সমকামী, রূপান্তরকামী, হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রাইড ওয়াক-এর অহঙ্কারী পা ফেলার সাক্ষী থাকল কলকাতা বছরশেষের মুহূর্ত গোনার সময়ে, ২০১৮-এর শেষ রবিবার, ৩০শে ডিসেম্বর। এই বছরের প্রাইড নতুন মাত্রা পায় উদযাপন এবং প্রতিবাদের দ্বৈত মুখরতায়। ধারা ৩৭৭ উঠে যাওয়া ও সমকামিতার উপর থেকে অপরাধের তকমা সরে যাওয়ার আনন্দ ও গর্ব-এর পাশাপাশি ফেটে পড়ল ট্রান্সজেন্ডার বিল-এর বিরূদ্ধে রাগ এবং ক্ষোভ। ছিল ট্রান্স বিলকে কে সাময়িকভাবে আটকে দেওয়ার বিজয়গর্ব। লিখছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
রাজপথের দখল নিয়ে নেওয়া হাজার মানুষ। তথাকথিত মূলস্রোত তাদের গায়ে ছাপ ফেলে দেয় প্রান্তিক বলে। কিন্তু তাদের এই নির্ভীক উদ্যাপন বলে দেয় যে এই বিভেদটা তৈরি করে হাজার বছরের সামাজিক ট্যাবু আর ‘অপর’ করে দেওয়ার মানসিকতা। সমকামী, রূপান্তরকামী, হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রাইড ওয়াক-এর অহঙ্কারী পা ফেলার সাক্ষী থাকল কলকাতা বছরশেষের মুহূর্ত গোনার সময়ে, ২০১৮-এর শেষ রবিবার, ৩০শে ডিসেম্বর। রামধনু পতাকার উত্তাল ঢেউ আর হাজার কন্ঠের সম্মিলিত উচ্ছাস প্রমাণ দিল রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, কোনও কিছুই একজন স্বাধীন মানুষের লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করতে পারে না। তা একান্তই ও সর্বতোভাবেই তার নিজস্ব।
রঙীন বেলুনে সাজা, বিভিন্ন গান ভেসে আসা প্রাইড ওয়াক-এর গাড়ি থেকে শেষ বিকেলের আলোয় যখন দুই তরুণ হাত ধরে সুর মিলিয়ে বলে ওঠেন ‘আই ডোন্ট কেয়ার’ তখন বোঝা যায় সমলিঙ্গের প্রেম ৩৭৭ ধারার শিকল ভেঙে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতেই পেরেছে। যখন কলেজ-পড়ুয়া তরুণী বলেন, “আমি বিষমকামী। কিন্তু আমার লজ্জা লাগছে ভাবতে যে আমার কলেজের অনেক বন্ধুই এলজিবিটিকিউ সম্পর্কে জানে না। আমি আজকের ভিডিও করছি, ওদের নিয়ে গিয়ে দেখাব যে এটা কত স্বাভাবিক বিষয়। আমিই তো আজকে আমার বান্ধবী ও তার প্রেমিকার সঙ্গে এখানে এসেছি। তাতে সমস্যা কোথায়?” – তখন মনে হয় এই একসাথে পথ হাঁটা সফল। যখন সদ্য দশম শ্রেণী পেরোনো কিশোরীরা প্রথম বার প্রাইড ওয়াক-এ এসে নিজেদের গালে এঁকে নেওয়া রামধনু রঙে উজ্জ্বল হয়ে হয়তো বা প্রথমবারের জন্যই বলে – “আমরা বাইসেক্সুয়াল। কিন্তু আমাদের স্কুলে এ কথা বলা বা ভাবা অসম্ভব। আমাদের স্কুলে তো হাতও ধরতে দেয় না। সমকামিতা নিয়ে কোনও অ্যাওয়ারনেস-ই নেই। আমাদের কোনও বন্ধুও জানে না আমাদের বিষয়ে। কিন্তু জানেন তো, খুব মনে হয় এগুলো নিয়ে কথা বলা দরকার, সচেতন করা দরকার স্কুল লেভেল-এই,” – তখন তার সঙ্গে মিলে যায় কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়া ক্যুয়ার তরুণীর কন্ঠ, যিনি বলেন, “আমার যৌনতা আমার নিজস্ব বিষয়, আমি মনে করি না সেটা নিয়ে আমাকে সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিন্তু স্কুল, কলেক স্তরে সেক্স এডুকেশন ও জেন্ডার সচেতনতা তৈরি করা ভীষণ জরুরি।”
কলকাতা শহরের প্রাণকেন্দ্রে যখন নিজেদের লিঙ্গ পরিচিতি ও যৌন পরিচিতির পর্দা সরিয়ে পোশাক ও প্রসাধনে অভিনবত্ব এনে – হ্যাঁ কিছুটা চমকে দিয়েই – পথচলতি মানুষদের অবাক দৃষ্টির সামনে কুন্ঠাহীন এই মিছিল চলছিল তখন সেখানে মিশে ছিল অনেক সমর্থনও। কোনও পথচারীকে যখন জিজ্ঞেস করা হল জানেন কি এটা কিসের মিছিল, উত্তর এল – “হ্যাঁ। প্রাইড তো। যতদূর জানি ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের নিয়েই তো এই মিছিল। এটা তো খুব জরুরি বিষয়। সকলেরই উচিত তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া। আমাদের মধ্যে তো কোনও তফাৎ নেই।” তথ্যে হয়তো কিছু খামতি ছিল, তবু আশা জাগে যে আন্দোলনের পাশে থাকেন সহ-নাগরিকেরাও। ভরসা জাগে যখন সঙ্গে থাকা সন্তানকে এ বিষয়ে জানাবেন কি না জানতে চাওয়ায় বলেন, “:অবশ্যই। জানতে তো হবেই। না জানলে বৈষম্য কমবে কীভাবে!” অপর আরেক পথচারী যেমন বললেন তিনি ৩৭৭ উঠে যাওয়া সম্পর্কে জানলেও ট্রান্সজেন্ডার বিল নিয়ে জানেন না, তবে এটুকু বললেন যে প্রত্যেকের জীবন তার নিজস্ব, সেখানে সরকারের খবরদারি অর্থহীন।
কলকাতা প্রাইড ওয়াক যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল বেশ কয়েক জন অভিভাবকের অংশগ্রহণে। প্রথমবার এই মিছিলে অংশ নেওয়া এক অভিভাবক যেমন বললেন, “আমি অত কূটকচালী বুঝি না। আমি জানি কে কাকে ভালবাসবে, কে নিজেকে কি বলবে সেটা তার উপরেই ছেড়ে দিতে হবে। অন্য কেউ কেন বলবে? সবাই নিজেদের জীবন নিজেরা বাঁচুক।” প্রতিবেশী, আত্মীয়দের প্রশ্ন সামলাবেন কীভাবে? বললেন, “সে তো সবাই নানা কথা বলবেই। আমার কিছুই যায় আসে না। আমি তো তাদের থামাতে পারব না। আমি জানি আমি কী করছি। আমি আশা করি তাদেরও সময় লাগলেও বুঝবে কোনও না কোনও দিন।” এমন অভিভাবকও ছিলেন যিনি স্বীকার করলেন যে শুরুতে সন্তানের ক্যুয়ার সত্ত্বা তিনি মেনে নিতে পারেননি, অস্বস্তিতে পড়েছেন। কিন্তু যত নিজের সন্তানকে জেনেছেন, এর আগেও প্রাইড ওয়াক-এ অংশ নিয়ে রূপান্তরকামী, সমকামী মানুষদের দেখেছেন তত বিষয়টির স্বাভাবিকতা উপলব্ধি করেছেন। সাহস পেয়েছেন, অনেকটা ভরসাও।
এ বছরের প্রাইড ওয়াক অবশ্যই শুধু উদ্যাপনের নয়, প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠারও। একদিকে যেমন ধারা ৩৭৭ উঠে যাওয়া ও সমকামিতার উপর থেকে অপরাধের তকমা সরে যাওয়ার আনন্দ ও গর্ব, পাশাপাশি রূপান্তরকামীদের অধিকার-বিরোধী ট্রান্সজেন্ডার বিল-এর বিরূদ্ধে চলতে থাকা লাগাতার আন্দোলন। যখন হিজড়া সম্প্রদায়ের কয়েক জন মানুষ মিছিলে হাঁটতে হাঁটতেই বলেন, “আমরা হাঁটছি মোদীর বিরূদ্ধে। আপনারাও সবাই বলুন। উনি যা করছেন সবটাই ভুল,” তখন বোঝা যায় রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব নেই।
