকুকে কিভাবে ধর্মকারবারিদের ব্যাবসার জায়গাতে পরিণত হয়। সেখানে ক্ষমতাশালী রাজনীতিও কিভাবে মিশে যায়। আমরা এখানে “বোবাকাহিনী”র আরজান ফকিরের কথা পড়ব; যিনি সহজ জীবনে বাঁচতে বিশ্বাসী; আর সহজ বাঁচাটা তাঁর ধর্ম। যা এই গ্রামে সংখ্যালঘু। তবুও এই সংখ্যালঘু আরজান ফকির ও তাঁর সারিন্দা মোকাবিলা করে লেলিহান সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে, সুর আর প্রেম দিয়ে। আরজান ফকিরের ওই কথাগুলো আজকের দিনেও সমান প্রাসঙ্গিক — “হেবার রসূলপুরির সাথে মামুদপুরির লড়াই। দুই পক্ষে হাজার হাজার লাইঠাল। কতজনের বউ যে সিঙ্গার সিন্দুর আরাইত, কতজনের মা যে পুত্র শোগী ঐত সেই কাইজায়। কি করব, দুই দলের মদ্দিখানে জায়া সারিন্দায় সুর দিলাম। দুই দলের মানুষ হাতের লাঠি মাটিতে পাইতা সারিন্দার গান শুনতি লাগল। মাওলানা সাহেব! আমারে যে শাস্তি দিবার দ্যান, কিন্তুক আমার সারিন্দাডারে বাঙবেন না”।
‘৮৯ সালে কাটরা মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে হিংসার আগুনে জেলাগুলো জ্বলেছে। বাউলফকিরদের একটা দল কাটরা থেকে কলকাতা পায়ে হেঁটে সম্প্রীতির গান শুনিয়েছিল মানুষকে। আমরা আরজান ফকিরদের ভুলে যেতে পারি না। বাংলার মেহনতি মানুষের লড়াইয়ে আরজান ফকিরদের গুরুত্ব অনেক – তাই চলুন আমরা সংক্ষিপ্ত ভাবে বোবাকাহিনীর আরজান ফকির, মৌলানা সাহেব, চতুর ধর্মরাজনীতির ব্যাবসায়ি উকিলসাহেবের কথা আরেকবার পড়ি।
মোনাজাত শেষ হইলে মাওলানা সাহেব বলিলেন, ‘ভাইসব’! এবার ডিসট্রিক্ট বোর্ডের ভোটের দিন আপনারা উকিল সাহেবকে ভুলিবেন না। আর শহরে যাইয়া মামলা মোকাদ্দমা করিতে সকলের আগে আপনাদের দরদী বন্ধু উকিল সাহেবকে মনে রাখিবেন।
তখন উকিল সাহেব উঠিয়া বক্তৃতা আরম্ভ করেন, ভাইসব ‘ভাইসব’! ইতিপূর্বে মাওলানা সাহেব সব কিছুই বলিয়া গিয়াছেন। আমি মাত্র একটি কথা বলিতে চাই। দুনিয়া যে গায়েব হইয়া যাইবে সে বিষয়ে আমার একটুমাত্রও সন্দেহ নাই। আমরা কি দেখিতেছি — মুসলমানের ঘরে জন্ম লইয়া বহু লোকে গান বাজনা করে, সারিন্দা-দোতারা বাজায়, মাথায় লম্বা চুল রাখে আর রাত ভরিয়া গান করে। উহাতে আল্লাহ্ কত বেজার হন তাহা আপনারা মাওলানা সাহেবের মুখে শুনিয়াছেন। আপনারা খেয়াল করিবেন দেশে যে এত বালা মুছিবাত আসে, কলেরা বসন্তে হাজার হাজার লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাহা এই গান বাজনার জন্য। ভাইসব! আপনাদের গ্রামে যদি এখনও কেহ গান বাজনা করে তাহাকে ধরিয়া আনিয়া এই ধর্ম-সভায় ন্যায় বিচার করেন। এই বলিয়া উকিল সাহেব তার বক্তৃতা শেষ করেন।
তখন গ্রামের মধ্যে কে গান করে, কে সারিন্দা বাজায় তাহাদিগকে ধরিয়া আনিয়া বিচার করা হয়।
