আর্টিস্ট ইউনাইট – শিল্পীরা জোটবদ্ধ। অর্থাৎ? ইভেন্ট করে জোটবদ্ধ হওয়ার কি প্রয়োজন? তার মানে কি শিল্পীরা জোটবদ্ধ ছিলেন না? দেশব্যাপী এই ইভেন্টের ডাকেই হঠাৎ করে জোটবদ্ধ হলেন? একদিনের জন্য জোটবদ্ধ হয়ে লাভটাই বা কি হলো? প্রশ্ন বিবিধ, সন্দেহ অনেক। আসুন, একে একে জট ছাড়ানো যাক। লিখেছেন লাবণ্য দে।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা, ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই জোটবদ্ধ হওয়ার ডাক। ঠিক যেমন ২০১৭ এর ২৮ শে জুন জুনাইদের মৃত্যুকে সামনে রেখে দলিত ও মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে সারা ভারতব্যাপী ‘নট ইন মাই নেম’ এর ডাক দেওয়া হয়েছিলো। এর শুরু দিল্লীবাসী চলচ্চিত্রপরিচালক সাবা দেওয়ানের ফেসবুক পোস্টের ভিত্তিতে। তিনিই আবার এ বছরের ২ ও ৩ মার্চ বর্তমান ফ্যাসিবাদী আক্রমণ রুখতে ভারতবর্ষের সকল শিল্পীমানুষকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান, আহবান জানান অত্যাচারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলার।
প্রতিস্পর্ধা জারি রাখতে এই দুদিন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর কলকাতায় শিল্পীরা জমায়েত করেছেন। একজোট হয়ে গান গেয়েছেন, কবিতা পড়েছেন, নাটক করেছেন, পারফর্মেন্স আর্ট করেছেন, প্রোজেক্টার স্ক্রিন নিয়ে এসে দেখিয়েছেন বিভিন্ন ফিল্ম। একদিকে হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধের পরিস্থিতি ভয়াবহভাবে গ্রাস করে নিতে আসছে আমাদের অস্তিত্বকে, সমালোচনা করলে নেমে আসছে ব্যক্তিগত আক্রমণ, উগ্র জাতীয়তাবোধ দিয়ে ঘিরে ফেলা হচ্ছে আমাদের চারপাশ। এই পরিস্থিতিতে উপায় একটাই। এই ‘ওদের’ চিহ্নিত করে ‘আমাদের’ হাতগুলোকে শক্ত করা। আমরা যারা আজও দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদকে পৃথক করতে জানি, যারা হিংসার বিরূদ্ধে শান্তির বার্তা দিতে জানি, যারা বর্ণ, ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান অধিকারের কথা বুক বাজিয়ে বলি, সেই আমাদেরই আজ যুদ্ধপরিস্থিতিতে আরেকটু কাছাকাছি আসতে হবে, একজন দুজন করে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে জড়ো হয়ে তৈরি করতে হবে ব্যূহ- ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাতে হবে। আর্টিস্ট ইউনাইট এই প্রতিবাদ জানানোর মঞ্চ, নির্ভীক চিত্তে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হওয়ার মঞ্চ।
যে প্রশ্নগুলো দিয়ে এই লেখার শুরু তার দিকে খানিক দৃকপাত করা যাক।
আসলে, আর্টিস্ট ইউনাইটে এসে শিল্পীরা নতুন করে জোটবদ্ধ হয়েছেন এমন ভাবাটা বোধ হয় ভুল হবে। সমমনস্ক শিল্পীরা স্থান কাল সময় নির্বিশেষে বরাবর ই জোটবদ্ধ, সুরে কবিতায় দর্শনে বেঁধে বেঁধে থাকাই তাঁদের ধর্ম। তাই ‘How many deaths will it takes till he knows/that too many people have died’ থেকে ‘তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল’ মাঝখানে কয়েক সমুদ্র ব্যবধান পেরিয়েও একসাথে এসে হাত ধরে। তবে যুদ্ধ যখন ঘরে ঘরে, দাঙ্গার পরিস্থিতি যখন নিজের পাড়াতেও- তখন এই হাতগুলো আরেকটু কঠিন করতে হয়। যুগে যুগে কঠিন সময় শিল্পীরা যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, সেই ইতিহাসকে আরেকবার স্মরণ করে সংহতিতে থাকা হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। আর্টিস্ট ইউনাইট এই সংহতির মঞ্চ, শিল্পীদের নতুন করে জোটবদ্ধ হওয়া নয়, বরং তাঁদের এই ঐতিহাসিকভাবে জোটবদ্ধ থাকার রাজনীতিকে আরেকবার দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করাই তার মূলমন্ত্র।
