বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসন, বেগম রোকেয়া নামে যিনি পরিচিত, একজন বাঙ্গালি লেখক, চিন্তাবিদ, সামাজিক কর্মী, নারীবাদী, এবং ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতীয় উপমহাদেশে নারীশিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম এবং মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁকে সম্মান জানাতে “কলমের আঁচড়” কাটছেন সামসুন নিহার।
“সোনার পিঞ্জরে ধরে রেখো না আমায়,
আমারে উড়িতে দাও দূর নীলিমা।”
মুক্তির এমন আকুতি একবিংশ শতকের বিশ্বায়নের কালে বসেও আমার মনকে শিহরিত করে। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিশশতকের তিনদশক ছিল এই মানবের বিচরণ ক্ষেত্র। কে এই মানব? মনে পড়ে? চেনা লাগে? পাঠক বলবেন এমন প্রশ্ন কেন? বাস্তব পরিস্থিতি এমন প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করছে।
কেউ কেউ জানেন উক্ত উক্তিটি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসনের। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অন্য কথা বলছে। শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত, শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত আধিকাংশ মানুষ এই নামটি শোনন নি। অথচ চলমান কালে নারী বিষয়ক আলোচনায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ – ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২) নামটি উচ্চারণ না করলে, সেই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তবে এটাও ঠিক যে, তাঁকে নিয়ে আলোচনার পরিসর নারী বিষয়ক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে তা হবে অসম্পূর্ণ আলোচনা। কারণ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামটি হল সার্বিক জীবনদৃষ্টিভঙ্গির সমগ্রতা। বহুমুখী ছিল তাঁর জীবন চর্যা। এটা ঠিক যে, নারীদের শিক্ষার অঙিনায় এনে, তাদের আত্মার জাগরণ ঘটিয়ে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে সেই উদ্দেশ্য সাধনের তরে তাঁকে হাটতে হয়েছে নানা পথে।
নারীর সার্বিক উন্নতি বিষয়ক ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠান স্থাপন তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে পরিচিতি দিয়েছে। আর সেই ভাবনাকে বৃহৎ ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর লেখনী তাঁকে দিয়েছে সাহিত্যিক খ্যাতি। ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ বা ‘নিখিলবঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠার দ্বারা বহু বিধবা নারী, বহু দরিদ্র নারীর বিবাহ খরচ ও বহু দরিদ্র মেয়েরর শিক্ষা লাভের পথ খুলে গেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন সমাজ সেবক। পরাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক রোকেয়া বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন, সত্যাগ্রহ আন্দোলন প্রভৃতিতে স্বশরীরে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও তিনি এসব বিষয়ে সচেতন ছিলেন। স্বদেশিকতা বোধের সাক্ষর রেখেছেন ‘চাষার দুঃখ’ ও ‘এণ্ডিশিল্প’ নামক প্রবন্ধে। প্রথম রচনাটিতে চাষিদের দুরবস্থা ও দেশের শিল্প অবলুপ্তির কারণ সম্পর্কে লেখকের উপলব্ধি “আবার সেই ‘মরাই ভরা ধান,ঢাকা মসলিন’ ইত্যাদি লাভ করিবার একমাত্র উপায় দেশি শিল্প — বিশেষতঃ নারী শিল্প সমূহের পুনরুদ্ধার। জেলায় জেলায় পাটের চাষ কম করিয়া তৎপরিবর্তে কার্পাসের চাষ প্রচুর পরিমাণে হওয়া চাই এবং চরকা ও এণ্ডি সুতোর প্রচলন বহুল পরিমাণে হওয়া বাঞ্ছনীয়। … … …. পল্লীগ্রামে সুশিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা হওয়া চাই। গ্রামে গ্রামে পাঠশালা আর ঘরে ঘরে চরকা ও টেকো হইলে চাষার দারিদ্র ঘুচবে।”
আর দেশ প্রেমিক বীর কানাই লালের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি যখন লেখেন–
” যত কৃতঘ্ন হোক সংসার
তবু এ কানাই স্মৃতি
ভারত হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে
জাগরুক রবে নিতি!
বীর সন্তান। জাগিয়া প্রভাতে
স্মরিবে কানাই নাম…….”
