হাবল বাগদি, বিশ্বনাথ বাগদি, কলি বাগদি ও রিঙ্কু বাগদি গত ৩১শে জানুয়ারি(২০১৯) বাঁকুড়ার বড়জোড়া নর্থ কোলিয়ারি থেকে কয়লা তুলতে গিয়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। প্রশাসন ও মিডিয়ার ভাষায় এঁরা ‘কয়লাচোর‘। গত ২০–২৫ বছর ধরে এটাই খনি অঞ্চলের দস্তুর। বাম–শাসক বা পরিবর্তনের সরকার – ছবিটা একটুও পাল্টায়নি। সুমন কল্যাণ মৌলিক–এর প্রতিবেদন।
(১)
হাবল বাগদি(৬২), বিশ্বনাথ বাগদি(৪২), কলি বাগদি(৪০), রিঙ্কু বাগদি আমাদের সহ নাগরিক ছিলেন। ক্রিয়াপদটি অতীতকালে লেখার কারণ গত ৩১শে জানুয়ারি(২০১৯) ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের এই সন্তানেরা বেআইনিভাবে বাঁকুড়ার বড়জোড়া নর্থ কোলিয়ারি (কয়লা খনিটির মালিক ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন) থেকে কয়লা তুলতে গিয়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। নাগরিক, প্রজাতন্ত্র প্রভৃতি গুরুগম্ভীর শব্দগুলো হাবল বা বিশ্বনাথদের পাশে যুক্ত করাতে অনেকে অস্বস্তি বোধ করতে পারেন, কারণ প্রশাসন ও মিডিয়ার ভাষায় এঁরা ‘কয়লাচোর’। ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার মধ্যে যথারীতি কোনো নতুনত্ব নেই। যেমন স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত প্রধান জানিয়েছেন এবার থেকে তাঁরা গ্রামবাসীদের কয়লা তুলতে যাওয়ার (চুরি) বিপদ সম্পর্কে অবহিত করবেন। যেন এই গ্রামবাসীরা জানেন না কয়লা তুলতে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাণের ঝুঁকি আছে। খনি অঞ্চলের এক বিশিষ্ট বামপন্থী শ্রমিক নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ অভিযোগ করেছেন যে শাসক দল ও পুলিশের যোগসাজশে বেআইনি কয়লার বাড়বাড়ন্ত, প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। কিন্তু এই অঞ্চলের একটা বাচ্চা ছেলেও জানে যে গত ২০-২৫ বছর ধরে এটাই খনি অঞ্চলের দস্তুর। বাম-শাসক বা পরিবর্তনের সরকার – ছবিটা একটুও পাল্টায়নি।
বিষয়টা একটু বিশদে বলা দরকার। শিল্পসভ্যতার চালিকাশক্তি কয়লা যাকে আমরা কালো হীরে বলে জানি – আসানসোল-রাণীগঞ্জ অঞ্চলে রয়েছে তার বিপুল ভাণ্ডার। ১৬৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই এলাকায় বর্তমানে চালু রয়েছে ৭৩ টি ভূগর্ভস্থ ও ১৩টি খোলামুখ খনি। ব্রিটিশ আমলে ব্যক্তি মালিকানাধীন কয়লাখনি, ’৪৭ পরবর্তীতে কয়লাখনির জাতীয়করণ, ৯০’র দশকে সংস্কার কর্মসূচির নামে কয়লাখনির বেসরকারিকরণের নীল নকশা, সর্বোপরি বহু আলোচিত কোল ব্লক কেলেঙ্কারি – কয়লা শিল্পের এই যাত্রাপথ নিয়ে কম আলোচনা হচ্ছে না। কিন্তু এই প্রতিবেদনের ভরকেন্দ্র অন্য। আমরা আলোচনা করছি পুলিশ-প্রশাসন-রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায়, সরকারি কোল কোম্পানিগুলির মদতে ও কয়লা মাফিয়াদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক বিপুল বেআইনি কয়লা শিল্প নিয়ে। এই শিল্পে খনি অঞ্চলের হাজার হাজার বেকার মানুষ যুক্ত। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আদিম ‘ইঁদুরগর্ত’ (Rat hole mining) পদ্ধতিতে তাঁরা কয়লা তোলেন টাকার জন্য। সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষেরা (তপশিলি জাতি, উপজাতি ও সংখ্যালঘু) এইভাবে প্রাণ হাতে করে খাদানে নামেন কয়লা তোলার জন্য। দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বেআইনি কয়লা খননের গল্পে কোনো নতুন ঘটনা নয়। যেমন বড়জোড়ার ঘটনার কয়েকদিন আগে (২৫ শে জানুয়ারি) রাণীগঞ্জের কাছেই একটি বেআইনি খোলামুখ খনি থেকে কয়লা তুলতে গিয়ে ৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় কিন্তু মৃতদের পরিচয় জানা যায় নি। বড়জোড়ার ঘটনার দশদিন আগে বাংলা – ঝাড়খণ্ড সীমান্ত এলাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত কোল কোম্পানি ইসিএল(ECL) এর খনিতে কয়লা তুলতে গিয়ে বেশ কয়েকজন মানুষ মারা যান। ২০১৮ সালের কুলটির বড়িড়াতে মারা যান একজন। সময়ের চাকা আর একটু পিছনের দিকে ফেরালে আমরা দেখতে পাব ২০০৬ সালে গাংটিকুলিতে বেআইনি কয়লা খনিতে দুর্ঘটনা ঘটে। এলাকায় ঘুরে জানা গেছিল, ২৫-৫০ জন মানুষের সলিল সমাধির কথা। ২০০৭ সালে সালানপুরের পাহাড়গোড়ায় কয়লাস্তুপে চাপা পড়া ১৩ জন মানুষের দেহ বার করতে বাধ্য করেছিলেন প্রাক্তন সাংসদ হারাধন রায়। ২০০৫ সালে গৌরান্ডির লালহঁরি এলাকাতে বহু মানুষের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। আসলে বেআইনিভাবে কয়লা খনন, উত্তোলন এবং তার ফলে মানুষের মৃত্যু – বাঁকুড়ার বড়জোড়া, বারাবনী, বীরভূমের খয়রাসোল বা পুরুলিয়ার নিথুড়িয়া, পারবেলিয়ার – এক নেহাতই চেনা ছবি। তবে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর কথা প্রায় প্রকাশই পায় না। সাধারণভাবে খাদান থেকে কয়লা তোলানোর কাজটা করানো হয় বহিরাগত (বিশেষ করে ঝাড়খণ্ড) মানুষদের দিয়ে, তাই কেউ মারা গেলে তা খবর হয় না। পুলিশি ঝুট-ঝামেলা থেকে বাঁচতে কেউ মৃতদের পরিচয় দেন না। কয়লা অঞ্চলে বেআইনি কয়লার কাজ করতে গিয়ে মৃত মানুষদের পরিবারদের সশব্দে কান্নার অধিকার পর্যন্ত নেই। চুপ করে থাকলে সিন্ডিকেটের মাতব্বরদের কল্যাণে এককালীন টাকা মেলে। একমাত্র মৃত মানুষরা স্থানীয় গ্রামের লোক হলে প্রাথমিক কিছু হৈচৈ হয়। ব্যাস ওই পর্যন্তই। আর সত্যের খাতিরে এ কথাটাও বলা দরকার যে ভারতের সমস্ত কয়লা খনি অঞ্চলে বেআইনি কয়লার কারবার চলে। কিছুদিন আগে মেঘালয়ে কয়লাখনির সুড়ঙ্গের মধ্যে জল ঢুকে ১৫-২০ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু তার আরেক প্রমাণ।
(২)
সংগঠিত ও আইনি কয়লাখনিগুলির মত সমান্তরালে বেআইনি কয়লা শিল্পও সংগঠিত ভাবে চলে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে এই কয়লার উৎস কি। বেআইনি কয়লার উৎস একাধিক। ব্রিটিশ আমল থেকে এখানে প্রচুর ব্যক্তিমালিকানাধীন কয়লাখনি ছিল, যা বর্তমানে পরিত্যক্ত। এছাড়া রয়েছে এমন খনি যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত কোল কোম্পানি হয়তো আগে কয়লা তুলত, কিন্তু বর্তমানে লাভজনক না হওয়াতে তারা কয়লা তোলা বন্ধ রেখেছে। এমনও উদাহরণ আছে যেখানে ইসিএল কয়লা তোলার জন্য প্রাথমিক কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু পরে আর কিছু করে নি। সেইসব এলাকার ম্যাপ, আনুমানিক কয়লার পরিমাণ সম্পর্কিত তথ্য যথা নিয়মে সিন্ডিকেটের লোকদের কাছে পৌঁছে যায়। এছাড়া রয়েছে সাধারণের জমির তলায় থাকা কয়লা। এলাকার মানুষের অভিমত হল জোঁড়ের (জলের উৎস) এলাকাগুলোতে মাটি খুঁড়লে কয়লা পাবার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। সাধারণত এই অঞ্চলগুলি থেকে বেআইনি কয়লা তোলা হয়।
