বিপর্যয় এলে কী হবে সেই আলোচনার চাইতে অনেক বেশি জরুরি বিপর্যয় আটকানো। যে কারণে বিপর্যয় ঘটতে পারে, ঘটছে, তার প্রতিকার।
তিথি রায়
Groundxero | Oct 09, 2025
কাশ্মীর, হিমাচল, উত্তরাখান্ড, উত্তরবঙ্গ – গোটা হিমালয় জুড়ে বিধ্বংসী বন্যা ও ধস নামার ঘটনা ঘটে চলেছে পালা করে। ধর্মীয় বিশ্বাসে, হিমালয়ে বসবাস ঈশ্বরের। এ জমানায়, পুঁজি-বাজার-মুনাফাকেই আমরা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মত ঐশ্বরিক সত্য বলে মেনে নিয়েছি। ফলে, বিধির বিধান হিসেবে এমন ধ্বংসলীলা মেনে নিতেই হবে। আমাদের ভালো থাকা এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য ‘উন্নয়ন’ চাই। এবং সেই ‘উন্নয়ন’ ভাবনা একমাত্রিক নগরায়ন ও পন্যায়ণের। গোদাভাবে বললে, বাজার বানাও, পুঁজি ঢালো, মুনাফা কামাও। পর্বত-অরণ্য-নদী-চা বাগান যেখানে যেভাবে যতটুকু সম্ভব মুনাফা চাই। তবে, এই সত্যের নীচে আরেক সত্য চাপা পড়ে আছে, যা আমাদের ‘উন্নয়ন’ ‘উন্নয়ন’ বলা সরকার, তাদের বেরাদর পুঁজি-মালিকরা ভুলিয়ে রেখেছে। কী সেই সত্য? এই ছোট লেখায় একটু পরিষ্কার বোঝাবুঝি করতে চাইছি।
উত্তরবঙ্গের বন্যা সংক্রান্ত হালহকিকত, ক্ষয়ক্ষতি ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছেন পশ্চিমবঙ্গবাসীরা। তা নিয়ে বর্ণনায় না গিয়ে কিছু কাজের কথা বলা যাক। উত্তরবঙ্গের এই ভয়াবহ বন্যা/ধস আজকের বিষয় নয়। উত্তরবঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন আসামের জেলাগুলিতে নিয়মিত বন্যার ঘটনা ও তজ্জনিত ক্ষয়ক্ষতি এই অঞ্চলের পুরোনো বাসিন্দাদের স্মৃতিতে এখনও বেশ টাটকা। বন্যা ব্যাপারটা বোঝার জন্য উত্তরবঙ্গের পাহাড়-মাটি-নদী-জঙ্গল সম্পর্কে জানা-বোঝা জরুরি।
পাহাড়ে ধসের ইতিহাস
দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে, উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই মাটি ক্ষয়ে যাওয়া এবং ধস, ব্রিটিশ সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। ধসের কারণে চায়ের উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেয়। সয়েল ইরোসন বা মাটির ক্ষয়ে যাওয়া এবং, ধসের প্রাথমিক কারণই হচ্ছে ডিফরেস্টেশন অর্থাৎ বন-জঙ্গল ব্যাপক হারে ধ্বংস হওয়া। ১৯০৯ থেকে ১৯১৩-র মধ্যে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার একাধিক কমিটি গঠন করেছিলেন বনধ্বংস বা ডিফরেস্টেশনের প্রভাব বুঝতে। ১৯০৯, ১৯১১-র প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ধসের পিছনে দায়ী পাহাড়ের সাধারণ মানুষের পশুচারণ। তার চেয়েও আরও বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো পাহাড়িদের পানিক্ষেত। অর্থাৎ, যে চাষে জল বা পানি বেশি লাগে যেমন, ধান ও বড় এলাচ। সমস্যার দাওয়াই হিসেবে তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছিল ক্ষেতের মাঝে নতুন করে গাছের বাগিচা বা প্ল্যান্টেশন করার কথা। সাহেব-বাবুরা বেশ বুঝতেন, সাধারণ মানুষের চাষ আদৌ সমস্যা নয়। কিন্তু তাকে দোষী সাব্যস্ত না করলে তাদের বাগিচা শিল্প বা প্ল্যান্টেশন ইন্ডাস্ট্রি গড়েই উঠত না।
