অযোধ্যা পাহাড়ে জনসভা সেরে কোলকাতায় ফেরার পথে পুলিশি হেনস্থার শিকার হলেন বনাধিকার আইন নিয়ে কর্মরত ছাত্র, শিক্ষক ও সামাজিক কর্মীরা। “এই হেনস্থা দেশব্যাপী বনাঞ্চল এবং বনগ্রামবাসীর উপর সুপরিকল্পিত আক্রমণেরই একটি অংশ,” বললেন আটক হওয়া ছাত্র। “ঠুড়্গা প্রকল্পে আদালতের স্থগিতাদেশ সাময়িক জয়, সামনে কঠিন লড়াই,” বললেন সংহতি মঞ্চের প্রবক্তা। আগামী ২২ তারিখ বিকেল চারটেয় কলেজ স্ট্রিটে জমায়েত ও পথসভার ডাক। গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন।
গত ১৪ই জুলাই পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড়ে ‘ঠুড়্গা প্রকল্প’ নিয়ে জনসভা সেরে কোলকাতায় ফেরার পথে পুলিশি হেনস্থার শিকার হলেন বনাধিকার আইন নিয়ে কর্মরত ছাত্র, শিক্ষক ও সামাজিক কর্মী। ওইদিন সভা শেষে, উপস্থিত বাঘমুণ্ডি থানার পুলিশ অফিসার এবং রাজ্য সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের কর্তারা থানায় নিয়ে যেতে চান আন্দোলনের সংহতিতে কোলকাতা থেকে আসা ছাত্র-শিক্ষকদের। জনবিরোধী, প্রকৃতিবিরোধী প্রকল্পটিকে স্থগিত রাখার সদ্য জারি হওয়া হাইকোর্টের রায়ের ফলে সভাস্থলে সর্বসমক্ষে জোর করতে না পারলেও, এরপর ছাত্র-শিক্ষকরা বাসে করে কোলকাতা ফেরার সময় বাসের পিছনে ধাওয়া করে পুলিশের গাড়ি। মাঝপথে বাস থামিয়ে তাঁদের শনাক্ত করে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ, এবং জোর করে বাস থেকে টেনে নামায়। সকলের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়, এবং জোর করে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আড়ষা থানায়, যেখানে আড়াই ঘণ্টা জেরা করা হয় সকলকে। পুলিশের বড়কর্তার প্রধান ‘অভিযোগ’ – “তোমরা মাওবাদী”। এই ভিত্তিহীন অভিযোগ অস্বীকার করলে পুলিশ তাঁদের শাসায়, “UAPA, সেডিশান কেস দিয়ে দেবো – প্রমাণ, সাক্ষ্য যা দরকার আমরা তৈরি করে নেব।” এরপর রাত সাড়ে ১০টায় ছাত্র এবং শিক্ষকদের থানা থেকে বেরোতে দেয় পুলিশ, পার্সোনাল বন্ডে সই করিয়ে নেওয়ার পর। এর অর্থ, ভবিষ্যতে ওই অঞ্চলে বনাধিকারের প্রশ্নে কোনও “ল এন্ড অর্ডার সিচুএশান” হলে গ্রেফতার করা হতে পারে এঁদের – সে সময়ে এঁরা ওই অঞ্চলে থাকুন বা না থাকুন।
“আজকের ভারতবর্ষে বনাধিকার আইন নিয়ে কাজ করতে যাওয়া মানেই এই ধরনের পুলিশি হেনস্থা, শাসানি, মিথ্যা অভিযোগ এমনকি গ্রেফতার হওয়া – এসব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তরবঙ্গে সেভক-রংপো আন্দোলনেও আমরা একই জিনিস দেখেছি। আমাদের এই হেনস্থা দেশব্যাপী বনাঞ্চল এবং বনগ্রামবাসীর উপর সুপরিকল্পিত আক্রমণের একটি অংশ। অযোধ্যা পাহাড়ের আন্দোলনরত মানুষদের উপর এর থেকে অনেক বেশি পুলিশি অত্যাচার প্রতিনিয়ত চলে,” বললেন সৌরভ – আড়ষা থানায় অবৈধভাবে আটক হওয়া ছাত্রদের মধ্যে একজন।
