আবারও সঙ্গীত হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। তুরস্কের ফোক-রক গ্রুপের বিরুদ্ধে ভীত রাষ্ট্রের সেই একই অস্ত্র – সন্ত্রাসের জুজুর নামে অবদমন।
নীলাঞ্জন দত্ত
যে কোনও রক গ্রুপের যা যা থাকে সবই আছে। গলার কারিকুরি, জমজমাট অর্কেস্ট্রা, আলোর খেলা, ধোঁয়ার ফোয়ারা, আতসবাজী, শ্রোতাদের উদ্দাম সাড়া – মাঝে মাঝে স্বতঃস্ফূর্ত কোরাস, তীব্র শিস আর নাচ। কোথাও তাদের কনসার্টের পোস্টার দেখলেই সাড়া পড়ে যায়, এক একটা অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষের ভিড় হয়, নতুন অ্যালবাম বেরোলে আর পড়তে পায় না। কেবল নিজেদের দেশ তুরস্কে নয়, সারা ইউরোপ জুড়েই তাদের খ্যাতি।
কিন্তু ক’টা রক গ্রুপ আর রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের মত আপ্যায়ন পায়? আপাতত ১১ জন গাইয়ে-বাজিয়ে জেলে, আরও ছ’জনের নামে হুলিয়া বেরিয়ে গেছে – একেক জনের মাথার দাম তিন লক্ষ টার্কিশ লিরা! এই গানের দলের নাম ‘গ্রুপ ইওরুম’। তুর্কি ভাষায় ‘ইওরুম’ মানে ‘মন্তব্য’।
তুরস্কের বহুল-প্রচারিত কামহুরিয়েত পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, যারা জেলে আছেন, তাঁদের একজন, ২২ বছরের দিলান পয়রাজ-এর ক্যান্সারে আক্রান্ত মা জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ের মস্তিস্ক আর ফুসফুসে রক্তবাহী ধমনীগুলিতে ব্লক ধরা পড়েছে। দিলানের বাবা জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসে বলেছেন, তাঁর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসা হচ্ছে না।
সম্প্রতি লন্ডনের দা গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত গ্রুপ ইওরুম সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পরিস্থিতির জন্য তার সদস্যরা যে তৈরি ছিলেন না তা নয়। দমনপীড়ন সহ্য করতে তাঁরা একরকম অভ্যস্তই হয়ে গেছেন। এদের গত ৩৩ বছরের ইতিহাসে বহুবার তাদের ওপর আঘাত নেমে এসেছে। কারণ, তাঁদের গান মানেই প্রতিবাদ – পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, উন্নয়নের নামে গরিবদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে। আর এইসব গান শুনেই খেটে-খাওয়া মানুষরা নাকি ক্ষেপে যায়!
একেক সময় রাষ্ট্রের আক্রমণ তুঙ্গে ওঠে। যেমন উঠেছিল ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে আভ্যন্তরীণ সংকটকে চাপা দিতে। তখন থেকে একাধিক বার গ্রুপ ইওরুমের সংস্কৃতি কেন্দ্রে রেইড হয়েছে, এমনকি বাজনাগুলোও নাকি ভেঙে ভেঙে তার মধ্যে অস্ত্র আর বিস্ফোরকের জন্য ব্যর্থ তল্লাস চলেছে, সদস্যদের ধরপাকড় করা হয়েছে। অনেকেরই কপালে জুটেছে হেফাজতে অত্যাচার। ২০১৭র মে মাসে গ্রেপ্তারের পর বেরগুন ভারান নামে একটি মেয়ের মাথার মাঝখান থেকে চুলগুলো সেই যে গোড়াশুদ্ধ টেনে টেনে উপরানো হয়েছিল, তার চিহ্ন সে আজও বহন করছে।
এক সময় তুর্কি কবি নাজিম হিকমত লিখেছিলেন, “ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না, নিগ্রো ভাই আমার পল রোবসন”। আজ তাঁর স্বদেশে গ্রুপ ইওরুমের গান গাওয়াও নিষিদ্ধ। কোথাও কনসার্টের খবর পেলে লাঠিসোটা, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান নিয়ে ছুটে যায় সাঁজোয়া পুলিশ। তবুও গান বন্ধ হয় না, কীভাবে জানি হঠাৎ হঠাৎ আশ্চর্য আসর বসে মাঠে ময়দানে রাস্তার মোড়ে, এমনকি কোনও বড় বাড়ির ছাদে। গানের সঙ্গে সঙ্গে হাতে হাতে ঝলসে ওঠে একেকটা প্ল্যাকার্ড বা ব্যানার, যা থেকে কখনও উঁকি মারে মার্ক্স-এর মুখ, কখনও বা ১৯৭২-এ শহিদ হওয়া তুরস্কের বিপ্লবী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা মাহির চায়ান-এর। অর্কেস্ট্রা না থাকুক, বাইলামা আর বাঁশির সুরেই লোক জমে যায়।
এই ‘ফোক-রক গ্রুপ’ মনে করে, তারা পীর সুলতান আবদাল-এর উত্তরসূরী। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের তুরস্কের এই চারণকবির অধিকার আর মানবমুক্তির গানগুলো এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে অটোমান শাসকরা ভয় পেয়েছিল, প্রজারা আর তাদের মানবে না। তাই তারা তাঁকে ফাঁসি দেয়। কিন্তু তার পরেও দেশের দিকে দিকে এত ‘পীর সুলতান আবদাল’ জন্ম নিল আর বাইলামা বাজিয়ে মুক্তির গান গেয়েই চলল, যে শাসকরাও বুঝে গেল আর আজকের সঙ্গীত গবেষকরাও স্বীকার করেন, পীর সুলতান আসলে একজন ব্যক্তি নয়, এক পরম্পরা, যাকে হত্যা করা যায় না।
ছয় শতাব্দী পেরিয়েও পীর সুলতান তুরস্কের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একেবারে সামনের সারিতেই রয়ে গেছেন। আর গ্রুপ ইওরুম তাঁর মতই বলে, “গান থামবে না।” তুরস্কে কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু এর মধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় এই নামেই একাধিক বিদ্রোহী ব্যান্ড গড়ে উঠেছে। জার্মানিও তাদের “সন্ত্রাসবাদী” বলে নিষিদ্ধ করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রমাণ দিতে পারেনি। আমেরিকা আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান উঠে পড়ে লেগেছে তাদের “সন্ত্রাসবাদী” তালিকায় ঢোকাতে।
গত সাত বছর এই সময় গ্রুপ ইওরুম ‘মুক্ত তুর্কি’ নাম দিয়ে বিশাল কনসার্টের আয়োজন করেছে। এবছর দমনের মুখে তা করা যায়নি। কিন্তু গান থামেনি। ২৯ এপ্রিল সারা পৃথিবী শুনেছে ইন্টারনেটে ‘অষ্টম মুক্ত তুর্কি লাইভ কনসার্ট’। এখন ইউটিউবে তা শুনতে পাওয়া যাবে:
পার্ট 1:
পার্ট 2: