রাফাল: দুর্নীতির সহজ পাঠ (প্রথম ভাগ)


  • March 29, 2019
  • (0 Comments)
  • 3170 Views

সময়টা ২০১৪সামনে লোকসভা নির্বাচন এবং দেশ জুড়ে কর্পোরেটদের আর্থিক সহায়তায় ব্র্যাণ্ড মোদীর আগ্রাসী প্রচার। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেনসেই মোদীময় ভারতবর্ষে ভাবী প্রধানমন্ত্রীর একটা বচন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল – “না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা অভূতপূর্ব নির্বাচনী সাফল্য নিয়ে নরেন্দ্র মোদী গদিতে আসীন হলেন তারপর প্রায় পাঁচটা বছর অতিক্রান্ত। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি যথা নিয়মে গঙ্গা ও নর্মদার জলে ভেসে গেছে। আর সততার ধ্বজাধারীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠছে রাজা তোর কাপড় কোথায়? প্রত্যেক দিন নতুন নতুন তথ্যের আগমনে জমে উঠেছে রাফাল দুর্নীতির প্রশ্ন সেই দুর্নীতির গল্প লিখেছেন সুমন কল্যাণ মৌলিকএটি গল্পের প্রথম ভাগ।

 

 

রাফাল বিতর্কের সূচনা ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে, যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর ফ্রান্স সফরের সময় দীর্ঘ আট বছরের আলোচনা প্রক্রিয়াকে বাতিল করে ৩৬ টি রাফাল বিমান (Ready to fly) কেনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। কর্পোরেট মিডিয়া দু হাত তুলে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও দু একটা বিরোধী কন্ঠ তখনই শোনা গিয়েছিল। তবে দুর্নীতির অভি্যোগ জোরালো হতে শুরু করে যখন প্রথমবার “জনতা কা রিপোর্টার” (নভেম্বর ১৪,২০১৭) রাফাল চুক্তির অসংগতি নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট করলে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা শুরু হয়। এরপর Wire ওয়েবসাইটে বিভিন্ন রিপোর্ট বেরোতে থাকে। শুরু হয় সরকার ও বিরোধীপক্ষের তরজা। ঘটনা গতি পায় যখন ১১ ই সেপ্টেম্বর (২০১৮) পূর্বতন এন ডি এ সরকারের মন্ত্রী অরুণ শৌরি, যশবন্ত সিনহা এবং আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ সাংবাদিক সম্মেলন করে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভি্যোগ করেন। তাঁরা পরে সি বি আই প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জি জানিয়ে আদালতের দারস্থ হন। সি বি আই প্রধানকে আকস্মিক ছুটিতে পাঠানোয় তরজা আরো বৃদ্ধি পায়। সরকার যদিও নানান ভাবে অভি্যোগগুলি অস্বীকার করছে কিন্তু মিডিয়াতে নতুন নতুন খবর ও তথ্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মোদি সরকারের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে।

 

 

প্রয়োজনীয় পূর্বকথা

 

ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োজনের তুলনায় বিমানের সংখ্যা কম – এ আলোচনা নতুন নয়। ২০০০ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত সংসদীয় দল তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করে যে খুব দ্রুত বিমানবাহিনীর ৪০ শতাংশ বিমান অকার্যকরী হয়ে যাবে। ১৯৯৬ সালে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির পরিণামে কিছু সুখোই বিমান পাওয়া যাবে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এই সংকটের কারণ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাশিয়ান মিগ বিমানগুলির জীবনচক্র ফুরিয়ে আসা এবং দেশীয় কৃৎকৌশলে তৈরী ‘তেজস’ বিমান এখনও সম্পূর্ণ না হওয়া। এই সময় বায়ুসেনা কর্তৃপক্ষ প্রথমবার জানায় তাদের ১২৬ টি বিমান (৬ স্কোয়্যাড্রন ) দরকার। এ সময় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কিছু বেসরকারি সংস্থাকে স্বাগত জানানো হয়, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়, সর্বোপরি দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচতে সমরাস্ত্র কেনার পদ্ধতিকে ত্রুটিমুক্ত করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করা হয়। এই নীতির নাম ‘Defence Procurement Procedure-2002’। তখন ক্ষমতাসীন অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার কারগিল যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া বিমানগুলির পরিবর্তে ফরাসি সংস্থা দাসাউ নির্মিত ১০ টি ‘মিরাজ-২০০০’ কেনার অনুমতি দিলেও বাকিগুলির জন্য সরকার নির্ধারিত টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করে।

