এপিডিআর, চন্দননগর-এর আহ্বানে ১৬ জুলাই, ২০১৮ ভূপেন সেন স্মারক বক্তৃতা। ‘এনআরসি, জাতীয়তাবাদ ও গণবিপন্নতা’ শীর্ষক সেই বক্তৃতাটির এটি পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপ, যা কয়েকটি ভাগে গ্রাউন্ডজিরোতে প্রকাশিত হবে। এটি চতুর্থ (শেষ)পর্ব। লিখছেন বক্তা দেবাশিস আইচ।
বিজেপি-পালিত উপমন্যু কমিশন গলার জোরে ৪০ লক্ষ সংখ্যাটিকে ৫০ লক্ষে নিয়ে যেতে চেয়েছে। এদিকে এবারের এনআরসি-তে বাদ পড়ার তালিকায় রয়েছেন মুসলমান ছাড়াও বাংলা সমেত নানা ভাষা ও জনজাতির মানুষরা। হিন্দুরাও। বিজেপির নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলের উদ্দেশ্য অবশ্য এনআরসি-তে যে সমস্ত হিন্দুরা বাদ পড়বে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া। কারণ সঙ্ঘী পরিবার তথা বিজেপির কাছে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুরা ‘শরণার্থী’ এবং মুসলমানরা ‘অনুপ্রবেশকারী’। এই নিয়ে অসমিয়াদের এক বড় অংশের প্রবল আপত্তি রয়েছে। অন্যদিকে দরিদ্র সাধারণ মানুষ নাগরিকত্ব প্রমাণের চেষ্টায় ছুটে বেড়াচ্ছেন অফিস থেকে অফিসে, রাজ্য থেকে রাজ্যে -অনেকেই বেছে নিতে শুরু করেছেন আত্মহত্যার পথ।
প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব ও তৃতীয় পর্বের লিংক।
আবারও এনআরসি
হরেক কিসিমের আইন আদালত, নানা প্যাঁচ পয়জারের রাজনীতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গণহত্যা যা পারেনি, তাই করে দেখাল জাতীয় নাগরিকপঞ্জির নবীকরণ। এক কথায় অসমিয়া জাতীয়তাবাদের দাবিতে সিলমোহর বসিয়ে দিল যেন। আসু’র দাবি ছিল ৪০ লক্ষ মানুষ বিদেশি। পঞ্জির খসড়া তালিকাও যেন সুরে সুর মিলিয়ে বলছে, হ্যাঁ ৪০ লক্ষই বটে। এমনটা মনে হতেই পারে। এই গভীর বিপন্নতা নিয়ে কথা বলার আগে একটি খুবই কম আলোচিত বিষয়ে চোখ বুলিয়ে নেব।
অসম নির্বাচন শেষ হওয়ার পর পর কিন্তু বিদেশি শনাক্তকরণ কিংবা বিতাড়নের কোনও উচ্চনাদ ঢক্কানিনাদ শোনা যায়নি। আইন মোতাবেক উপায়ে দুটি পথ নেওয়া শুরু হয়। প্রথমটি হল, আইনজীবী উপমন্যু হাজরিকাকে অসম বিষয়ক একটি কমিশনের কমিশনার নিযুক্ত করে জাস্টিস রঞ্জন গগৈ ও জাস্টিস রোহিন্টন নরিম্যানের ডিভিশন বেঞ্চ। সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ পরবর্তীতে এনআরসি সংক্রান্ত রায় দেবে। উপমন্যু কমিশনকে বলা হল, তদন্ত করে জানানো হোক অসমের সীমান্তে বেড়া, রাত পাহাড়া, ফ্লাড লাইট ইত্যাদি যে বন্দোবস্তের আদেশ দিয়েছিল আদালত তার কী হল। কে এই উপমন্যু হাজরিকা? বিজেপি’র ছাত্র নেতা থেকে যাঁর উত্থান এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলি’র হাতে গড়া এক দুঁদে আইনজীবী। অসমে তেমন কোনো ভিত্তি না থাকলেও তিনি গড়ে তোলেন ‘প্রব্রজন বিরোধী মঞ্চ’। ২০১২ সালের কোকরাঝাড়ে বোড়ো-মুসলমান দাঙ্গার পর পর তিনি এই সংগঠন গঠন করেন। ঘোষিত লক্ষ্য, অসমকে বাংলাদেশি অভিবাসী মুক্ত করার জন্য অন্তিম লড়াই। কী হয়েছিল কোকরাঝাড়ে এক ফাঁকে একটু জেনে নিই। ২০১২ সালে কোকরাঝাড়ে বোড়ো-মুসলমান সংঘর্ষে ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। যার ৯০ শতাংশ মুসলমান। ঘর ছাড়া হয়েছিলেন ৩,৯২,০০০ মানুষ। তাদেরও সিংহভাগই মুসলমান। অভিযোগ উঠেছিল এই দাঙ্গায় অন্যতম প্রধান মদতকারী ছিল বিজেপি। এই এক সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ১২০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট জমা দেয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯৫১ সালে সেন্সাসে যারা নাগরিক তালিকা ভুক্ত তারা এবং তাদের উত্তরসূরি ছাড়া আর অন্য কাউকে বিক্রি করার, কেনার বা উপহার দেওয়ার জন্য জমি হস্তান্তর করার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক। এখান থেকেই কমিশনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যায়। অর্থাৎ, ১৯৫১’র পর যারা এ দেশে এসেছেন তারা যেন কেউ নাগরিকত্ব না-পান। রিপোর্ট আরো দাবি করে এই অভিবাসনের ফলে ২০৪৭ সালের মধ্যে অসমিয়ারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। সেন্সাস রিপোর্ট দেখলেই এই বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ হয়ে যাবে।
২০০১ সালের জনগণনার তথ্য বলছে, অসমে মোট ২৬.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে অসমিয়া ভাষাভাষীর সংখ্যা ১৩.১ মিলিয়ন। বাংলাভাষীর সংখ্যা ৭.৩ মিলিয়ন। এই দুই বৃহৎ ভাষিকগোষ্ঠী হল অসমের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। কিন্তু, মোট জনসংখ্যার ৪৮.৮ শতাংশ অসমিয়াভাষী। যেখানে ১৯৯১ সালে অসমিয়াভাষী ছিলেন মোট জনসংখ্যার ৫৭.৮ শতাংশ। অন্যদিকে, বাংলাভাষী জনসংখ্যা এই সময়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশ (১৯৯১) থেকে ২৭ শতাংশে (২০০১)। এর কারণ বোঝার আগে জেনে নেওয়া যাক যে এই ঝোঁক দেখা যাচ্ছে ১৯৭১ সাল থেকেই। ১৯৭১ সালে মোট জনসংখ্যার ৬১ শতাংশ ছিলেন অসমিয়াভাষী। ১৯৯১ সালে দেখা যাচ্ছে জনজাতি রাভা, বোড়ো, মিসিংদের জনসংখ্যা উচ্চহারে বেড়ে গিয়েছে। শতকরা বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ২৪৭ শতাংশ, ১২২ শতাংশ এবং ১১৫ শতাংশ। সমাজতাত্ত্বিক অনিন্দিতা দাশগুপ্তের মতে এ হল শিলং (১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অসমের রাজধানী) ও দিসপুরের অসমিয়াকরণের ভ্রান্ত নীতি। পাশাপাশি, জনজাতিদের আত্মপরিচয় এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও সজাগ হয়ে ওঠার লক্ষণ। বাঙালিভাষী জনসংখ্যা বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও বলা যায় যে, ১৯৫১ ও পরবর্তীতে চর ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার যে মুসলমানরা অসমিয়া পরিচয়ে পরিচিত হয়েছিলেন, অসম আন্দোলন এবং নেলি সেই ‘ন অসমিয়া’ বা নব্য অসমিয়া মুসলমানদের মোহভঙ্গের কারণ হয়েছে। তাঁদের একাংশ ফের বাংলাভাষী হিসেবে নিজেদের নিবন্ধিত করেছেন।
একই মত পোষণ করছেন সঞ্জয় হাজরিকা। তাঁর মতে, “This is happening not because of the migrants but because those who were for long in the tight grip of the larger Assamese fold want out, and want to be comfortable in their smaller ethnic formations: whether it is the Bodos, Tiwas, Karbis, Cacharis or Ravas. Each seeks its own space, territorial, linguistic and political. It appears more to have been the failure of the core Assamese middle class and caste Hindus which have failed to have a respectful relationships with the ‘others’ as well as their hold that smaller groups resent.”
অন্যদিকে, ২০১১ সালে অসমে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩১.১ মিলিয়ন। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল শতকরা ১৬.৯-এ। এই সময় জাতীয় বৃদ্ধির হার ছিল ১৭.৩। অর্থাৎ, ভারতের তুলনায় অসমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। মুসলমান জনসংখ্যা ৩০.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৪.২ শতাংশে। এ বৃদ্ধিও অভিবাসন নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুসলমানদের দারিদ্র, অশিক্ষা, সামাজিক পশ্চাদপদতা বেশি। আর এ কারণেই তাদের মধ্যে উচ্চ জন্মহার দেখা যায়।
আর একটি বিষয় এই কমিটি দাবি করে বসে যে, ২০০১ সাল পর্যন্ত অসমে বেআইনি অভিবাসীর সংখ্যা ৫০ লক্ষ। আটের দশকের আসু’র তুলনায় তিনি যে এককাঠি সরেস তা নিয়ে নিশ্চয় আর কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না। এই রিপোর্ট তুলে ধরে সঞ্জয় হাজরিকা প্রায় চোখ কপালে তুলে লিখছেন, “This is a staggering number for it is one sixth of the population of the state alone and just under one eight of the entire region. On what basis are such figures trotted out? For that number of people to have come into Assam, they would have had to cross the border every year at not less than 1,oo,ooo per year for fifty years. Is this humanly possible especially after Assam’s border shranks from over 800 kilometres with Bangladesh to less than 300 kilometres by 1971 with the creation of new state of Meghalaya? সঞ্জয় এখানেই শেষ করেননি তাঁর বক্তব্য। তিনি আরো হিসেব কষে দেখাচ্ছেন, এই ৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত, মানে অসম-বাংলাদেশ মূল সীমান্তের পাঁচ ভাগেরও কম এলাকা, যার আবার ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার নদী, বালিয়াড়ি আর গ্রীষ্ম-বর্ষায় বানভাসি, সে পথ দিয়ে যদি বছরে এক লক্ষ মানুষকে অনুপ্রবেশ করতে হবে। তার অর্থ, প্রতি ২৪ ঘণ্টায় অনুপ্রবেশ করতে হবে ২৭০-এর বেশি মানুষকে। উপমন্যু রিপোর্ট নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কোনও নির্দেশ জারি করেনি। এ বিষয়ে আলোচনাও হয়নি। তবে, এটি যে আসু, অগপ এবং বিজেপি’র একটি হাতিয়ার হয়ে রইল তা বলাই যায়।
অন্য এবং প্রধান আইনি ও প্রশাসনিক হাতিয়ারটি হল নাগরিক পঞ্জি। বর্তমান সর্বানন্দ সোনোয়াল সরকার নাগরিক পঞ্জি নবীকরণে বিশেষভাবে মনোযোগী। এবং যে কোনো বিরোধ সামলাতে নতুন করে আফস্পা জারি করতেও পিছপা হননি। শত মনোযোগের পরেও তালিকা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। বাদ পড়ার তালিকায় যে শুধু মুসলমান আছে তা তো নয়। দেখা যাচ্ছে রয়েছেন নেপালি, হিন্দিভাষী, রাজবংশী, এমনকি গারো জনজাতির মানুষরাও। বাঙালি হিন্দুরা তো আছেই। হিন্দুদের সমস্যা সমাধানে বিজেপি নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল এনেছে। যে বিলের উদ্দেশ্য হল এনআরসি-তে যে সমস্ত হিন্দুরা বাদ পড়বে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া। সঙ্ঘী পরিবারের কাছে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুরা ‘শরণার্থী’ এবং মুসলমানরা ‘অনুপ্রবেশকারী’। আরএসএস-এর নীতিকেই এই সুযোগে আইনি মর্যাদা দিতে চাইছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই নিয়ে অবশ্য আসু, অগপ-সহ অসমিয়াদের এক বড় অংশেরই প্রবল আপত্তি রয়েছে। তারা যে হিন্দু-মুসলমানে বিরোধ চায় না, তা এই জন্য নয় যে তা সাম্প্রদায়িক, পক্ষপাতমূলক কিংবা ভারতীয় সংবিধানের ১৪ ধারার পরিপন্থী। যেখানে বলা হচ্ছে, আইনের চোখে সবাই সমান। তারা হিন্দু বাঙালিকেও বিদ্বেষের চোখেই দেখে।
কেন ১৯৫১?
বেশ কিছুকাল আগেই এ প্রশ্ন তুলেছেন এবং তার উত্তরও দিয়েছেন অনিন্দিতা দাশগুপ্ত। ১৯৪১ ও ১৯৫১’র জনশুমারির তথ্যের মধ্যে তুলনা করে তিনি জানান, ‘৪১-এর তুলনায় ‘৫১-য় মুসলমান জনসংখ্যা ১৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এর কারণ ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যার ফলে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী মুসলমান দেশান্তরী হয়েছিলেন। কত তাঁদের সংখ্যা গবেষক বি পি মিশ্রের গবেষণাকে উদ্ধৃত করে অনিন্দিতা জানাচ্ছেন, গোয়ালপাড়া থেকে ৬০ হাজার, কামরূপ থেকে ২০ হাজার এবং দরং জেলা থেকে ৬ হাজার মানুষ দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। দেখা গিয়েছে ১৯৫০, ১৯৬০, ১৯৭০ জনশুমারির ঠিক পূর্ববর্তী বছরেই নিম্ন অসমে সংখালঘু নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং মুসলমান বিরোধী দাঙ্গা সংগঠিত করা হয়েছে। পাশাপাশি, সাংসদ হেম বরুয়ার গ্রন্থ ‘রেড রিভার এন্ড ব্লু হিলস’ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন অনিন্দিতা। আমরা জানতে পারছি, দেশভাগের সময় অসমের ‘৫৩ হাজার মুসলমান পরিবার দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন।” এর একটি বড় অংশ নেহরু-লিয়াকত চুক্তির ফলে ফিরে আসেন বটে কিন্তু ১৯৫১ সালের সেন্সাসে তাঁদের নাম নথিভুক্ত হয়নি। অতএব, ১৯৫১’র নাগরিক পঞ্জিতে নথিভুক্ত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এছাড়াও কম করে দু’লক্ষ হিন্দু বাঙালি এবং গারো উদ্বাস্ত ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। স্বাভাবিক ভাবেই ১৯৫১-র তালিকায় তারাও নেই।
অনিন্দিতা জানাচ্ছেন, “This departure of a significant proportion of the population of lower Assam found categorical mention in the census report of 1951, which noted that there was a “clear underestimation of some 68,815 persons”. A subsequent census report also stated that “there may have been some Muslims of Goalpara and Kamrup who might not have been able to comeback to their homes in Assam during the 1951 census, (and) some Muslims living in chars and sandbanks of river Brahmaputra also might have been left out of the 1951census”.” অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে এক ধাক্কায় বেশ কিছু মানুষকে ১৯৫১-র নিরিখেই আইনত বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া গেল।
অতঃকিম
এই লক্ষ লক্ষ বিপন্ন মানুষ কীভাবে রক্ষা পাবেন কোথায় যাবেন তা সত্যিই আমার জানা নেই। বাংলাদেশ এই মানুষদের গ্রহণ করবে না। আর এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মতো পড়শিকে বিব্রত করতে চাইবে না ভারত। একটি তো জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। অন্যটি অর্থনৈতিক। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, ভ্রমণ ও বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশ গুয়াহাটিতে এবং ভারত সিলেট ও খুলনায় হাই-কমিশনের কার্যালয় স্থাপন করতে চলেছে। ২০১৫ সালে দু’দেশ এ বিষয়ে একমত হয়েছে। এবং এই সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে ২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক চুক্তি হয়। ইতিমধ্যেই উত্তর-পূর্ব ভারতে বাণিজ্যি পরিবহণ নিয়ে একটি চুক্তির খসড়া অনুমোদন করেছে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা। পাঁচ বছরের এই চুক্তির ফলে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে আগরতলা-আখাউড়া, ডাউকি-তামাবিল, সুতারকান্দি-শেওলা এবং বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর চেকপোস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশি ট্রাকে ভারতীয় পণ্য পাঠানো হবে। যার সবিশেষ ফল ভোগ করবে বিশেষভাবে অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ। এইতো গত ১০ সেপ্টেম্বর ত্রিপুরা-বাংলাদেশ রেল সংযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা হল। ছিলেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এই আগরতলা-চট্টগ্রামের আখাউড়ার মধ্যে প্রস্তাবিত রেলপথ বাস্তবায়িত হলে শুধু উত্তর-পূর্ব নয় উপকৃত হবে পশ্চিমবঙ্গও। আগরতলা ও কলকাতার মধ্যে রেল সংযোগের ক্ষেত্রে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে। ‘লুক ইস্ট’ নীতির উদগাতারা এই সুযোগ হারাতে চাইবে না।
অন্যদিকে, নাগরিক পঞ্জি বিষয়ে মূলত তিনটি মত উঠে আসছে। এক, অসমিয়া জাতীয়তাবাদ, আসু’র বিদেশি তাড়াও স্লোগানের বকলমে অনঅসমিয়া বিদ্বেষ, বিজেপি’র ফ্যাসিস্ট শাসন এবং মুসলমানদের প্রতি ঘৃণার তথ্য তুলে ধরে একটি পক্ষ এনআরসি বাতিলের দাবি তুলছেন। দ্বিতীয় একটি মত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভাবে এনআরসি কর্তৃপক্ষ কাজ করুক। যাতে চিরদিনের জন্য এই বিদেশি খেদাওয়ের রাজনীতি বন্ধ হয়। তৃতীয় পক্ষ ৪০ লক্ষে খুশি নয়। তাদের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ লক্ষ। এর জন্য যে কোনো পদক্ষেপ তারা করবে বলেই মনে করছে প্রথম পক্ষ। তাদের মতে, অত্যন্ত সংগঠিত ভাবে খেদাওবাদীরা তালিকা মুক্তদের বিরুদ্ধে আপত্তি জানাবে। ফলে সংখ্যাটি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নানা সূত্রেই বার বার এ কথা উঠে এসেছে যে বন্যায়, দাঙ্গায় ভিটেমাটি নথি হারানো হতদরিদ্র মানুষ প্রমাণই করতে পারবেন না তাঁরা এদেশের নাগরিক নন। সংবাদপত্রের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বার বার সে তথ্য উঠে আসছে। মুসলিম মহিলাদের ক্ষেত্রে পদবির হেরফের হয়। সাধারণ ভাবে অবিবাহিতা খাতুন হলে বিয়ের পর তিনিই বিবি কিংবা বেগম ব্যবহার করেন। আবার স্বামীর মৃত্যুর পর হয়ে যান অমুক বেওয়া। এই তফাতও নাগরিকত্ব পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পূর্ব পুরুষের পদবি বা নামের বানান ভুল হলেই বিদেশি বলে সাব্যস্ত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। জন্মের শংসাপত্র নেই এমন মানুষ তো ভূরি ভূরি। আবার তাদের মধ্যে যারা মাধ্যমিক অবধি পৌঁছায়নি, তাদের পক্ষে তো জন্ম তারিখ প্রমাণই করা সম্ভব নয়। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও গ্রাহ্যে আনা হচ্ছে না পঞ্চায়েতের শংসাপত্র। ভিন রাজ্য থেকে যাঁরা জীবিকার কারণে কিংবা বিবাহ সূত্রে স্থায়ী বসবাস করছেন তাঁদের লিগ্যাসি ডেটা তো স্ব স্ব রাজ্যে। সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে হাজির করতে না পারার জন্য প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষের নাম তালিকায় ওঠেনি। তাঁরা পাগলের মতো রাজ্যে রাজ্যে ছুটে বেড়াচ্ছেন। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি ১ লক্ষ ১৪ হাজার ৯৭১। এতকাল বাদে প্রকাশিত হচ্ছে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের কাজের নানা অসঙ্গতি, কর্মচারীদের একাংশের চরম দুর্নীতি, আইনজীবী ও আইনরক্ষকদের একাংশ কীভাবে গরিব মানুষকে আর্থিকভাবে চুষে ছিবড়ে করে ছেড়েছেন সে কাহিনি। এতকালের যাবতীয় আইনি, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক অপদার্থতার বলি হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। ইতিমধ্যেই আত্মহত্যার সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছেছে। মায়ের নাম বাদ পড়েছে অথচ নতুন করে নথিপত্র নিয়ে হাজিরা দিতে যে অর্থ লাগে তা নেই বলে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ছেলে। ‘ডি’ ভোটার বলুন, ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা বন্দিরা বলুন কিংবা পঞ্জিহারা – সিংহভাগই হা-গরিব দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। শুধু চল্লিশ লক্ষ নয়, প্রকৃত অর্থে সারা দেশকেই এক চরম বিপন্নতার মধ্যে ঠেলে ফেলা হল। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের কোনও চটজলদি সমাধান সূত্র নেই। তবে, মনে হয়, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নবীকরণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং আইনের দ্বারস্থ হওয়া একান্ত জরুরি।
ব্যবহৃত গ্রন্থ, পত্রিকা ও সংবাদপত্র:
১। সুবীর চৌধুরী, ট্রাবলড পেরিফেরি, ক্রাইসিস অভ ইন্ডিয়াজ নর্থ ইস্ট, সেজ, ২০০৯
২। ড. দেবব্রত শর্মা, অসমীয়া জাতিগঠন আরু জাতীয়-জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠানসমূহ, (১৮৭৩-১৯৬০), একলব্য প্রকাশন, ২০০৭
৩। সঞ্জয় হাজরিকা, রাইটস অভ প্যাসেজ, বর্ডার ক্রসিং, ইমাজিন্ড হোমল্যান্ডস, ইন্ডিয়া’স ইস্ট এন্ড বাংলাদেশ, পেঙ্গুইন বুকস, ২০০০
৪। সঞ্জয় হাজরিকা, স্ট্রেঞ্জার্স অভ দ্য মিস্ট, টেলস অভ ওয়ার এন্ড পিস ফ্রম ইন্ডিয়া’স নর্থইস্ট, পেঙ্গুইন বুকস, ২০১১
৫। সঞ্জয় হাজরিকা, স্ট্রেঞ্জার্স নো মোর, আলেফ বুক কোম্পানি, ২০১৮
৬। সজল নাগ, এক ঢিলে দুই পাখি, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ আগস্ট, ২০১৮
৭। দেবাশিস আইচ, আর ক’কটি উপত্যকা পেরোবেন কালীকিশোরেরা?, গ্রাউন্ড জিরো, অগস্ট ২০১৮
৮। মিলন দত্ত, মাতৃভাষা-হারানো এক বিস্মৃত বাঙালির বৃত্তান্ত, আরেক রকম
৯। প্রবীর কুমার তালুকদার, নর্থ-ইস্টার্ন ফোরে, ফ্রন্টলাইন, জুন ১০, ২০১৬
১০। উদয়ন মিশ্র, ভিকট্রি ফর আইডেনটিটি পলিটিকস, নট হিন্দুত্ব ইন আসাম, ইপিডাবলিইউ, ২৮ মে, ২০১৬
১১। সৌমিত্র বৈশ্য, আসাম চুক্তি, এনআরসি-র বিভীষিকা এবং ইতিহাসের প্রেক্ষাপট, শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০১৮
১২। দেবব্রত ঠাকুর, জয় এল আঁতে ঘা দিয়েই, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮
১৩। অনিন্দিতা দাশগুপ্ত, দ্য মিথ অভ দি আসামিজ বাংলাদেশি, হিমল সাউথএশিয়ান, প্রথম প্রকাশ অগস্ট ২০০০, পুনঃপ্রকাশ ৩১ জুলাই, ২০১৮
ছবি সৌজন্যে – এপিডিআর, চন্দননগর
লেখক স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।