বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি আর বজ্রকঠিন চরিত্রের কল্পকথাগুলি একটু একটু করে ধুলো হয়ে উবে যাচ্ছে অনেকদিন হল। এখন তর্কটা এসে দাঁড়িয়েছে তিনি আদৌ এদেশের – দেশের মানুষের – জন্য শুভ কিছু, কল্যাণকর কিছু করে – বা অন্তত শুরু করে – যেতে পেরেছিলেন কি? নাকি স্রেফ ব্রিটিশ প্রভুদের ইশারায়, অঙ্গুলিহেলনেই বাঁধা ছিল তাঁর কার্যপরম্পরা? ঘুলিয়ে ওঠা কাদাজল সামান্য স্বচ্ছ করার প্রচেষ্টায় অশোক মুখোপাধ্যায়।
[১]
বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী এগিয়ে আসছে। আমরা যারা বিভিন্ন কারণে এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা করি এবং তাঁর জীবন ও চরিত্র থেকে কিছু শেখার কথা ভাবি বা বলি, তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কেন এই শ্রদ্ধা এবং শেখার ইচ্ছা, তার সপক্ষে কিছু কথা বলা। না হলে বিদ্যাসাগর চর্চাটা ধাক্কা খেতে থাকবে। কেন না, বিদ্যাসাগর বিরোধী একাধিক মহল আছে, যারা উপযুক্ত সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠে নানা যুক্তিটুক্তি তুলে তাঁর সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনকে গুরুত্বহীন করে দেখাতে থাকেন।
প্রথম বিরোধী দল হল সংঘ পরিবারের শাখাপ্রশাখা। বিদ্যাসাগর ওদের কাছে ভারি সমস্যার। শুধু এই জন্য নয় যে তিনি হিন্দু বিধবা বিবাহের আইনি আয়োজন প্রস্তুত করেছিলেন। বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সম্মতি আইনকে শাস্ত্রের বাইরে শারীরবৃত্তীয় বিচারে টেনে আনার চেষ্টা করেছিলেন। এগুলো তো আছেই। এর উপরে আছে তাঁর দুটো লিখিত উক্তি। যা তাঁর জীবন কাল শেষ হওয়ার অনেক পরে (১৯২৬ সাল নাগাদ) আবিষ্কৃত হয়েছে। উক্তি তো নয়, দুটো কাল-ব্রহ্মাস্ত্র — গোদা বাংলায় যাকে বলে টাইম বম্ব (যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য বলে রাখি: বোমা বা বম্ব শব্দগুলি ব্রহ্মাস্ত্র থেকে কলিযুগের অপভ্রংশে নিষ্পন্ন)!
এই ব্রহ্মাস্ত্রদ্বয়কে নিষ্প্রভ করতে হলে সাম্প্রদায়িক মুদ্দায় বাংলা বন্ধের মতো হুজুগ আর কিছু হয় না। অতএব –
অতএব উক্তি দুটোকে স্মরণ করতেই হয়।
১) That Samkhya and Vedanta (sic!) are false systems of philosophy is no more in dispute. যস্যার্থ:- “সাংখ্য ও বেদান্ত (হায়!) যে ভ্রান্ত দর্শন তন্ত্র, সে কথা আর বলতে!”
২) ইংরেজরা জানতে চেয়েছিল, ভারতীয় দর্শনের কিছু বই কি ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়ানো যায় না? (তখনও মাক্সম্যুলার ও ওল্ডেনবার্গ সেই পঞ্চাশ খণ্ড অনুবাদ কর্মে হাত লাগাননি।) বিদ্যাসাগরের সাফ সাফ উত্তর, আরে মশাই, ওগুলো শুধু দুর্বোধ্য মনে হয় বলে অনুবাদ করা যাবে না – এমন নয়। আসলে কী জানেন, “there is nothing substantial in them”! যস্যার্থ:- অনুবাদ করার জন্য কিছু মাল মশলা থাকার দরকার হয়। ওগুলোতে সেরকম কিছু নেই!