এই মিছিলে তাই অধিকার ও নিজস্ব পরিচিতির চিৎকার আছড়ে পড়ে ‘উই উইল উই উইল রক ইউ’ গানের সুরে, আবার পাশাপাশি গণতন্ত্রের সোচ্চার কন্ঠ শোনা যায় ‘গাঁও ছোড়াব নাহি, জঙ্গল ছোড়াব নাহি’ গানে। আসলে লড়াইগুলো যে সবই এক – অধিকারের, সম্মানের, জীবনের। তাই ফুটপাথের চা-দোকানের দোকানী বলেন, “এই মিছিলটা প্রতি বছর হয় দিদি। আমরা দেখেছি আগেও। খুব ভালো হয়। এই মানুষগুলোরও তো কাজ দরকার। ওদের দেখে সবাই কেন হাসবে? এই মিছিলটা হওয়া দরকার।”
প্রতিবাদের সামনে স্থগিত হল ট্রান্সজেন্ডার প্রোটেকশন অফ রাইটস্ বিল, ২০১৬
“আওয়াজ দো হম এক হ্যায়” – নিশ্চিত এই আওয়াজ, এই বহুকন্ঠের স্লোগান ২০১৮-এর শেষভাগে, ২৮শে ডিসেম্বর পৌঁছে গেছিল দেশের রাজধানী দিল্লি থেকে দেশের নানাপ্রান্তে যখন ট্রান্সজেন্ডার প্রোটেকশন অফ রাইটস্, ২০১৮ বিল-এর বিরোধিতায় যন্তর-মন্তর-এর সামনে জমায়েত করেছিলেন দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে জড়ো হওয়া রূপান্তরকামী, হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা, ক্যুয়ার আন্দোলনে শামিল ব্যক্তি ও সংগঠন। সারা দেশের মতোই কলকাতাতেও ২৮ তারিখ একটি জমায়েতের আয়োজন করা হয় দক্ষিণ কলকাতার এক ব্যস্ত মোড়ে। শুধু এই বিলটিই নয়, ট্র্যাফিকিং অফ পার্সনস বিল ২০১৮, সারোগেসি (রেগুলেশন) বিল ২০১৮-এর বিরোধিতায় এই জমায়েতে সামিল হয়েছিলেন বিভিন্ন রূপান্তরকামী মানুষ, শিক্ষার্থী সংগঠন, গোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠন, গণ সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও ব্যক্তিরা।
এই দিন সারা দেশ জুড়ে যে প্রবল প্রতিরোধের প্রধিনিধিত্ব দিল্লিতে দেখা যায় তার চাপের মুখে আপাতত সংসদে এই বিলটি স্থগিত রাখা হয়েছে, চলতি অধিবেশনে রাজ্যসভায় তা পেশ হচ্ছে না, অর্থাৎ বিলটি নিয়ে আরও কিছু আলোচনার পরিসর তৈরি হল। কলকাতার জমায়েতেও বারবারই বিভিন্ন বক্তার বক্তব্যে উঠে আসে কীভাবে ট্রান্সজেন্ডার বিল মানুষের মৌলিক অধিকার বিঘ্নিত করছে, কীভাবে এই তিনটি বিল মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করে তাকে রাষ্ট্রনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আটকে ফেলতে চাইছে ও নজরদারির মধ্যে রাখতে চাইছে। এই জমায়েতের বিভিন্ন শ্লোগান থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় ‘মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী, মুসলিমবিরোধী, শ্রমিক,কৃষকদের স্বার্থবিরোধী’ সরকারের কাছে নতিস্বীকার করতে কোনওভাবেই রাজি নয় দেশের এক বিরাট অংশ। ভোট রাজনীতিকে সামনে রেখে পরপর বিল পাশ করে বর্তমান কেন্দ্র সরকার এক ধরনের খেলা খেলছে বলেই তারা মনে করছে। এ ধরনের অগণতান্ত্রিক বিল-এর বিরূদ্ধে পথে নেমে সবরকম ভাবে প্রতিরোধ তৈরি করা হবে বলেই জনমত তৈরি