গ্রাউন্ডজিরো: প্রাসাদনগরী কলকাতায় অনেকগুলি দ্বীপ আছে, যার খবর খুব কম লোকে রাখে। শ্যামবাজার থেকে যশোর রোড ধরে নাগেরবাজার যেতে, মাঝে পড়ে পাতিপুকুর রেল ব্রিজ। সেখান থেকে সামান্য এগিয়ে লেক টাউনের বিপরীতে তেঁতুলতলার কাছে প্রধান সড়ক থেকে আঁকাবাঁকা গলিপথ ধরে বেশ কিছুটা ভিতরে গোয়ালাবাগান বস্তি। দেশবিভাগের পর থেকে ১৭/১৮টি উদ্বাস্তু পরিবার সেখানে বসবাস করে আসছে। জঙ্গল সাফ করে যারা প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাঁরা তো আর নেই। এখন তাঁদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম সেখানে দিন অতিবাহিত করছে।
এক/দেড় কাঠা জমিতে এক বা দুই কামরার টালির ঘর। বর্ষাকালে বুক সমান ঘাস গজিয়ে ওঠে। সাপখোপের উপদ্রব দেখা দেয়। অধিবাসীদের অবস্থা ‘দিন আনি দিন খাই’ গোত্রের। গোয়ালাবাগান বস্তির অধিবাসীরা টেকনিক্যালি বিপিএল কিনা, সেটা বিশেষজ্ঞদের বিচার্য বিষয়। কিন্তু বর্ষা সুযোগ পেলেই তাঁদের ঘরে প্রবেশ করতে পারে। জটিল অসুখে হাসপাতালের ফ্রি বেড তাঁদের ভরসা। সে যাই হোক, সুদীর্ঘ ৫০ বছর তাঁরা নির্ঝঞ্ঝাটেই দিন কাটিয়েছেন। গত প্রায় দশ বছর ধরে তাঁদের জীবনের শান্তি হরণ করেছে এলাকার কিছু গুন্ডা তথা জমি-মাফিয়া। বস্তিবাসীদের ঊচ্ছেদ করে জমি দখলের জন্য ক্রমাগত তারা বস্তিবাসীদের উত্যক্ত করে যাচ্ছে। ঘরের টালি ভেঙে গেলে বা ফুটো হলে তা সারাতে দিচ্ছে না, জঙ্গল সাফ করতে দিচ্ছে না। অকথ্য গালিগালাজ, মেয়েদের হেনস্থা, মারধর কিছুই বাদ যায়নি। দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে লেকটাউন থানায় FIR দায়ের করা হয়েছে, পুলিশে অসংখ্য ডায়েরি করা হয়েছে। কাজের কাজ বিশেষ কিছুই হয়নি। অত্যাচার নিবারণ এবং সুস্থ বসবাসের অধিকারের দাবিতে বিধাননগর পুলিশ কমিশনার, উদ্বাস্তু, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, স্থানীয় বিধায়ক— নিচ থেকে উপর সর্বত্র আবেদন জানিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি। স্থানীয় কাউন্সিলর কিছুটা দয়াপরবশ হয়ে মিউনিসিপ্যালিটির সাহায্যে একবার জঙ্গল সাফ করে দিয়েছিলেন। এটুকু মাত্র প্রশাসনিক সাহায্য বস্তিবাসীরা পেয়েছেন।
ইতিমধ্যে RTI আইনে দরখাস্ত করে, BLLRO অফিস থেকে জানা গেছে, দখলিকৃত জমির মালিকদের কোনো হদিস নেই। উত্তর ২৪-পরগণা জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিকের নিকট দখলিস্বত্ব রেকর্ডের জন্য আবেদন জানানো হয়। BLLRO অফিস থেকে একটা তদন্তও হয়। সেই তদন্তেও জমি মাফিয়ারা বাধাদান করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত BLLRO রিপোর্টে দরখাস্তকারীদের দীর্ঘদিনের দখল এবং নথিভুক্ত মালিকদের অস্তিত্বহীনতা স্বীকার করে নেওয়া হয়। ২০১৬ সালে সংশ্লিষ্ট কালিদহ, জে এল নং ২৩ মৌজায় যখন সেটেলমেন্ট রেকর্ড প্রস্তুতির কাজ শুরু হয় (সে এক হবুরাজা-গবুমন্ত্রীর অদ্ভুত নিয়ম। কাঁচা রেকর্ড প্রস্তুতই হল না, কিন্তু খসড়া প্রকাশ হয়ে গেল।), তখন সমুদয় বস্তিবাসীর পক্ষে দখলকারীদের নাম নথিভুক্ত করার জন্য নিয়ম মেনে ‘আপত্তি’ দাখিল করা হয়। আপত্তি নাকচ হয়। আপিল করা হয় DLLRO অফিসে। দখলকারীদের নাম নথিভুক্ত হওয়া বিধিসম্মত হওয়া সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ আপিল নাকচ করে দিলেন। কী অদ্ভুত রেকর্ড। অস্তিত্বহীন ব্যক্তিদের নাম নথিভুক্ত হয়ে রইল। বাস্তবদের অস্বীকার করা হল। মাফিয়াদের জমি লুঠের রাস্তা পরিষ্কার করে দেওয়া হল।
আদালতেও মামলা করেছেন গোয়ালাবাগান বস্তির অধিবাসীরা। কোর্টে তারিখের পর তারিখ পড়ছে। আবেদনকারীরা হাজিরা দিছেন। কিন্তু শুনানির সময় আর হয় না। মাফিয়ারা মজা দেখছে।
১৭ এপ্রিল ২০১৮-র ঝড়ে কলকাতার অন্য অঞ্চলের মতো গোয়ালাবাগান বস্তিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। অনেক ঘরের চাল উড়ে গিয়েছিল। পরের দিন বস্তিবাসীরা যখন ঘর সারাইয়ের উদ্যোগ নেন, মাফিয়া বাহিনী দলবদ্ধ ভাবে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘর মেরামত তারা করতে দেবে না। এই অবস্থায় বস্তিবাসীদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। গত ২১ তারিখ, শনিবার, বস্তির মহিলা-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে যশোর রোডে পথ অবরোধ করেন। ঘটনাচক্রে শাসকদলের রাজ্যসভার এক সদস্যের গাড়িও পথরুদ্ধ হয়। পুলিশ এসে এমপি-র গাড়ির পথ করার চেষ্টা করলে অবরোধকারীরা আরোহীর পরিচয় জানতে পারেন এবং তাঁর গাড়ি ঘেরাও করেন। এমপি মহাশয় ধৈর্য ধরে অবরোধকারীদের বক্তব্য শোনেন। স্থানীয় কাউন্সিলর এবং বিধায়ককে ফোন করে খোঁজখবর করেন। অবশেষে পুলিশের পক্ষ থেকে সুরক্ষার সুনির্দ্দিষ্ট আশ্বাস পাওয়ার পর অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
গরিব মানুষ ঘরের সামান্য চালটুকুও বজায় রাখতে পারছে না, এমনই হয়েছে রাজ্যের হাল। ঘরের চাল ছাওয়ার জন্যও ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষদের পথে নামতে হয়। ক্ষমতার মদত না থাকলে মাফিয়াদের এত বাড়বাড়ন্ত হয় না। গোয়ালাবাগান বস্তি জানে, তাঁদের উচ্ছেদ করার পিছনে কে বা কারা কলকাঠি নাড়ছে। স্থানীয় বিধায়কের নীরবতা সত্যই বিস্ময়ের।