খনি অঞ্চলে কয়লা তোলা ও পরিবহনের সম্পূর্ণ ব্যাপারটা কোল মাফিয়া(চলতি কথায় সিন্ডিকেট) দের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কয়লা তোলার কাজটা করতে হয় প্রাণ হাতে করে। সিন্ডিকেট প্রাথমিক পুঁজি বিনিয়োগ করে, যা দিয়ে খনি থেকে জল পাম্প করে সরানো (স্থানীয় ভাষায় জল মারা), ঝুড়ি, শাবল, গাঁইতি দেওয়া ও কয়লা কাটার জন্য শ্রমিক আনা ও তাদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়। সুড়ঙ্গ খুঁড়ে এগিয়ে যাওয়া, কুয়ো খুঁড়ে কয়লা বার করা সাধারণ পদ্ধতি। ইনক্লাইনগুলোতে ডিনামাইট ব্যবহার করা হয় না কারণ তাতে ধ্বস হবার সম্ভাবনা প্রবল। কয়লা খননের কাজের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের প্রথম পছন্দ বহিরাগত শ্রমিক কারণ তাতে দুর্ঘটনা ঘটলে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা কম৷ পশ্চিম বর্ধমানের ক্ষেত্রে দেখা যায় দামোদর ও অজয় নদীর ওপারে ঝাড়খণ্ড ও বীরভূম থেকে কয়লা কাটতে লোক আসে। অঞ্চলগত পার্থক্য থাকলেও সাধারণভাবে কয়লা কাটার সাথে যুক্ত মানুষেরা দৈনিক ৭০০-৯০০ টাকা আয় করেন। এই কয়লা ঝুড়ি করে বয়ে আনার কাজ করে আরেকদল। এদের আয় তুলনামূলক ভাবে কম, ৪০০-৫০০ টাকা। বহু ক্ষেত্রে এই কাজে মেয়েরাও যুক্ত হয়। এইভাবে সুড়ঙ্গ থেকে কয়লা মাটির উপরে আসে, কিন্তু এরপর কয়লা যায় কোথায়?
এই পর্বে যুক্ত হয় এলাকার সাধারণ মানুষ। সাইকেল বা মোটরবাইকের মাধ্যমে কয়লা তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সিন্ডিকেট নির্ধারিত স্থানে যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে স্পট। “Necessity is the mother of invention” – কথাটা কতখানি সত্য তার প্রমাণ মেলে কয়লা পরিবহনের কাজে যুক্ত সাইকেল ও মোটরসাইকেলগুলোর দিকে তাকালে। কয়লা পরিবহনের কাজে সুবিধার জন্য সাইকেল ও মোটরসাইকেলগুলোর মডেলে পরিবর্তন আনা হয়েছে। খাদানের কাছে নিরক্ষর মানুষদের যোগদান বেশি কিন্তু পরিবহনের কাজে এলাকার বেকার শিক্ষিত যুবকরাই বেশি সক্রিয়। একটা কথা পরিষ্কার, যে উৎস থেকেই কয়লা আসুক না কেন, সিন্ডিকেট ছাড়া তা বাজারে বিক্রি করা সম্ভব নয়।
তবে আরো দু-একটি পদ্ধতিতেও বেআইনি কয়লা সংগৃহীত হয়। যেমন কয়লা শিল্পে নীতিগত পরিবর্তন হওয়ার পরে বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিকে কোল প্যাচ(patch) দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে খোলামুখ খননের মাধ্যমে কয়লা উত্তোলিত হয়। সেই কয়লা তোলার সময় প্রচুর মাটি ও পাথরের মিশ্রণ উঠে আসে (ওভারবার্ডেন), যা কোল কোম্পানিগুলি একটি নির্দিষ্ট এলাকায় জমা করে। স্থানীয় কথায় একে বলে ‘ন্যাচারাল’৷ এই ন্যাচারাল থেকেও বেছে কয়লা বার করা হয়৷ সেই কয়লার অধিকার নিয়ে প্রায়শই গোষ্ঠী সংঘর্ষ দেখা দেয়। সম্প্রতি বারাবনী ব্লকে সরিশাতলি কোল প্রজেক্ট (গোয়েঙ্কাদের মালিকানাধীন) ন্যাচারাল থেকে কয়লা সংগ্রহ করা নিয়ে দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। আক্রান্ত হয় এলাকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও আই সি ডি এস সেন্টার। আবার আসানসোলের ভানোড়া ওয়েস্ট প্যাচে কোম্পানি দু’ঘন্টার জন্য পাহারা সরিয়ে নেয় যাতে গ্রামবাসীরা কয়লা সংগ্রহ করতে পারে।