এই সব কথা বলার জন্য দেশের বেদপন্থী সনাতনপন্থীরা বিদ্যাসাগরকে কোনো দিনই ক্ষমা করতে পারছে না। যে বে-দা-ন্ত নিয়ে বিবেকানন্দের অত উদাত্ত আহ্বান, যে শাঙ্কর বেদান্তকে দুনিয়ার জ্ঞানের শিরোমণি বলে কত পণ্ডিতের কত আস্ফালন, অত বড় একজন সংস্কৃতবিদ এরকম বলেছেন জানার পর তার আর কোনো ইজ্জত থাকে? থাকলে এঁকে সেদিন পাকিস্তানেই পাঠিয়ে দিত ওরা!
বিদ্যাসাগর প্রায় কোনো আন্দোলনেই সফল হননি। বিধবা বিবাহ আইন হলেও উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা একে গ্রহণ করেনি। বিধবা মেয়েরা সাদা থান পরে না খেয়ে আধ পেট খেয়ে থাকবে — এর মধ্যে বিবেকানন্দ যে অপরিসীম সৌন্দর্য ও মাধুর্য দেখেছিলেন (দেখার চোখও বটে!), সেই দৃশ্যই তাদের বেশি পছন্দ হয়েছে। এক্কেবারে মনের মতো ছবি। বাল্য বিবাহ বহু বিবাহ তিনি বন্ধ করার আইনও করাতে পারেননি। সংস্কার তো বহুত দূর কি বাত! ঐতিহ্যের আগ্নেয়শীলা একেবারে এককাট্টা হয়ে আটকে দিয়েছে। বাল্য বিবাহেরও কত সুখ্যাতি স্বামীজির বাজপায়ি কণ্ঠে শুনেছি। বিদ্যাসাগর চাইলেই হল? এত সুখ কেউ ছাড়ে নাকি?
বিদ্যাসাগরের শিক্ষা প্রকল্পও পুরোপুরি সফল হয়নি। তিনি যা চেয়েছিলেন, সিলেবাসে ঢুকেছে। কিন্তু যারা পড়ায় শেখায় তাদের মগজে ঢোকেনি। ব্যাচ বাই ব্যাচ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। “বিজ্ঞান পড়ছ অঙ্ক শিখছ ভালো কথা। কিন্তু মনে রেখ, এই সবই বেদে ছিল।” “অ্যাঁ, কোথায় কী আছে জানতে চাও? ভারি পাকা ছোকরা তো হে তুমি। বলি কটা শাস্তর পড়েছ? সাত হাজার নশো ঊনষাট খানা পুঁথি আছে জানো? বাপের এক জন্মে শেষ করতে পারবে না!” – সেই সব মগজের সংস্কার তিনি করে যেতে পারেননি। বলেছিলেন, “সাত পুরু মাটি তুলে নতুন করে চাষ করতে হবে।” মাটি কোপানো শুরু করলেও বেশি দূর কাটতে পারেননি।
কাল্টিভেশনের নতুন ভবন উদ্বোধনে নারকেল ভাঙায় যাঁরা অবাক হয়েছেন, তাঁরা বুঝতেই পারেননি, আমাদের জ্ঞানী পণ্ডিতদের মস্তিষ্ক আসলে তো নারকেলডাঙাই। খানিকটা ছিবড়ে, আর খানিকটা জল। ব্যস, পুরো জ্ঞান একেবারে জলভাত! এঁরা খুব ভালো ভক্ত হন, প্রভুভক্তও হন। দেশের দুহাজার সাতশ বেয়াল্লিশটা কুসংস্কারের প্রতিটাই এরা বহন ও প্রচার করে থাকেন বিজ্ঞান ভবনে বসে সবচাইতে দামি স্মার্তফোন হাতে নিয়েই। এক ধরনের টেরচা হাসি সহ।
তবু, যাঁরা অবাক হয়েছেন, যাঁরা আপত্তি জানিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বিদ্যাসাগর ঢুকে বসে আছেন! অত বড় এক অচলায়তন — তার দরজা ভাঙতে না পারলেও দেওয়ালে কিছু ফুটো তিনি করে দিয়ে গেছেন। সেই ফুটোগুলো মেরামতির অযোগ্য। ফলে কিছুটা হলেও বুদ্ধির প্রগতির মৌসুমি বায়ু ঢুকে গেছে কিছু মানুষের অন্তরে। হাতে এসে গেছে বাংলা অক্ষর। ঋ ৯ ইত্যাদিদের দোতলা বাসগুলি বসিয়ে দিয়ে। সংস্কৃত দাপট মুক্ত বাংলা ব্যাকরণ হয়ে গেছে সহজ সরল। কেমন একটা বাংলা-বাংলা ভাব নিয়ে। জল পড়ে যে দুচারটে পাতা নড়েছিল, তা দেখে আরও কিছু পাতা নড়েছে। তারপর আরও অনেক কটা। অসংখ্য কুযুক্তির রঙমশালের মধ্যেও কিছু কিছু লোকের হাতে যুক্তিবাদের মোমবাতিগুলো জ্বলছে তো জ্বলছেই।
