পরিবেশ-বন্ধু পাটের বিষয়ে গণকনভেনশন


  • April 7, 2019
  • (0 Comments)
  • 2221 Views

 

শ্রমিক-কৃষক সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে পাটের রক্ষা ও বিকাশের সম্পর্কে সচেতনতা জাগানো এবং পাটকে ঘিরে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত ৬ এপ্রিল, কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরি হলে, এক গণকনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সেই গণকনভেনশন বিষয়ে গ্রাউন্ডজিরোর প্রতিবেদন।

 

বাংলার সম্ভাবনাময় সোনালি ফসল পাটকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা বড় একটা হয়না। অথচ যুগ-যুগান্ত ধরে পাট বিশেষত বাঙালি জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ছিল। গরিব মানুষের আচ্ছাদন, আবরণ, জ্বালানি সহ হরেক রকম কাজে বড় ভরসা ছিল পাট। আধুনিক যুগে এসে যখন পাটকলগুলি মাথা তুলে দাঁড়াল, তখন তো চাষ ও শিল্প মিলিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্ন জুগিয়েছে পাট। এখনও, সংগঠিত শিল্পগুলির মধ্যে পাট-ই সবচেয়ে শ্রমনিবিড় শিল্প।

 

আজকের দিনে পাট আবার নতুন আশা-ভরসার ক্ষেত্র হয়ে ফিরে আসতে পারে আমাদের জীবনে। কারণ, পাটের মত সর্বতো পরিবেশ-বন্ধু প্রাকৃতিক তন্তু খুব বেশি নেই। আজকের দূষণ-বিধ্বস্ত দুনিয়ায় একদিকে বাতাসকে বিশুদ্ধ রেখে, মাটিকে উর্বর করে পাট যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে, অন্যদিকে তেমন প্লাস্টিকের উপযুক্ত বিকল্প হিসেবে অন্ততপক্ষে খাদ্যের ক্ষেত্রে পাট আমাদের রক্ষা করতে পারে প্লাস্টিকের বিষাক্ত হামলা থেকে। পাট দিয়ে তৈরি কাঠ ও কাগজের ব্যবহারের প্রসার দেশ তথা পৃথিবীর বৃক্ষ ও বনসম্পদকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম। এছাড়াও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অসাধারণ প্রাকৃতিক বৈশিষ্টে ভরপুর এই পাটের কত যে বিচিত্র ব্যবহারের রাস্তা খুলে যাচ্ছে, তারও সীমাসংখ্যা নেই। অবস্থাটা এমন যে, পাটের যাবতীয় সম্ভাবনাকে ঠিকমত বিকশিত করতে পারলে পাটের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের যে অভূতপূর্ব প্রসার ঘটবে, তাতে কৃষক ও শ্রমিক ছাড়াও অন্তত এই রাজ্যের হাজার হাজার কর্মপ্রার্থীর কর্মসংস্থানের কোন সমস্যা থাকবে না। বস্তুত, বাংলার অর্থনীতির মরা গাঙে জোয়ার এনে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই পাট।

 

অথচ, পাটের কথা উঠলেই সাধারণ মানুষের মনে একটা হতাশার অনুভূতি জাগে। দীর্ঘদিনের প্রচারে এমন একটা ধারণা জনমানসে গেড়ে বসেছে যে, প্লাস্টিকের এই যুগে পাটের ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। আজ পাটের কৃষি এবং শিল্প — দুইয়েরই যে বেহাল দশা, তাতে ধারণাটা সত্যি বলেই মনে হয়। মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি-প্রযুক্তি-পদ্ধতিতে পাটের চাষ এবং শিল্প চলে এক মধ্যযুগীয় আবহাওয়ায়। কি কৃষিতে, কি শিল্পে, চলছে ফড়ে-ফাটকাবাজদের রমরমা। বেশির ভাগ মিলে কোন বৈধ মালিকই নেই। শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি-বোনাস-ডিএ-পিএফ-পেনসন-গ্র্যাচুইটি সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে দেদার লুটতরাজ করে সরে পড়াটা এখন এদের নিয়মে দাঁড়িয়েছে। সরকার সব জেনেও উদাসীন, নিষ্ক্রিয়। এই ভয়ঙ্কর নৈরাজ্যের মধ্যে পাট টিকবে কিভাবে, সেটাই প্রশ্ন। আর সেখানে পাটের সম্ভাবনা, তার বিকাশ নিয়ে ভাবনাচিন্তার তো প্রশ্নই ওঠেনা।