 

২০০৪ সালে কংগ্রেস সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হবার পর বিমান কেনার প্রক্রিয়াটি গতি পায়। আগ্রহী বিমান নির্মাতাদের কাছ থেকে দরপত্র আহবান করা হয়, আনুমানিক অর্ডার মূল্য স্থির হয় ৪২,০০০ কোটি টাকা। টাকার বিচারে এটাই ছিল ভারতের প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত সবচেয়ে বড়ো অর্ডার। ২০০৫ সালে ডিফেন্স প্রকিউরমেন্ট প্রসিডিওরে একটা নতুন ধারা যুক্ত করা হয়, যাতে পরিষ্কার ভাবে বলা হয় যে বিদেশি সংস্থা বরাত পাবে তাদের অর্ডারের একটা অংশ ভারতের বিনিয়োগ করে সেখানে উৎপাদন করতে হবে (একে বলে অফসেট ক্লজ)। দরপত্রের প্রথম দিকে দাসাউ তাদের পরিচিত ব্র্যাণ্ড ‘মিরাজ-২০০০’ বিমানকে নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিল। কিন্তু দরপত্র প্রক্রিয়াটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে ফরাসি সংস্থাটি জানায় যে তারা মিরাজের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে, তার পরিবর্তে নতুন বিমান নিয়ে তারা দরপত্র জমা দেবে। আমলাতান্ত্রিক লালফিতের ফাঁস বা সিদ্ধান্তহীনতা – কারণ যাই হোক না কেন, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ২০০৭ সালের প্রথম থেকেই বায়ুসেনা কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে চাপ দিতে থাকে। ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকার দরপত্র আহবান করে। মন্ত্রকের পক্ষ থেকে পরিষ্কার ভাবে জানানো হয় যে সংস্থা নির্বাচিত হবে তাদের অর্ডার মূল্যের অর্ধেক ভারতে পুনর্বিনিয়োগ করতে হবে এবং একই সঙ্গে করতে হবে প্রযুক্তি হস্তান্তর। প্রযুক্তি হস্তান্তর জরুরি কারণ ভারতের লক্ষ্য আগামীদিনে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বনির্ভরশীল হওয়া। দরপত্রে বলা হয়েছিল প্রথম ১৮ টা বিমান আনা হবে সরাসরি বিদেশ থেকে (Fly away) এবং বাকি ১০৮ টা হস্তান্তরিত প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরী হবে। এক বিদেশি প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ লেখান – ‘The most elaborate and detailed RFP in the history of aviation business’.

 