ব্রিটিশ ভারত থেকে আজকের দিন পর্যন্ত, পাহাড়ি ঢালে যত চা বাগিচা হয়েছে, বনধ্বংস বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সেই সঙ্গে পাহাড় কেটে বড় নির্মাণ, রাস্তা বানানো, বাঁধ ইত্যাদি, আরো বনধংস। ফলে, পাহাড়বাসীর কাছে ধস এখন নিত্যদিনের বিপদ। চিরঞ্জীব নাদের এক গবেষণাপত্র অনুসারে, বড় রাস্তাগুলির ধারে অন্তত ৩২টি ধসপ্রবণ স্থান চিহ্নিত হয়েছে (এর মধ্যে ১৬টি পুরনো তিস্তা ভ্যালি রোডে), এবং এর সত্তর ভাগ যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ার আশঙ্কায়।
২০১৫ সালে – দুধিয়া, মিরিক থেকে সুখিয়াপোখরি পর্যন্ত অঞ্চলে বড়সড় ধস নেমেছিল। অন্তত ৩৮ জনের মৃত্যু, অগণিত ঘরবাড়ি ও বাগান ধ্বংস হয়। গবেষক সুমন্ত্রসারথী বিশ্বাস ও রঘুনাথ পাল তাঁদের এক বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, ১৮৯৯ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত প্রায় প্রতি দশকেই ধস দার্জিলিংয়ের বুকে দুঃখ ডেকে এনেছে। কখনও ৭২ জন, কখনও ৬৬৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ভূবিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই সতর্ক করছেন – দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় একটি জটিল কৌণিক অবস্থানে হেলে রয়েছে। সেখানে নির্মাণ আসলে আশ্রয় নয়, বরং বিপদকে ঘুরপথে ডেকে আনা। পাহাড় ফাটিয়ে রাস্তা বানানো বা পাহাড়ি ঢালে উঁচু দালান তোলার কারবার প্রকৃতির সহনশীলতার সীমা ছুঁয়ে ফেলছে। দার্জিলিং পুরসভাও একসময় নির্দেশ দিয়েছিল – ৬০ ডিগ্রির বেশি ঢালে ৫০ ফুটের বেশি উঁচু বাড়ি তৈরি একরকমের আত্মঘাতী কাজ।
তিস্তা বিপর্যয়
তিস্তা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের যে অংশগুলোতে ড্যামের জন্য নির্মাণকাজ করা হয়েছে অথবা চলছে, সেই এলাকাগুলোতে প্রতি বছরই ধস নামছে। কালিম্পং থেকে সিকিম পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকায় এনএইচপিসির দুটি প্রকল্প শেষ হয়েছে, আরও তিনটি পরিকল্পনায় আছে। তিস্তা নিচু বাঁধ প্রকল্প ৩ ও ৪-এর ইআইএ প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বাঁধগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ ও দুর্বল পাহাড়ে তৈরি হচ্ছে, যেখানে বড় নির্মাণকাজ বিপদের কারণ হতে পারে। পাহাড় ফাটানো, রাস্তা চওড়া করা ইত্যাদি কাজ ধসের ঝুঁকি বাড়ায়। পুরোনো ধস ও ঢালের ফাটলগুলোকে সক্রিয় করে। এবং নতুন ধসের সম্ভাবনাও থাকে। গঠনগত দিক দিয়ে দেখলে, হিমালয় নবীন ও ভঙ্গিল পর্বত। পাহাড় ভঙ্গুর হওয়া সত্ত্বেও বাঁধ নির্মাণ ও ডিনামাইট ফাটানোর পর থেকে ধসের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে।
