ঝো”ড়োবস্তির মাঠেই চুলে বাহারি ছাঁট দেওয়া, হাতে আধুনিক মোবাইল কিশোরেরা অবশ্য স্বীকার করে নিল মা-কে ছাড়া বাড়ি অচল। একযোগে বলে উঠল – মা-ই তো ‘হিরো’। কিন্তু এই ‘হিরো’ হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়েও যে মা-দের, মহিলাদের লিঙ্গনির্দিষ্ট কাজের ঘেরাটোপে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, পরিশ্রমের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সময়ের হাত ধরে বুঝছে তারা।” বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে খেলার মাঠে মেয়েদের পা দেওয়া ও পুরুষদেরও সেই কাজে সঙ্গে নেওয়া – খেলাধুলার মাধ্যমে লিঙ্গ সমতা আনার অভিনব এক প্রচেষ্টার কথা লিখছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
ঘটনা ১: সদ্য শেষ হয়েছে ফুটবল ম্যাচ। দু’ দলের খেলোয়াড়রাই খানিক বিশ্রাম নিচ্ছেন। কথা বলতে বলতেই উঠে এল – “পাড়া প্রতিবেশীরা অনেক সময়েই নানা কথা বলে। মেয়েদের ফুটবল খেলা ভালো নয়। কেউ বিয়ে করবে না এইসব…,” এক রাগী কিশোরী ফুটবলারের কন্ঠ ভেসে এল, “বলতে দে। দেখবি যখন আমাদেরই কেউ ইন্ডিয়া লেভেলে খেলবে তখন এরাই অন্য কথা বলবে।”
ঘটনা ২: যতক্ষণ পর্যন্ত কিশোরী মেয়েটি টেবিল টেনিস র্যাকেটে বলটি নাচাচ্ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত তার সমবয়সী কিশোরেরা চিৎকার করে উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছিল। নানারকম খেলার প্রতিযোগিতা হচ্ছিল পাড়ার মাঠে। কে কতক্ষণ র্যাকেটে বল নাচাতে পারে, এই ছিল খেলা। শুধু মেয়েদের জন্য। উৎসাহ দেওয়া, নানা মন্তব্য করে তাতিয়ে দেওয়া, সবেতেই অংশ নিচ্ছিলেন পাড়ার বিভিন্ন বয়সের কিশোর ও পুরুষেরা। সন্ধ্যাবেলার ‘টাইম কল’-এর জল আনতে চলে যাওয়া মেয়েটিকে ডেকেও আনছিল। নিজেদের মধ্যে গল্প করতে থাকা ক’জন কিশোরের কাছে জানতে চাইলে তারা জানাল কয়েক জন পরিবারে মায়ের কাজে সাহায্য করলেও, অনেকেই করে না। কারণ পারে না। বেশিরভাগের বাবা-ই বাইরে যান কাজ করতে। অনেকের মায়েরাও নানা জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। অধিকাংশ কিশোরই স্বীকার করল মা-কেই মূলত বাড়ির সব কাজ সামলাতে হয়, তিনি বাইরের কাজ করলেও।
দক্ষিণ কলকাতার টলিগঞ্জ এলাকার ঝোড়োবস্তি অঞ্চলে চলছিল “জেন্ডার মেলা” – যার ট্যাগলাইন ছিল ‘লিঙ্গ সমতার পথে নারী পুরুষ একসাথে’। উদ্যোগটি ছিল ফেম-এর। মোট ১৬টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা একসঙ্গে হয়ে তৈরি হয়েছে একটি মঞ্চ – ফোরাম টু এনগেজ মেন/ফেম; উদ্দেশ্য – পুরুষদের সমতার সাথী হিসাবে তৈরি করা। সেদিনের জেন্ডার মেলায় বার্তা দেওয়া চলছিল ‘পুরুষদের উপরেও থাক শিশুদের যত্নের ভার’। মহিলাদের বল-এর ব্যালান্স, পুরুষদের জামাকাপড় ভাঁজ করা এবং একজন মহিলা ও একজন পুরুষের জুটিতে একটি শিশুকে সবচেয়ে কম সময়ে স্কুলের জন্য তৈরি করে দেওয়া – এই তিন খেলার মধ্যে দিয়েই বাড়ির কাজে নারী ও পুরুষের সমান থাকার কথা বলা চলছিল খেলার মাঠে ভিড় করা সকলের সামনে।