এইভাবে সভা করিতে করিতে একবার উকিল সাহেব তাহাদের দলবল লইয়া পদ্মানদী পার হইয়া ভাসানচর গ্রামে উপস্থিত হইলেন। সেখানে খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বক্তৃতা করিয়া উকিল সাহেব যখন বসিয়া পড়িলেন; তখন গ্রামের একজন লোক বলিল, ‘হুজুর! আমাগো গায়ের আরজান ফকির সারিন্দা বাজায়া গান গায়’।
উকিল সাহেব উপস্থিত লোকদিগকে বলিলেন, আপনারা কেহ যাইয়া আরজান ফকিরকে ধরিয়া আনেন। বলা মাত্র তিন চারজন লোক ছুটিল। আরজান ফকির কে ধরিয়া আনিতে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বছির দেখিল সৌম্যমূর্তি একজন বৃদ্ধকে তাহারা ধরিয়া আনিয়াছে। তাহার মুখে সাদা দাঁড়ি মাথায় সাদা চুল। বৃদ্ধ হইলে মানুষ যে কতো সুন্দর হইতে পারে এই লোকটি যেন তাহার প্রতীক। মুখখানি উজ্জ্বল হাসিতে ভরা। যেন কোন বেহেস্তের প্রশান্তি লাগিয়া আছে। সে আসিয়া বলিল, ‘বাজানরা! আপনারা আমারে বোলাইছেন? দয়াল চান গো, এত কাইন্দা কাইন্দা ডাহি। দেহা দেয় না। আইজ আমার কতই ভাগ্যি দয়াল চান- রা আমারে ডাইকা পাঠাইছেন।’
এমন সময় শামসুদ্দিন মাওয়ালানা সাহেব সামনে আগাইয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তোমার নাম আরজান ফকির?
— ফকির হাসিয়া বলিল ‘হয় বাজান! বাপ মা এই নামই রাইখাছিল।
মাওলানা সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মিঞা! তুমি মাথায় লম্বা চুল রাখিয়াছ কেন?
— আমি তো রাখি নাই বাজান! আল্লাহ্ রাইখাছেন!
আল্লাহর উপর ত তোমার বড় ভক্তি দেখতে পাই! আল্লাহ্ কি তোমাকে লম্বা চুল রাখিতে বলেছেন?
— বাজান! লম্বাও বুছি না খাটোও বুঝি না। হে যা দিছে তাই রইছে।
— চুল কাটো নাই কেন?
— বাজান! হে যা দিছে তাই রাখছি। যদি কাটানের কতা ঐত, তয় হে দিল ক্যান?
— আর শুনতে পেলাম, তুমি সারিন্দা বাজিয়ে গান কর। মরাকাঠ, তাই দিয়ে বাদ্য বাজাও।
— কি করবো বাজান? দেহ কাঠ এত বাজাইলাম, কথা কয় না। তাই মরা কাঠ লয়া পড়ছি। এহনও কথা কয় নাই। তবে মদ্দি মদ্দি কথা কইবার চায়।
— তোমার সারিন্দা আমরা ভেঙে ফেলাব।
— কাঠের বাঙবেন বাজান? বুকের মদ্দি যে আর একটা সারিন্দা আছে সেডা ভাঙবেন কেমুন কইরা? হেডা যদি ভাঙতি পারতেন তয় ত বাঁচতাম। বুহির মদ্দি যহন, সুর গুমুইরা ওঠে তখন ঘুম হয় না। খাইতে পারি না। সেইডার কান্দনে থাকপার পারি না বইলা কাঠের সারিন্দা বানায়া কান্দাই। আমার কান্দনের সঙ্গে হেও কান্দে, তাই কিছুক শান্তি পাই।
দেখ ফকির! তোমার ওসব বুজরুকি কথা শুনতে চাইনে। আজ তুমি আমার কাছে তোবা পড় – আর গান গাইতে পারবে না।
— বাজান গান বন্দ করার কল কৌশল যদি আপনার জানা থাহে আমারে শিহায়া দ্যান। বুকের খাঁচার মদ্দি গান আটকায়া রাখপার চাই। খাঁচা খুইলা পাখি উইড়া যায়। মানষির মনে মনে গোরে। কন ত বাজান! এডা আমি কেমন কইরা থামাই?
