সবে গতকাল ভারত রাষ্ট্র সামরিক জাঁকজমক দেখিয়ে তার ৭০তম প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করেছে। আর ঠিক সেই সময়ে ৪ লক্ষ অসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মী ২৩–২৬ জানুয়ারি তিন দিনের ধর্মঘট করেছেন। সিদ্ধার্থ বসুর প্রতিবেদন।
মোদী সরকারের শ্রমিকবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিরোধে ২০১৮ সাল থেকে বনধ–ধর্মঘট–কর্মবিরতির যে ঢেউ উঠেছিল, ২০১৯ এও তাতে এতটুকু ভাটা পড়েনি। দেশের শ্রমক্ষেত্র যেন হঠাৎই খুব ঘটনাবহুল হয়ে উঠেছে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো দক্ষিণপন্থী ধনতান্ত্রিক সরকারের নব্য উদারনৈতিক নীতির আগ্রাসনে প্রাথমিক রক্ষণাত্মক অবস্থান ছেড়ে পালটা লড়াই দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
গত বছর মোদী সরকার সরকারি ক্ষেত্র বিএসএনএল–কে ৪জি স্পেক্ট্রাম চালু করতে দিতে অস্বীকার করে, যখন সমস্ত বেসরকারি একচেটিয়া সংস্থাগুলো এই স্পেক্ট্রাম ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। এর প্রতিবাদে ৩ ডিসেম্বর ২ লক্ষ বিএসএনএল কর্মী এক বিরাট টেলিকম ধর্মঘট সফল করেন। অস্থায়ী ‘নন পারফর্মিং এসেট‘ সংকটের মোকাবিলার সহজ পন্থা হিসেবে সরকার তিনটি পাব্লিক সেক্টর ব্যাঙ্ককে মার্জ করিয়ে দেবার নীতি নেয় যার প্রতিবাদে ২১ ও ২৬ ডিসেম্বর পরপর দুটো ব্যাঙ্ক ধর্মঘট হয়। তারপর বহু বিভিন্ন ক্ষেত্রের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারীদের অংশগ্রহণে সফল হয় ২ দিনের ঐতিহাসিক সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘট, এ মাসেরই ৮ ও ৯ তারিখ। আর এবারে এই অসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মীদের ৩ দিনের ধর্মঘট।
প্রায় ৪ লক্ষ অসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মী ২৩ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩ দিনের ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন। একদিকে সরকারি প্রতিরক্ষা বিভাগের অবস্থা শোচনীয় ও অন্যদিকে বিজেপি সরকার প্রতিরক্ষা পণ্য তৈরির দেশীয় বিভাগগুলোকে বেসরকারি ও বহুজাতিক কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধেই তাঁদের প্রতিবাদ। সেই সঙ্গে তাঁদের লড়াই ন্যায্য পেন্সনের অধিকারের সপক্ষেও। অল ইন্ডিয়া ডিফেন্স এম্পলয়িজ ফেডারেশন (এ.আই.ডি.ই.এফ), ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ওয়ার্কার্স ফেডারেশন (আই.এন.ডি.ডব্লু.এফ) ও সঙ্ঘ পরিবারের শাখা শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় প্রতিরক্ষা মজদুর সংঘ (বি.পি.এম.এস) যৌথভাবে এই ধর্মঘটের ডাক দেয়।
৪১ টা অর্ডন্যান্স কারখানায় তৈরি ২৭৫ টার বেশি প্রতিরক্ষা পণ্য ‘নন–কোর‘ বলে ঘোষিত হয়েছে এবং সে বাবদে তাদের উৎপাদন বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্র, গোলাবারুদ, রাইফেল, বোমা, মিসাইল ইত্যাদি। এর ফলে ২৫ টার মতো অর্ডন্যান্স কারখানা ও তাদের কর্মীরা চরম সংকটে পড়েছেন। শেকাতকার কমিটির সুপারিশ অনুসারে করা এই ঘোষণা কর্মী সংগঠংনগুলিকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে করা হয়েছে।
বিজেপি সরকার অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড (ও.এফ.বি) এবং অন্যান্য ডিফেন্স পাব্লিক সেক্টর আন্ডারটেকিং (ডি.পি.এস.ইউ)-এ আর টাকা ঢালতে চায় না। সেই সঙ্গে সরকার দুটো প্রধান ডি.পি.এস.ইউ — হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড (এইচ.এ.এল) ও ভারত ডাইন্যামিক্স লিমিটেড (বি.ডি.এল)-এর শেয়ার বেচে দিতে চাইছে। অথচ এইচ.এ.এল ও বি.ডি.এল, দুটো কোম্পানিই বড় লাভ করে চলছে, ২০১৬–১৭ র হিসেব অনুসারে যার পরিমাণ যথাঃক্রমে ২৬১৬ কোটি ও ৫২৪ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, ফ্রান্সের ড্যাসল্টের থেকে ১২৬ টি রাফালের টেন্ডার ডাকা হয় যার ১০৮ টি প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে তৈরি করার কথা ছিল এইচ.