নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে জুনিয়র ডাক্তারদের উপর বহিরাগত দুস্কৃতিদের হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠা আন্দোলন আমাদের সবাইকেই ভাবাচ্ছে। গত কয়েকদিনে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার দাবিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের জেরে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবাই ভেঙ্গে পড়তে বসেছে। একদিকে সরকারের শাসক সুলভ ঔদ্ধত্য অন্যদিকে স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনের একমুখীনতা, এই দুই-এর বাইরে দাঁড়িয়ে, দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা দেশের গণস্বাস্থ্য আন্দোলনে থাকা নানাবিধ প্রশ্ন, রাজনৈতিক অভিমুখগুলি এই আন্দোলনে একেবারেই অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছে। সে প্রশ্নগুলিই তুললেন সৌমিত্র ঘোষ।
ভোটশেষের পর বাংলা জুড়ে খবরের কাগজ, টিভি, সোস্যাল মিডিয়া, যেখানে চোখ রাখা যাক, হিংসা, রক্তপাত, ধুন্ধুমার। যেহেতু এই অপরূপ সময়কালে এসব মানেই তৃণমূল বিজেপি, এবং একটি বিশেষ সম্প্রদায় ও বাঙালি হিন্দু (অবাঙালি হিন্দু একটি ভিন্ন সম্প্রদায় বটে), আমরা সবাই মন দিয়ে স্মার্টফোনে রাজনীতিচর্চা করছি। এই সময় নীলরতন সরকার হাসপাতালে শুরু হয়ে, ডাক্তারদের আন্দোলন ছড়াচ্ছে রাজ্যের সর্বত্র, রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের অন্য শহরগুলোয়। ‘বাজারি’ মিডিয়া ও ‘সহি’ মিডিয়া (যথা ফেসবুক) মন দিয়ে দেখেশুনে যা বোঝা গেলো, আন্দোলনরত ডাক্তারেরা ন্যায় ও নিরাপত্তা চাইছেন।যেহেতু এ রাজ্যে যা ঘটে তা রাজনৈতিক দলের চৌহদ্দির বাইরে ঘটে না, এই ঘটনাও দলীয় রাজনীতির চেনা ছকের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এবং যেহেতু এ রাজ্যে এখন দলীয় রাজনীতি মানেই তৃণমূল বিজেপি এবং সমাসন্ন বিধানসভা ভোট, ডাক্তারদের আন্দোলনটাও কার্যত সেই ভোটরাজনীতির হাঁ-মুখ গর্তে ঢুকছে, এমন মনে হচ্ছে। যত দিন গড়াচ্ছে, আন্দোলন জোরদার হচ্ছে, একদা পরিবর্তনকামী সুশীল সমাজ মাঠে নেমে পড়েছেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে কী পরিমাণ মূর্খ অশিক্ষিত খারাপ অত্যাচারী ও মহিলা, সে চীৎকারে তামাম সুবা ফেসবুক ট্যুইটার আলোড়িত, উই ওয়ন্ট জাস্টিসের রণহুঙ্কারে টিভিবাক্স কাঁপছে।
এ সব সময়ে পক্ষ নিতে হয়। না নিলে কিছু বলা যায় না। বললেই ধরে নেওয়া হবে মতলবি কুচক্রান্ত, হয় আপনি এপক্ষের নয় অন্য পক্ষের। ডাক্তারদের যে আন্দোলনের কথা বলছি, দেখাই যাচ্ছে যে সেখানে একটা খুব স্পষ্ট এপক্ষ-ওপক্ষ আছে। একদিকে ডাক্তারেরা, যাঁরা ন্যায় নিরাপত্তা চাইছেন। অন্যদিকে রাজ্য সরকার, অর্থাৎ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ডাক্তারেরা বলছেন রাজ্য জুড়ে তাঁরা বিপন্ন, সরকারি হাসপাতালে তাঁদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নেই, রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী সেই নিরাপত্তা দিতে শুধু যে অক্ষম তাইই নয়, সরকার মানে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং সে নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছেন। অন্য পক্ষে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে চিৎকাররত, তাঁর মোদ্দা মতে আন্দোলনরত ডাক্তারেরা ‘বহিরাগত’ ও বিজেপি-সিপিএমের চর-অনুচর, রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত করে তাঁকে ও তাঁর সরকারকে প্যাঁচে ফেলতে চাইছেন। দুপক্ষই এতো সরব, অনমনীয় ও আত্মমুখর, অন্যদিকে আন্দোলন এত তীব্র, এ সময়ে, যা চলছে তার বাইরে অন্য কিছু বলার সুযোগ থাকে না, ভাববার অবকাশও নয়। তাও চেষ্টা করি। পক্ষ-বিপক্ষের চেনা দ্বিত্বের বাইরে গিয়ে বর্তমান আন্দোলনটি কিছু ভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রশ্নগুলো পুরানো, চেনা, কিন্তু মীমাংসিত নয়। সেগুলোই আবার করা যাক।
আশির দশকের ডাক্তারি আন্দোলন ও স্বাস্থ্যের রাজনীতি
এই ডাক্তারি আন্দোলনটি দেখে আমার মতো অনেকেরই আর একটি আন্দোলনের কথা মনে পড়ছে। সেই আন্দোলনও জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন, সেখানেও পক্ষ-বিপক্ষ ছিল, অন্য চেহারায়, কিন্তু ছিল। আন্দোলন দীর্ঘকাল গড়ায়, সরকারি নিপীড়নও চলে (তখন এই খারাপ মুখ্যমন্ত্রী নন, রাজ্যে সংগ্রামের হাতিয়ার বামফ্রন্ট সরকার), সময়ের নিয়মে অবস্থান ধর্ণা ছেড়ে ডাক্তারেরা আবার কাজে ফেরেন। কিন্তু আন্দোলন চলাকালীন ও আন্দোলন পরবর্তী সময়ে কিছু সেসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন রাজনৈতিক প্রশ্ন উঠে আসে। এক, স্বাস্থ্যের রাজনীতির প্রশ্ন। আশির দশকের প্রথম দিক, সেসময় এ দেশের কোথাওই বেসরকারি চিকিৎসার সেরকম প্রচলন ছিলো না, নার্সিং হোম ও বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা হাতেগোনা। তা সত্ত্বেও, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামগ্রিক পরিসরে কী করে বড় পুঁজি ছোটো পুঁজি ঢুকছে, কী করেই বা এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের একদা কল্যাণকামী ভূমিকা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, ডাক্তারি আন্দোলনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সচেতন ও দীর্ঘ প্রচার চালানো হয়। বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিরা কেন একই ওষুধের দশরকম নাম ও দাম রাখে, কেন সস্তার ওষুধ অনেক গুণ বেশি দামে বাজারে বিক্রি হয়, এই সব দরকারি প্রশ্ন আন্দোলনকারীরা তোলেন, মানুষকে সেসব নিয়ে বোঝান। ওষুধের জেনেরিক নাম রাখতে হবে, এই দাবী ওঠে। সমস্ত ডাক্তারদের পেশাগত বর্গপরিচয় দিয়ে চিহ্নিত না করে, সেই আন্দোলন দেখায়, কি করে ডাক্তারেরা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা ওষুধকোম্পানীদের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, কী করে ওষুধকোম্পানীর মুনাফার অংশ ডাক্তারদের কাছে পৌঁছচ্ছে, কী করেই বা স্বাস্থ্যপরীক্ষার নামে একের পর এক বেসরকারি ক্লিনিক খোলা হচ্ছে স্রেফ মুনাফার জন্য, সেই সব ক্লিনিকে রোগী পাঠানোর জিম্মা নিচ্ছেন ডাক্তারেরাই। অর্থাৎ স্বাস্থ্য আপাদমস্তক একটা ব্যবসা হয়ে উঠছে, যেখানে পুঁজি লগ্নি হয়, বাড়ে। চিকিৎসা নয়, সমাজসেবাও নয়, পরিষেবাও নয়, যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে তার মূল চালিকাশক্তি পুঁজি।
