ভিটেমাটি হারানোর রোজনামচা


  • August 5, 2018
  • (0 Comments)
  • 3425 Views

বাংলাদেশ-নিবাসী ফটোগ্রাফার আসমা বীথি ও মইনুল আলমের সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে উঠে এল ভিটেমাটি ছাড়া রিফিউজি জীবনের নানা মুহূর্ত, শরণার্থী শিবিরের রোজনামচা। তাঁদের এই কাজটিকে আরও গভীরে বুঝতে চেয়ে ইমেলে আসমা বীথির সাক্ষাৎকার নিলেন নন্দিনী ধর

আলোকচিত্রী আসমা বীথির সাথে আমার পরিচয় কলকাতায়। আসমা চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের মেয়ে, সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন কলেজ স্ট্রীটের সি. গুহ মেমোরিয়াল গ্যালারি(বইচিত্র)তে “দ্য ইনফ্লাক্স প্যাসেজ” নামে তাঁর ও মইনুল আলমের আলোকচিত্র প্রদর্শনী উপলক্ষে। প্রদর্শনীর মূল বিষয়বস্তু সাম্প্রতিক সময়ের রোহিঙ্গা সংকট। বিশেষ করে, আসমা ও মইনুল ক্যামেরাবন্দি করেছেন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের রোজনামচা।

যখন আসমার প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম, তখন মাথার ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলছিলো আসামের এনআরসি। আজ এনআরসি বাস্তব। এই দেশভাগ, শরণার্থী-স্মৃতি-বাস্তবতা পীড়িত এই উপমহাদেশে আবার ঘরছাড়া, রাষ্ট্রবিহীন, নাগরিকত্ববিহীন হতে চলেছেন ৪০ লক্ষ মানুষ। বিশ্বজুড়েই — তা সে মধ্যপ্রাচ্যে হোক, অথবা দক্ষিণপশ্চিম আফ্রিকা — কাতারে কাতারে মানুষ আবার ভিটেমাটিছাড়া। শরণার্থী শিবিরের একফালি ঘরেই তাঁদের গার্হস্থ্যজীবন। তবু মানুষ বাঁচতে চায়, সৌন্দর্য খোঁজে। সেই অন্বেষণের অন্যতম দলিল আসমার ছবি।

নন্দিনী: আলোকচিত্রী হিসেবে আপনার যাত্রাপথের কথা একটু বলুন? আপনি ফটোগ্রাফির মাধ্যমটি বেছে নিলেন কেন?

আসমা: মুহূর্ত অতীত হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে-মুহূর্তে। ব্যাপারটি সবসময় আমার কাছে বিস্ময়কর। অতীত মুহূর্তটিকে চোখের সামনে নিমিষে এনে দিতে পারে একটি ছবি। বুদ্ধি হবার বয়স থেকেই এটা উপভোগ করতাম। সাইবার শটে প্রচুর ছবি তুলেছি। ডিএসএলআর হাতে পাবার ঘটনা বেশীদিনের নয়। বছর সাতেক। যখন এই মাধ্যমটিকে বেছে নিলাম, তখন ভালো লাগা ছাড়া আর কিছু কাজ করেনি। এখন ভাবি…

ন:ফটোগ্রাফি কী পারে যা সাংবাদিকতা পারে না?

আ: ফটোগ্রাফি সাংবাদিকতার অংশ। সম্পর্কহীন তো নয়, খুবই সম্পর্কযুক্ত।

ন: রোহিঙ্গাদের শরণার্থী-জীবনের টুকরো টুকরো ছবি ক্যামেরাবন্দি করতে গিয়ে আপনি ঠিক কি কি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?

আ: বাইরে থেকে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়িনি। ভেতরে ভেতরে অনেকগুলো বিষয় মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই যেমন ওদের ভাষাটা বুঝি না, মন খুলে কথা বলতে পারছি না। অপরের সাহায্য লাগছে। তারপর এমন-এমন সব পরিস্থিতি এসেছে শাটার অন করব না পরিস্থিতির পাশে দাঁড়াবো, এই ধরনের জটিলতা কাজ করেছে। ফটোগ্রাফার হিসেবে প্রথমে উপযুক্ত ক্লিকটিই করে ফেলা উচিত জানি, কিন্তু সবসময় দ্বিধামুক্ত হতে পারিনি।