ছ’টি সংস্থা আবেদন জমা দেয় – মিগ-৩৫(আর এ সি মিগ/রাশিয়া), জে এ এস-৩৯ গ্রিপেন (সাব/সুইডেন),রাফাল(দাসাউ/ফ্রান্স), এফ-১৬ ফ্যালকন (লকহিড মার্টিন/মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), এফ এ -১৮ সুপার হর্নেট (বোয়িং/মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং ইউরোফাইটার টাইফুন (ব্রিটিশ,জার্মান,স্প্যানিশ ও ইতালির কনসর্টিয়াম)। রাজস্থানের মরুভূমিক ও লাদাখের তুষার মালভূমিতে বিমানগুলিকে পরীক্ষা করার পর রাফাল ও ইউরো ফাইটারকে চূড়ান্ত তালিকায় নির্বাচিত করা হয় এবং নির্মাতা সংস্থাটিকে বলা হয় তাদের চূড়ান্ত আর্থিক শর্ত জমা দেওয়ার জন্য। ২০১২ সালের প্রথম দিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে দাসাউ এর দরপত্র চূড়ান্ত বিবেচিত হয়েছে। সত্যি কথা হল দাসাউ-এর এই অর্ডার লাভ শুধু সংস্থা নয়, ফ্রান্সের অর্থনীতিতে নতুন জীবনীশক্তির সঞ্চার করে। মিরাজের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া আর তারপর প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দাসাউ-এর একমাত্র বাজি ছিল রাফাল। কোম্পানির আশা ছিল বিমানের জন্য বিদেশ থেকে তারা অনেক বরাত পাবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। দক্ষিণ কোরিয়া,মরক্কো ও ব্রাজিল রাফালকে প্রত্যাখান করে। তাই যে কোনও ভাবে ভারতেই এই বরাত পেতে দাসাউ মরিয়া হয়ে ওঠে।

 

যদিও নাম চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও দাসাউকে বরাতটা দেওয়া যায়নি। কারণ তেলেগু দশম পার্টির একজন সাংসদ ও বিজেপির যশবন্ত সিনহা কিছু প্রশ্ন তোলেন নির্বাচনের পদ্ধতি ও দরপত্রের শর্ত নিয়ে। বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, ফলে প্রক্রিয়াটি আরো দীর্ঘায়িত হয়। এই পর্বে অফসেট ক্লজ নিয়েও আলোচনা জারি থাকে। যেহেতু মিরাজের ক্ষেত্রে দাসাউ ও সরকারি সংস্থা হিন্দুস্তান অ্যারোনেটিকস লিমিটেড (হ্যাল) যৌথভাবে কাজ করেছিল, তাই রাফালের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই হ্যালের নাম আলোচনাতে উঠে আসে। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে এন ডি টি ভি প্রথম জানায় যে রাফাল তৈরির ক্ষেত্রে দাসাউ ও হ্যালের মধ্যে একটি ‘Work-share agreement” সাক্ষরিত হয়েছে। ২০১৫ সালের ১১ মার্চ, দাসাউ এর শেয়ারহোল্ডারদের বার্ষিক সভায় কোম্পানি ডিরেক্টর এরিক ট্র্যানিয়া ঘোষণা করেন কোম্পানি হ্যালের সঙ্গে যৌথভাবে ভারতের মাটিতে ১০৮ টি রাফাল বিমান তৈরী করবে। তবে তাঁর আগেই ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতাসীন ইউ পি এ সরকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে দাসাউ এর সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত, কিন্তু বরাত দেওয়া হবে নতুন আর্থিক বর্ষে। ইতিমধ্যে লোকসভা নির্বাচন চলে আসে এবং নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতাসীন হন “সততার ধ্বজাধারী” নরেন্দ্র মোদী।

 

পূর্বকথাটি থেকে এটা স্পষ্ট যে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতাসীন হবার আগেই রাফাল চুক্তির শর্ত, দাম, অফসেট পার্টনার চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। এক সময়সাধ্য ও শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চুক্তিটি চূড়ান্ত রূপ পায়। কিন্তু কেন গোটা প্রক্রিয়াটি বাতিল করে নতুন ভাবে ৩৬ টা রাফাল (Ready to fly) অর্ডার দেওয়া হল সেটা নিয়েই যত গোল। দুর্নীতির অভিযোগ ঠিক এখান থেকেই উঠছে।

 

রাফাল কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদে। সুত্রঃ https://www.dnaindia.com/india/report-it-was-mandatory-for-dassault-to-sign-reliance-as-partner-for-rafale-deal-report-2673972

 

নরেন্দ্র মোদীর ফ্রান্স সফর নাটকীয় পরিবর্তন

 