১৮ই জুলাই (বৃহস্পতিবার) ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভাগৃহে ঠুড়্গা আন্দোলনের সংহতির ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে ডাকা একটি মিটিংয়ে বক্তব্য রাখছিলেন সৌরভ। “প্রশাসন চায় যে কলকাতার লড়াই কলকাতায় চলুক, অযোধ্যা পাহাড়ের আন্দোলন পাহাড়েই সীমিত থাকুক। পুলিশের কর্তা আমাদের স্পষ্ট বলেন, কোর্ট-এর কাজ করছেন করুন, এখানে (আন্দোলনের কেন্দ্রে) আসবেন না,” বললেন সৌরভ।
গত ২ জুলাই ২০১৯, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের ওপর প্রস্তাবিত ঠুড়গা পাম্প স্টোরেজ পাওয়ার প্রজেক্টের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে ঐতিহাসিক রায় দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। গত বছর সেপ্টেম্বরে উচ্চবিচারালয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সত্তরোর্ধ রবি বেসরা, সুশীল মুর্মু, এবং মুনিরাম টুডু – প্রকল্প খারিজ করার দাবীতে। আদালত যদিও প্রকল্পটিকে খারিজ করেনি। খারিজ করেছে প্রকল্পটি স্থাপনে যে প্রক্রিয়াগত অস্বচ্ছতা হয়েছিল সেইগুলিকে। তার ফলেই আপাতত প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকবে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী প্রশাসনকে ‘বনাধিকার আইন ২০০৬’-এর নিরিখে স্বচ্ছ এবং আইনসম্মতভাবে বনগ্রামসভাগুলির সম্মতি নিতে হবে। পার্টি-শাসক-প্রশাসনের তরফ থেকে খুনের হুমকি, মামলার হুমকি, রাতবিরেতে পিটিশনারদের বাড়িতে পার্টির নেতার চড়াও হওয়া, পুলিশি-হয়রানি, আন্দোলনের আর্থিক সাহায্য সংগ্রহে বাধা দেওয়া – এই সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন পাহাড়ে আন্দোলনকারী জনতার গড়ে তোলা ‘প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ’। পাশাপাশি, আন্দোলনের সংহতিতে সমতলে এবং রাজধানী কলকাতা ও শহরতলীতে বিভিন্ন পরিবেশকর্মী, অধিকার আন্দোলন কর্মী, ছাত্রছাত্রী, গবেষক, বিজ্ঞানী সহ সমাজের বিভিন্ন বর্গের মানুষেরা তৈরি করেন ‘আযোধিয়া বুরু বাঁচাও আন্দোলন সংহতি মঞ্চ’। পুলিশি হেনস্থার শিকার সৌরভ প্রকৃতিবাদী, সুমন মণ্ডল-রা এই সংহতি মঞ্চের সদস্য।
বৃহস্পতিবার ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভাগৃহের আলোচনায় দীর্ঘ কথাবার্তা হয় ‘বনাধিকার আইন ২০০৬’ নিয়ে। পরিবেশ ইতিহাসবিদ শান্তনু চক্রবর্তী মনে করিয়ে দেন যে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কোনদিনই সেইভাবে, সামাজিক স্তরে গড়ে ওঠেনি বনাধিকার আইন নিয়ে গণচেতনা। ঠুড়্গার ক্ষেত্রে যেভাবে প্রশাসন গ্রামসভার নামে সাধারণ মানুষকে এতদিন ধোঁকা দিয়েছে, তার থেকেই এটা স্পষ্ট। এক হাজার ছ’শোরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার (২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী) অযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েতে মাত্র ২৪ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি সম্মতিপত্র দাখিল ক’রে সরকার দাবী করে প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ বাসিন্দাদের সম্মতি নেওয়া হয়েছে। জেলায় জেলায় বনগ্রাম এলাকাগুলিতে বছরের পর বছর প্রশাসন থেকে বনগ্রামবাসী মানুষের নামের লিস্ট ঝুলিয়ে প্রশাসন দাবী করে গেছেন, “এই তালিকাভুক্ত মানুষেরা এই এলাকার বাসিন্দা নন। যদি হন, তাহলে স্থানীয় প্রশাসনিক অফিসে এসে প্রমাণ করুন যে আপনি এখানকার বাসিন্দা!” দক্ষিনবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকা হওয়া সত্ত্বেও “FRA-র ছায়া পর্যন্ত পড়তে দেওয়া হয়নি সেখানে,” বললেন শান্তনুবাবু।
সৌরভ নিজের বক্তব্যে মনে করিয়ে দেন যে, FRA শুধুমাত্র আদিবাসীদের বিষয় নয়। জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল যেকোনো মানুষ, জঙ্গলের পার্শ্ববর্তী গ্রাম, জঙ্গলের মধ্যেকার গ্রাম – যাকে ‘বনগ্রাম’ বলা হচ্ছে, Minor Forest Produce-এর উপর নির্ভরশীল বিভিন্ন জনজাতি – বহু ক্ষেত্রেই হয়ত যারা আদিবাসী নন – FRA এঁদের প্রত্যেকের। সুপ্রিম কোর্টের জারি করা সারা দেশব্যাপী ১১ লক্ষ মানুষকে জঙ্গল ও তার আশপাশ থেকে উৎখাত করার বিধ্বংসী রায়ের ফলস্বরূপ এরাজ্যে যে ৮৬০০০ মানুষকে জঙ্গল থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে – তাঁরা শুধু আদিবাসী নন।
সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয় অদূর ভবিষ্যতে পাশ হতে চলা “Indian Forest Act” নিয়ে। ভয়ঙ্কর এই বিলটিকে “জঙ্গলের AFSPA” বলে বর্ণনা করেন সৌরভ। যেভাবে কাশ্মীর এবং উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলিতে Armed Forces Special Powers Act (AFSPA)-কে হাতিয়ার করে ‘আতঙ্কবাদী’ সন্দেহে গুলি করে খুন করতে পারে সামরিক বাহিনী, ঠিক একইভাবে এই নতুন প্রস্তাবিত ‘জঙ্গল আইন’-এর ফলে জঙ্গলে বসবাস করা যেকোনো মানুষকে জঙ্গলে ‘অনুপ্রবেশকারী’ সন্দেহে হত্যা করার ছাড়পত্র পেতে চলেছে বন দপ্তর এবং আধাসামরিক বাহিনী। AFSPA-র মতনই এ ক্ষেত্রেও এই সমস্ত খুনের বিরুদ্ধে কোনরকম তদন্তের বা বিচারব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে না উর্দিধারী খুনি বা তাদের উচ্চতন অফিসারদের। “এই নতুন জঙ্গল আইনের খসড়াটি পড়লে দেখবেন, ‘FRA’ শব্দটি প্রায় শতাধিকবার আছে ওতে। কেন? কারণ, বারবার বলা হচ্ছে, ‘যদিও FRA আইনে অমুক অমুক অধিকার দেওয়া আছে, তবুও নতুন জঙ্গল আইন অনুযায়ী …’। অতএব এই নতুন আইনটি প্রকৃতপক্ষে FRA-কে উল্টে দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া,” বললেন সৌরভ। “এই ধরণের নতুন আইনের মূল উদ্দেশ্য বনগ্রামবাসী মানুষদের থেকে তাঁদের জঙ্গল কেড়ে নিয়ে, বনগ্রামগুলি থেকে তাঁদের উৎখাত করে জঙ্গলকে মুনাফাখোর কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দেওয়া,” বললেন অন্যান্য বিভিন্ন বক্তা। ঠুড়্গা, সেভক-রংপো, নিয়মগিরি, পস্কো – এসব এই বৃহত্তর প্রক্রিয়ারই ল্যাবরেটরি।
কোচবিহার জেলার পরিবেশরক্ষা আন্দোলনের কর্মী তাপস বর্মণ মনে করিয়ে দেন, আইন রাষ্ট্রের। কাজেই রাষ্ট্র তার সুবিধামত আইন তৈরি করবে, এবং পরে সেই আইন রদবদল করবে বা বাতিল করবে, বা নতুন পরস্পরবিরোধী আইন লাগু করবে – এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, এটাই নিয়ম। ভবিষ্যতে যখন FRA আইনই থাকবে না, তখন আদালতে জঙ্গলের অধিকার নিয়ে লড়াই করার রাস্তা এমনিতেই বন্ধ হয়ে পড়বে। “কাজেই রাস্তার লড়াই রাস্তাতেই লড়তে হবে। এ লড়াই শুধু জঙ্গলরক্ষার লড়াই নয়, আজকের সময়ে এ লড়াই পরিবেশ, প্রকৃতি রক্ষার লড়াই – এবং সেই বৃহত্তর লড়াই -এর সাথে আমাদের জুড়তে হবে,” বলেন তাপস।
সভায় বারবার উঠে আসে এবছর পশ্চিমবাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অনাবৃষ্টির প্রসঙ্গ। “মানুষ এবার ভাবতে শুরু করেছেন, জলসঙ্কট নিয়ে, খরা-অনাবৃষ্টি-বন্যা নিয়ে। অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গল এবং সেই জঙ্গলের অভিভাবক হাজার হাজার বনগ্রামবাসীদের অস্তিত্বের লড়াই, তাঁদের মর্যাদার লড়াই – আজ কলকাতার বুকে জলসঙ্কটের লড়াইয়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে” – এই বক্তব্য বার বার ফিরে আসে বক্তাদের কথায়। অথচ যারা এই লড়াই লড়ছেন – সেই সমস্ত বনগ্রামবাসী এবং তাঁদের সংহতিতে কোলকাতা ও শহরতলীর বিভিন্ন অধিকারকর্মী, পরিবেশকর্মী, ছাত্রছাত্রীরা আজ রাষ্ট্রের চোখে ‘আতঙ্কবাদী’, নয়ত ‘মাওবাদী’, নয়ত ‘অনুপ্রবেশকারী’। তাঁদের জন্য আছে সরকারি বন্দুকের গুলি, বা UAPA, সিডিশান, AFSPA, Indian Forest Act-এর মতো মনগড়া আইন, এবং কারাগার।
আগামী ২৪শে জুলাই সুপ্রিম কোর্টে FRA-র “সাংবিধানিক বৈধতা” (পড়ুন ‘FRA-র ভবিষ্যৎ’) নিয়ে দাখিল হওয়া রীট পিটিশান-এর পরবর্তী শুনানি। এই মামলাতেই কিছু মাস আগে কোর্ট হুকুম জারি করেছিলেন ১১ লাখ পরিবারকে জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ করার। তার আগে, ২২শে জুলাই, ভারতবর্ষের বনাঞ্চল এবং তার অস্তিত্বরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থার উপর দেশের শাসকশ্রেণী এবং বিচারব্যবস্থার এই যৌথ আক্রমনের বিরুদ্ধে, ঠুড়্গার আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বে কোলকাতায় একটি জমায়েতের ডাক দিয়েছেন ‘আযোধিয়া বুরু বাঁচাও আন্দোলন সংহতি মঞ্চ’।
২২ তারিখ বিকেল চারটেয় কলেজ স্ট্রিট মোহিনী মোহন কাঞ্জিলালের সামনে এই জমায়েত ও পথসভায় লিফলেট বিলি করে শহরবাসীকে ঠুড়্গা আন্দোলনের হালহকিকত জানানো হবে, এবং প্রতিরোধ করা হবে দেশের লক্ষ লক্ষ বনগ্রামবাসীর আসন্ন উচ্ছেদের বিরুদ্ধে।
if the Jeiko company of Japan has permission to built in Ayodia, how a citizens of India, of WB can be marked as ‘outsider’? aca be illegally detained or threatened for saving the national forests?