কৃষক আত্মহত্যার হার বিজেপি সরকারের চার বছরে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ঋণজর্জর অনাহারী কৃষক চাষের খরচটুকু না যোগাতে পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। এমনকি পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মতো তথাকথিত স্বচ্ছল রাজ্যেও কৃষকরা সম্পূর্ণভাবে কৃষি ঋণের ওপর নির্ভর করে জীবন কাটান এবং শেষতক সর্বস্ব হারিয়ে দিনমজুরবৃত্তিতে জীবিকা নির্বাহ করেন। এর মধ্যে এ মাসের শেষে ডাকা কৃষক মহাসমাবেশ কি আশার আলো দেখাতে পারবে? লিখছেন সিদ্ধার্থ বসু।
১২ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের নন্দেড জেলায় ৬৫ বছর বয়স্ক পোতান্না রামালু বল্পিলোয়াড নামের এক কৃষক নিজের জমিতে নিজের তৈরি চিতায় আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। জানা গেছে যে ফসল ভালো না হবার কারণে ব্যাংক ও কো অপারেটিভ সোসাইটি থেকে নেওয়া ঋণ তিনি পরিশোধ করতে পারছিলেন না। একটি রাজ্য সরকারি স্কিম অনুসারে তিনি কৃষিঋণ মকুবের জন্য অনলাইন আবেদনও করেছিলেন, কিন্তু তাঁর আর্জি মঞ্জুর হয় নি।
লক্ষ্য করার বিষয় হল কৃষক আত্মহত্যার হার বিজেপি সরকারের চার বছরে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০১০ এর জানুয়ারি থেকে ২০১৩র ডিসেম্বর ৬০২৮ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছিলেন। ২০১৫ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সেপ্টেম্বর এ সংখ্যাটা হয়ে গেছে ১১,২২৫। কারণ হিসেবে সবার প্রথমে উঠে আসছে অনাবৃষ্টি, যার ফলে চাষের খরচ বেড়ে যাচ্ছে আর সেই সঙ্গে কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ। কৃষক আন্দোলনের চাপে দেবেন্দ্র ফডনবিশ সরকার ৪৭ লক্ষ কৃষকের প্রায় ২১,৫০০ কোটি টাকা ঋণ মকুব করতে বাধ্য হয়েছে।
এমনকি পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মতো তথাকথিত স্বচ্ছল রাজ্যেও ছোটো ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা বিপুল(পাঞ্জাবে ৩৫.৪% ও হরিয়ানায় ৬৫.৪%)। পাঞ্জাবের প্রায় ৬৪.৫% গ্রামীণ অধিবাসী ভূমিহীন, হরিয়ানায় ৫৫.৯%। এঁরা সকলেই সম্পূর্ণভাবে কৃষি ঋণের ওপর নির্ভর করে জীবন কাটান এবং শেষতক সর্বস্ব হারিয়ে দিনমজুরবৃত্তিতে জীবিকা নির্বাহ করেন (পাঞ্জাবে ৪৮.০৩% ও হরিয়ানায় ৪২.৭%)।
অক্টোবর মাসে দেওয়া অল ইন্ডিয়া কিসান সংঘর্ষ কো অরডিনেশন কমিটি (এআইকেএসসিসি)র হিসেব অনুযায়ী এ মরশুমের প্রথম তিন সপ্তাহেই কৃষকরা ১,১৪৯ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন এবং এর কারণ হল প্রধানমন্ত্রী অন্নদাতা আয় সংরক্ষণ অভিযান (পিএম-এএএসএইচএ) স্কিম কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসে (এমএসপি) ফসল বিক্রি নিশ্চিত করতে পারে নি। মান্ডিগুলোতে অনেক কম দামে শস্য বিকোচ্ছে। সরকারের মূল্যতথ্য বিষয়ক নিজস্ব ওয়েবসাইট আগমার্কেট অনুসারেই এই তথ্য পাওয়া যায়।