কলকাতা সংলগ্ন নিউ টাউন এলাকা আপাতত ‘পরিকল্পিত শহর’ বা প্ল্যানড সিটি। তবে সেই চেনা শহরের মধ্যেই থাকে মহম্মদপুরের মতো আধা শহর, আধা গ্রাম এলাকা। শীতের পড়ন্ত রোদ গায়ে মেখে তুমুল উৎসাহে ঘাম ঝরিয়ে ফুটবল খেলছিল দু’টি দল। দু’টিই মেয়েদের দল। একটি স্থানীয় মেয়েদের, অপরটি পার্শ্ববর্তী একটি মেয়েদের স্কুল-এর। ভিড় উপচে পড়ছিল মাঠে। মাথায় ঘোমটা টানা তরুণী গৃহবধূ, মাঝবয়সী মায়েরা, কিশোরী, বয়স্ক মহিলারা এবং নানা বয়সের পুরুষ ছিলেন দর্শক। তার আগে খেলা হয়েছে দড়ি টানাটানি ও কাবাডি। সবগুলিই মহিলাদের।
এই উদ্যোগ টু ওয়ার্ডস ফিউচার সংস্থার। যাদের নানা রকম সামাজিক উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম একটি হল প্রতি বছর এই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করা ও এর মধ্যে দিয়ে মেয়ে ও মহিলাদের সামাজিক ট্যাবু কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসা, ও সমানাধিকার বিষয়ে সকলের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।
লিঙ্গ সমতা বিষয়টি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটা সহজ নয় সকলের কাছে বিষয়টি তুলে ধরা। বিশেষত বৃহত্তর পরিসরে হয়তো এ প্রসঙ্গে কথা বলা তুলনামূলকভাবে সহজ, কিন্তু বাড়ির ভেতরে বা পরিবারের মধ্যে কীভাবে লিঙ্গবৈষম্য জড়িয়ে থাকে এবং সমাজ কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, তা সকলের বোঝার মত করে বলাটা কঠিন। ঠিক এই জায়গাতেই কাজে আসছে বিভিন্ন খেলা। শুনতে অবাক লাগলেও লিঙ্গ সমতার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলা আজকাল ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং এই বিষয়ে কাজ করছেন যাঁরা তাঁরাও নিত্যনতুন খেলা তৈরি করে বিভিন্ন পরিসরে লিঙ্গ সমতার প্রয়োজনীয়তা, লিঙ্গ বৈষম্য কোথায় কীভাবে লুকিয়ে থাকে ও কেন তা দূর করা দরকার – এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা চালাতে পারছেন, সচেতনতা তৈরি করতে পারছেন।
খেলার মাঠে প্রতিযোগীরা ছাড়াও যারা উপস্থিত থাকছেন দর্শক হিসাবে, উৎসাহ দিচ্ছেন মেয়েদের, মহিলাদের, তাদের সঙ্গে কথা বললেই যেমন অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায় ছেলে ও মেয়ের সমান অধিকার বিষয়ে প্রচলিত চিন্তা কোথায় রয়েছে, বা যারা এই চেনা ছক ভাঙতে চাইছেন তারাও কেন এমনটি ভাবছেন।
ঝোড়োবস্তির মাঠে যেমন হাজির ছিলেন বেশ কিছু প্রৌঢ়া, বয়স্ক নারী। তাঁদের মধ্যে কয়েক জনের মেয়েদের খেলাধূলা করা না-পসন্দ। তাঁরা এটিই মনে করেন বাড়ির সব কাজ মেয়েদেরই করা উচিৎ, বাড়ির ছেলেদের নয়। নিজেদের গোটা জীবন পুরুষতন্ত্রের পরিচিত গন্ডীর মধ্যে কাটিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের নিজস্ব ভাবনাগুলিও সেইভাবেই গড়ে উঠেছে। খুব সহজ নয় তাতে চিড় ধরানো। অবশ্য নিজের জীবন দিয়েই অন্যরকম বুঝেছেন প্রৌঢ়া মন্দা দলুই। বৃদ্ধ বয়সে মেয়েই তাঁর আশ্রয়। বললেন, “নিশ্চয়ই ছেলে আর মেয়েকে সমান কাজ করতে হবে সংসারে। আমার মেয়েও তো বাইরে কাজ করে। জামাইও করে। জামাইকে তো ও ব’লে ব’লে বাড়ির কাজ করায়। না হলে চলবে কেন?”
আবার বিবাহিত তরুণীদের মধ্যে পাওয়া গেল ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য। ছ’ বছরের বিবাহিত জীবন মঞ্জুশ্রী হালদারের। জানালেন তাঁর স্বামী খুব কিছু ঘরের কাজ না পারলেও, রান্না করতে পারেন। তাতেও কিছুটা সাহায্য হয়। সুনীতা পুরকাইত আবার জানালেন তিনি শুধুই সন্তান সামলান, বাড়ির অধিকাংশ কাজই স্বামী করেন। তাঁর স্বামী পেশায় গাড়িচালক। তবে বাড়ির কাজ কিছু না বলতেই সেরে ফেলেন। পাঞ্চালী মাইতি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সন্তানের জন্মের কারণে ছুটিতে। তাঁর স্বামীও প্রাইভেট কোম্পানীতে কর্মরত। বাড়ির সমস্ত কাজ একা হাতে সামলান পাঞ্চালী। স্বামী বারণ করলেও তিনি স্বেচ্ছায় করেন। কেন জানতে চাইলে বললেন, “সংসারে তো অ্যাডজাস্ট করাটাই আসল। কে কখন কী করবে তার জন্য বসে না থেকে নিজে করে নিলেই তো হল। আমার স্বামী করতে চাইলেও আমিই সব করে নিই।”এর থেকে সম্ভবত বোঝা যায় যে, প্রথম থেকেই মেয়েদের মধ্যে কাজের লিঙ্গনির্দিষ্ট ভূমিকা তৈরি করে দিলে তারা নিজেরাই তা থেকে বেরোতে পারেন না।
মহম্মদপুরের গ্রামে যারা খেলা দেখতে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যেও উৎসাহ ছিল অনেক। তবে ঘরের গন্ডী পেরিয়ে মাঠে এসে সকলের সঙ্গে খেলা দেখার বিস্ময় ও আড়ষ্টতাও ছিল। মেয়েদের ফুটবল খেলা উচিৎ কি না প্রশ্নের জবাবে কোনও মহিলা যেমন বললেন, “নিশ্চয় উচিৎ। ব্যাটাছেলেরা খেললে, মেয়েরাও খেলবে না কেন?” তেমনি কেউ আবার ঘোর আপত্তি তুলে বললেন, “আপনিই বলেন না, এসব কি মেয়েদের কাজ? একদমই ঠিক নয়।” আসলে জীবন থেকে যিনি যেমনভাবে শিক্ষা নেন। কেউ যেমন ঐতিহ্য, সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা-নিষেধের সীমারেখা পেরোতে পারেন না, তেমনি শুধুমাত্র মহিলা হওয়ার কারণে নিজেদের অধিকার, শখ, ইচ্ছে থেকে বঞ্চিত হওয়া বহু মানুষ পরবর্তী প্রজন্মের মেয়েদের মধ্যে স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা দেখলে পরম উৎসাহে পাশে থাকতে চান।
খেলার মাঠটা কখন যেন একটা খোলা আকাশ হয়ে ওঠে। বাড়ির দরজা খুলে দর্শক হিসাবে বা প্রতিযোগী হিসাবে সেই মাঠে পা দিলেই যেন মনে হয় নিজেদের অস্তিত্বটা সকলের সামনে স্পষ্ট করা গেল। আবার কতরকম খেলার মধ্যে দিয়েই বলে দেওয়া যায় বাড়ির ভেতরের কাজগুলোর মধ্যে বহু যুগ ধরে চলে আসা বৈষম্য কেমন গেঁড়ে বসেছে আমাদের মধ্যে, আর একদম খেলাচ্ছলেই আমরা চাইলেই তা দূর করে দেওয়া যায়। রোজকার গৃহকাজের