— ওসব বাজে কথা আমরা শুনতে চাইনে।
— বাজান! জনম কাটাইলাম এই বাজে কথা লয়া। আসল কথা ত কেউ আমারে কইল না। আপনারা যদি জানেন আমারে শিহায়া দ্যান।
— তোমার মতো ভণ্ড কোথাও দেখা যায় না।
— আমিও ত কই বাজান। আমার মত পাপী লোক আর আল্লার আলমে নাই। কিন্তুক এই লোকগুলান তা বুঝবার পারে না। ওরা আমারে টাইনা লয়া বেড়ায়।
— শুনতে পেলাম তোমার নাকি কতকগুলান শিষ্য জুটেছে। তারা তোমার হাত পা টিপে দেয়। মাথায় মালিশ করে। জান এতে কত গুনা হয়? আল্লাহ্ কত বেজার হন?
—কি করবো বাজান? ওগো কত নিষেধ করি। ওরা হোনে না। ওরা আমার ভালোবাসায় পড়েছে। প্রেম নদীতে যে সাঁতার দেয় তার কি ডোবা র ভয় আছে? এর যে কুল নাই বাজান। ভাইবা দেখছি, এই দেহডা ত আমার না। একদিন কবরে রাইখা শূন্য ভরে উড়াল দিতি অবি। তাই দেখলাম, আমার দেহডারে ওরা যদি পুতুল বানায়া খেইলা সুখ পায় টাতে আমি বাদী ঐব ক্যান?
— আচ্ছা ফকির। তুমি হাতে পায়ের নখ কাট না কেন?
— বাজান! একদিন মানুষ হাতের পায়ের নখ দিয়াই কাইজা ফেসাদ করত। তাই নখ রাখতো। তারপর মনের নখের কাইজা আরম্ভ ঐল। কলমের নখের কাইজা আরম্ভ ঐল। তহন আতের পায়ের নখের আর দরকার ঐল না। তাই মানষি নখ কাইটা ফ্যালাইল। আমার যে বাজান বিদ্যা বুদ্ধি নাই। তাই মনের নখ গজাইল না। হেই জন্যি আতের পায়ের নখ রাখছি। মনের নখ যদি থাকতো তয় ডিগ্রি জারীতে ডিগ্রী কইরা কত জমি জমা করতি পারতাম। কত দালান কোঠা গড়াইতাম মনের নখ নাই বইলা দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা কইরা খাই। গাছতলায় পাতার ঘরে বসত করি।
এ পর্যন্ত আরজান ফকির যত কথা বলিল, তার মুখের মৃদু হাসিটি এতটুকুও মলিন হয় নাই। মাওলানা সাহেব যতই কুপিত হইয়া তাহাকে প্রশ্ন করিয়াছেন, সে ততই বিনীত ভাবে তাহার উত্তর করিয়াছে। সভাস্থ সমবেত লোকেরা অতি মনোযোগের সঙ্গে তাহার উত্তর শুনিয়াছে। উকিল সাহেব দেখিলেন বক্তৃতা করিয়া ইতিপূর্বে তিনি সভার সকলের মনে যে ইসলামি জোশ আনয়ন করিয়াছিলেন, আরজান ফকিরের উত্তর শুনিয়া সমবেত লোকেদের