তখন তিনি পাঠকের কাছে দেশপ্রেমী কবি হিসাবে পরিচিত হন। আর নারীসমাজের কল্যাণ সাধিকা রোকেয়ার কলম ঝলসে ওঠে “যদি এখন স্বাধীন ভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয় তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী ব্যারিস্টার, লেডী জর্জ — সবই হইব! পঞ্চাশ বৎসর পরে লেডী Viceroy হইয়া এদেশের সমস্ত নারীকে রাণী করিয়া ফেলিব! উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা ‘স্বামী’র গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না? আমরা যদি রাজকীয় কার্য্যক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব” – এমন জোরালো ও আত্মবিশ্বাসী লেখনীতে। তিনি বিশ্বস করতেন নারীদের আপন মনে জাগিয়ে তুলতে হবে আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস থেকেই আসবে আত্মজাগরণ। যা নারী মনের দাসত্ব মোচনের সহায়ক হবে। আর এইজন্য আবশ্যক নারী শিক্ষা। এইজন্য তাঁর জোরালো ঘোষণা “কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জ্জন করুক।”
আবার মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষার ব্যাপারে কঠোর রক্ষণশীলতাকেও তিনি বিদ্ধ করতে পিছুপা হোন নি। সেই ব্যাপারে তাঁর নির্ভিক বলিষ্ঠ উচ্চারণ “মূর্খতার অন্ধকার যুগে… …. কন্যাবধ করিত, যদিও ইসলাম ধর্ম কন্যাদের শারীরিক হত্যা নিবারণ করিয়াছে তথাপি মুসলমানগণ অম্লানবদনে কন্যাদের মন, মস্তিষ্ক এবং বুদ্ধিবৃত্তি অদ্যাপি অবাধে বধ করিতেছেন…… তেরশত বৎসর পূর্বেই আমাদের জন্য শিক্ষাদানের বাধ্যতামূলক আইন আনা হয়ে গিয়াছে। কিন্তু আমাদের সমাজ তাহা পালন করে নাই….।” শিক্ষা ব্যতিত মুসলিম নারী, তথা সমগ্র নারী সমাজ এবং সমাজের সার্বিক উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়, একথা তিনি তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গভীর অনুভূতির দ্বারা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই নারী মুক্তির জন্য নারী শিক্ষার আকুতি তাঁর কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হয়েছে। কেননা তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা “মুসলমানদের যাবতীয় দৈন্য দুর্দশার একমাত্র কারণ স্ত্রী শিক্ষার ঔদাস্য।” তাই তিনি শিক্ষার দ্বারা মুসলিম সমাজের জেনানামহলের আড়ষ্টতা ভাঙিয়ে সেখানে জাগরণের মুক্ত হাওয়া বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি “কেবল পাশ করা বিদ্যাকে প্রকৃত শিক্ষা বলে মনে করি না।” তাঁর কাছে শিক্ষার অর্থ আরো গভীর। তাঁর ঘোষণা “আমি চাই সেই শিক্ষা যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে”। ভাবা যায়! নাগরিক অধিকার লাভের কথা ধ্বনিত হচ্ছে রোকেয়া কন্ঠে, সেই সময়ে। যা চলমান কালের জনপ্রিয় শব্দ। যার জন্য গোটা দেশ তোলপাড়। অথচ এমন এক মানব আজও আমাদের কাছে অপরিচিত থেকে গেল। আর পরিচিতি যেটুকু পেয়েছে সেটা কেবল নারীবাদী, এই বিশেষ এক অভিধায় ভূষিত হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় তিনি নারীবাদী নন। তিনি যুক্তিবাদী, তিনি মানবতাবাদী। তাঁকে কোন একটি বা দুটি বিশেষণে বিশেষিত করলে তাঁর বৃহৎ কর্মযজ্ঞকে বোঝা কঠিন হয়ে যায়। মানুষের কাছে তাঁর পরিচয়ের ব্যাপ্তিটাও হয়ে যায় সংক্ষিপ্ত।