ন: আপনার কি মনে হয় প্রাত্যহিক জীবনের যে ছোটোখাটো মুহূর্তগুলো হারিয়ে যায় প্রথাগত ইতিহাসের আখ্যান থেকে, ফটোগ্রাফি সেই মুহূর্তগুলিকেই একধরনের মান্যতা দেয়? সেই জায়গা থেকে জিজ্ঞেস করি, রোহিঙ্গা শরণার্থী জীবনের ছবি তোলার মধ্য দিয়ে আপনি ঠিক কি ধরনের ইতিহাস লিখতে চেয়েছেন? একে কি বিকল্প ইতিহাস বলা যায়? 

আ: সচিত্র ইতিহাস। বিকল্প নয়। একটা ঘটনার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, ভবিষ্যতে অনেক কিছু বদলে যেতে পারে, কিন্তু যা আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করছি, সেখানে তো মিথ্যার কোনো জায়গা নেই। ইতিহাসবিদদের জন্য প্রামাণ্য়‌ দলিল হিসেবে ছবি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

ন: শরণার্থী জীবনের ছবি তুলতে গিয়ে বহু জায়গায় আপনি ক্যামেরার ফোকাস নিয়ে খেলেছেন। কেন?

আ: ফোকাস নিয়ে কোনো এক্সপেরিমেন্ট‌ করিনি। মইনুল আলমের একটিমাত্র ছবিতে ফোকাস ভিন্ন জায়গায় ছিল, যেটি ঐ বিশেষ ছবিটার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ছিল। ব্যানারে ছবিটা ব্যবহার করা হয়েছে।

ন:ফটোগ্রাফির কাছে একটি জনপ্রিয় দাবি যে, ছবি যেন সুন্দর হয়। বিশেষ করে, যাকে আমরা কমার্শিয়াল ফটোগ্রাফি বলে থাকি। আপনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে এই কাজটি করতে গিয়ে অনেকাংশেই এই সৌন্দর্যের ফাঁদে পা দেননি। কেন ? কীভাবে? সাধারণভাবে, আপনি কীভাবে ফটোগ্রাফির কাছে এই যে পণ্যায়নের দাবি, তার মোকাবিলা করেন?

আ: হ্যাঁ, এটা সচেতনভাবেই। শুধু এই ক্ষেত্র বা বিষয়টিকে ঘিরে নয়, সর্বক্ষেত্রে চমকপ্রদতাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। আমার অন্য ছবির গল্পগুলোও সম্ভবত একই কথা বলবে। মুখাবয়বের খোলসের চাইতে আত্মাকে ফুটিয়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপারটা কঠিন। আবার মনে হয় কঠিনও নয়। বিষয়বস্তুকে সময় দিলে, পর্যবেক্ষণ করলে সেই আত্মাটি ধরা দেয়।

ন:আপনি বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে কবি বলে বর্ণনা করেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ওপর আপনার যে কাজ, সেখানে কবিতা কোথায় ? গণহত্যার বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কি কবিতা হয় ? সেখানে ছবির ভূমিকা কি ?

আ: যখন একজন চিত্রকর, যাঁর ছবি আঁকার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তিনি যখন ছবি তুলবেন, স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কম্পোজিশন সেন্স, কালার সেন্স, ফ্রেমিং ইত্যাদি অন্যদের তুলনায় অগ্রসর হওয়ার সুযোগ থাকবে। যে কবিতা লেখে তার কল্পনাশক্তি, চিত্রকল্প, অন্তর্গত অনুভূতি ইত্যাদি ছবি তোলার ক্ষেত্রে নিশ্চয় আলাদা কোনো মাত্রা দিতে পারে। অন্তত দেওয়ার কথা। এটাকে একটা কৌতূহল-উদ্দীপক সম্ভাবনার জায়গা হিসেবে দেখতে পারেন। আর গণহত্যার বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কবিতা হয় কি না? বরং বেশী করে হয়! সমাজ যখন স্থিতিশীল থাকে, এমনকী ব্যক্তিমানুষও, তখন কিন্তু সৃষ্টিও শ্লথ হয় নিত্যকার যাপনের মতো। কবিতা বা যেকোনো শিল্পের অবদানই প্রত্যক্ষে নয়। এটা যদি কেউ ব্যাংকিং লেনদেনের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে চায় তবে মুশকিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এত এত গান-কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল দুর্বার প্রেরণা। সরকার আলতাফ মাহমুদকে পাক-হানাদাররা তুলে নিয়ে গিয়েছিল তা কি এমনি? বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও একই বিষয় — মহৎ সব চলচ্চিত্র, রচনা সৃষ্টি হয়েছে দুর্ভি‌ক্ষপীড়িত, যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে। ছবির ভূমিকা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ছবির ভূমিকা প্রেরণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের কোন প্রান্তে কি ঘটছে — ছবির বার্তা বিশ্ব-পরিস্থিতি তোলপাড় করে দিতে পারে।