মন হইতে তাহার প্রভাব একেবারেই মুছিয়া গিয়াছে। সভার সকল লোকই এখন যেন আরজান ফকিরের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাহারা যখন অতি মনোযোগের সঙ্গে আরজান ফকিরের কথাগুলি শুনিতেছিল উকিল সাহেবের মনে হইতেছিল তাহারা মনে মনে তাহাকে সমর্থন করিতেছে। তিনি ঝানু ব্যক্তি। ভাবিলেন এইভাবে যদি ফকিরকে কথা বলিবার সুযোগ করিয়া দেওয়া হয়, তবে তাহার আহ্বান করা সভা ফকির সাহেবের সভায় পরিণত হইবে।
তাই তিনি হঠাৎ চেয়ার হইতে উঠিয়া বক্তৃতার সুরে বলিতে লাগিলেন, ভাইসব! ভেবেছিলাম আমাকে আর কিছু বলতে হবে না। এই ভণ্ড ফকিরের কথা শুনে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। ইহার কথা আপনাদের কাছে আপাতত মিষ্ট হইতে পারে। ভাইসবেরা একবার খেয়াল করে দেখবেন, শয়তান যখন আপনাদের দাগা দেয় এইরূপ মিষ্টি কথা বলেই আপনাদের বশে আনে। আপনারা আগেই আলেমদের কাছে শুনেছেন, গান গাওয়া হারাম। যে কাঠ কথা বলতে পারে না সেই কাঠের বাদ্য বাজানো হারাম। এই ভণ্ডবেশী ফকির সারিন্দা বাজিয়ে গান করে। এই গান আসমানে সোয়ার হয়ে আল্লার আরশে যেয়ে পৌঁছে আর আল্লার আরশ কুরছি ভেঙে খানখান হয়। বিরাদারানে ইসলাম। এই ফকিরের মিষ্টি কথায় আপনারা ভুলবেন না। আমাদের খলিফা হজরত ওমর (রাঃ)বিচার করতে বসে আপন প্রিয় পুত্রকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন, মুনসুর হাল্লাজকে শরিয়ত বিরোধী কাজের জন্য পারস্যের অপর একজন খলিফা তার অর্ধ অঙ্গ মাটিতে পুঁতে প্রস্থর নিক্ষেপ করে মারার হুকুম দিয়াছিলেন। ভাই সকল! এখন দীন ইসলামী সময় আর নাই। নাছারা ইংরেজ আমাদের বাদশা। এই ফকির যা অপরাধ করেছে তাকে হত্যা করা হাদিসের হুকুম। কিন্তু বিচার আমাদিগকে করতেই হবে। ভাই সাহেবেরা, মনে রাখবেন আপনারা সকলেই আজ কাজির আসনে বসেছেন। খোদার কসম আপনাদের, কাজির মতোই আজ বিচার করবেন। আপনাদের প্রতিনিধি হয়ে মাওলানা সাহেব এই ফকিরের প্রতি কি শাস্তি হতে পারে তা কোরান কেতাব দেখে বয়ান করবেন, আপনারা ইহাতে রাজী?