‘সুগৃহিনী’ প্রবন্ধে লিখেছেনন “নারী ও নর উভয়ে একই বস্তুর অঙ্গ বিশেষ।…..তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পূর্ণ উন্নতি লাভ করিতে পারিবে না।” “সমাজের অর্ধঅঙ্গ বিকল রাখিয়া উন্নতি লাভ করা অসম্ভব।” একবিংশ শতকে বসে আমরা এই বুলিই আওড়ে যাচ্ছি। আমরা এখন বসে যা ভাবছি, বিশশতকের গোড়াতে বসে রোকেয়া তা ভেবেছেন। তার চিন্তা চেতনার জগৎ ছিল এমনই প্রগতিশীল। আর আমরাও এখন প্রগতিশীল, তাঁর বুলি আওড়াতে, আদর্শ বাস্তবায়নে নয়।
নিরঙ্কুশ যুক্তিবাদী রোকেয়ার ধর্ম সম্পর্কে ব্যাখ্যা “ধর্মশাস্ত্রগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।….. আরো দেখ যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ় সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। প্রমাণ সতীদাহ, যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল সেখানে রমণী অপেক্ষাকৃত স্বাধীন অর্থাৎ পুরুষের সমতুল্য। এ স্থলে ধর্ম অর্থে ধর্মের সামাজিক বিধানকে বুঝাইতেছি।” পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনস্তত্ত্বকে অনুধাবনের কী সাংঘাতিক মনের তীক্ষ্ণতা।
সর্বধর্ম সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত এঁকেছেন তাঁর ‘পদ্মরাগ’ নামক উপন্যাসের মধ্যে। সমকালে বিপন্ন সময়ে বসেও তিনি কী অনায়াসে তাঁর ‘তারিণী -ভবন’ নির্মাণ করতে পারেন,”মুসলমান, হিন্দু, ব্রাহ্মণ, খ্রীষ্টান, সকলে যেন এক মাতৃগর্ভাজাতা সহোদরার ন্যায় মিলিয়া মিশিয়া কার্য্য করিতেছেন” — সর্বধর্মের মানুষের এমন সহাবস্থানের দ্বারা। উপন্যাসের চরিত্র আদম শরীফের কন্ঠে যখন উচ্চারিত হয়,”আপ বইঠিয়ে, মাইজী আবি পূজাপাট করতা হায়। পূজা হো জানে সে মাইজী আবি আয়েগা।” আর যখন তিনি রাফিয়া ও কোরেশাকে সেই তারিণীর শতরঞ্জির উপর নামাজ পড়ান, তখন তাঁর তারিণী ভবন হয়ে ওঠে একখণ্ড ভারতবর্ষ। আমরা কি আজও পেরেছি এমন সমাজ গড়ে তুলতে। সবই তো আজও আমাদের অধরা।
ইসলাম ধর্মে ধর্মের আবেগকে কাজে লাগিয়ে চলে নারীর শোষন ও শাসন। জন্মসূত্রে মুসলিম হওয়ার সুবাদে এবিষয়ে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু নিজে কোরাণ শরিফ পড়ার ও সেটাকে আত্মস্থ করার ক্ষমতা ছিল বলেই তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে লিখতে পারেন “কোরাণ শরিফের সার্ব্বজনীন শিক্ষা আমাদের নানাপ্রকার কুসংস্কারের বিপদ থেকে রক্ষা করবে।” এই শিক্ষা আমরা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে আজও ব্যর্থ। অথচ বিপরীত কাজটা কত অনায়াসে করে ফেলেছি। যাক, রোকেয়াকে নিয়ে লিখতে গেলে থামা কঠিন। তবু থামতে তো হবেই। শেষে রোকেয়া সম্পর্কে একজন চিন্তাবিদের কথা দিয়ে আজকের মতো বিদায় নেবো।
রোকেয়া সম্পর্কে আব্দুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন, “চিন্তায়, চেতনায়, কর্মে, নারীজাগরণে তথা বাংলার নবজাগরণে তার ভূমিকা দ্বিতীয়রহিত। আধ্যাত্মিকতার স্থলে ঐহিকতা, গড্ডলের স্থলে ব্যাক্তিকতা, ভাবালুতার স্থলে ভাবুকতা, আবেগের স্থলে যুক্তিশীলতা, প্রশ্নহীন সমর্থনের স্থলে জিজ্ঞাসু বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা, বিমূর্ত কল্পনার স্থলে মনস্বিতা ও তার সকর্মক প্রয়োগ — বেগম রোকেয়া রেনেসাঁসের এই সব চরিত্রলক্ষণে অসম্ভব উজ্জীবিত। ” অথচ এমন এক ব্যক্তিত্ব আজও পেলো না তাঁর প্রাপ্য সম্মান। আজও আমরা পারলাম না তাঁকে ও তাঁর আদর্শকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে সম্মান জানাতে কেবলই কলমের আঁচড় কাটা।
সামসুন নিহার চণ্ডীদাস মহাবিদ্যালয়ের আংশিক সময়ের অধ্যাপক। সাহিত্য ও সমাজ বিষয়ে প্রবন্ধ লেখক। বই ‘বাংলা উপন্যাসে মুসলিম নারী’।