একনায়কতন্ত্রের পথে আরও এক ধাপ এগোলেন মমতা


  • May 14, 2018
  • (0 Comments)
  • 4244 Views

একনায়কতন্ত্রের পথে আরও এক ধাপ এগোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চায়েত ভোটে লাগামহীন সন্ত্রাস। বেসরকারি মতে মৃত ১৮।

দেবাশিস আইচ

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন। আস্থা হারিয়েছেন গণতন্ত্রে। এই অবিশ্বাস, অনাস্থা, অশ্রদ্ধার পথেই একনায়কতন্ত্রের জন্ম হয়। এই কটি বাক্য লিখেই মনে হল তিনি কি কখনও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন? ইতিহাস বলছে, মানুষ অন্তত বিশ্বাস করেছিল তিনি গণতন্ত্রের রক্ষাকারী হয়ে উঠবেন। বামফ্রন্ট আমলের দাম্ভিক, একচ্ছত্র ক্ষমতার দমবন্ধ পরিবেশের পরিবর্তন ঘটিয়ে মুক্ত হাওয়া বইয়ে দেবেন। এই বিশ্বাস ও আস্থা তাঁকে ও তাঁর দলকে ক্ষমতায় এনেছিল। সাত বছরে প্রমাণিত ‘মা-মাটি-মানুষ’ নয়, ক্ষমতা, শুধুমাত্র একক নিরঙ্কুশ ক্ষমতাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। লাগাতার প্রতিবাদের রাজনীতি যাঁকে অবিসংবাদী বিরোধী নেত্রীর সম্মান এনে দিয়েছিল। ক্ষমতায় এসেই তিনি সমস্ত বিরোধিতা, সমস্ত সমালোচনা স্তব্ধ করে দিতেই সচেষ্ট হয়ে উঠেছেন। দল ও মন্ত্রিসভাতে একই সঙ্গে তিনি ‘একমেবাদ্বিতীয়ম ও শেষ কথা’। পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটিতেও তিনি ‘শেষ কথা’ই হয়ে ওঠার সাধনায় মত্ত। এমন অভিযোগ উঠলে তা এককথায় উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই।

বিলকান্দা পঞ্চায়েত পার্ট নং ২১৫ – ক্যান্ডিডেট রাজু বিশ্বাস

এই মদমত্ত ক্ষমতাই দাম্ভিক উচ্চারণে ‘বিরোধী শূন্য’ পঞ্চায়েতের ডাক দিতে পারে। মনোনয়ন পর্বে প্রবল সমালোচনার মুখে পালটা হুমকির স্বরে বলতে পারে ‘একশো শতাংশ’ আসনে জয়ী হওয়ার কথা। স্বাভাবিক ভাবেই সর্বময়ী নেত্রীর ‘অনুপ্রেরণা’য় দলীয় অপরাধী বাহিনী রাজ্য জুড়ে সমস্ত বল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছে তার অন্যতম কারণই তো ‘অনুগত’ পুলিশ-প্রশাসনের কাঁধে কাঁধ মেলানো প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। ফলাফল, ৩৪ শতাংশ আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দলের জয়লাভ। যা, ১৯৭৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সমস্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে, মোট বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর চেয়ে বেশি। একটি সংবাদসংস্থার হিসেব মতো, ২০১৮ সালে মনোনয়ন ও প্রচারপর্বে মৃত ১৯, নির্বাচনের দিন রাত নটা পর্যন্ত মৃত ১৮। দুই পর্বেই আহত অসংখ্য। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি ভাবে অবশ্য সন্ধ্যা পর্যন্ত ছজনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ পুরকায়স্থ রাজ্যবাসীকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন, অন্যান বছরের চেয়ে এ-বছর হিংসার ঘটনার সংখ্যা কম। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম-এর কর্মী-সমর্থক, সাধারণ ভোটারও।