ঋণের দায়ে কৃষক আত্মহননের ঘটনার পাশাপাশি তাকানো যাক পাব্লিক সেক্টর ব্যাংকগুলোর দিকে। সেগুলোয় তামাদি হয়ে যাওয়া ধারের টাকার বেশিরভাগটাই কিন্তু কর্পোরেট লোন। ২০১৬-১৭বছরে মোট ঋণের ৩৭% দেওয়া হয় কর্পোরেট শিল্পক্ষেত্রগুলোকে এবং তা ব্যাংকগুলোর মোট নন পার্ফরমিং এসেটস এর প্রায় ৭৩%। যেখানে খুচরো ঋণ দেওয়ার পরিমাণ ২২.৮৩% হলেও তা মোট নন পারফর্মিং এসেটস(এনপিএ)-এর মাত্র ৩.৭% অংশ দখল করে। আরো খুঁটিয়ে দেখলে ২০১৭ র ৩১ মার্চ পর্যন্ত পিএসইউ ব্যাংকগুলোর মোট ৬.৪১ লক্ষ কোটি টাকা মোট এনপিএ-র মধ্যে ৪.৭০ লক্ষ কোটি হচ্ছে কর্পোরেট ঋণ। যেখানে খুচরো ধারের মাত্র ২৩,৭২৫ কোটি টাকা এনপিএ খাতে গেছে।
২০১৬-১৭ তে প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনার আওতায় আসা মোট কৃষকদের প্রায় ১৫% (প্রায় ৮৪ লক্ষ কৃষক) স্কিম থেকে বেরিয়ে এসেছেন। অথচ রিলায়েন্স, আইসিআইসিআই, এইচডিএফসি, আইএফএফসিও সহ বীমা কোম্পানিগুলো এ পর্যন্ত প্রায় ১৫,৭৯৫ কোটি টাকা লাভ করেছে। আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট পি পি কাপুরের মতে শস্য বীনা স্কিম স্রেফ এক ধাপ্পা, যাতে শুধু বেসরকারি বীমা সংস্থাগুলোরই লাভ। সরাসরি কৃষকদের কাছে অর্থসাহায্য পৌঁছতে পারলে এর চেয়ে অনেক বেশি কল্যাণকর হত।
অতএব ঋণজর্জর অনাহারী কৃষক চাষের খরচটুকু না যোগাতে পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। আর সেই একই দেশে, একই সময়ে কোটি কোটি টাকা কর্পোরেট ঋণ মকুব করে দিতে কার্যত বাধ্য হচ্ছে সরকারি ব্যাংক-ব্যবস্থা। ধারের টাকা ফুঁকে দিয়ে বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মহুল চোক্সিরা বিদেশ পালাচ্ছে। এই আজকের বাস্তব।
তবে আশার কথা এই যে কৃষকরা ক্রমশ আরও ব্যাপক ভাবে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছেন। মার্চ মাসের ‘লং মার্চ‘ এবং অক্টোবর মাসে শান্তিপূর্ণ কৃষক মিছিলের উপর পুলিশি আক্রমণের ঘটনায় তারই প্রতিচ্ছবি দেখা গিয়েছিল। আগামী ২৯-৩০ নভেম্বর দিল্লির রামলীলা ময়দানে নানা রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় প্রায় ২০০ কৃষক সংগঠনের আহ্বানে লক্ষাধিক কৃষককে নিয়ে মিছিল ও একটি বৃহৎ সমাবেশ আয়োজিত হতে চলেছে। এই জমায়েতের মূল দাবি একবারে সমস্ত কৃষিঋণ মকুব এবং স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী এমএসপি নির্ধারণ (যাতে A2 + FL ফরমুলা অনুযায়ী বর্তমান নিয়মে কৃষি উৎপাদনের খরচ ও পরিবারের মোট শ্রমের মূল্যের পরিবর্তে C2 ফরমুলা অনুযায়ী কৃষির উপাদানের দাম, পরিবারের মোট শ্রম ও জমির খাজনা, নিজের খরচ ও কৃষিঋণের সুদ অনুযায়ী এমএসপি নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছিল)। এছাড়াও এই রিপোর্টের অন্যান্য সুপারিশ – যেমন উৎপাদন, লাভ, কৃষি বিষয়ক প্রযুক্তি, কম জলে চাষ, স্টক প্রাইস ইত্যাদি – নানা বিষয়ক দাবি এই সমাবেশে তোলা হবে। দিল্লি সমাবেশের সাথে সাথে দেশের নানান শহরে সমান্তরাল ভাবে কৃষকদের ও সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মীদের মিছিল ও সমাবেশ ডাকা হচ্ছে। যেমন আগামীকাল প্রায় ২০০০০ কৃষক ও আদিবাসী মুম্বই শহরে মিছিল করে ঢুকবেন বলে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
সিদ্ধার্থ বসু জীববিদ্যার শিক্ষক এবং কবি।