বোঝা সরিয়ে যখন মেয়েরা, মহিলারা নাম দেন দড়ি টানাটানি, কাবাডি বা টেবিল টেনিস র্যাকেটে বল নাচানোর খেলায় তখন তার মধ্যে অনেকখানি জেদ লুকিয়ে থাকে – খেলার মাঠে দুপুর, বিকেল, সকাল শুধু পুরুষদের দাপিয়ে বেড়ানোরই অধিকার নেই, নিজেদের ইচ্ছেমতো খেলায় শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষমতা প্রকাশ করতে পারেন যেকোনও বয়সের মহিলারাই।
মহম্মদপুরের মাঠে খেলায় অংশ নেওয়া স্থানীয় গ্রামের সপ্তম থেকে দশম শ্রেণীর পড়ুয়া কিশোরী পরভীনা, স্নেহা, রিয়াস্মিনা, রুনা, কাশ্মিরা, তুহিনা, আরমিনা, রানিয়া, মমেনা, হেনা, ঈশিতা, রিমি, শাবানা–রা যেমন প্রথমবার পায়ে বল ছোঁয়াল। দেড় মাসের প্রশিক্ষণে তারা খুঁজে পেয়েছে স্বাধীনতার এক অন্য মানে। এক ম্যাচে যা থামাতে চায় না তারা, প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে চায়। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলাও যে তাদের নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করতে পারে, বুঝতে পারছে তারা। পরিবার বেশিরভাগেরই পাশে থাকলেও মূল সমস্যা তৈরি হয় পিতৃতান্ত্রিক, গোঁড়া মানসিকতার সমাজ ও প্রতিবেশীদের তরফ থেকেই, একবাক্যে স্বীকার করল সকলেই। “আমাদের বলে ছোট প্যান্ট পরে কেন খেলবে? (শর্টস-এর নীচে লেগিংস পরে খেলেছে তারা) মেয়েদের এসব করা উচিত নয়। হাত, পা ভেঙে যাবে। ফুটবল ছেলেদের খেলা…,” বলে চলেছিল তারা। আর বলে না যে বিয়ে হবে না? “ও বাবা, সে তো সব সময়ে বলে। বিয়ে না হলে না হবে। কি হবে বিয়ে না হলে? আমরা লেখাপড়া করব, চাকরি করব আর খেলাও চালিয়ে যাব,” বলে ওঠে জোরালো এক কিশোরী গলা। কারওর বোন রয়েছে ফুটবল দলে, কারওর মেয়ে। কথা বলতে গিয়ে বারবারই মনে হচ্ছিল একটা রাগ চেপে রাখেন তারা এই সমাজের প্রতি, যে সমাজ শুধু মেয়ে বলে স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় শিকল পরায়। তাই পরভীনা, রিমি, শাবানা ফুটবলে শট মারলে তারা যেন একসঙ্গে বলে ওঠেন, “সব সময়ে বলে ছেলেদের খেলা, ছেলেদের কাজ। মোটেই না। ছেলেরা যা পারে, মেয়েরাও তা একইরকম পারে। বিয়েটাই মেয়েদের জীবনে সব নয়। পড়াশোনা, ফুটবল এসবকিছু আমরাও পারি।” যাত্রাগাছি স্কুল দলের ফুটবলার মেয়ে সীমা, রিয়া, প্রিয়াঙ্কা, প্রীতি সকলেই এখন পুরোদস্তুর ফুটবলের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন পেশাদার ফুটবলার হওয়ার জন্য। বাধা এসেছে তাদের সামনেও, কিন্তু খেলার প্রতি অদম্য