এই নির্বাচন পর্বে সন্ত্রাসের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভাঙ্গরের কথাই ধরা যাক। কেন না বিগত প্রায় দু’বছর ধরে সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও তৃণমূলি সন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়ে ‘জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি’ তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। দলীয় জোর ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে যারা শাসক দলের তুলনায় নিতান্তই হীনবল। অথচ তাদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, তারাই সে অভিযোগ আদালতে মিথ্যা প্রমাণ করে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়াইয়ে নামে। স্বাভাবিক আইনি পথে তাদের প্রতিনিধিরা মনোনয়ন পত্র জমা দিতে পারেনি। হাইকোর্টের রায়ের পরও নয়। শেষ পর্যন্ত হোয়াটসএপে মনোনয়ন পাঠালে হাইকোর্ট তাকে মান্যতা দেয়। অথচ ভোটের দিন দেখা গেল ‘তাজা নেতা’ আরিবুল ইসলামের বিরুদ্ধে পঞ্চায়েত সমিতির আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অপরাধে কমিটির প্রার্থী সরিফুল ইসলামকে অপহরণ করে প্রচণ্ড মারধর করার অভিযোগ উঠল আরাবুলের দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। একই রকম অপরাধে, আরিবুল পুত্র হাকিমুল ইসলামের বিরুদ্ধে পঞ্চায়েত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায়, মহ: এন্তাজুল খানকেও তুলে নিয়ে গিয়ে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে। দুজনেই গুরুতর আহত। নির্বাচনের দুদিন আগেই এক কমিটি সমর্থককে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় আরিবুলকে। কমিটির নেতা শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর অভিযোগ, “বারুইপুরের পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিংহের গাড়িতে বসে এলাকায় ভোট পরিচালনা করতে দেখা গেছে আরিবুলকে। এবং ছাপ্পা ভোটের নেতৃত্ব দিয়েছে কাশীপুর থানার অফিসার- ইন-চার্জ।”

ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে এক একজন ভোটারকে তিন স্তরে তিনটি ব্যালটে ভোট দিতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই ভোট পর্ব মিটতে দীর্ঘ সময় লাগে। সংবাদসংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী শত শত বুথে দুপুরের মধ্যেই ভোটদান পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছে। সংবাদসংস্থা আরও জানাচ্ছে, কোচবিহার জেলার দিনহাটায় ৭০-৭৫ শতাংশ বুথ সকাল থেকেই দখল হয়ে যায়। ব্যালট বক্স, ব্যালট পেপার, প্রয়োজনীয় নথি এমনকি ব্যক্তিগত সামগ্রী ফেলে পালিয়ে যান বহু বুথের ভোটকর্মীরা। অবাধে ছাপ্পা ভোট, ব্যালট বাক্স লুঠ, ব্যালট পেপারে আগুন দেওয়া, বুথ ভাঙচুর, পুলিশ ও সাংবাদিকদের মারধর, গাড়ি-বাইক জ্বালিয়ে দেওয়া, ভাঙার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। মূল অভিযোগ অবশ্য শাসক দলের বিরুদ্ধেই। অন্তর্দলীয় সংঘর্ষ এবং বিরোধী দলের হিংসার বলি হয়েছে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরাও।

রাজনৈতিক ও নির্বাচনী হিংসা এ রাজ্যের ট্র‍্যাডিশন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের জন্য হিংসার আশ্রয় নিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল ব্যতিক্রম নয়। তিনি আর গণতন্ত্রের মসিহা নন। কোনও স্বচ্ছ, দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন উপহার তিনি দিতে পারেননি। তাঁর দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যত আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, এ রাজ্যে আর কোনও দলের বিরুদ্ধে তা ঘটেনি। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ তুলে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত, মসনদে বসে তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে সেই একই ‘অপরাধ’ করে চলেছেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনে লাগামহীন সন্ত্রাসের কারণ হিসেবে, পঞ্চায়েতে বিপুল পরিমাণ অর্থের যোগানকে অনেকেই দায়ী করেন। সেটি একটি কারণ হতে পারে কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। একচ্ছত্র ক্ষমতার উদগ্র লোভ, গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাহীনতা, আদর্শহীন রাজনীতিও বড় কারণ। রাজনৈতিক দলগুলি চায় না গ্রামের সর্বনিম্ন স্তরে স্বশাসনের আদর্শ প্রসারিত হোক। গ্রামের মানুষ বুঝে নিক গ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনা। শাসক-বিরোধী দুপক্ষই ভাগ নিক, দায় নিক। পঞ্চায়েতি রাজের সে স্বপ্নের ক্ষয় আশির দশকের শেষ থেকেই শুরু হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সে কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছে। পঞ্চায়েতি-রাজ আজ আক্ষরিক অর্থেই আমলা-রাজ। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন একনায়কতন্ত্রের পথে মমতার এক বৃহৎ উল্লম্ফন বলা যেতে পারে।

কথায় আছে শিয়ালকে ভাঙা বেড়া দেখাতে নেই। গণতন্ত্রের এই ভাঙা বেড়া দিয়ে আরও এক চরম বিপজ্জনক ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটবে না তা কেই-বা হলফ করে বলতে পারে। হ্যাঁ, বিজেপি’র কথাই বলছি। এ রাজ্যে ইতিমধ্যেই যে সঙ্ঘ পরিবার রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছে।

দেবাশিস আইচ সাংবাদিক ও সমাজকর্মী, বর্তমানে গ্রাউন্ডজিরোর হয়ে সাংবাদিকতা করছেন।
Share this
Leave a Comment