আশির দশকের পর থেকে দীর্ঘ কয়েকযুগ অতিক্রান্ত, স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে পুঁজির আওতাধীন, থাকবেও অনন্তকাল, এটা আর দশটা বাজার সত্যকে যেমন, আমরা প্রায় সবাই প্রশ্নহীন ভাবে মেনে নিয়েছি। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা মেলে না, ওষুধ থাকে না, স্বাস্থ্যপরীক্ষা ব্যবস্থা ও রোগনির্ণয়ের ব্যবস্থা থাকে না, এমনকি চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীরাও থাকেন না, এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ নেই, যে পারে সে দাম দিয়ে চিকিৎসা কেনে, কেননা না কিনে উপায় নেই। ডাক্তারের কাজ এই পুঁজিবাজারে ঠিক কী সে প্রশ্নও তোলা বাতুলতা, ডাক্তারেরা এই বাজারের সঙ্গে যুক্ত, আছেন, থাকবেন, এটাও একরকম গ্রাহ্য হয়ে গেছে। সুতরাং ডাক্তারেরা নার্সিং হোম হাসপাতাল খুলে ব্যবসা ও লাভ করবেন, ওষুধকোম্পানী ও বিভিন্ন কিসিমের ক্লিনিক থেকে কমিশন মানে লাভের বখরা নেবেন, এটাও গ্রাহ্য, অর্থাৎ এতে অন্যায়ের কিছু নেই। আজকের এই আন্দোলনে যে ডাক্তারেরা যুক্ত, তাঁরা ন্যায় চাইছেন। ন্যায় বলতে তাঁরা ঠিক কী বোঝেন জানতে পারলে ভালো হয়। এ রাজ্যে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে যাঁরা উচ্চশিক্ষা লাভ করেন, তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে চার বছর সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে হয়। বাধ্যতামূলক না হলে তাঁরা কজন সরকারি কাজে যেতেন? স্বেচ্ছায়, ভালোবেসে? রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এই বাধ্যতামূলক কাজের প্রচলন করাটাকে কজন ডাক্তার ন্যায় মনে করেন? পুঁজির হাতে স্বাস্থ্য ব্যাপারটাকে ছেড়ে না দিয়ে সেখানে রাষ্ট্রের উদ্যোগ বাড়ানোর চেষ্টা করলে বা চিকিৎসাব্যবসায় যথেচ্ছ লাভ করার কলে সরকারি কাঠি পড়লে ঠিক কজন ডাক্তার সেটাকে ন্যায় বলে ভাববেন? ঠিক কজন ডাক্তার রাজি হবেন ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতে?
উই ওয়ন্ট জাস্টিস!
কিন্তু জাস্টিস শব্দটির পিছনে সামাজিক কল্যাণ ও অ-ন্যায়ের বিরোধিতার একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সে নিরিখে দেখলে ডাক্তারদের লাভের পিছনে দৌড়োনোর বর্তমান পরম্পরাটি ন্যায় নয়, ঘোরতর অন্যায়। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে অর্থ ডাক্তারপিছু ব্যয় হয়, তা মুখ্যমন্ত্রীর অর্থ নয়, জনগণের টাকা বা পাবলিক মানি। সেই টাকা কেন ডাক্তারদের পিছনে খরচা হবে? যখন পয়সা দিয়ে চিকিৎসা কেনা দস্তুর ও চিকিৎসকদের যে কোনো উপায়ে লাভ করাটা অন্যায় নয়, হবু ডাক্তারেরা কেন তাঁদের চিকিৎসা শিক্ষাটা বাজার থেকে মূল্য ধরে দিয়ে খরিদ করবেন না? এ সব প্রশ্ন কিলবিল করতে থাকে, তাদের নির্বংশ করা যায় না।
যে ডাক্তারেরা বর্তমান আন্দোলন করছেন, মিডিয়ায় বাইট দিচ্ছেন, যাঁরা তাদের সমর্থনে ফেসবুকে নিরন্তর আস্তাকুঁড়ের ভাষায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে গাল পারছেন, তাঁদের প্রতি আবেদন, এই আন্দোলন কে তাৎক্ষণিক ও চটকদারি ইভেন্টে পর্যবসিত না করে, একটু তলিয়ে ভাবা যায় কি? সরকারি হাসপাতালে এখন শুধু তাঁরাই যান যাঁদের চিকিৎসা কেনার ক্ষমতা নেই। হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে, ইমারজেন্সি চালু না রেখে, হাসপাতাল চত্বরে হাততালি ও স্লোগান সহযোগে মিছিল করে আপনারা ঠিক কার বিরুদ্ধে, কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করছেন? সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে রুগীর পরিবারের লোকজন ভাঙচুর করছে, ডাক্তারদের ধরে মারছে, এসব সমর্থনযোগ্য নয়, কোন অবস্থাতেই নয়। কিন্তু, এটাও কি