 

এই পরিস্থিতিতে পাটের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নির্মাণ করবে কে? বড় পুঁজির মালিকদের কথা মনে হতে পারে। কিন্তু তারা অনেক আগেই পাট থেকে শুধু সরে গেছে তাই নয়, তাদের বরং বেশি উৎসাহ পাটের নিজস্ব বাজারটুকুও প্লাস্টিক দিয়ে দখল করায়, কারণ তাতেই তাদের লাভ বেশি।

 

পাটের কথা তাই ভাবতে হবে তাদের, পাটের জন্য এগিয়ে আসতে হবে তাদের, যাদের পাটকে দরকার। পাটের বিকাশের সঙ্গে যাদের ভবিষ্যত জড়িয়ে আছে। অর্থাৎ, বাংলার অগণিত সাধারণ মানুষকে। বস্তুত, পাটকে নতুন জীবন দিতে আজ যে উদ্যোগ, যে বিনিয়োগ দরকার, তা আসতে হবে সমাজের কাছ থেকে। চাই সামাজিক উদ্যোগ, চাই সামাজিক বিনিয়োগ। এক প্রবল গণ উদ্যোগ, গণ আন্দোলন চাই, যা চলতি বহুজাতিক পুঁজি-নির্ভর উন্নয়নের বিপরীতে তৈরি করবে মানুষের নিজস্ব প্রয়োজনের জায়গা থেকে উঠে আসা গণমুখী উন্নয়নের ধারা। আর এই কাজে আজ পাট এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসাবে উঠে আসছে তার ঐতিহাসিক ও সামাজিক বাস্তবতা থেকে।

 

তবে এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন শ্রমিক-কৃষক সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে পাটের রক্ষা ও বিকাশের সম্পর্কে সচেতনতা জাগানো। এখন প্রধানত দরকার পাট নিয়ে প্রচারমূলক আন্দোলন। এই ভাবনার জায়গা থেকে ইতিমধ্যেই ছোট ছোট কিছু উদ্যোগ গড়ে উঠছে এদিক-ওদিক। এমনই একটি ছোট উদ্যোগ ‘পাটচাষ, জুটশিল্প ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন প্রস্তুতি কমিটি’ ৬ এপ্রিল এক কনভেনশনের ডাক দিয়েছিল কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরি হলে। কনভেনশনের চর্চার বিষয় ছিল পাটের রক্ষা ও বিকাশের সপক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কাছে ১৪ দফা দাবি–সম্বলিত একটি গণ-দাবি সনদ। পাশাপাশি, পাটকে ঘিরে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার উপযোগী প্রাথমিক একটি সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাবও এই কনভেনশনের আলোচ্য ছিল।

 

ডাঃ সন্মথ নাথ ঘোষের সভাপতিত্বে এবং প্রফুল্ল চক্রবর্তীর সঞ্চালনায় কনভেনশনে তুষার চক্রবর্তী, বিশ্বজিত মুখার্জি, ভূপেন সরকার, কার্তিক ব্যানার্জি, রতন ব্যানার্জি, দিলীপ বসাক, আমিন মন্ডল, নব দত্ত প্রমুখ আজকের অবস্থায় পাটের সপক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে সাধারণ মানুষের একজোট হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বিষয়টি তুলে ধরেন। গণ-দাবি সনদের বিষয়ে জনমত তৈরি করার লক্ষ্যে দাবি সনদে রাজ্য জুড়ে গণ স্বাক্ষর সংগ্রহ করার প্রস্তাবও কনভেনশনে অনুমোদন পায়।

 

Share this
Leave a Comment