এ.এল–এর। সেখান থেকে মোদী সরকার অনিল আম্বানীর রিলায়েন্স ডিফেন্সকে অফসেট অংশীদার করে ৩৬টি রাফাল পুরোপুরি কিনে নেবার চুক্তি করে, যার ফলে এইচ.এ.এল সমস্যায় পড়ে যায়। এরপর, সাধারণভাবে স্বচ্ছল ও লাভজনক সংস্থা এইচ.এ.এল কে কর্মী মাইনে দিতে ব্যাঙ্ক লোন করতে হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ সংসদে বলেন যে সরকার এইচ.এ.এল–এর জন্য ১ লক্ষ কোটির অর্ডারের বন্দোবস্ত করেছে। অথচ এইচ.এ.এল মুখপাত্ররা সেকথা অস্বীকার করে।
প্রতিরক্ষা পণ্য তৈরিতে ভারতীয় বেসরকারি কোম্পানি প্রায় নেই বলা চলে। বিদেশী অর্ডন্যান্স ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচরার (ও.ই.এম)-ই বেশি। ফলে এক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ মানেই গোটা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র বিদেশী কোম্পানির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়া এবং ফলস্বরূপ জাতীয় স্বয়ম্ভরতা হ্রাস। ধর্মঘটের আগে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ.আই.ডি.ই.এফ জানায় যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া‘র নামে সরকার প্রতিরক্ষায় ১০০ শতাংশ এফডিআই এর প্রচলন করছে। এর ফলে সরকারি অর্ডন্যান্স কারখানায় তৈরি হয়ে চলা পণ্যগুলির ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
এসবকিছুর সঙ্গে রয়েছে ঠিকা শ্রমিক প্রথার বাড়বাড়ন্ত। সেনাদের দুধ সরবরাহি ফার্মগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, স্টেশন কর্মশালা ও সেনা ডিপোগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জি.ও.সি.ও (গভর্ন্মেন্ট ওন্ড কর্পোরেট অপারেটেড) মডেলের নামে আটটা সেনা বেস কর্মশালা বেসরকারি উদ্যোগের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যার ফল ভুগছেন প্রায় ১২ হাজার কর্মচ্যুত কর্মী।
প্রতিরক্ষা গবেষণার কাজকর্ম এবং ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডি.আর.ডি.ও)-এর নতুন প্রযুক্তিও বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ডি.আর.ডি.ও–র কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে, চুক্তিভিত্তিক গবেষক নিয়োগ চলছে, যার ফলে কয়েকবছর পর চুক্তিমুক্ত কর্মহীন গবেষকদের মারফৎ সামরিক তথ্য ফাঁস হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ন্যাশনাল পেন্সন সিস্টেম (এনপিএস) এর বিরুদ্ধেও এই ধর্মঘটে কথা তোলা হয়েছে। এই স্কিমের অধীনে কর্মীদের পেন্সন মাত্র ১০০০–২০০০ টাকা, যেখানে ডিফাইন্ড পেন্সন স্কিমে ন্যূনতম পেন্সনের অঙ্কই ৯০০০, তার সঙ্গে রয়েছে দৈনিক ভাতা।
অর্ডন্যান্স কারখানা, জাহাজ ডক, স্টেশন কর্মশালা, সেনা ডিপো – সর্বত্র ধর্মঘটের পূর্ণ সমর্থন মিলেছে। দিল্লী, চেন্নাই, পুনে, জবলপুর, কানপুর, মুম্বই, আগ্রা, কোলকাতা ও অন্যান্য বিচ্ছিন্ন অঞ্চলেও ধর্মঘট সম্পূর্ণ সফল। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সমস্ত সরকারি প্রতিরক্ষা শিল্প।
সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়ে সঙ্ঘ পরিবারের শাখা শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় প্রতিরক্ষা মজদুর সঙ্ঘ এই ধর্মঘটে যোগ দিয়েছে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, দক্ষিণপন্থী ও কর্পোরেটমুখিন রাজনীতির উত্তাল ঢেউ–এর মধ্যে দাঁড়িয়ে এই শ্রমিক ধর্মঘটগুলি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পদক্ষেপের মর্যাদা বহন করে। এই বিশাল প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আজ, আগের চেয়েও অনেক বেশি করে, এদেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ওপর নির্ভরশীল।
লেখক একজন শিক্ষক এবং রাজনৈতিক কর্মী।