আর্টিস্ট ইউনাইট শিল্পীদের হায়ারার্কিতে বিশ্বাসী নয়। অতি পরিচিত, প্রসিদ্ধ অর্থেই তারা শিল্পী আর নিজের মতো দোতারা বাজিয়ে গান করা মানুষটার কোনো খ্যাতি নেই বলে সে শিল্পী নয় –এমন নিদান এই সম্মেলনে দেওয়া হয় না। আমরা প্রত্যেকেই জানি বিখ্যাত হওয়ার রাজনীতির কথা। ভাস্কর চক্রবর্তীর সেই অমোঘ বাক্য “বিখ্যাত বিখ্যাত আর বিখ্যাত হতে চাওয়ার মধ্যে একটা অশ্লীলতা আছে”। তাই বিখ্যাত, কম বিখ্যাত, অখ্যাত সকল শিল্পীমানুষের সমাগম হয়েছিলো এই আর্টিস্ট ইউনাইটে। বরং প্রতিষ্ঠিত সুপ্রসিদ্ধ শিল্পীর থেকে অল্পপরিচিত শিল্পীদের জমায়েতই বেশী করে দেখা যায় এই দুটি দিনে। চেন্নাইএর সমাবেশে ফিল্ম স্ক্রিনিং, আলোচনার পাশাপাশি হয় লাঠিখেলা এবং ঢাকিদের পারফর্মেন্স, দিল্লীতে বৃষ্টি মাথায় করে হয় নাচ, গান, ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের কবিতাপাঠ, কলকাতায় স্বনামধন্য আর্টিস্টদের উপস্থিতি ছাড়াই পারফর্ম করেন শহরের বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের সাথে যুক্ত থাকা মানুষেরা। প্রতিটা শহরেই স্টার আর্টিস্টদের থেকে অল্পচেনা মুখগুলোর প্রাধান্যই ছিলো বেশী। অন্যান্য শহরে খোলা প্রাঙ্গনে এই জমায়েত হলেও কলকাতায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বাইরে মাইক বাজানো নিষেধ থাকায় নিরঞ্জন সদনে জমায়েত হতে হয় আমাদের। একইসাথে নিরঞ্জন সদনের বাইরের চত্বরে পারফর্মেন্স আর্ট, ভেতরে লাইভ পেন্টিং থেকে হলের ভেতর নানাবিধ গান, ইন্টার্যাক্টিভ সেশান, বক্তৃতা, ফিল্ম স্ক্রিনিং চলে।
দুপুর তিনটে থেকে অনুষ্ঠান শুরু, বেলা একটা থেকেই উপস্থিত আয়োজকের দল। নানাজনের তৈরি করা নানাবিধ পোস্টার, ফ্লেক্স দিয়ে তখন সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার পালা। তিনটের কাছাকাছি সময় নিরঞ্জন সদনের বাইরের চত্বরে বেশ অনেক মানুষের সমাবেশ হয়ে গেছে। মুখ কাপড় দিয়ে আটকে তা রেলিঙের সাথে বেঁধে দুজন শুরু করলেন তাঁদের পারফর্মেন্স আর্ট। জড়ো হওয়া লোকজনের দৃষ্টি তখন এই পারফর্মেন্সকে কেন্দ্র করে। এই লোকজনের মধ্যে থেকেই একজন হঠাৎ বাঁশি বাজিয়ে উঠলেন, খানিক পরে বোঝা গেলো তিনিও পারফর্মেন্সটির অংশ। ততক্ষণে হলের ভেতরেও তোরজোড় শুরু হয়ে গেছে, ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’ দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী নীতি আটকাতে আমাদের কতোটা কঠোর হতে হবে,ফ্যাসিবাদকে কতটা ঘৃণা করতে হবে, সেই বক্তৃতায় যখন সোচ্চার মঞ্চ তখন হলের বাইরে শিল্পীরা রং তুলি দিয়ে প্রতিবাদ আঁকছেন কাগজে। হলের ভেতর বাইরে জুড়ে প্রায় ছ’শো লোকের সমাবেশ। হলের মধ্যে চলছে একের পর এক সমাজকর্মী, সাহিত্যিক,নৃত্যশিল্পী দের বক্তব্য, উপস্থাপনা আর বাইরে লাইভ পেন্টিং, পারফর্মেন্স আর্ট। সন্ধে হয়ে এলে দেখানো হলো দুটি শর্ট ফিল্ম। এতো মানুষের সপ্রতিভ অংশগ্রহণে নিরঞ্জন সদন চত্বর জুড়ে যেন যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি তুঙ্গে।
সারাদিনের অনুষ্ঠান শেষে বাইরে বেরিয়ে আসি আমরা, হাতে হাত দিয়ে মানবশৃঙ্খল তৈরি করে শপথ নি এভাবেই একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ জারি রাখার, এভাবেই যুদ্ধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রেমের গান গাওয়ার।
আসলে এই দুইদিনের একত্রিত হওয়া কেবল দুইদিনেরই নয়। এ প্রারম্ভিক প্রস্তুতি মাত্র। সামনে আরো দুর্দিন, জোর লড়াই। তার আগে গান গেয়ে, ছবি এঁকে নিজেদেরকে প্রস্তুত করে তোলা দরকার। প্রতিপক্ষ যখন শক্তিশালী, তখন এই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথেই ক্রমমুক্তি আসবে কিনা জানা নেই। তাও, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় পিট সিগারের যুদ্ধবিরোধী গানে আমেরিকার মানুষ যেমন সারা রাস্তা দখল করে নিয়েছিলো – সেরকম বিশ্বাস, রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে সরবোর্ন ইউনিভার্সিটির একদল তরুন তরুণী যে রাষ্ট্রের বিরূদ্ধে সোচ্চার হতে পেরেছিলো- তেমন বিশ্বাস। এই বিশ্বাস করবার প্রাঙ্গনই আর্টিস্ট ইউনাইট, এই বিশ্বাসে ভর রেখে সমবেত আর্তনাদের মঞ্চই আর্টিস্ট ইউনাইট। তাই এটা কোনো দুইদিনের ইভেন্ট বা ইস্যু নয়- বরং ভবিষ্যতে আরো শক্ত হয়ে লড়াই করবার প্রস্তুতিক্ষেত্র মাত্র!
লাবণ্য দে কলকাতার আর্টিস্ট ইউনাইটের আয়োজনার সাথে যুক্ত, এনার অভিনীত একটি শর্ট ফিল্ম(…আফটার আসিফা) কলকাতার আর্টিস্ট ইউনাইটের মঞ্চে স্ক্রিনিং হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যর ছাত্রী লাবণ্য ফিল্ম, সাহিত্য, থিয়েটার সহ শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে উৎসাহী।
Image Courtesy : Raktim Mondol