“স্বপ্নো কি সওদাগর” নরেন্দ্র মোদী বিদেশযাত্রার ব্যাপারে যে রেকর্ড করেছেন তা ইতিমধ্যে আলোচিত। একই সঙ্গে এটাও দেখা গেছে যে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যেক বিদেশযাত্রায় বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা (বিশেষ করে আদানি ও আম্বানি গোষ্ঠী) একাধিক নতুন প্রকল্পের চুক্তি সম্পাদন করেছে বিদেশের সংস্থাগুলির সঙ্গে। তবে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে যখন মোদি ফ্রান্স গেলেন তখন স্বাভাবিক ভাবে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাফাল চুক্তি। সবাই আশা করেছিল দশ বছর ধরে চলে আসা প্রক্রিয়াটি এবার পরিণতি লাভ করবে। তখনও পর্যন্ত চলমান প্রক্রিয়াটি যে জীবন্ত ছিল তাঁর প্রমাণ হিসেবে দুটি উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। প্রথমত ৮ই এপ্রিল (২০১৫) তৎকালীন বিদেশ সচিব ডঃ এস জয়শংকর সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে ফরাসি সংস্থা (দাসাউ), ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ও হ্যালের মধ্যে আলোচনা চলছে। এর সঙ্গে দুই শীর্ষনেতার বৈঠককে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। দ্বিতীয়ত মোদী ও ফরাসি রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া ওলান্দের বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা আগে ওলান্দ ‘Le Figaro’ (দাসাউ গোষ্ঠীড় মালিকানাধীন সংবাদপত্র) কে বলেন আলোচনা প্রক্রিয়া জারি আছে। হঠাৎ করে কোনো ঘোষণা আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ করবে না, তবে আমাদের পক্ষ থেকে কথাবার্তা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। উল্লেখিত উদাহরণ দুটি থেকে জানা যায় যে তখনও পর্যন্ত আলাদা করে ৩৬ টা রাফাল বিমান ক্রয় করার কোন গল্প ছিল না।

 

কিন্তু সেইদিন বিকেলেই ঘটনাপ্রবাহের নাটকীয় পট পরিবর্তন ঘটে। শীর্ষ বৈঠকের পর নরেন্দ্র মোদী সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে দুই সরকারের মধ্যে সরাসরি আলাপ আলোচনার পর আমরা ৩৬ টি ওড়ার জন্য প্রস্তুত (Ready to fly) রাফাল বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি …, বিমান অস্ত্র ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ আগে যে টেস্ট হয়েছিল ও বায়ুসেনা কর্তৃপক্ষ যে মান নির্ধারণ করেছিল সেই মোতাবেক হবে … মেইনটেন্যান্সের গ্যারান্টি দেবে ফ্রান্স।

 

এই ঘোষণা শুধু যে আকস্মিক ছিল তাই নয়, এই চুক্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যালের যে কোনো ভূমিকা থাকছে না তা পরিষ্কার হয়ে যায়, যদিও অনিল আম্বানির সংস্থার নাম সেই মূহুর্তে সামনে আসেনি। কিন্তু সবচেয়ে হাস্যকর ছিল তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পরিকরের ভূমিকা। প্রধানমন্ত্রী যখন ফ্রান্সে বসে এই ঘোষণা করছেন তখন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোয়ায় একটি ভ্রাম্যমাণ মৎস্য বিক্রয় কেন্দ্রের উদ্বোধন করছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নে দৃশ্যত নাকাল পরিকর বলে দেন এটা সম্পূর্ণভাবে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। আই বি এন চ্যানেলে (১৩ই এপ্রিল, ২০১৫) পরিকর এটাও বলেন যে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের কথা জানান। সেই পরিকর ২০১৬ র সেপ্টেম্বরে ফরাসি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ৩৬টি রাফাল কেনার চূড়ান্ত চুক্তিপত্রে সাক্ষর করেন। জানানো হয় যে ২০১৯ থেকে ২০২২ এর মধ্যে বিমানগুলো ভারতে সরবরাহ করা হবে। একই সঙ্গে এটাও জানা যায় যে গত দশ বছর ধরে ১২৬ টা রাফাল বিমান কেনার ব্যাপারে যে প্রক্রিয়া চলছিল তা বাতিল। সে সময় ৩৬ টি বিমানের দাম মোটামুটি ৫৯,০০০ কোটি টাকা হবে (৮.৭ মিলিয়ন ডলার) এমন খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণার পর থেকে ধীরে ধীরে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ উঠতে থাকে, যা বর্তমান বিশাল আকার ধারণ করেছে।

 

মোদী ও আনিল আম্বানি। সুত্রঃ https://indianexpress.com/article/india/pm-modi-behaving-like-chowkidaar-of-anil-ambani-rahul-gandhi-on-fresh-rafale-revelations-5397176/

 

দুর্নীতির অভিযোগসবিস্তার বিচার

 

রাফাল বিমান ক্রয় সংক্রান্ত অসংগতি ও দুর্নীতির যে বহুমাত্রিক অভিযোগ উঠেছে সেগুলি অনেকটা এরকম –

১) প্রথম বিষয়টি হল ১২৬ টি বিমান ক্রয় করার জন্য দশ বছর ধরে যে আলোচনা চলছিল তা রাতারাতি বাতিল করে মাত্র ৩৬ টা বিমান কেনার জন্য একতরফা সিদ্ধান্ত কোন প্রেক্ষাপটে নরেন্দ্র মোদী নিলেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী পদাধিকার বলে ক্যাবিনেটের প্রধান, তবুও কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনও রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিরক্ষার মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্রে একতরফা ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি শুধু প্রতিরক্ষামন্ত্রীর গুরুত্বকে খাটো করেননি, একই সঙ্গে “ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন কাউন্দিল” (DAC) কে গুরুত্বহীন করে তুললেন। বিশিষ্ট আইনজীবী ও এই বিতর্কে অন্যতম অভিযোগকারী প্রশান্ত ভূষণের মতে বায়ুসেনা কর্তৃপক্ষকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী , জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা বায়ুসেনা প্রধান একক ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এটা বেআইনি।

 

সরকার পক্ষ থেকে এ অভিযোগের জবাবে বলা হয়েছে যে জরুরি ভিত্তিতে এই বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, না হলে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হত। এখন কথা হল যে বায়ুসেনা কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে ১২৬ টি বিমান ক্রয়ের দাবি জানাচ্ছিল। এ অবস্থায় ৩৬ টি বিমান কিনলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে – এটা কার সিদ্ধান্ত? বরং এতে বায়ুসেনা কর্তৃপক্ষের চাহিদা পূরণের দাবিটি আরো বিলম্বিত হবে। কারণ ৩৬ টি বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো ১২৬ টি বিমানের চুক্তিটা বাতিল করা হয়েছে। তাই শতাধিক বিমান নতুন করে ক্রয় করতে হলে পুনরায় সরকারকে গ্লোবাল টেন্ডার করতে হবে। আবার কমপক্ষে ৫-৬ বছর লাগবে, ফলে বিমান বাহিনীর স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন আরো দূরগামী হবে।

 

একই সঙ্গে ওয়াকিবহাল মহল এ প্রশ্নও তুলছে যে, জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হলে মোদীর ঘোষণার আগে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে বিষয়টি নিয়ে কী ধরণের আলোচনা হয়েছিল? সেইসব আলোচনার বিবরণী কোথায়? এই প্রশ্নের সামনে মোদী সরকার কতখানি অসহায় তাঁর প্রমাণ মিলছে সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া সরকারি হলফনামায়। সেখানে বলা হয়েছে ২০১৫ সালের মে মাসে ইন্ডিয়ান “নেগোশিয়েটিং টিম” গঠন করা হয়। ১১ মাস ধরে ফ্রান্সের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা হয়। ফরাসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মোট ২৬ টি মিটিং হয়। যা চূড়ান্ত হয় ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে। এই হলফনামাতেই মোদী সরকারের ঝোলা থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে নরেন্দ্র মোদী ফ্রান্সের ৩৬ টি রাফাল কেনার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ছিলেন, আর তাঁর পরের মাস থেকে শুরু হল বিমান কেনার আলোচনা! ঘটনা পরম্পরা সঠিক ভাবে প্রমাণ করছে যে কোনো আলোচনা ব্যতিরেকে নরেন্দ্র মোদী এককভাবে বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ও পরে মুখ বাঁচাতে নেগোশিয়েটিং টিমের নাটক সাজানো হয়েছে।

 

২) রাফাল বিতর্কে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন হল বিমানের দাম কত? এক্ষেত্রে সরকারের বক্তব্যের মধ্যে কোন ধারাবাহিকতা নেই। তবে সবচেয়ে দৃষ্টিকটু হল গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে দাম সংক্রান্ত আলোচনাকে বন্ধ করার চেষ্টা। রাফালের কৃৎকৌশল নিয়ে আলোচনা সুরক্ষার স্বার্থে গোপন রাখা যেতেই পারে কিন্তু দাম নিয়ে এত লুকোচুরি কেন? দাম সংক্রান্ত অভিযোগ প্রথমে করেন রাহুল গান্ধী। তাঁর বক্তব্য ছিল ১২৬ টি রাফালের দাম ইউ পি এ সরকারের সময় স্থির হয়েছিল ১০.২ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু মোদী সেই চুক্তি বাতিল করে নতুন যে চুক্তি করেছেন তাতে মাত্র ৩৬ টা বিমানের জন্য দাম স্থির হয়েছে ৮.৭ বিলিয়ন ডলার। আগের বার যেখানে বিমান পিছু দাম ছিল ৭০০-৭৫০ কোটি টাকা যেখানে এবার দাম দাঁড়াচ্ছে বিমানপ্রতি ১৬৬০ কোটি টাকা। কোন জাদুবলে বিমান প্রতি দাম ৯০০ কোটি টাকা বেড়ে গেল তাঁর জবাব অবশ্যই সরকার বাহাদুরকে দিতে হবে। কারণ বিমান কেনার টাকার জোগান আমআদমির পকেট থেকেই যাবে।

 

দামের ব্যাপারে ধারাবাহিকতার না থাকার কারণ মোদী সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম দাম বলা হচ্ছে। ২০১৬ র নভেম্বর মাসে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পরিকর লোকসভায় বলেছিলেন একটি বিমানের দাম হবে ৬৫০-৭৫০ কোটি টাকা। ২০১৮ র মার্চ মাসে প্রতিরক্ষা দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সুভাষ ভামরে জানান যে একটি রাফাল বিমানের দাম হবে ৬৭০ কোটি টাকা। কিন্তু দাসাউ তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে যে হিসাব দিয়েছে তাতে বিমানের দাম দাঁড়াচ্ছে ১৫০০-১৬০০ কোটি টাকা। সরকার এই অসংগতির ক্ষেত্রে যে যুক্তি হাজির করছে তা একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে। সরকারের মতে বিমানের মূল দাম ৭০০ কোটি টাকার মধ্যেই কিন্তু তাঁর মধ্যে ভারতীয় পরিবেশের জন্য দরকারি প্রযুক্তি (India specific changes) যুক্ত করার জন্য এবং মেন্টেনেন্স খরচ যুক্ত করার জন্য খরচ বেড়ে গেছে। এটা নেহাৎই ছেলেভুলানো যুক্তি। কারণ নরেন্দ্র মোদি তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে পরিষ্কার ভাবে বলেছিলেন যে “বিমান, অস্ত্র ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ আগে যে টেস্ট হয়েছিল ও বায়ুসেনা কর্তৃপক্ষ যে মান নির্ধারণ করেছিল সেই মোতাবেক হবে … মেন্টেনেন্স গ্যারান্টি দেবে ফ্রান্স।“ তাহলে নতুন করে ভারত-নির্ভর প্রযুক্তির কথা উঠছে কী করে? এছাড়া ২০০৭ সালের দরপত্রে বলা ছিল বিমানের খরচের মধ্যে আছে – initial purchase+transfer of technology+licensed production+life time maintenance support for the aircraft।

