দরিদ্রতম আরব দেশ ইয়েমেনে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে মারাত্মক ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে ইউএস-সৌদি জোট। হুঠি বিদ্রোহীদের দমন ও ইরানকে প্রতিহত করার অজুহাতে খুন করছে হাজার হাজার ইয়েমেনীয় নাগরিককে। স্কুল, বাজার,খামার, মসজিদ বিধ্বস্ত। দেশজুড়ে বেকারী, অনাহার, মহামারী ও দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া। আরবের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর সাথে খোলাখুলি অস্ত্রের লেনদেন চালাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। লিখছেন সিদ্ধার্থ বসু।
২০১৫-র মার্চ থেকে সৌদি আরব-আরব আমিরশাহি-ইউএস-ইউকে জোট আরবের দরিদ্রতম দেশ ইয়েমেনে মারাত্মক যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। ২০১১ পরবর্তী সময়ে আরব বিদ্রোহের ঝড়ে কাঁপতে থাকা ইয়েমেনে একনায়ক আলি আব্দুল্লা সালের বিরুদ্ধে জনগণ রাস্তায় নামে। জবাবে সালে, মার্কিন-সৌদি জোটের সাথে আঁতাত শক্ত করে এবং সেই অনুষঙ্গে হুঠি বিদ্রোহীদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলার প্রচেষ্টা নেয়। জায়দি ইসলাম সংশ্লিষ্ট এই হুঠিরা সুন্নি সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই চালাত। তাই তাদের বিপরীতে সৌদি গোষ্ঠী, সুন্নি ধর্মনায়কদের মদত দিতে থাকে। তাদের বক্তব্য ছিল ধর্মীয় সামঞ্জস্যের কারণে হুঠিদের মাধ্যমে ইরান ইয়েমেনে থাবা বসাতে চাইছে। অতঃপর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও ইরানকে প্রতিহত করা – যুদ্ধে নামার জন্য এ দুটোই হয়ে দাঁড়ায় ওয়াশিংটনের ঘোষিত যুক্তি।
মার্কিন মিত্র সৌদি আরব একের পর এক বিমানহানা চালাতে থাকে ইয়েমেনের ওপর। মার্কিন যুদ্ধবিমানও আক্রমণ চালায়। সৌদি ফাইটারগুলোকে জ্বালানি ও অস্ত্রশস্ত্রের যোগানও দিতে থাকে মার্কিন সামরিক বিভাগ। ‘Destroying Yemen’-এর রচয়িতা অধ্যাপক ইসা ব্লুমির কথায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সৌদি সামরিক তৎপরতার প্রধান ও কেন্দ্রীয় কারক। কূটনৈতিক ও সামরিক দুদিক থেকেই এ বিধ্বংসকে ইন্ধন যোগাচ্ছে আমেরিকা। জেনারেল ডিনামিক্স, রেথিয়ন, বোয়িং, লকহিড মার্টিন প্রভৃতি ইউএস অস্ত্রনির্মাতারা সৌদি ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহিকে অস্ত্র বেচে বিপুল লাভ করছে। ওবামার আমলে এই লাভের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১১৫ বিলিয়ন ডলার। অধ্যাপক ইসা ব্লুমি আরো বলেন যে হতদরিদ্র ইয়েমেনের ওপর এই নারকীয় নির্যাতনের কারণ হল তাদের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণে বাধ্য করে তাদের তেল, গ্যাস ও অন্যান্য খনিজে ভরা প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডারের দখল নেওয়া। সেইসঙ্গে রয়েছে ইয়েমেনের সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান। ইয়েমেনে যুদ্ধ চালাতে সৌদি আরবের প্রতিদিন প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। কিন্তু তাতেও তাদের আখেরে লাভেরই আশা।
এর মধ্যে স্কুলশিশুদের বাসের ওপর বোমা পড়ে, যাতে প্রায় ৪৩ জনের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে অন্তত ২৯ জনের বয়স ১৫র নিচে। হোডাইডা বন্দরের প্রবেশপথের কাছে আল থাওয়া হাসপাতালেও মর্টার হানায় মারা যায় বহু মানুষ। সা’দায়, টানা ২০ মাস সৌদি আক্রমণে প্রায় ১০, ০০০ লোক মারা যায়, উচ্ছিন্ন হয় প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ। আর সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স মহম্মদ বিন সল্মন ‘ইয়েমেন যুদ্ধের ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ’ দেখিয়ে বলেন যে এর মধ্যে দিয়ে হুঠি বিদ্রোহীদের দমন করা যাবে। ওবামা ও পরে ট্রাম্প সরকারও এই সংঘাতকে হুঠিদের দমনে উচিত পদপক্ষেপ বলেই উল্লেখ করেন। কারণ হুঠিরাও ইয়েমেনীয় জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হল সৌদি-মার্কিন হানাদারীর বেশিরভাগটাই ইয়েমেনের অসামরিক অংশের ওপরে। ‘১৮-র এপ্রিল পর্যন্ত ১৭,২৪৩ এর বেশি বিমানহানায় ৩৮৬ টা খামার, ২১২ টা স্কুল, ১৮৩ টা বাজার ও ৪৪ টা মসজিদ বিধ্বস্ত হয়েছে। বিয়ে বা অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দিতে আসা মানুষজনও নির্বিচারে খুন হয়েছেন। আর সৌদি জোট বলে যাচ্ছে এগুলো খুচরো ভুল এবং তারা নিরপরাধ প্রাণ রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ করছে। এবং হুঠি সন্ত্রাস – সত্যিই যদি তেমন কিছু থাকে – এই ভয়ানক ধ্বংসলীলার সঙ্গে কোনো তুলনাতেই আসে না।
ন্যূনতম ত্রাণ বা সাহায্য আসার প্রধান পথ হোডেইডা বন্দরে বোমা বর্ষণ হয়েছে। সরবরাহ পৌঁছনোর অন্য সব পথও অবরুদ্ধ। এবং তার পক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে হুঠিদের হাতে ইরান থেকে অস্ত্র না ঢুকতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা। বিষয়টা আরো বেশি মারাত্মক কারণ ইয়েমেন, দেশের খাদ্যদ্রব্যের প্রায় ৯০ শতাংশ বাইরে থেকে আমদানি করে। ফলে খাদ্য ও জ্বালানি ঢোকার সব নৌ-পথগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অপরিহার্য জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ২ মে ২০১৭ তে রাষ্ট্রসংঘের প্রতিবেদনে পাওয়া যায় ইয়েমেনের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ অনাহারে রয়েছে। প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ শুধুমাত্র ত্রাণসামগ্রীর ভরসায় বেঁচে আছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০%। নরওয়েজিয়ান রিফ্যুজি কাউন্সিলের মতে ৭ মিলিয়ন ইয়েমেনি, মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষের শিকার। বিশ্বব্যাংকের মতে, আরো প্রায় ৮.৪ মিলিয়ন মানুষ আসন্ন দুর্ভিক্ষের মুখে দাঁড়িয়ে। ইউনিসেফের হিসাবমতো ৪৬০,০০০ এর বেশি শিশু অপুষ্টির শিকার। ৩.৩ মিলিয়ন শিশু ও গর্ভবতী বা স্তনদানকারী মহিলা তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। ১০,০০০ এর ওপর মানুষ মারা গেছে, যার মধ্যে ১৫৬৪ জন শিশু। বেকারীর হার ১৪%, দারিদ্র সর্বব্যাপী, মূদ্রাস্ফীতি চরমে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া, নিঃস্ব।
WHO-র হিসেবমতো ২০১৭ এপ্রিল থেকে ২০১৮ জুলাই এর মধ্যে ১.১ মিলিয়ন ইয়েমেনি কলেরাক্রান্ত, যার মধ্যে অন্তত ২৩১০ জন মারা গেছেন। ১৯৪৯ এর পর থেকে ধরলে এ হল পৃথিবীর শোচনীয়তম কলেরা মহামারী। এবং এর পিছনেও আসলে যুদ্ধেরই কালো ছায়া। হামলাবিধ্বস্ত নিকাশি ব্যবস্থার কারণে আবর্জনা জমে পানীয় জলে ভয়ানক দূষণ ছড়িয়েছে, আর তার ওপর পানীয় জল পরিস্রুতকরণ ক্ষেত্রগুলো জ্বালানির অভাবে দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ হয়ে আছে।
আবার এসবকিছুর ওপর রয়েছে উদবাস্তু সমস্যা। উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধবিক্ষুব্ধ ও দুর্ভিক্ষপীড়িত আরো অন্তত তিনটে দেশ থেকে বিপন্ন মানুষের পালানোর রাস্তা এই ইয়েমেনের ভিতর দিয়ে। পালাতে গিয়ে তারা এসে পড়ে আরো ভয়ঙ্কর পরিস্থির মধ্যে। ২০১৬ অর্থবর্ষে ইয়েমেনে ১১৭,০০০ জন উদ্বাস্তুর জায়গা হয়েছে। সোমালিয়া থেকে এসেছে প্রায় ২৫৫,০০০ জন। গোটা দেশ অভাব আর ভয় নিয়ে এক অপরিসীম অন্ধকারের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকারের হাই কমিশনার জেইদ রা’দ আল হুসেইন পরিস্থিতি পর্যলোচনা করে বলেন যে যথেষ্ট হয়েছে। এবার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নিতে হবে। পেটফোলা হাজার হাজার জীবন্ত কঙ্কালের বিস্ফারিত চোখ টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠা রুখতে মার্কিনদেরই এগিয়ে আসা উচিত। মার্কিন জনগণের উচিত দেশের সরকারকে সদর্থক নীতি নিতে বাধ্য করা। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ইয়েমেনে ড্রোন হানা ও সামরিক তৎপরতা এবং সৌদি জোটের সঙ্গে অস্ত্রের কারবার পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনীয় দের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মনে রাখা দরকার যে রাষ্ট্রসংঘের ইতিহাসে শোচনীয়তম দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ইয়েমেনে। সমস্বরে চীৎকার করে না উঠলে এই যুদ্ধোন্মত্ত ক্ষমতা আর বোমাবাজির আস্ফালন থামানো যাবে না। যদিও ইউএস কংগ্রেসের প্রবল সমালোচনাও ওবামা বা ট্রাম্পের এই যুদ্ধব্যবসার প্রকল্পে এতটুকু আঁচড় কাটতে পারেনি। এবং বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক বিচারে, সৌদি জোটের নির্বিচার হামলা ও মার্কিন ড্রোনহানা ইয়েমেনকে ধ্বংসের এমন শেষ সীমায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যে তারা অনেকেই এখন একমাত্র বিকল্প হিসেবে আল-কায়দা সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিচ্ছে। তাদের আর পথ নেই।
লেখক একজন শিক্ষক ও সামাজিক কর্মী। ছবির উৎস: mintpressnews.com, endgenocide.org, anonymous-news.com, reuters.com