তাঁরাই জ্ঞানের বাতিটা জ্বালিয়ে রেখেছেন।
হ্যাঁ, ওঁদের কথাও বলতে হবে বৈকি! তাঁরা হলেন আর এক জবরদস্ত প্রতিপক্ষ। চরমপন্থী মার্ক্সবাদী। এক কালে সেই অতিবাম পক্ষ এসে প্রশ্ন তুলেছিলেন: বিদ্যাসাগর কেন কৃষিবিপ্লবের পক্ষে কথা বলেননি, কেন সংস্কৃত কলেজের দরজা জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য খুলে দিতে পারেননি, কেন তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের রণহুঙ্কার দেননি, তিনি সিপাহি বিদ্রোহের সময় সংস্কৃত কলেজে ভবন ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কেন, ইত্যাদি। এই সব প্রশ্ন তুলে তাঁরা রাজনীতির আসর গরম করে ফেলেছিলেন। তাঁরা অনেকেই ছিলেন বিরাট মাপের বুদ্ধিজীবী। কবি ও লেখক। সদর্থেই। বোঝা যায়, বিদ্যাসাগরের কাছে তাঁদের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। (হাজার হোক কার্ল মার্ক্স-এর বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেল্স আর আমাদের এই ঈশ্বর বাঁড়ুজ্জে একই বছরেই তো জন্মেছেন।) আশা ভঙ্গ হওয়ায় তাঁরা কিছু কর্মীকে দিয়ে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। পরে এঁদের কথা আরও বিস্তারে বলতে হবে। আজ শুধু এটুকুই বলে রাখি, তাঁদের উত্তরসূরীদেরও বিদ্যাসাগরের ঢালের পেছনে দাঁড়িয়েই এখন ক্রমবর্ধমান দক্ষিণ প্রতিক্রিয়ার আগ্রাসনকে, উপরে বর্ণিত প্রথম পক্ষকে, ঠেকানোর কথা ভাবতে হচ্ছে।
এখানেও বিদ্যাসাগর বোধ হয় জয়ী হয়েছেন।
[২]
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সত্যিই এক আশ্চর্য ব্যতিক্রমী মানুষ! সেকালের একজন অসাধারন বিদ্বান ব্যক্তি হয়েও তিনি কথা এতই কম বলতেন এবং লিখতেন — জ্ঞানগর্ভ কথা তো প্রায় বলেনইনি কোথাও—যার ফলে আমাদের কোনো গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লেখার সময় তার ভেতরে গুঁজে দেবার জন্য উদ্ধৃতি যোগ্য বাক্য পাওয়া খুব কঠিন। আর যা কিছু বলেছেন (বা লিখেছেন) তা একেবারে একশ শতাংশ সত্য ও তথ্যে ঠাসা। নিশ্চিত বিবৃতি। ডান দিক থেকে বাঁ দিকে, উপর থেকে নীচে — যেদিকে খুশি যান, দেখবেন, ‘তবে’, ‘যদিও’, ‘কিন্তু’, ‘তাই নাকি’, ‘মানে’, ‘দেখি’, ‘হয়ত’, ‘দেখা যাবে’, ‘চেষ্টা করব’, … এরকম পলাতকি অব্যয় (অথবা দ্বিধা জনিত বা কুণ্ঠা জড়িত তোতলামি) ঢোকানোর জায়গা কোথাও রাখেননি। আর একজন এরকম মানুষ কি আমরা আর এদেশে পেলাম?