হয়। রূপান্তরকামী, হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের অধিকারকে মানবাধিকারের মান্যতা দিয়ে লড়াই চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবী উঠে আসে। এই জমায়েত স্পষ্ট করে দেয় এই তিনটি বিল কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন নীতির বিরূদ্ধে দেশের নাগরিকদের গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার লড়াই, প্রান্তিক মানুষদের লড়াইটি আসলে এক যোগসূত্রে বাঁধা।
রূপান্তরকামীদের কাফে, জেন্ডার মেলায়, রেনবো কার্নিভাল-এ সমতার বার্তা বছরভর
২০১৮ সালটি রূপান্তরকামী মানুষদের সমতার লড়াইতে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। কারণ বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে তাদের জীবন, জীবিকা ও সমাজের সব স্তরে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলতেই থেকেছে। এর মধ্যে যেমন উল্লেখযোগ্য হল কলকাতার সোনাগাছি যৌনপল্লী এলাকায় আনন্দম ও দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে তৈরি হওয়া একটি পপ-আপ কাফে-র উদ্যোগ। কোনও নির্দিষ্ট দিন নয়, দু’-তিন মাসে এরকম অস্থায়ী পপ-আপ কাফে-র আয়োজন করছে তারা গত বছর দুই ধরে। এখন থেকে এটিকে আরও বেশি নিয়মিত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই কাফে-তে স্থানীয় রূপান্তরকামী মানুষেরাই খাবারের পদ তৈরি করে নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করছেন। রূপান্তরকামী মানুষেরা নাচ, গানে অংশগ্রহণও করছেন। শুধু এই সম্প্রদায়ই নয়, অন্যেরাও এতে যোগ দিতে আসছেন। আনন্দম-এর সেক্রেটারি সিন্টু বাগুই যেমন বলেছিলেন – “আমরা এই কাফের উদ্যোগকে আরও নিয়মিত করব ভবিষ্যতে। এটি এক্সক্লুসিভলি ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের দ্বারা তাদের জন্যই হবে। অন্য কোনও কাফে চাইলে তাদের সাথে কোলাবোরেটও করতে পারি। এটা তো বাস্তব যে আমাদের মতো রূপান্তরকামী মানুষেরা চাইলেও ও টাকা থাকলেও বাইরের কাফে-তে অনেক সময়েই যেতে পারেন না আমাদের পোশাক দেখে পাঁচ জন যেভাবে ব্যবহার করেন তার অস্বস্তিতে। তাই এই কাফে।”
এখানে আসা অনেকেই যেমন বলেছিলেন এই কাফে-তে তারা নিজেদের মতো করে আনন্দ করতে পারছেন। অন্যদের জন্য অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে না। নিজেদের দক্ষতা মতো নাচ, গানও করছেন। তথাকথিত জনপ্রিয় বা চলতি কফিপশে অনেক সময়েই যেন তাদের নিজেদের ভিনগ্রহের প্রাণী মনে হয় অন্যদের অবাক দৃষ্টির সামনে। আপত্তিজনক বক্তব্য বা ব্যবহারের সামনেও পড়তে হয়। তারা নিজেরাও যেন অস্বস্তিতে থাকেন। এধরনের নির্দিষ্ট কাফে থাকলে তারাও নিশ্চিন্তে খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ করতে, আড্ডা দিতে পারেন মন খুলে এমনটাই মত ছিল তাদের। শহরের কলেজ পড়ুয়ারা জানিয়েছিলেন, শহরের অধিকাংশ কফিশপেই এই শ্রেণীবৈষম্য চোখে পড়ে। খাবারের মেনুতে দামও অনেক সময়ে সকলের সাধ্যের মধ্যে থাকে না। রূপান্তরকামীদের এই পপ-আপ কাফে, যৌনপল্লী এলাকায় উদাহরণ তৈরি করার মতোই। এরফলে অনেক সামাজিক ট্যাবু একসঙ্গে ধাক্কা খাবে ও এই গোষ্ঠীর লড়াই ও কথা অনেক বেশি দৃশ্যমান হবে। আরও বেশি এই পপ-আপ কাফে হওয়া দরকার।
