ছত্তিসগড়ে সরকার বদল হয়েছে বটে কিন্তু বস্তারে নিরীহ আদিবাসী হত্যা, নির্যাতনের পরম্পরা বদলায়নি। সাম্প্রতিক তম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ভৈরমগড়ের তাড়িবল্লা গ্রামে। আদিবাসী শিক্ষিকা, অধিকার রক্ষা কর্মী এবং রাষ্ট্রের চরম অত্যাচারের শিকার সোনি সোরি ও অধিকার রক্ষা কর্মী লিঙ্গারাম কোড়োপি’র দাবি এটি আরেকটি রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ভৈরমগড় ঘুরে এসে সোনি ও লিঙ্গারাম লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেই বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হল।
গ্রাউন্ডজিরো: নকশাল বিরোধী অভিযান ও সংঘর্ষের নামে ১০ জন নিরীহ আদিবাসীকে হত্যার অভিযোগ উঠল নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বস্তারের বিজাপুর জেলার অবুঝমাড় পাহাড়ের তাড়িবল্লা গ্রামে এই হত্যাকাণ্ডর ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছেন আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের কর্মী সোনি সোরি। এক বিবৃতিতে তিনি জানান, সরকার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এই ঘটনাকে এক ‘বিরাট জয়’ হিসেবে দেখালেও ‘কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন এবং একটি সাধারণ অনুসন্ধান করলেই হাড় কাঁপানো বাস্তব প্রকাশ হয়ে পড়ে’। গত ৫ মার্চ সোনি’র নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধানকারী দল ভৈরমগড়ে উপস্থিত হয়েছিলেন।
বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, “আমরা পরিষ্কার ভাবে বলতে চাই ওই দিন নিরাপত্তা বাহিনী যাঁদের খুন করেছে তাঁরা কেউ নকশালপন্থী ছিলেন না। এমনকী কোনও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।” মৃতদের অধিকাংশই শিশু এবং তারা সেদিন গ্রামীণ ক্রীড়ায় অংশ নিতে জড়ো হয়েছিল বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে। আরও দাবি করা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে উপস্থিত হয় এবং নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে আহতদের উপর ফের নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়।বাহিনী দু’জন বালিকাকে ধর্ষণ করে। ১২ বছরের এক বালিকার যৌনাঙ্গহানিও ঘটায়। অভিযোগ, অত্যাচারিত এবং নিহতরা সকলেই নিরীহ গ্রামবাসী এ কথা জেনে বুঝেও বাহিনী এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে। গুলি চালানোর পাশাপাশি তারা ঘটনাস্থলে কাপড়-জামা, ঘটি-বাটি, বিভিন্ন পাত্র সহ যা যা ছিল তা পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং পস্কো আইন অনুযায়ী বাহিনীর বিরুদ্ধে পালটা হলফনামা দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
অনুসন্ধানকারী দল প্রশ্ন তোলেন এবং জানতে চান, “…কেন আমাদের গ্রামে গ্রামে প্রত্যেক রুটিন টহলের সময় প্রতিবার নিরাপত্তা বাহিনী এমন খারাপ ব্যবহার করে? কোথা থেকে তারা এই আদেশ পায়? ” তাঁদের দাবি, প্রত্যেক দিন কোনও কারণ কিংবা প্রমাণ ছাড়াই আদিবাসীদের পথ-ঘাট, হাট থেকে ক্যাম্প কিংবা পুলিশ স্টেশনে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। যতদিন ইচ্ছে আটক রাখা এবং অত্যাচার করা হয়। পরিবারকে কিছুই জানানো হয় না। এর পর মর্জি হলে হয় ছেড়ে দেয় কিংবা নকশালপন্থী মামলায় জড়িয়ে দেয়।
অতীতে বার বার যে মৌলিক প্রশ্ন সামাজিক ও মানবাধিকার কর্মী, সমাজতত্ত্ববিদরা তুলে এসেছেন সেই একই প্রশ্ন তোলা হয়েছে এই বিবৃতিতে। প্রশ্ন ও অভিযোগ উঠেছে, “কার হুকুমে বাহিনী মনে করে মহিলাদের শরীর তাদের নিজস্ব সম্পত্তি? সুতরাং যেমন খুশি ইচ্ছেমতো তাদের নিগ্রহ এবং শ্লীলতাহানি করা যায়। এমনকী গর্ভবতী মহিলা, বালিকা, দুধের শিশুকে বুকে জড়িয়ে রাখা মায়েদেরও ছাড় দেওয়া হয় না।” মহিলাদের উপর অত্যাচারের ঘটনার অভিযোগ জানালে ‘জাতিবিদ্বেষী ঢাল’ ব্যবহার করে বলা হয়ে থাকে, “আদিবাসী মেয়েদের গায়ে বদ গন্ধ, ওদের কে ছোঁবে?”
প্রশ্ন তোলা হয়েছে নিরীহ আদিবাসীদের নৃশংস ভাবে কোতল করার রীতি-রেওয়াজের বিরুদ্ধেও। অভিযোগ, ধারাবাহিক ভাবে মৃত্যু ও ধ্বংস বস্তারের মানুষের নিত্যসঙ্গী। ঘরবাড়ি লুঠপাট, জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। কষ্টের আয়, পোশাক, শষ্য, গৃহপালিত পশু, মুরগি আর যা কিছু সম্পদ সবই যেন সরকারের চোখের বালি। এমন অভিযোগ তুলে প্রশ্ন করা হয়েছে, “এ কোন জাতীয় সামরিকীকরণ?” যেখানে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা সেখানে এ জাতীয় ঘটনা প্রবল ভয়ের উদ্রেক করে চলেছে। বিবৃতিতে বিচারের দাবি জানিয়ে বলা হয়েছে, “যা আমরা হারিয়েছি, যা আমরা সহ্য করেছি, যে দুর্দশা, দুর্গতি সরকার আমাদের দান করেছে – তার কোনও পরিমাপ হয় না। কিন্তু আজ সরকারকে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, ন্যায়বিচার দিতে হবে।”
রাজ্য সরকারের কাছে অনুসন্ধান দলটি চার দফা দাবি জানিয়েছে:
(১) ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২, ৩০৭, ৩৭৬(২) (সি), ২০১ এবং পস্কো আইনের ৫(বি) ধারা অনুযায়ী পালটা হলফনামা দিতে হবে। ঘটনার পূর্ণ এবং স্বচ্ছ তদন্ত করতে হবে। (২) ঘটনা তলিয়ে দেখতে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির তত্ত্বাবধানে কমিশন গঠন করতে হবে। (৩) মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের হাতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এবং এফআইআর-এর কপি তুলে দিতে হবে। (৪) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গাইডলাইন অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত করতে হবে যাতে নিহতদের পরিবার নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে।