একদিকে ফ্যাক্টরি দুর্ঘটনায় মৃত শ্রমিকদের তালিকায় এবার নাম লেখালেন ভিলাইয়ের স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড-এর ৯ জন শ্রমিক, আরও বেশ কয়েকজন গুরুতর ভাবে ঝলসে গিয়ে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। অন্যদিকে ম্যানেজমেন্টের মানসিক অত্যাচারে আত্মহত্যার চেষ্টা করে হাসপাতালে সঙ্কটজনক অবস্থায় ভর্তি রয়েছেন মানেসর মারুতি সুজুকির জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। একটি গ্রাউন্ডজিরো রিপোর্ট।
গত জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছত্তিসগড়ের দুর্গ জেলায় কেন্দ্রীয় সরকার অধিকৃত স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড(সেইল)-এর নতুন ও আধুনিক পদ্ধতিতে বর্ধিত ফ্যাক্টরিটিকে উন্নয়নের জ্বাজল্যমান উদাহরণ হিসেবে দেশের প্রতি ‘উৎসর্গ’ করেন। আজ, ৯ অক্টোবর ২০১৮, সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ এই ফ্যাক্টরিতে একটি কোক ওভেন ব্যাটারি কমপ্লেক্সে গ্যাস পাইপলাইনে আগুন লেগে যে বিস্ফোরণ হয়, তাতে সেখানে কর্মরত ২৬ জন শ্রমিকের মধ্যে এখন অব্দি ৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে এবং আরও ৪ জনের অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। বাকিরাও গুরুতর আহত ও অর্ধদগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিং, স্টিল মন্ত্রী চৌধুরী বীরেন্দর সিং এবং রাজ্য পুলিশ নিয়মমাফিক দুঃখপ্রকাশ করে অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন অব্দি কোম্পানির তরফ থেকে এই দুর্ঘটনার কারণ বিষয়ে কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
ভিলাইয়ের আজকের ঘটনা কোনো ব্যতিক্রম নয়। গত মাসে বিজনৌরে একটি প্রাইভেট পেট্রোকেমিকাল কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে ৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু, মার্চ মাসে সোনিপতের রায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায় রঙের ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে ৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু, বা গত বছর রায় বেরিলিতে এনটিপিসি-র উঞ্চাহার পাওয়ার প্ল্যান্টে ৪৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু, বিহার সুগার মিল ব্লাস্টে ৬ জনের মৃত্যু – কোনো ক্ষেত্রেই মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে বলার মত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, উল্টে অনেকসময় শ্রমিকদেরই দায়ী করা হয়েছে, বিশেষত বড় কোম্পানির ক্ষেত্রে। মানেসরের এসপিএম অটোকম্প সিস্টেম প্রাইভেট লিমিটেড-এর শ্রমিক ৩৭ বছরের শত্রুঘ্ন কাজ করার সময় মেশিনে আটকা পড়েন। কোম্পানি ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ – এই খবর পাবার পরেও উৎপাদনের ক্ষতি হবে, এই অজুহাতে মেশিন বন্ধ করতে এতটাই সময় নেওয়া হয় যে শত্রুঘ্নকে আর বাঁচানো যায়নি।
ভিলাইয়ের আজকের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর যেমন এই শ্রমিকরা মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন, তেমনই লড়ছেন মানেসর মারুতি সুজুকি কোম্পানির এক ট্রেনিংরত জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার কৌশল। গত ৫ অক্টোবর সকালে, কারখানার পরিসরের মধ্যেই, অপমানজনক ব্যবহার সইতে না পেরে নিজে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। লখনউ-এর বাসিন্দা এই যুবক ৪ অক্টোবর রাতের শিফটে সুপারভাইজার হিসাবে কাজের দায়িত্বে ছিলেন (যা ট্রেনি হিসেবে তাঁর থাকার কথা নয়) এবং সম্ভবত অত্যধিক কাজের চাপের ফলে তিনি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পাহারায় থাকা কোনো ব্যক্তি তাঁর ঘুমন্ত অবস্থার ছবি তুলে ডিপিএম-এর কাছে পাঠিয়ে দিলে ম্যানেজমেন্টের লোক তাঁর উপর চড়াও হয় ও তাঁকে মানসিকভাবে নির্যাতন করে। ৫ অক্টোবর জেনারাল শিফট শুরু হবার আগেই কৌশল হতাশায় এবং অসম্মানের ভয়ে ছুরি চালান নিজের গলায়।
কৌশল এখন মানেসরের রকল্যান্ড হাসপাতালের আইসিইউতে সঙ্কটজনক অবস্থায় ভর্তি রয়েছেন এবং তাঁর কাছে ম্যানেজমেন্টের লোকজন বাদে কেউই যাতে পৌঁছতে না পারে, তার ‘সুব্যবস্থা’ করা হয়েছে। যদিও তিনি ম্যানেজমেন্টের নিম্নপদস্থ কর্মচারী, তবুও শ্রমিক ইউনিয়ন এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে মারুতি-সুজুকিসহ অন্যান্য কারখানায় চলতে থাকা বাধ্যতামূলক অতিরিক্ত শ্রমদান, অসম্মানজনক কাজের পরিবেশ, শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়েছে। দিনের পর দিন শ্রমিকদের আরও বেশি করে অধিকারহীন করার লক্ষ্যে কন্ট্র্যাক্ট শ্রমিক নিয়োগ এবং কাজের পরিসরের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি – শুধু মারুতি সুজুকি নয়, গোটা দেশে উন্নয়নের পিছনের কাহিনী এমনই। এইভাবে শ্রমিকদের উপর নেমে আসা দমন নীতির কারণ হিসাবে উচ্চআদালত এবং বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম বারংবার ইনিয়ে বিনিয়ে যে বক্তব্য রাখে, তা হল, শ্রমিক অসন্তোষের ফলে বিদেশি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৌশলের আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনা এবং ভিলাইয়ের অগ্নিকাণ্ড আবার মালিকশ্রেণীর ন্যক্কারজনক চেহারার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগঠিত ও প্রতিবাদী ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা সামনে নিয়ে এল – যে মালিকশ্রেণীকে বছরের পর বছর বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল, বিকিয়ে যাওয়া পুলিশ-প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও সংবাদমাধ্যম অনৈতিকভাবে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। অন্যদিকে আবার শ্রমিকরা দলবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ালে ২০১২ সালে মানেসরের মারুতি সুজুকি কোম্পানির ঘটনার মত তাঁদের উপর কর্তৃপক্ষের তরফে মিথ্যে সাক্ষ্য খাড়া করে সাধারণ জনতার সামনে তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। মালিকপক্ষের টিকিটিও ছোঁয়া যায় না।
কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তার দাবীর প্রশ্নটি রাজনীতিতে বড় একটা সামনে আসে না। সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তাকালেও দেখা যায়, এমনকি লিবারাল বাম পরিসরেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে যত আলোচনা হয়, লিঙ্গ বা দলিত পরিচিতি-সত্ত্বা নিয়ে যত তর্কবিতর্ক হয়, তার দশ শতাংশ আলোচনাও হয় না শ্রমিক সংগ্রাম, শ্রমিকদের উপর শোষণ এবং কর্পোরেট ও সরকারের মিলিত ভাবে নামিয়ে আনা নিয়মনীতির বিরুদ্ধে। শ্রমিকশ্রেণীকে অদৃশ্য করে রাখার এই রাজনীতিটি বুঝে নেবার প্রয়োজন আছে। আসলে বিশ্বায়ন, নয়া উদারনৈতিক আর্থিক সংস্কারের নামে ‘৯১-র পরে যে শ্রেণীকে মিডিয়া এবং সমাজ-রাজনীতি ব্রাত্য করে রেখেছে অর্থনীতি থেকে শুরু করে অ্যাকাডেমিয়া-সাহিত্যসংস্কৃতি অব্দি সমস্ত পরিসর থেকে, তা হল শ্রমিক শ্রেণী। পুঁজি জানে, যে এই ২০১৮তেও তার মৌলিক দ্বন্দ্ব আসলে শ্রমের সাথে। তার বিনাশের বীজও ঐ দ্বন্দ্বের ভিতরেই লুকিয়ে আছে। তাই সে শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠিতকরণের এতটুকু আভাস পেলেও আতঙ্কিত হয়।
যতদিন মালিকের মুনাফার স্বার্থে বিদেশি বিনিয়োগের গল্প ফাঁদা হতে থাকবে, ততদিনই শ্রমিকদের – সাধারণ মানুষের – মৃত্যুমিছিল আরও দীর্ঘ হতে থাকবে। এই পরিস্থিতির নেতিবাচক এবং ইতিবাচক দিক আসলে একটাই, যে অত্যাচার সহনশীলতার মাত্রাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। হয়তো তা এইভাবে একদিন পরিবর্তনের প্রয়োজনকে সকলের সামনে নিয়ে আসবে।