“আমাদের আসলে একটা আরও ভালো, বৈষম্যহীন কাজের পরিবেশ প্রয়োজন” – ডাঃ কাফিল খান   


  • September 30, 2024
  • (0 Comments)
  • 446 Views

ডাঃ কাফিল খান সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর ‘দ্য গোরখপুর হসপিটাল ট্র্যাজেডি’ বইটির বাংলা অনুবাদ “গোরখপুর হসপিটাল ট্র্যাজেডি – এক চিকিৎসকের কলমে ভয়াবহ বিপর্যয়ের স্মৃতিলিখন”-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে। তার মাঝেই তিনি বন্যা কবলিত মেদিনীপুর জেলার ডেবরা ব্লকে করেছেন হেলথ ক্যাম্প। যেভাবে একটি স্কুলের হলরুমে প্রায় ৯০ জন মানুষ থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, তা দেখে তাঁর মনে পড়েছে নিজের জেল জীবনে ছোট্ট কুঠুরিতে বন্দীদের গাদাগাদি করে থাকার স্মৃতি। হতাশ হয়েছেন দেখে যে বন্যার সঙ্গে যে হাজারো সংক্রামক ও অ-সাংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ে তা সামলানোর যথাযথ ব্যবস্থা নেই। সুদর্শনা চক্রবর্তী-র সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সরকারি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পেছনে দুর্নীতির কথা। বললেন তাঁকেও বলা হয়েছিল, “সরকার বহোত বড়া হ্যায় আপ কেয়া কর পাওগে?” কিন্তু তাঁর লড়াই থামেনি।

 

জিএক্স: ২০২৪ সাধারণ নির্বাচনের পর প্রথম আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল, উত্তরপ্রদেশের ফলাফল জানার পর আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন যখন নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর মাস চারেক কেটে গেছে, কী মনে হচ্ছে আপনার?

 

ডাঃ কাফিল খান: সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল তো ভাল ছিল। আমরা ঠিক এতটাও আশা করিনি। আমার হিসাব ছিল ২৫০ থেকে ২৬০। সেরকমই মোটামোটি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আশা ছিল। আর বাস্তবে যখন সত্যিই সেরকম হল, আমরা সবাই খুবই খুশি হয়েছিলাম। ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য এটি একটি সুন্দর মুহূর্ত ছিল। এখন অন্তত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কিছু আইন প্রত্যাহার করতে হয়েছে, যেগুলি দেশের জন্য ভালো ছিল না। কাওকে একটা থাকতে হবে যে চোখে আঙুল দিয়ে ভুল সিদ্ধান্তগুলি দেখিয়ে দিতে পারবে। সেটা এখন হচ্ছে। 

 

কিন্তু আপনি যদি আমাকে উত্তরপ্রদেশের প্রেক্ষিতে জিজ্ঞেস করেন, অনেকেই আমার কাছে জানতে চান যোগী আদিত্যনাথ কি দুর্বল হয়ে গেছেন? আমি বলব – এখন তিনি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। সত্যি যে ৮০টি আসনের মধ্যে ৪০টি তাঁরা বিরোধীদের কাছে হেরেছেন, এখন উত্তরপ্রদেশের সাধারণ মানুষও এগিয়ে এসে সরকারের সমালোচনা কর‍ছেন, বলছেন – “আমরা শুধু রাম মন্দির চাই না। আমরা খাদ্য চাই, আমরা রোজগার চাই, আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য চাই।” তবে সেই একটা প্রবাদ আছে না, যে যখন রাজা দুর্বল হয়ে পড়েন তখন সেনাপতি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। উত্তরপ্রদেশে এখন সেটাই হয়েছে।

 

আমি মনে করি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। কেন্দ্র সরকার কিছু দিন আগে তাঁকে পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।

 

জিএক্স:  দু’বছর আগে গ্রাউন্ডজিরো-কে দেওয়া শেষ সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, নির্বাচনী ফলাফল যাইহোক না কেন, আপনার ন্যায়ের জন্য লড়াই চলবেই। সেই লড়াইকে এখন আপনি কীভাবে দেখছেন?