ভারত সরকারের ভূতত্ত্ব সর্বেক্ষণের পূর্বাঞ্চল শাখার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নদীতে বাঁধ দিয়ে জলাধার বানালে পাহাড় আরও নড়বড়ে হয়ে যায়। কারণ, জমা জল ধীরে ধীরে মাটির ফাঁক দিয়ে পাহাড়ের ভেতরে ঢুকে যায়। জল ঢুকে পাহাড়ে ফাটল ধরে। ফাটল বরাবর ধস নামে। ফলে, ১০ নম্বর মহাসড়ক ও আশেপাশের রাস্তা ধসে পড়ছে তিস্তার জলে।
২০০৪ সালে তিস্তা নিচু বাঁধ প্রকল্প-৪ (কালিঝোরা) থেকে প্রকল্প-৩ (২৭ মাইল) পর্যন্ত রাস্তায় ১৬–২০টি ধসের জায়গা দেখা গেছে, যার মধ্যে অন্তত ১০টি নতুন। অনেক জায়গায় পুরো পাহাড় ভেঙে পড়ছে। যেমন – প্রকল্প-৩-এর সামনের ঢালে, যেখানে এখন পাথরের দেয়াল তুলে পাহাড় ঠেকানোর চেষ্টা চলছে।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে সিকিমের হ্রদ বিস্ফোরণের জেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় তিস্তার দুপাশে। সিকিম এবং লাগোয়া কালিম্পং জেলার বেশ কিছু গ্রাম এখনো সেই ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন, পরিজন বিয়োগের শোক বয়ে বেড়াচ্ছে। ভেসে গিয়েছে পুরোনো রংপো গ্রাম। তারঘেরা, দেওরালি, কারমাট, মেল্লী গ্রামের ঘরে ও পাহাড়ে ফাটল ধরেছে। কালিঝোরা, ২৭ মাইল, ২৯ মাইল থেকে তিস্তা বাজার অবধি দুপাশের বনগ্রাম এবং সাধারণ গ্রাম-জনপদগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তিস্তা নিচু বাঁধ প্রকল্প-৩-এর জলাধারে বৃষ্টির জল চাপ বাড়াচ্ছে প্রতিদিন। ২৯ মাইল ও গেইলখোলা এলাকার নিচে নদীর প্রবাহ আরও তীব্র হয়েছে। সেবক রোড ও জাতীয় সড়ক ১০ জুড়ে প্রতিমাসেই কোথাও না কোথাও রাস্তা ধসে নেমে যাচ্ছে নদীতে।
তিস্তার নীচের দিকে, জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবা ব্যারেজ সংলগ্ন এলাকাতেও অবস্থা তথৈবচ। লালটং ও চমকডাঙি — নদীর চরের জঙ্গলে থাকা দুটো গ্রাম রাতারাতি তলিয়ে গেল। গজলডোবা ১২ নম্বর, বোয়ালমারি, ভোটমারি, মন্ডলঘাটসহ চর এলাকার বাসিন্দারা একই ভয়ে দিন গুনছেন।
ডুয়ার্সের পরিস্থিতি
পশ্চিমে মেচি থেকে পূর্বে তিস্তা – এই হল পাহাড়-তরাইয়ের সীমা। তিস্তা থেকে পুবদিকে একেবারে বক্সা-পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে সংকোশ পর্যন্ত ডুয়ার্স এলাকা। তিস্তা পেরিয়ে পূর্বে যত যাওয়া এক এক করে আসে লীস, ঘীস, চেল, মাল, মূর্তি, কুর্তি, নেওড়া, জলঢাকা, ডায়না নদী। এবং তারও পরে তোর্সা। তোর্সা পেরোলে ভান্ডারী, বানিয়া, কালজানি, ডিমা, জয়ন্তী, রায়মাটাং, রায়ডাক, সংকোশ। এত নদী এই ডুয়ার্স অঞ্চলে ভুটান পাহাড় থেকে নেমে এসে সমতল ছুঁয়েছে। এবং তার ভেতরে রয়েছে একের পর এক বড় বড় জঙ্গল – লাটাগুড়ি, চাপড়ামারি, গরুমারা, মোরাঘাট, তিতি, জলদাপাড়া, চিলাপাতা, বক্সা এবং চ্যাংমারি। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বাদ দিলে, মোটামুটি ভাবে বলা যায় ১৯৬৮-র বন্যা ও ১৯৯৩-র বন্যায়, বেনজির ক্ষতি হয়েছিল ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সাম্প্রতিক বন্যায় মাল-মূর্তি-নেওড়া-জলঢাকা অংশের মধ্যে থাকা চা-বাগান, বনবস্তি ও সাধারণ গ্রামগুলোয় ক্ষয়ক্ষতি হয়ছে। এবং মৃত্যু ঘটেছে। বাকি অঞ্চলের জনবসতিও ক্ষতিগ্রস্ত। তবে, সেখানে ক্ষতি মূলত চাষের জমিতে। কুমারগ্রাম, কালচিনি আলিপুরদুয়ার, ধুপগুড়ি, মাদারিহাট ব্লকের বেশকিছু গ্রামে চাষ-জমি সংকোশ, রায়ডাক বা তোর্সা এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা ছোট বড় সোঁতার জলে ভেসে গিয়েছে। কোথাও কোথাও চাষের জমিতে জল ঢুকে এবছরের ফলন নষ্ট করছে। গাই-বাছুর, হাঁস-মুরগির অসুবিধা তৈরি করেছে। জঙ্গলে ও জঙ্গল লাগোয়া গ্রাম-বসতিগুলোয় যাতায়াতের জন্য সোঁতার ওপরে ছোট পুল তৈরি করা হয়। বেশ কিছু জায়গায় পুল ভেঙ্গে পড়েছে জলের তোড়ে। যাতায়াতের সমস্যায় ভুগছেন গ্রামবাসীরা। সমগ্র অঞ্চল জুড়ে থাকা বন্যপ্রাণী – হাতি, গন্ডার, বাইসনও সুরক্ষিত নয়। তারাও মরেছে বা ভেসে গেছে।
ডুয়ার্সের নদীকে, গাঙ্গেয় উপত্যকার নদী-ভূপ্রকৃতি দিয়ে একেবারেই বোঝা যায় না। শিক্ষা সংস্কৃতিতে গাঙ্গেয় উপত্যকার নাগরিকদের আধিপত্যের কারণে উত্তরবঙ্গের নদীপরিকল্পনার গোড়ায় গলদ (এমনটা নয়, গাঙ্গেয় উপত্যকায় নদী পরিকল্পনায় আজ পর্যন্ত খুব সদর্থক হয়ে উঠেছে প্রকৃতি ও মানুষ – উভয়ের কাছে)। পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বালি-পাথর-গাছের ধ্বংসাবশেষ, চুনামাটি ভর্তি হয়ে থাকে। এই সমস্ত ডেব্রি সঞ্চিত হবার প্রবণতা, অর্থাৎ পলি পড়ার বা সিল্টেশনের হার মারাত্মক। ঠিক ভুটানের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় জঙ্গলের ভিতর, নদীগুলো যেখানে নামছে, সেখানে নদী এতটাই বালি-পাথর-ঘোলা মাটি নিয়ে নামে যে এক বছর রাস্তা তৈরি করলে বা ব্রিজ তৈরি করলে, তার পরের বছর ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। অগত্যা নদীখাতগুলোকেই গ্রামবাসীরা রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করেন। উল্লেখযোগ্য, এখানে নদীর কোন একটাই সুনির্দিষ্ট নদীখাত নেই। যখন জল কম থাকে হয়তো কোন একটা খাতের মধ্যে দিয়ে জল বইছে। আবার ভরা বর্ষায় দু-তিনটে খাতের মধ্যে জল হু হু করে নেমে আসে। এই সমান্তরালে থাকা প্রত্যেকটি ধারাই নদীখাতের অংশ। ধারাগুলোর কোনোটাতে সারা বছর জল থাকে, কোনোটাতে থাকে না। সেগুলোকে এলাকার মানুষ নানাবিধ নাম দিয়ে থাকেন। এখানে নদীর মূল সমস্যা – নদীগর্ভে ব্যাপক হারে বালি-পাথর-মাটির সঞ্চয়। স্থানীয় মানুষ আইনি-বেআইনি পথে নদীগুলো থেকে বালি পাথর তোলার কাজ চালান। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে।
ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালে সুভাষ দত্ত, স্টেট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল-র বিরুদ্ধে আবেদন করেছিলেন, বক্সা টাইগার রিজার্ভে সমস্ত রকম বাণিজ্যিক কাজকর্ম বন্ধ করার জন্য। কারণ দেখানো হয়েছিল জঙ্গল বাঁচানো, বন্যপ্রাণী বাঁচানো। সেই সূত্র ধরেই গোটা ডুয়ার্সের জঙ্গল এলাকায় নদী থেকে পাথর-বালি তোলার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এরই সঙ্গে, বিগত কয়েক বছরে ঢালু জঙ্গল-নদী এলাকায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পর্যটন। নদী-জঙ্গলগুলোর ধারে কংক্রিটায়ন হচ্ছে। নদীর চরে একের পর এক হোমস্টে, খাবার দোকান, মদের ঠেক গুটি বসন্তের মতো ফুটে উঠছে। যারা বক্সা, হাসিমারা, গরুমারার জঙ্গল নদীতে কখনো না কখনো ঘুরতে গেছেন কিংবা দার্জিলিং পাহাড়ে, পাহাড়ের নীচে বালাসন নদীর ধারে পানিঘাটা-দুধিয়ায় ঘুরতে গেছেন – তাঁরা প্রত্যেকেই নদীর চরে গজিয়ে ওঠা চা ও মোমো-র দোকানে ঘোরাফেরা করেছেন। প্রত্যেক বছর নতুন নতুন দোকান, হোমস্টের পরত পড়ছে নদীর পাড়ে। পর্যটনের কারণে পাকা রাস্তা, ব্রীজ আরো ঝাঁ-চকচকে হচ্ছে। আর সেই সবই হচ্ছে মানুষের রোজগার, বেঁচে থাকার জন্য। আসলে এই ক্ষণিকের বেঁচে থাকার লোভ দেখিয়ে সমগ্র পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্স জুড়ে থাকা মানুষ, জঙ্গল ও বন্যপ্রাণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছি আমরাই।
আবার ওইদিকে একশ্রেণীর বনবাঁচানো কর্মীরা এই ধুয়ো তুলে বন্ধ করিয়ে দিতে চাইছে পর্যটন এবং জঙ্গল-নদী এলাকায় যে কোনো অর্থনৈতিক কাজ। আইনত, পাকাপাকিভাবে বন্ধ করা হয়েছে নদী থেকে বালি-পাথর তোলা। জয়ন্তী, বক্সা, তিতি, জলদাপাড়া অঞ্চলে নদীর খাত এতটাই উঁচু হয়ে গেছে যে তার পাশে থাকা গ্রামগুলোয় চাষের জমি বা বসতবাড়ি নদীখাতের থেকে নীচুতে। এলাকার মানুষের সঙ্গে কথাবার্তায় উঠে আসে আরও বহুকিছু। তাদের আশঙ্কা তিস্তা, মাল, মূর্তি-র মতো জল যদি আচমকা ওদিকের নদীতেও নামে বা ‘৯৩ এর বন্যার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে যেতে পারে। আশঙ্কা বাড়ছে। এর মধ্যে একের পর এক নদী পরিকল্পনা, তার জন্য কমিশন, কমিটি, বাঁধ বানানোর পরিকল্পনা করেছে – কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকার, কখনো কেন্দ্র-রাজ্য যৌথভাবে, কখনো বা, আন্তর্জাতিক সহায়তায়। অথচ, নদী বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাজ নদীগর্ভ থেকে নিয়ন্ত্রিতভাবে বালিপাথর তোলা, নদীকে নাব্য রাখা। সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা ও উদ্যোগ কোথাও নেই। এছাড়া, আশু প্রয়োজন নদীর জলবিভাজিকা বা ওয়াটারশেড অঞ্চলে যথেচ্ছ গাছ কাটা, খনন ও নির্মাণ কাজ বন্ধ করা। উত্তরবাংলার বন্যাপ্রবণ নদীদের অনেকগুলোই ভুটান পাহাড় থেকে নামছে। ভুটানের ভিতর তাদের নিম্ন জলবিভাজিকা ও অববাহিকা এলাকায় গত কয়েক দশক ধরে অনিয়ন্ত্রিত চুনাপাথর বা ডলোমাইট খনি খোঁড়া চলছে। পাহাড় ভাঙছে, বালিপাথরে ভরে যাচ্ছে নদী, নীচের চাষজমিতে পলির বদলে বালি পড়ছে তো পড়ছেই।
জলবায়ু সংকটকালে কী হচ্ছে – কী করা যেতে পারে
গোদের উপর বিষফোঁড়া, জলবায়ুর সংকট। আসলে, জলবায়ু সংকটের জন্য দায়ী সেই পুঁজি আর পুঁজি-মালিকরাই। যে বা যারা জঙ্গল খায়, জমি লুঠ করে, চর বুজিয়ে ভুয়ো কর্মস্থান, বহুতল আবাস তৈরি করে, জীবনে ‘ভালো থাকা’র, ‘উন্নয়ন’-এর বিভ্রান্তিকর ছক তারাই মুহুর্মুহু আমাদের সামনে হাজির করে। তার ভেতরেই আমরা ক্রমশ খাঁচাবন্দি হতে থাকি।
গত দু-তিন দশকে পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, ভুটানে বহু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে উঠেছে, উঠছে। ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদী ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। এখন নদীর জলস্তর ওঠানামা করে না প্রাকৃতিক কারণে। বরং নির্ভর করে কোন বাঁধে কত জল আটকে রাখা বা ছাড়া হচ্ছে, কতটা পলি জমছে তার ওপর। নির্ভর করে নদীতে ড্রেজিং এর কাজ করা হচ্ছে কিনা সেসবের ওপর।
পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সের মানুষ, নদীর অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়ে আসছে ঐতিহাসিক সময় থেকেই। সেই অনিশ্চয়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, সেচবাঁধ, নদী থেকে বালি-পাথর তোলা বন্ধ করে দেওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। হিমালয়ে বর্ষার ধরণ বদলে যাচ্ছে, ফলে পাহাড় ও সমতল দু জায়গাতেই ভয় ও অনিশ্চয়তা; কবে কোন বাঁধ থেকে জল ছাড়া হবে; কখন নদীর দামাল স্রোত ঘরবাড়ি, চাষজমি, পাহাড়-জঙ্গল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
মুশকিল হলো, তথাকথিত বন-বাঁচানো লোকজনের কায়েমি স্বার্থ এবং উল্টোদিকে ভোটের লোভে পাইয়ে দেওয়া ঠুনকো কর্মসংস্থান – দুটোর কোনটাই প্রকৃতি, মানুষ এবং বন্যপ্রাণী – এই তিনের বেঁচে থাকাকে সুরক্ষিত করতে পারেনা, পারেনা তাদের সহাবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে। অথচ একসঙ্গে বাঁচবার, বেঁচে থাকবার এহেন বোঝাপড়ার জন্যই গোটা উত্তরবঙ্গের, নিসর্গ, প্রকৃতিকে তার নিজস্ব প্রেক্ষাপটে খতিয়ে দেখা জরুরি। স্থানীয় মানুষের, মূলনিবাসীদের প্রজন্মগত জ্ঞান, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে যুক্ত করা প্রয়োজন নদী-পরিকল্পনায়। বাস্তুতন্ত্রের ঐতিহাসিক বদলের কারণগুলো গভীরে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখা এবং তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও আশু কাজ।
এই কাজ স্থানীয় মানুষ, পরিবেশকর্মী, সমাজকর্মী ও ভূ-বিজ্ঞানীদের একাংশ করেই চলেছেন বিগত কয়েক দশক ধরে। ছোট-বড় নানান মিছিল, আন্দোলন গড়ে উঠেছে নদী ও জীবন বাঁচানোর তাগিদে। আজ রাজ্য সরকার বেকায়দায় পড়ে আন্তঃরাজ্য, (যেমন পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম) এবং আন্তর্জাতিক (যেমন ভুটান, বাংলাদেশ, নেপাল) পরিপ্রেক্ষিতে নদী পর্যালোচনার জন্য কমিশন গঠনের, আলাপ-আলোচনার বার্তা দিয়েছেন। অথচ, এই পশ্চিমবঙ্গ সরকার, জিটিএ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা এনএইচপিসি তিস্তার বুকে আরও বাঁধ তৈরি করতে উদ্যোগী। ভুটানেও এই কাজ হচ্ছে। নতুন নতুন প্রকল্পের কথা শোনা