তাঁর যে কোনো কথা মানে একেবারে সেই কথাই। অন্য কথা নয়। তিনি যখন বললেন, “আমি দেশাচারের দাস নই। যা কর্তব্য মনে করি তা পালন করার জন্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতেও পিছিয়ে যাব না”—তার মানে একেবারে এটাই। তাঁর পিতৃভক্তি মাতৃভক্তি নিয়ে বাজারে কত গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বর্ষাকাল — দামোদর — ভয়ঙ্কর পদ্মাস্টাইল স্রোত—সাঁতার, এমনি আরও কত কিছু! অথচ বিধবা বিবাহ আইন প্রচলন ও প্রয়োগ করতে গিয়ে বাবা-মা-স্ত্রী পরিবারের প্রায় সকলের সাথেই বিচ্ছেদ ঘটে গেল। ভাই শম্ভুচন্দ্র যখন চিঠিতে লিখলেন, “পিতামাতা অসন্তুষ্ট হইতেছেন”, ঈশ্বরচন্দ্র প্রত্যুত্তর দিলেন, “আমি জ্ঞানত তাঁহাদের সুখের কোনো ব্যাঘাত ঘটাই নাই, তাঁহারা কেন আমার সুখ প্রদায়ক কর্মের ব্যাঘাত হইবেন?” বিদ্যাসাগর অটল রইলেন।
তিনি যখন স্থির করলেন, ছাত্রদের জন্য প্রাচীন টুলো শিক্ষা নয়, “কে কী শিখল, তাতে আমার কী আসে যায়?”-জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতি নয়, আধুনিক বৈজ্ঞানিক মানবতান্ত্রিক শিক্ষা চালু করতে হবে, ধরাবাঁধা আনুষ্ঠানিক নিয়মানুগ পদ্ধতিতে শেখাতে হবে, ছাত্র এবং শিক্ষক উভয় পক্ষকে ঘড়ি ঘন্টা মেনে শিক্ষায়তনে এবং শ্রেণি কক্ষে ঢুকতে হবে, পড়তে হবে এবং পড়াতে হবে, সংস্কৃত কলেজে এবং পরে মেট্রপলিটান স্কুলে সেটা চালু করে দেখালেন। যে সমস্ত শিক্ষকরা বয়সের দোহাই দিয়ে দেরি করে কলেজে ঢুকতেন, ঈশ্বরচন্দ্র তাঁদেরও ফটকের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে লজ্জা দিয়েছেন। “এই এলেন বুঝি? আচ্ছা যান, ভেতরে।” সেটাই অনেক ঠেলা ধাক্কা খেয়েও (কেন না, এই দেশের উত্তর-বিদ্যাসাগর বহু-প্রজন্ম এর মর্মার্থ সেদিন থেকে শুরু করে আজ অবধি বুঝতে পারেনি) শেষ পর্যন্ত টিকে রইল। এমনকি অনেকের ঘোরতর অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
যদিও আমাদের ৯১.২৭ শতাংশের এখনও হাতে ঘড়ি পরার এবং দেওয়ালে ঘড়ি টাঙানোর তাৎপর্য খুব একটা মালুম হয়নি। অনেকেই সেই কারণে নরেন দত্তকে মেট্রপলিটান স্কুলের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার ঘটনাটা ক্ষমা করে উঠতে পারেননি। অথচ, নরেন স্যার ক্লাশে নিয়মিত আসবেন না, এলেও ছাত্রদের কাছে দক্ষিণেশ্বরের কালী সাধকের গল্প বলে সময় খরচ করবেন—এটা তাঁর আক্ষরিক অর্থেই না-পসন্দ ছিল। আমরাও আমাদের কালে কোনো বিদ্যালয়ে এরকম শিক্ষকের দেখা পেলে অপছন্দই ব্যক্ত করি, শিক্ষকদের জাত তুলেও গাল পাড়ি, কিন্তু তাই বলে নরেন দত্তর বেলায় একই নিয়ম খাটানো যায় নাকি? “জানেন, তিনি শেষ পর্যন্ত কে হবেন? কী করবেন?” না, ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র দুই বছরের জন্য জেনে যেতে পারেননি। যেটুকু জেনেছিলেন, তাতেই অবশ্য তিনি কী চান বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ইস্কুল মানে যে ছাত্রদের পড়াশুনার ক্ষতি করে গল্প করার জায়গা নয়, তিনি সেদিন এটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন!