এই বছরের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয়েছিল ইস্পাত জেন্ডার মেলা, যার সহযোগিতায় ছিল আনন্দম। এখানে স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র, রূপান্তরকামী মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনাসভা ও রূপান্তরকামী মানুষদের তৈরি হাতের কাজের সামগ্রীর স্টল, ফেস পেইন্টিং ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল, যার উদ্দেশ্য লিঙ্গ সমতা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই জেন্ডার মেলায় উল্লেখযোগ্যভাবে অংশগ্রহণের উৎসাহ দেখা গিয়েছিল। স্টল থেকে জিনিসপত্রের বিক্রিও ছিল চোখে পড়ার মতো। আনন্দম-এর পক্ষ থেকে ডঃ সোমা রায় যেমন বলেছিলেন, “প্রান্তিকতা তো আসলে সমাজই তৈরি করে দেয়। এই জেন্ডার মেলা দিয়ে অন্তত এটা প্রমাণ করা যায় যে সুযোগ পেলে লিঙ্গ পরিচয়ে প্রান্তিক মানুষগুলিও নিজেদের দক্ষতা দিয়ে, নিজেদের কথা বলে একইভাবে তথাকথিত মূলস্রোতের অংশ হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও এই মানুষগুলির মধ্যে জেন্ডার মেলার মতো উদ্যোগ দিয়েই মেলবন্ধন তৈরি হতে পারে।”
আবার জেন্ডার স্টিরিওটাইপ ভাঙতে গিয়ে তার মধ্যেই আটকে পড়া থেকে বাঁচার পরামর্শ ছিল প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট-এর অনিন্দ্য হাজরার কথায়। এই উদ্যোগের প্রশংসা করেই তিনি বলেছিলেন, “বৃহত্তরভাবে জেন্ডারটা যদি একটা নিগড় হয় ও সেই নিগড় ভাঙার গল্প যদি আমরা বলি তাহলে সার্বিকভাবেই তা ভাঙার একটা প্রয়াস থাকতে হবে। জেন্ডার বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট রূপককে দেখা ও তার কয়েকটি সোজা-সাপ্টা উত্তর খোঁজার চেষ্টা থেকে বেরোনোরও বোধহয় এখন সময় এসেছে। ছাঁচভাঙার গল্পটাই যদি জেন্ডার-এর গল্প হয়, তাহলে রূপান্তরকামী মানেই কোনও নির্দিষ্ট ছাঁচ – এমন ভাবনাকেও প্রশ্ন করতে হবে। কারণ এর থেকেও নতুন বাইনারি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।”
২০১৯-এর প্রথম সপ্তাহেই কলকাতায় অনুষ্ঠিত হবে রেইনবো কার্নিভাল। নানা অনুষ্ঠান, সাহিত্য সভা ইত্যাদিতে চলবে সচেতনতা তৈরির অবিরাম প্রয়াস। তবে ২০১৮-এর বিভিন্ন ভাবে সমকামী, রূপান্তরকামী, হিজড়া, ক্যুয়ার মানুষদের আন্দোলন মূলস্রোত আর প্রান্তিক বিভাজন মুছে এক বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেছে।
সুদর্শনা চক্রবর্তী ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক। ছবি: লেখক।