যাচ্ছে। এসব চলছে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত ভূকম্পপ্রবন এলাকায়। ভেঙে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া ১০ নম্বর সড়ককে বাড়িয়ে ফোর লেন করা হবে, সরকারি তরফে এ কথা ইতিমধ্যেই বিজ্ঞাপিত। ইতিমধ্যে বাঁধ, রাস্তা, রেলপথ – এ জাতীয় বড় প্রকল্পের ছাড়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রসরকারের তরফ থেকে নিয়ম-নীতি আলগা করা হয়েছে। প্রকল্পে পরিবেশের কত ক্ষতি হতে পারে তা নিয়ে ইআইএ-র (এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) রিপোর্ট ছাড়াই কাজ শুরু করে দিতে পারে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা বা তার ঠিকাদার কোম্পানিগুলো। পরিবেশ ও মানুষের সামূহিক ক্ষতির জন্য গ্রামসভার সঙ্গে কথাবার্তা বলা, জন-শুনানি করার মতো কাজগুলিও বাধ্যতামূলক থাকছে না। দেশের বন-জঙ্গল এবং পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্ত নিয়ম-কানুন বদলে ফেলা হয়েছে বিগত ১০ বছরে। সেসব নিয়ম কানুন ঘাঁটলেই বোঝা যায়, পরিবেশ বাঁচানোর নামে আসলে জঙ্গলকে আরও বেশি করে নষ্ট করবার ছাড়পত্র দেওয়াই সরকারের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, জনপরিসরে এ বিষয়ে কথাবার্তা উঠে আসছে না। স্বাভাবিকভাবেই, আজকের প্রচারমাধ্যম এবং মিডিয়া সন্তর্পণে এড়িয়ে যাচ্ছে এইসব সমস্যাজনক নিয়মবদল।
এমন অবস্থায়, হিমালয়-সংলগ্ন উত্তরবঙ্গে যাবতীয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলির বিশদ নিরপেক্ষ পর্যালোচনার প্রয়োজন। সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কথাবার্তা চালানো জরুরি সামাজিক স্তরে। আমাদের সকলের দায়িত্ব, রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারকে, পাহাড়ের গোর্খা আঞ্চলিক প্রশাসন (জিটিএ)-কে আলোচনায় বসতে বাধ্য করা। বিপর্যয় এলে কী হবে সেই আলোচনার চাইতে অনেক বেশি জরুরি বিপর্যয় আটকানো। যে কারণে বিপর্যয় ঘটতে পারে, ঘটছে, তার প্রতিকার। পাহাড়-নদী-জঙ্গল-চাবাগানে ঘিরে থাকা উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিপদ, কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জনমত গড়ে তুলতে। পরিবেশসম্মত, দীর্ঘমেয়াদী এবং বৈষম্যহীন উন্নয়নের ভাবনা নিয়ে পারস্পরিক মত বিনিময় শুরু করা যাক। প্রয়োজনে গণ-আন্দোলনও গড়ে উঠুক।
তথ্যঋণ:
১. অ্যাফেক্টটেড সিটিজেনস ফর তিস্তা (অ্যাক্ট), উত্তরবঙ্গ বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চ, নেসপন, শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন, হিমালয়ান ফরেস্ট ভিলেজার্স অর্গানাইজেশন কর্তৃক প্রেস বিজ্ঞপ্তি: তিস্তা বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কে? ৬ অক্টোবর ২০২৩, শিলিগুড়ি
২. সময়ভ্রমণ: দার্জিলিং: পাহাড় সমতলের গল্পগাছা, সৌমিত্র ঘোষ, সুপ্রকাশ, ২০২২, কলকাতা
_______________ তিথি রায় একজন স্বাধীন গবেষক।