বেআইনি কয়লার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল খনি অঞ্চল থেকে উত্তোলিত কয়লা নিরাপদে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা। বর্তমানে স্পট থেকে ১৪ বা ১৬ চাকার বিশালাকার ট্রাকে কয়লা তুলে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। রাস্তায় পুলিশ – প্রশাসন ম্যানেজ করার জন্য প্রত্যেক ট্রাক পিছু ‘প্যাড’ কিনতে হয়। ভারতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে তারা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার জন্য বাৎসরিক টাকার বিনিময়ে মোগলসম্রাট ফারুখসিয়ারের কাছ থেকে এক ছাড়পত্র আদায় করেছিল যার নাম ‘দস্তক’। প্যাড খানিকটা তার মত। প্যাড (বর্তমানে একটি প্যাডের দাম গড়ে ৮০,০০০-১,০০,০০০ টাকা) থাকলে গাড়ি বেআইনি কয়লা নিয়ে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছায়।
(৩)
অনেকে প্রশ্ন করেন যে, প্রতি মুহূর্তে প্রাণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মানুষ (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) বেআইনি খাদানে নামে কেন! এর একমাত্র উত্তর দারিদ্র এবং দারিদ্র। দারিদ্র যেহেতু কাউকে মহান করে না, বা খ্রিস্টের সম্মান দেয় না, তাই গরীব মানুষ কঠিন জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার জন্য বা সন্তানের মুখে দুটো গরম ভাত তুলে দেবার জন্য অন্ধকার খাদানে নামে। প্রচণ্ড বেকারি ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় গরীব মানুষ এ পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। একটা সময় ছিল যখন সারা দেশের মানুষ কাজের সন্ধানে আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে আসত। কিন্তু ৮০’র দশকের শেষ থেকে শিল্পের উল্টোযাত্রা শুরু হয়। গ্লাস ফ্যাক্টরি, রানীগঞ্জ পেপার মিল, জে কে নগরের অ্যালুমিনিয়াম, সেনরালের সাইকেল কারখানা, দুর্গাপুরে এমএএমসি, ফিলিপস কার্বন ব্ল্যাক, সিমেন্ট কারখানা, অতি সাম্প্রতিক সময়ে বার্ন স্ট্যান্ডার্ড ও হিন্দুস্থান কেবলস – একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়। এই শিল্পগুলিকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত অনুসারী শিল্প গড়ে উঠেছিল, তারাও ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হয়। বহু বিজ্ঞাপিত অঙ্গদপুর, মঙ্গলপুর ও কন্যাপুরের শিল্পতালুকগুলি মৃতপ্রায়। ফলে এই অঞ্চলের অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ শ্রমজীবীর হাতে জীবনধারণের জন্য কোনো কাজ নেই। কয়লাশিল্পে যে সমস্ত নীতিগত পরিবর্তন হয়েছে, তার সাথে কয়লাখনিতে কাজের সুযোগও কমেছে। বর্তমানে ভূগর্ভস্থ খনির বদলে সর্বত্র খোলামুখ খনি চালু হচ্ছে। আধুনিক দৈত্যাকার মেশিন দিয়ে উৎপাদনের ফলে খনিতে কাজের সুযোগ কমছে। একই সঙ্গে খোলামুখ খনি অঞ্চলের মানুষের জন্য ডেকে আনছে অভূতপূর্ব পরিবেশগত বিপর্যয়। দীর্ঘ সময় ধরে খনি ও শিল্প কারখানাগুলি জীবিকার প্রধান উৎস হওয়ার কারণে একদা সচল কৃষি খনি অঞ্চলে অবহেলিত। ফলে কৃষিকে ঘিরে বাঁচারও সুযোগ নেই। অনেকে বিকল্প জীবিকা হিসাবে একশ দিনের রোজগার যোজনার কথা বলছেন। কিন্তু সেখানেও গড়ে পঞ্চাশ দিনের বেশি কাজ পাওয়া যায় না। বহু ক্ষেত্রে যন্ত্রের সাহায্যে কাজ কাজ করা হয়, মজুরির