আমার অবশ্য এই প্রসঙ্গে কিঞ্চিত ভিন্ন একটা কথা আছে।
বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকারীর দরকার ছিল। মশালটাকে জ্বালিয়ে রাখার জন্য। নরেন দত্ত ছিলেন তার জন্য একজন অন্যতম ও অত্যন্ত সম্ভাবনাময় উপযুক্ত চরিত্র। যিনি যেখানেই থাকবেন, নেতা হয়েই থাকবেন। সে গানের দল, ইস্কুল আর সন্ন্যাসীর আশ্রম—যেখানেই হোক। মেট্রোপলিটান যুগে তখনও তিনি পথ নির্বাচন চূড়ান্ত করে ফেলেননি। রামকৃষ্ণ তাঁকে টানলেও পুরোটা ধরে ফেলতে পারেননি। দ্বিধা দ্বন্দ্বের পালা চলছিল। সেই সময় যদি ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারতেন, একটু সময় দিয়ে তাঁকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জন ও প্রদানের কাজটা ভালো করে বুঝিয়ে দিতে পারতেন—তাহলে এই দেশের ইতিহাস আজ আর একটু অন্যরকম হলে হতেও পারত। সেটা হল না। নরেন দত্ত চাকরি খুইয়ে তাঁর ক্যারিয়ার নির্মাণের জন্য বাধ্য হয়ে সেই দক্ষিণেশ্বরেই ঝাঁপ দিলেন!
পঞ্চান্ন বছর বয়সী শ্রদ্ধার পাত্র শিক্ষককে পনের বছরের বালিকা বিবাহ করতে দেখে বলেছিলেন, “এ জন্মে আর মুখও দেখব না আপনার”। সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। বাল্য বিবাহ তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন। বাল্য বিবাহের পরিণতিতে যে বালবিধবা জন্মায়, তার সর্বাত্মক দুঃখজনক পরিণতিতে তিনি হৃদয়ের অন্তস্থলে এক নিরুপায় অনুপশম্য ব্যথা অনুভব করতেন। ওর মধ্যে সৌন্দর্য মাধুর্য দেখতে পাওয়ার মতো নান্দনিক চোখ তাঁর ছিল না! তাই সেই সত্য পালন।
জীবনের কোনো এক সময় তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, শত নিন্দা শুনলেও কারোর বিরুদ্ধে কোনো নিন্দা বাক্য উচ্চারণ করবেন না, তাঁর জিহ্বা তাঁর কলম তা একশ শতাংশ রক্ষা করে গেছে। তাঁর সমালোচক তাঁর নিন্দুক সেই কালে তো কম ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো উচ্চশিক্ষিত সাহিত্যিক মানুষও তাঁকে বিরোধিতা করে কলম ধরেছেন, উপন্যাসের এক চরিত্রের মুখ দিয়ে খুবই অশালীন মন্তব্য করিয়েছেন। বিদ্যাসাগর তাতে নিশ্চয়ই দুঃখ পেয়েছিলেন, কিন্তু পালটা একটাও কটু কথা তিনি বলেননি। বরং একবার যখন কোনো এক সভায় সুযোগ এল, তিনি বঙ্কিমকে সেই কথা স্মরণ করিয়ে খানিক রসিকতাই করেছিলেন!
তাঁর রচিত “বর্ণপরিচয়” আজও আমাদের বর্ণ পরিচয়ের সিংহদরজা — দুদিক থেকেই: আমরা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হই এই বই হাতে নিয়ে। আর আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি নীতিবোধ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে সেই দরজার মুখেই।
এই একটি মানুষকে শ্রদ্ধা জানানোর মতো কঠিন কাজ আর কিছু নেই! সেই রাস্তা সেই জন্যই নানা ছলে অনেকে পরিহার করে থাকেন হয়ত!
দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত এই লিঙ্কে
লেখক পরিচিতি: ‘সেস্টাস’ নামে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কিত মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক। বিজ্ঞান ও মার্কসবাদের আলোয় বিজ্ঞানের ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ে লোকপ্রিয় প্রবন্ধের লেখক।
Akhon etai khub jaruri manusher katchhe sathik tattha poichhe deoya … Likhhe Jan keu kothao sambridha hok …