ভালবাসা আর জেদ সব উড়িয়ে দিয়েছে। তবে তাদেরও বক্তব্য পরিবারে মা-বাবা-দাদা-দিদিরা পাশেই থাকতে চান। কিন্তু রক্ষণশীল, লিঙ্গ সমতায় বিশ্বাস না করা সমাজ থেকেই আসে প্রথম বাধা। অবশ্য তারা জানিয়ে দিল প্রয়োজন হলে মহম্মদপুরের ফুটবলার কিশোরীদের পাশে থাকবে তারা। সমাজে লিঙ্গবৈষম্য দূর করায় ফুটবল হাতিয়ার হতে পারে – এটাই বিশ্বাস তাদের।
ঝোড়োবস্তির মাঠে যখন পুরুষদের জামাকাপড় ভাঁজ করার খেলা চলছিল, হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছিলেন পাড়ার সব মহিলারা। কোনও খেলোয়াড়কে দেখে বলছেন, “ও পারবে, বাড়িতে তো বৌয়ের কাজে সাহায্য করে,” আবার কাওকে দেখে বক্তব্য, “মোটেই পারবে না। বাড়িতে তো কোনও কাজই করে না।” তবে সব বয়সের পুরুষেরাই লজ্জা, অস্বস্তি না রেখে খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। এরমধ্যে কেউ কেউ রয়েছেন যারা ‘সমতার সাথী’ অর্থাৎ যারা লিঙ্গ সমতার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে বাড়ির কাজে মহিলাদের সাহায্য করেন, ঘরোয়া কাজে নারী-পুরুষের বিভেদ করেন না, বা নিজের সন্তান অথবা ভাইবোনেদেরও তেমনি শিক্ষা দেন। তাদের দেখে অনেক কিশোর, তরুণও এই খেলায় নাম দিয়েছিলেন। কেউ যেমন বললেন, “বুঝতে পারলাম যে কাজগুলোকে আমরা ভাবি খুব সোজা, সেগুলো করতেও কত পরিশ্রম লাগে। মন দিয়ে করতে হয়। এখন থেকে মা-কে সাহায্য করব।” কারওর স্ত্রী আবার দর্শকদের মধ্যে বসে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। লাজুক হেসে পুরুষটি বললেন, “বাড়িতে আমি আর বৌ তো ভাগ করে কাজ করি। সব কাজ ও একা করবে কেন? তাই আমিও কিছু কাজ শিখে গেছি।”
নারী, পুরুষ জুটিতে যখন শিশুকে তৈরি করে স্কুলে পাঠানোর খেলাটি চলছিল তখনই বোঝা যাচ্ছিল বাড়ির কাজে মহিলাদেরই প্রথম থেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে যতটা দ্রুত ও নিখুঁত করে দেওয়া হয়, পুরুষেরা ততটা নন। যেভাবে মহিলা খেলোয়াড়ের হাত চলছিল শিশুকে তৈরি করায়, সঙ্গী পুরুষেরা যেন পেরে উঠছিলেন না। এই দোষ হয়তো পুরোপুরি তাদের একার নয়। কারণ একটি পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শৈশব থেকেই তাদের শিখিয়ে দেওয়া হয় বাড়ির কাজগুলি তাদের নয়, যার মধ্যে সন্তান প্রতিপালনও একটি। অথচ শুধু মা নয়, বাবা হিসাবে দায়িত্ব তাদের উপরেও বর্তায়। এই কথাটিই কত সহজে নিছক খেলার মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন উদ্যোক্তারা। কোনও দম্পতি যেমন খেলায় অংশ নিয়ে জানালেন তারা যেহেতু নিজেদের সন্তানদের এভাবেই প্রতিদিন একসাথে তৈরি করেন, তাই খেলার মজাটা বুঝেছেন, তেমনি অনেক প্রতিবেশী বন্ধু যারা জুটি বেঁধেছিলেন, তাদের মধ্যে অংশগ্রহণকারী পুরুষেরা জানালেন শিশুদের যত্ন নেওয়া যে কত কঠিন ও তাদের স্কুলের জন্য তৈরি করার মতো আপাত সহজ কাজেও মহিলাদের কতটা শ্রম দিতে হয় বুঝতে পারছেন তারা। নিজেরা প্রয়োজনে এই কাজে সাহায্য করবেন বলেও জানালেন, বাড়ির কাজ শেখার চেষ্টা করবেন।
অনেক মহিলা স্বীকার করলেন, তারা বাড়িতে ছেলেমেয়ের কাজের মধ্যে তফাৎ নেই মনে করলেও, তাদের স্বামীরা করেন। যেমন কয়েক জন কিশোর বললেন বাড়িতে জামাকাপড় গোছানো, রান্না করা, জল তোলা এগুলো তো মায়ের কাজ! বহু বছর ধরে মাথার মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা এই ভাবনাগুলো সরানোর জন্য সম্ভবত খেলতে খেলতে শেখানোটাই কার্যকরী উপায় হতে পারে।
সেখানেই মহম্মদপুরে এমন পুরুষদেরও দেখা মিলল যারা বাড়ির কিশোরীকে উৎসাহ দিয়ে ফুটবল দলে পাঠাচ্ছেন, মাঠ ঠিক করছেন যাতে তারা খেলতে পারে। আবার এ কথাও বলছেন, “পড়াশোনা যতদূর করতে চায় করাতে পারি। কিন্তু খেলাধূলা বেশি করাতে পারব না। লোকজন কী বলবে? বিয়েও তো দিতে হবে। মেয়ের বিয়ে হলে বাবার মাথা থেকে চিন্তা দূর হবে।” তাদেরই গ্রামের কিশোরী ফুটবলার অবশ্য দৃঢ় গলায় জানিয়ে দিয়েছে, “মেয়েরা বিয়ের আগে বাবার আর বিয়ের পর বরের কথা শুনে চলে। কেন? আমাদের নিজেদের কথা আমরা নিজেরাই বলব। নিজের পায়ে দাঁড়াব।”
ঝোড়োবস্তির মাঠেই চুলে বাহারি ছাঁট দেওয়া, হাতে আধুনিক মোবাইল কিশোরেরা অবশ্য স্বীকার করে নিল মা-কে ছাড়া বাড়ি অচল। একযোগে বলে উঠল – মা-ই তো ‘হিরো’। কিন্তু এই ‘হিরো’ হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়েও যে মা-দের, মহিলাদের লিঙ্গনির্দিষ্ট কাজের ঘেরাটোপে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, পরিশ্রমের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাও সময়ের হাত ধরে বুঝছে তারা। সচেতনতার অভাব এর জন্য দায়ী। তাই বদল আনতে হবে আস্তে আস্তে। যেমন আসছে খেলার হাত ধরে। বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে খেলার মাঠে মেয়েদের পা দেওয়া ও পুরুষদেরও সেই কাজে সঙ্গে নেওয়া, হয়ে উঠতে চাইছে লিঙ্গ সমতা আনার অন্যতম হাতিয়ার।
সুদর্শনা ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং স্বতন্ত্র সাংবাদিক। ছবি: লেখক।