চারিদিকে রব উঠিল, আমরা রাজী। তখন উকিল সাহেব মাওলানা সাহেবের কানে কানে কি বলিয়া দিলেন। মাওলানা সাহেব কোরান শরীফ হইতে একটা ছুরা পড়িয়া বলিলেন, ‘আল্লার বিচার মত এই ফকিরের মাথার লম্বা চুল কাইটা ফেলতি হবি।আর তায় সারিন্দাটাও ভাইঙ্গা ফেলতি হবি’।
উকিল সাহেবের বক্তৃতা শেষ করিলেন। দুই তিনজন লোক ছুটিল আরজান ফকিরের সারিন্দা আনিতে। এখন সমস্যা হইল কে ফকিরের মাথার চুল কাটিবে। গ্রামের লোক কেহই তাহার চুল কাটিতে রাজী হয় না। কি জানি ফকির কি মন্ত্র দিবে। তাহাদের ক্ষতি হইবে। অবশেষে মাওলানা সাহেব নিজে ফকিরের মাথার চুল কাটিবার জন্য আগাইয়া আসিলেন। এমন সময় সভাস্থ দুএকজন লোক আপত্তি করিয়া উঠিল। একজন বলিয়া উঠিল ‘আমরা জীবন গেলিও ফকিরসাবের মাথার চুল কাটবার দিব না’।
আরজান ফকির মৃদু হাসিয়া বলিল ‘বাজানরা। বেজার আবেন না, মাওলানা সাবের ইচ্ছা ঐচ্ছে আমার মাথার চুল কাটনের। তা কাটুন তিনি। খোদার ইচ্ছাই পূরণ হোক। বাপজানেরা। তোমরা গোসা কইর না। চুল কাটলি আবার চুল ঐব। আল্লার কাম কেউ রদ করতি পারবি না।’
মাওলানা সাহেব কাচি লইয়া আরজান ফকিরের মাথার চুল কাটিতে লাগিলেন। সেই কাচির আঘাত হেন অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের বুকের কোন সুকোমল স্থানটি কাটিয়া কাটিয়া খণ্ডিত করিতেছিল। কিন্তু কোরআন হাদিসের কালাম যার কণ্ঠস্থ সেই মাওলানা সাহেবের কাজে তাহারা কোন বাধাই দিতে সাহস করিল না। যতক্ষন চুলকাটা চলিল, আরজান ফকিরের হাসি মুখখানি একটুকুও বিকৃত হইল না। কি এক অপূর্ব প্রশান্তিতে যেন তারা শুভ্র শুশ্রু ভরা মুখখানি পূর্ণ।
এমন সময় দুই তিনজন আরজান ফকিরের সারিন্দাটি লইয়া আসিল কাঁঠাল কাঠের সারিন্দাটি যেন পূজার প্রতিমার মত ঝকমক করিতেছে। সারিন্দার মাথায় একটি ডানা মেলা পাখি যেন সুরের পাখা মেলিয়া কোন তেপান্তরের আকাশে উড়িয়া যাইবে। সেই পাখির গলায় রঙ বেরঙের পুঁতির মালা। পায়ে পিতলের নুপুর আর নাকে পল্লীবধুদের মত একখানা নখ পরানো। সারিন্দার গায়ের দুই পাশে কতকগুলি গ্রাম্য মেয়ে গান গাহিতে গাহিতে নাচিয়া কোথায় চলিয়াছে।
এই সারিন্দাটি আনিয়া তিন চার জন লোক মাওলানা সাহেবের হাতে দিল। সারিন্দাটির দিকে একবার চাহিয়া দেখিয়া আরজান ফকিরের মুখখানি হঠাৎ যেন কেমন হইয়া গেল। ফকির দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল ‘বাজানরা’। আপনারা যা বিচার করলেন, আমি মাথা পাইত্যা নিলাম। কিন্তু এই মরা কাঠের সারিন্দা আপনাগো কাছে কোন অপরাধ করে নাই। এর উপরে শাস্তি দিয়া আপনাগো কি লাভ? আমার মাথার চুল কাটলেন। এত লোকের মদ্দি আমায় বাল-মন্দ গাইলেন। আরও যদি কোন শাস্তি দিবার টাও দ্যান। কিন্তু আমার সারিন্দাটারে রেহাই দ্যান।’