 

প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কার্যকর্মের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত এক আধিকারিকের মতে ওড়ার জন্য প্রস্তুত (Ready to fly) বিমান কেনার খরচ কম হওয়া উচিত কারণ সেক্ষেত্রে প্রযুক্তির হস্তান্তরজনিত ফি দিতে হয় না, আর যে দেশে পাঠানো হচ্ছে তাদের কোন দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগ থাকে না। ৩৬ টি বিমান কেনার ক্ষেত্রে যেহেতু প্রযুক্তি হস্তান্তরের শর্ত নেই তাতে তো বিমানের দাম কম হওয়ার কথা।

 

বিমানের দাম নিয়ে সংশয় আরো বেড়েছে কারণ বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানিয়েছেন যে আগের চুক্তির তুলনায় নাকি ৩০ শতাংশ দাম কম হয়েছে। অথচ বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা রীতিমত হিসেব করে দেখিয়েছে যে আগের তুলনায় দাম ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাহলে একটা রাফাল বিমানের দাম কত, এই সামান্য প্রশ্নের উত্তর আজও মিলছে না।

 

৩) রাফাল বিতর্কের ক্ষেত্রে আরেকটা প্রধান বিষয় হল দাসাউ-সহযোগী সংস্থা হিসাবে অনিল আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠীর নির্বাচন। বিতর্কটা স্বাভাবিক কারণ যে কোম্পানি এতদিন একটা বন্দুক পর্যন্ত তৈরি করেনি তারা রাতারাতি বিমান নির্মাণ সংস্থা তৈরি করে অফসেট সঙ্গী হয়ে গেল দাসাউ-এর মত একটা আন্তর্জাতিক বিমান তৈরির সংস্থার – বিষয়টা খুব স্বাভাবিক নয় । বিরোধী পক্ষের দাবি নরেন্দ্র মোদীর সৌজন্যে আম্বানিদের এই শ্রীবৃদ্ধি। যদিও ভারত সরকার, অনিল আম্বানি ও দাসাউ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন যে আম্বানিদের সহযোগী হিসেবে নির্বাচন পুরোপুরি দাসাউ-এর সিদ্ধান্ত, এক্ষেত্রে ভারত সরকার বা নরেন্দ্র মোদীর কোন ভূমিকা নেই। এমন কি বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন যে আম্বানিরাই যে দাসাউ এর সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি করেছে সে সম্পর্কে ভারত সরকার এখনও পর্যন্ত ওয়াকিবহাল নন। কিন্তু মোদী যাকে পাশে বসিয়ে বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন সেই ফ্রাঁসোয়া ওলান্দ একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। তিনি একটি ফরাসি সংবাদপত্রে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে আম্বানিদের সহযোগী হিসাবে না মেনে উপায় ছিল না কারণ তারা ছিল ভারত সরকারের পছন্দ।

 

(এখন এই পরস্পর বিরোধী অভিযোগের সত্যাসত্য বিচার করা জটিল কিন্তু যেভাবে আম্বানির সংস্থা রাফাল চুক্তিতে প্রবেশ করল এবং পরবর্তী ঘটনাবলি গতি পেল তা যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে। দ্বিতিয় কিষ্টিতে আমরা এই নিয়ে আলোচনা করব।)

লেখক  একজন স্কুল শিক্ষক ও  গনতান্ত্রিক অধিকার  আন্দোলনের কর্মী।  লেখাটি প্রথম আসানসোল শিল্পাঞ্চলের উদ্যোগ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

কাভার ইমেজঃ রয়টার্স। 

 

Share this
Leave a Comment