ন: আপনার ছবি তথ্যকথা না শিল্প? একটু বিশদে বলুন?

আ: দর্শক বলুক।

ন: আচ্ছা, কোনো একটি বা দুটি ছবিকে ধরে তার পিছনের গল্পগুলি একটু বলবেন? যা আপনি কাজ করতে গিয়ে জেনেছেন, কিন্তু ছবিতে ধরা সম্ভব হয়নি? 

আ: থ্যাংখালি ক্যাম্পটি নতুন হচ্ছিল মাত্র। এই ক্যাম্পের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গারা তখন সবেমাত্র তাদের নতুন ঠিকানায় নিজেদের প্রস্তুত করছিল। আমরা ঘরে-ঘরে ছবি তুলছিলাম। টিলামতো বিস্তৃত উঁচু-নিচু পাহাড় চারপাশে। একপাশ থেকে সব জায়গায় অন্য পাশটা দেখা যায় না। সন্ধ্যা প্রায়। হঠাৎ দেখি একটা আট-ন বছরের বাচ্চা ছেলে হাউমাউ করে কাঁদছে। তাকে ঘিরে আরও অনেকে। ছেলেটির হাতে জলভরা ২ লিটার মিনারেল ওয়াটারের তিনটি বোতল বুকের কাছে ধরা। সে কাঁদছে আর চারপাশে দিশেহারা দৃষ্টি দিয়ে সব একইরকম দেখতে ছোট-ছোট ঘরগুলোর মধ্যে তার নিজের ঘরটি খুঁজছে। যেখানে তার মা-বাবা, অন্য স্বজনরা রয়েছে। এটি হয়তো উল্লেখ করার মতো কোনো ঘটনা না। একটি বাচ্চা ছেলে জল আনতে গিয়ে তার ঘরটি হারিয়ে ফেলেছে। এবং নিশ্চয় খুঁজেও পেয়ে গেছে। কিন্তু ঐ যে মুহূর্তটি, শিশুটির চোখে-মুখে যে আতঙ্ক-অসহায়ত্ব-বিপন্নতা দেহেছি, তা আমাকে বাস্তুচ্যুত, ভিটেছাড়া প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গার মনের অবস্থা বুঝতে সাহায্য করেছে। এই ছবিটি তোলা হয়নি।

ন:কখনো কি আপনার ছবি তুলতে গিয়ে মনে হয়েছে যে আপনার ক্যামেরা বড় বেশি একটি মানুষ বা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত জীবনে অনুপ্রবেশ করছে? হয়ে থাকলে নিজের কাজে এই বোধকে প্রতিহত করেন কীভাবে? 

আ: এই ক্ষেত্রে মনে হয়নি কেননা ওরা তো নিজের দেশে রাষ্ট্রীয় রোষানলের শিকার। অন্য একটি রাষ্ট্রে জীবন বাঁচাতে এসে পড়েছে। এখানে মিডিয়া, ক্যামেরা ওদের পাশে থাকার মানে পরিস্থিতির পরিবর্তন, উন্নয়ন। অন্তত এই সময়ে। আর অন্যসময়, অন্যান্য ক্ষেত্রে তখনই মনে হয় যখন একটা মুহূর্ত তৎক্ষণাৎ ক্লিক করতে হয়। অনুমোদন নিতে গেলে মুহূর্তটির মৃত্যু ঘটছে। তো, মোকাবিলাটা ওভাবেই হয়ে থাকে, বিষয়বস্তুর সাথে ঘনিষ্ঠতার মধ্যে দিয়ে। এর কোনো বিকল্প নেই।

ছবি – প্রদর্শনী থেকে (আসমা বীথি ও মইনুল আলম)

Share this
Leave a Comment