মাওলানা সাহেব বলিলেন ‘মিঞা। ও সকল ভণ্ডামির কথা আমরা কেউ শুনবো না। কোরান কেতাব মত আমাকে কাজ করতি হবি। তোমার ওই সারিন্দা আমি ভাইঙ্গা ফ্যলাব।’
ফকির আরও বিনীতভাবে বলিল, বাজান! আমার এই বোবা সারিন্দাডারে ভাইঙ্গা আপনাগো কি লাভ ঐব? আমার বাপের আতের এই সারিন্দা। মউত কালে আমারে ডাইকা কইল, দেখরে আরজান! টাকা পয়সা তোর জন্যি রাইখা যাইতি পারলাম না। আমার জিন্দিগির কামাই এই সারিন্দাডারে তরে দিয়া গেলাম। এইডারে যদি বাজাইতি পারিস তোর বাতের দুঃখ ঐব না। হেই বাপ কতকাল মইরা গ্যাছে। তারির আতের এই সারিন্দাডারে বাজায়া বাজায়া দুঃখীর গান গাই। পেরতামে কি সারিন্দা আমার সঙ্গে কতা কইত? রাইত কাবার কইরা দিতাম, কিন্তুক সারিন্দা উত্তর করত না। বাজাইতি বাজাইতি তারপর যহন অল দরল তহন সারিন্দার সাথে আমার দুঃখীর কতা কইতি লাগলাম। আমার মতন যারা দুঃখিত তারা বাজনা শুইনা আমার সঙ্গে কানত। মাওলানাসাহেব! আমার এই সারিন্দাডারে আপনারা ভাঙবেন না। কত সভায় গান গাইয়া কত মানষির তারিফ বয়া আঞ্ছি গিরামে এই সারিন্দা বাজায়া।
হেবার রসূলপুরির সাথে মামুদপুরির লড়াই। দুই পক্ষে হাজার হাজার লাইঠাল। কতজনের বউ যে সিঙ্গার সিন্দুর আরাইত, কতজনের মা যে পুত্র শোগী ঐত সেই কাইজায়। কি করব, দুই দলের মদ্দিখানে জায়া সারিন্দায় সুর দিলাম। দুই দলের মানুষ হাতের লাঠি মাটিতে পাইতা সারিন্দার গান শুনতি লাগল।মাওলানা সাহেব! আমারে যে শাস্তি দিবার দ্যান, কিন্তুক আমার সারিন্দাডারে বাঙবেন না। এই কথা বলিয়া আরজান ফকির গামছা দিয়া চোখের জল মুছিল।
চারিদিকে লোকজনের মধ্যে থমথমা ভাব। আরজান ফকিরের সারিন্দার কাহিনী ত সকলেরই জানা। তাহারা মনে মনে ভাবিতে লাগিল এখানে এমন কিছু ঘটিয়া যাক যাহাতে ফকিরের সারিন্দাটি রক্ষা পাইতে পারে। কিন্তু কেহই সাহস করিয়া কোন কথা বলিতে পারিল না।
উকিল সাহেব দেখিলেন, আরজান ফকির এই কথাগুলি বলিয়া সভার মন তাহার দিকে ফিরাইয়া লইতেছে। তিনি মাওলানা সাহেবকে, বলিলেন “আপনি আলেম মানুষ, নায়েব নবী কোরান কেতাব দেখে বিচার করেন। এই ভণ্ড ফকিরকে এসব আবলতাবল বলবার কেন অবসর দিচ্ছেন?”