ভাবতে হবে না, সরকারি হাসপাতালের এই হাল হবার পিছনে ডাক্তারদের ভূমিকা ঠিক কী? যে অর্থে আন্দোলনরত ডাক্তারেরা নিজেদের একটি বর্গ বা শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত করছেন, ডাক্তার বলতে আমরা এখানে সেই পরিচয়টিকেই ধরে নিচ্ছি। পুঁজি-অধিকৃত এই স্বাস্থ্যবাজারেও কিছু মানুষ তাঁদের সাধ্যমতো সরকারি হাসপাতালে কি তার বাইরে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীউদ্যোগে চিকিৎসার কাজটাই মন দিয়ে করেন, অনেক অসংখ্য বাধা সত্ত্বেও করেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো বলা নয়। কিন্তু সাধারণভাবে, সরকারি হাসপাতালে সব চিকিৎসকরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন কি? যে সময় ওয়ার্ডে চৌকি দেবার কথা, সে সময় নার্সিং হোমে কি নিজের চেম্বারে গিয়ে নিজের নিজের লাভ করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন না তো? ওপিডিতে রুগী পৌঁছলে তাকে নার্সিং হোম কিম্বা চেম্বারে আসতে বলেন না তো? সকাল-সন্ধ্যা ওষুধ কোম্পানি ও অন্য বহুবিধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে পঞ্চাশ রকম লাভ ও সুবিধার হিসাব কষেন না তো? সরকারি বাদ দিন, বেসরকারি হাসপাতালে যখন রুগীর স্বাস্থ্য, শরীর এমনকি মৃত শরীর নিয়ে কুৎসিত বানিয়াগিরি চলে, আপনাদের পবিত্র ন্যায়পরায়ণতা একই ভাবে সক্রিয় থাকে কি? মানুষের জীবনমৃত্যু স্বাস্থ্য যে পুঁজিবৃদ্ধির ময়দান হয়ে উঠতে পারে না, যা চলছে তার বিরোধিতা না করে যে ন্যায় অন্যায় নিয়ে কথা বলার নৈতিক অধিকার জন্মায় না, সে বিষয়ে আপনারা সচেতন তো?
নিরাপত্তা? কার নিরাপত্তা? কিভাবে?
বর্তমান আন্দোলনের অন্যতম দাবী, ডাক্তারদের নিরাপত্তা। নিরাপত্তা বলতে তাঁরা বুঝছেন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সশস্ত্র পুলিশ পাহারা, দিবারাত্র। আন্দোলনশুরুর দিনে, নীলরতন সরকারে জুনিয়র ডাক্তারদের ওপর হামলার পরে, একটি আবেদনপত্র সোশ্যাল মিডিয়া ও ই-মেইল-এ প্রচারিত হতে থাকে, যাঁর মুখ্য দাবী ছিলো, এই হামলায় অভিযুক্তদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে দেখতে হবে। এই আবেদনপত্রটি প্রথম প্রচার করতে শুরু করেন একজন চিকিৎসক। চিঠিটি আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে লেখা, যাতে তিনি এই অভিযুক্তদের সন্ত্রাসবাদীদের মতো সাজা দেন। এসব দেখে ভয় হয়। ডাক্তারেরা কি ধরেই নিচ্ছেন তাহলে রুগী হয়ে যে সব হতদরিদ্র মানুষেরা সরকারি হাসপাতালে যান, তাঁরা এবং তাঁদের আত্মীয় পরিজনেরা সবাই অপরাধী দুবৃত্ত সন্ত্রাসবাদী, যে কোন মুহূর্তে তাঁরা আক্রমণ চালাতে পারেন, যাঁদের হাত থেকে বাঁচতে গেলে রাষ্ট্রের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই? চিকিৎসক-রুগীর সম্পর্ককে কি এখন থেকে রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার চশমা দিয়ে দেখতে হবে? চিকিৎসকেরা তো এই সেদিন পর্যন্ত মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করতেন, পারিবারিক বন্ধু হয়ে উঠতেন, রুগীর কাছে শুধু নয়, সমাজের কাছে তাঁদের একটি বিশিষ্ট মর্যাদা, সন্মান, ভালোবাসা ছিল? যাঁরা এখন আন্দোলন করছেন, যাঁরা সমর্থন করছেন, তাঁরা একবার ভাববেন না যে কেন অবস্থাটা বদলে গেলো এভাবে, কেন পুলিশি নিরাপত্তা না থাকলে তাঁরা যে আর চিকিৎসা করতে পারবেনই না, এই অবস্থা তৈরি হলো?
আসলে বিষয়টা বোধহয় ডাক্তারদের নিরাপত্তার নয়। ডাক্তারদের পেশাক্ষেত্রে নিরাপত্তা দরকার কি দরকার নয়, প্রশ্নটা সেটাও নয়। এটা ভাবা দরকার যে ডাক্তারেরা নিছক পেশাজীবী নন, তাঁদের পেশাক্ষেত্র বলতে শুধু হাসপাতাল কি চেম্বারের চৌহদ্দিমাত্র নয়, তা গোটা সমাজ। রুগীরা যদি ডাক্তারদের নিছক পেশাজীবী হিসেবে দেখতে শুরু করেন, যদি তাঁদের মনে হতে থাকে নিজের, নিজের প্রিয়জনের জীবনের ভার ভরসা করে ডাক্তারদের হাতে আর তুলে দেওয়া যায় না, ডাক্তারেরা মূলত মুনাফাবাজ বিবেকহীন বানিয়া, সমাজের গভীরে প্রোথিত এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তাঁদেরও তাড়া করে বেড়ায়, ডাক্তারেরা নিরাপদ থাকতে পারেন না। হাজার পুলিশ থাকলেও না। চিকিৎসক-রুগীর সামাজিক সম্পর্ক বদলে গেছে, যাচ্ছে প্রতিদিন। তার কারণ সমস্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার, চিকিৎসা ব্যবস্থার সার্বিক বাজারিকরণ, সামাজিক সম্পর্কের জায়গায় লাভ লোকসানের পুঁজিসম্পর্ক ঢুকে পড়া। এই পুঁজিসম্পর্ককে মেনে নিয়ে, তার অংশ হয়ে, ন্যায়ের ও নিরাপত্তার দাবিতে কোন সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে? ওঠা সম্ভব?
ডাক্তারদের আন্দোলন : স্থিতাবস্থার পক্ষে না বিপক্ষে?
ফলত, আমরা যা দেখছি শুনছি এখন, খুব ভীতিপ্রদ। সামাজিক সম্পর্ক দুরস্থান, চিকিৎসা-রুগীর সম্পর্ক বিষয়ে এই আন্দোলন যে বার্তা দিচ্ছে, তার সঙ্গে মোদি সরকার ও সংঘ পরিবারের ‘অন্য’ তৈরি করা, অর্থাৎ আদারিং-এর রাজনৈতিক প্রকল্পের কোন পার্থক্য থাকছে না। সরকারি হাসপাতালে কাজের অবস্থা নেই, নিরাপত্তা নেই, মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধত ও দাম্ভিক, এগুলো বলে কিন্তু স্বাস্থ্যের রাজনীতির মূল প্রশ্ন নিয়ে কোন কথা না বলে এই আন্দোলন কার্যত স্থিতাবস্থাকে শক্তিশালী করছে। স্বাস্থ্যের প্রশ্নে সেই স্থিতাবস্থা বাজারের স্থিতাবস্থা, অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার হাল আরো খারাপ হতে থাকবে, অন্যদিকে রমরমা হবে পুঁজিমালিকদের, যাদের মধ্যে অনেক ডাক্তারেরাও থাকবেন। এই রাজ্যের রাজনীতির প্রশ্নে, সেই স্থিতাবস্থা বিজেপির ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রকল্পকে নিয়ামক জায়গায় পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকবে, তার সঙ্গে জুড়ে যাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ, গরীব নিম্নবর্গীয় রুগীদের ওপর উচ্চবর্গীয় মধ্যবিত্ত ও পেশাজীবীদের ঘৃণা।
১৯৮৪-র ঐতিহাসিক ডাক্তার আন্দোলন থেকে স্থাস্থ্যের, বিশেষত গণস্বাস্থ্যের আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যার সবটা এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি। সেই আন্দোলন চাইছিলো পুঁজির শাসন থেকে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বার করে আনতে। সবার জন্য সমমানের চিকিৎসার দাবি উঠেছিলো। বলা হয়েছিলো চিকিৎসাকে অর্থাৎ মানুষের জীবনকে পণ্য করে তোলা যাবে না। তখন আন্দোলন থেকে ন্যায় ও নিরাপত্তার দাবিও উঠেছিল, কিন্তু হায় এখনকার আন্দোলন তার রাজনৈতিক সামাজিক অন্তর্বস্তুতে সে আন্দোলন থেকে যোজন যোজন দূর।
লেখক সৌমিত্র ঘোষ সামাজিক ও পরিবেশ আন্দোলন-এর কর্মী।