একটা অংশ জব কার্ড হোল্ডাররা পান না। আবার একশ দিনের রোজগার যোজনায় সবাই যে কাজ পান, এমনটাও নয়। বড়জোড়ায় সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে জানা গেছে যে, মৃত হাবল বাগদি একশ দিনের রোজগার যোজনায় শেষ কাজ পেয়েছেন ২০১৮-র ফেব্রুয়ারি মাসে এবং বিশ্বনাথ বাগদি ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে। কাজের মজুরি দিনপ্রতি ১৮৬ টাকা, যা এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে খুবই সামান্য। ফলে মানুষ বাধ্য হচ্ছেন কয়লাচুরির কাজে অংশ নিতে কারণ এখানে দিনপ্রতি ৫-৬ ঘণ্টা গড়ে কাজ করে ৫০০-১০০০ টাকা উপার্জন করা সম্ভব। তাই মৃত্যুর আশঙ্কা সত্ত্বেও বেআইনি কয়লা খাদানে মানুষের যোগদান দিন দিন বাড়ছে।
(৪)
এ মৃত্যুমিছিল রোখার রাস্তা কোথায়? শুধুমাত্র পুলিশি সক্রিয়তা দিয়ে যাঁরা সমস্যা সমাধানের রাস্তা খোঁজেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। এই বিশাল অঞ্চলে অগণিত মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও জাতীয় সম্পদের ধারাবাহিক লুঠের প্রতিরোধ অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলি খোলার চেষ্টা একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে। বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেকগুলো কারখানার উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা আজও আছে। বিশেষ করে গ্লাস, সাইকেল, কাগজ ও ওয়াগন। শুধুমাত্র আধুনিকীকরণের কর্মসূচির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে জে কে নগরের অ্যালুমিনিয়ম ও রূপনারায়ণপুরের হিন্দুস্থান কেবলস কারখানা। সংস্কার কর্মসূচির নামে রাষ্ট্রের সম্পদ জলের দরে কর্পোরেটদের বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ কারখানা খোলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান জটিলতাগুলো দূর করার ক্ষেত্রে যথাযথ আইন প্রণয়ন করতে হবে। এশিয়ার সেরা কয়লা পাওয়া যায় খনি অঞ্চলে। কিন্তু সর্বনাশা খোলামুখ খনি প্রকল্পগুলি একাধারে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমাচ্ছে, অন্যদিকে মানুষের জীবন, বসতি ও বাস্তুতন্রের জন্য নিয়ে আসছে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। তাই খনি অঞ্চলকে বাঁচাতে ভূগর্ভস্থ খনিকে প্রাধান্য দিয়ে কয়লাশিল্পে নতুন নীতি প্রণয়ন করতে হবে। একটা সময় ছিল যখন এই খনি এলাকায় কৃষিকাজের দীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু আমাদের ঔদাসীন্য তাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সময় এসেছে এই এলাকার জমি ও জল-আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিবেশবান্ধব কৃষি পরিকল্পনা করা। এগুলো করতে পারলে, বেরোজগার মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কিছু বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে, তবেই কয়লা তুলতে গিয়ে মানুষের মরে যাওয়ার গল্প শেষ হবে, একইসঙ্গে শেষ হবে ‘কয়লা চোরের’ তকমা নিয়ে বেঁচে থাকার রোজকার অসম্মান।
লেখক একজন মানবাধিকার কর্মী।
Representational cover picture, courtesy Ghetty images.
গভীর পর্যবেক্ষণলব্ধ প্রতিবেদন ।সাধারণ পাঠককে সমস্যার গুরুত্ব এবং উদ্ভুত সংকট সম্পর্কে অবহিত হতে সাহায্য করবে ।