মাওলানা সাহেব তখন হাঁটুর সঙ্গে ধরিয়া সারিন্দাটি ভাঙিবার চেষ্টা করিলেন। সারি কাঁঠাল গাছের সারিন্দা। সহজে কি ভাঙিতে চাহে? সমবেত লোকেরা এক নিঃশ্বাসে চাহিয়া আছে। কাহার আদরের ছেলেটিকে যেন কোন ডাকাত আঘাতের পর আঘাত করিয়া খুন করিতেছে। কিন্তু ইসলামের আদেশ কোরান কেতাবের আদেশ। নায়েব নবী মাওলানা সাহেব স্বয়ং সেই আদেশ পালন করিতেছেন। ইহার উপর তো কোন কথা বলা যায় না।(পৃঃ১৬৫-১৭০)
৫
ক্ষিতিমোহন সেন, ‘বাংলার বাউল’- এ উল্লেখ করেছেন মুসলমান সমাজের সাধক বাউলের উপর অত্যাচারের কথা।
এনামুল হক, ‘বঙ্গে সুফি প্রভাব’ গবেষণা গ্রন্থে বাউল ফকিরদের উপর নিপীড়নের, তাঁদের সংখ্যা হ্রাসের কথা বলেছেন।
মৌলানা আকরাম খাঁ, ‘মোসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাসে’ বাউল ফকিরদের ইসলামের ঘরের শত্রু বলে উপস্থাপনা করেছেন।
শক্তিনাথ ঝা জানিয়েছেন মুসলমান সমাজে বাউল-ফকিরদের উপর অত্যাচার একটি ধারাবাহিক ঘটনা। আমরা অসংখ্য নথি এবং সাহিত্যে এর উল্লেখ পাব। তবে এটাও আমাদের উল্লেখ করা প্রয়োজন মুসলমান সমাজে সংখ্যালঘু এই বাউল-ফকিরেরা দরিদ্র এবং ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থান করেন, সে কারণে তাঁদের উপর হওয়া সামাজিক অত্যাচারের কথা নিয়ে অনেক সময়েই প্রশাসনের কাছে যান না। বরং তাঁরা গুরুর কাছে প্রার্থনা করেন। এ কারণে সমাজের নিম্নবর্গে এই ঘটনাগুলোকে কেউ কেউ তুচ্ছ বা অপ্রধান মনে করেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে এই বাউলফকির গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবিচ্ছিন্ন প্রচার চালায়। এখনো এই সমাজে নিজেদের হিন্দু মুসলমান পরিচয় না দিয়ে ‘মানুষ’ বলেন। বাংলা ভাষায় অসামান্য গান এবং তত্ত্বের প্রবক্তা এই প্রান্তিক মানুষেরা। তাঁদের উপর হওয়া এই ধারাবাহিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সব সময়েই মুখ খুলতে হবে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে যেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতে বাহুবল দেখিয়ে কারোর উপর জোর করে ধর্মমত চাপানো যায় কি না? সংখ্যালঘুদের মসজিদ ভেঙে দেওয়া যায় কিনা? জোর করে গোমাংস খাওয়া বন্ধ করে যাওয়া যায় কি না? এই প্রশ্নগুলির সাথে এই প্রশ্ন তোলা যায় জোর করে বাউল-ফকিরের গান হারাম বলে নিষিদ্ধ করা যায় কিনা? মাজারকে ঈদগাহে পরিণত করা যায় কিনা? একটু ভাবুন, একসাথে ভাবুন সকল প্রকার মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলুন। কারণ মৌলবাদের আঁতুড়ঘর একটাই…সে হিন্দু মৌলবাদ হোক বা মুসলমান।
বিদ্রঃ হুলাসপুরের ঘটনাটির সত্যতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, অনেকে জানাচ্ছেন পুরনো ঘটনা, কেউ বলছেন তিল কে তাল বানানোর প্রচেষ্টা। যাদের মনে সংশয় তাঁরা হুলাসপুরে যান এবং থানাতে দায়ের করা কেস, এবং কোর্ট থেকে ১৪৪ ধারা জারির সময়টা দেখে নিন। মাজারের জমির কাগজপত্র দেখুন যা আশিক ইকবালের কাছে আছে। এবং অঞ্চলে গিয়ে তৃণমূলের বাহুবলী সমেত জবরদখলকারী নেতৃত্বের সাথেও কথা বলে আসুন।
লেখক:লাবনী জঙ্গী সেন্টার ফর সোশ্যাল সাইন্স কলিকাতা–র শিক্ষার্থী ও গবেষক।
ছবি : বাউল-ফকিরদের ছবি তুলেছেন সুমন কুমার সাহা, হুলাসপুরের নতুন ঈদগাহর ছবি তুলেছেন কুণাল চক্রবর্তী।