 

ডাঃ কাফিল খান: এখন প্রায় ৮ বছর হয়ে গেছে আমি ন্যায়ের জন্য লড়ছি। শুধু আমার একার জন্য নয়, সেই রাত্রে যাঁরা নিজেদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন তাঁদের সকলের জন্য আমি এই লড়াই চালিয়ে যাব। বিআরডি অক্সিজেন ট্র্যাজেডির পর আমি যখন সারা ভারতে ঘুরতে শুরু করলাম আমি বুঝতে পারলাম যে বিআরডি অক্সিজেন ট্র্যাজেডি হল আমাদের ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মুখ। কোভিডের সময়ে আমরা তো দেখলাম আমাদের স্বাস্থ্যের পুরো ব্যবস্থাটায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার সীমানায় পৌঁছেছিল। শুধু বিআরডি অক্সিজেন ট্র্যাজেডি নয়, আমি হেল্থ ফর অল ক্যাম্পেইন করতে শুরু করলাম। আমার এই কাজের উদ্দেশ্য হল যাতে সরকার দায়িত্ব নেয়, ভারতের প্রত্যেক নাগরিক, তাঁদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ, প্রতিবন্ধকতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও লিঙ্গ পরিচিতি নির্বিশেষে তাঁদের বাসস্থানের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে সেরা স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিশেষত জরুরি চিকিৎসা পরিষেবা পান সেই ব্যবস্থা করার। 

 

আমার বই লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল সবাই যাতে আসল কাহিনীটা জানতে পারেন। আমি খুশি হয়েছে যে ‘জওয়ান’ সিনেমাতে এই ঘটনাটি দেখানো হয়েছে, বই থেকে তাঁরা ছ’টি চ্যাপ্টার নিয়েছেন। এর ফলে ঘটনাটা আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছেছে। মানুষের জানা উচিত পুরো সিস্টেমটা কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। আমি একজন ডাক্তার। কিনতু আমি জানি আমাদের কাজের ক্ষেত্রেও কত পচা মাছ (দুর্নীতিগ্রস্তের প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত) রয়েছে। 

 

জিএক্স: পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে সামগ্রিকভাবে জনস্থাস্থ্য পরিকাঠামোর অভ্যন্তরীণ যে গলদ সেগুলি একটু সংক্ষেপে বলুন। 

 

ডাঃ কাফিল খান: আমাদের সংবিধানে লেখা রয়েছে স্বাস্থ্য হল রাজ্যের দেখার বিষয়। অর্থাৎ রাজ্য ও কেন্দ্রশাষিত অঞ্চলগুলির সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে তাঁর নাগরিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখভালের। স্বাধীনতার পরে, আরও বেশ কিছু বছর পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু ২০-৩০ বছর পরে বেসরকারি সংস্থাগুলি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠল স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। ২০০০ সাল নাগাদ, যখন কংগ্রেসের আমল, মনমোহন সিং-এর প্রধানমন্ত্রীত্ব সেই সময়েও তাঁরা মোট জিডিপি-র মাত্র ১-২% ব্যবহার করতেন স্বাস্থ্য খাতে। সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে কোভিডের পর ৬%-৭% পর্যন্ত সরকারগুলি স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহার করছে। এমনকি মোদি সরকারও ঘোষণা করেছিল ২০২৫ সালের মধ্যে তাঁরা এই বরাদ্দ বাড়িয়ে ৫% করবে। ২০২৫ আসতে আর কয়েক মাস বাকি, কিছুই হয়নি। আসলে পুরো স্বাস্থ্য বাজেটটাই স্থির হয়ে রয়েছে, বাড়ছে না। প্রতি বছরে ২০,০০০ কোটি টাকার বৃদ্ধি শুনলে মনে হয় খুব বড় বাজেট, এটা আসলে এই এক বছরের মূল্যবৃদ্ধি মাত্র। এর অর্দ্ধেক যায় বেতনে, অর্দ্ধেক যায় খরচ-খরচায়। 

 

প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র যা যেকোনও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মেরুদন্ড তা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। বিশেষত উত্তর ভারতে। যদি আপনি কেরালা আর উত্তরপ্রদেশের তুলনা করেন, দেখবেন কেরালায় শিশুমৃত্যু যদি ৫ হয়, উত্তরপ্রদেশে তা প্রায় ৪০। এবার যদি আপনি শহর-গ্রামের বিভাজনের কথা ধরেন, ধরা যাক কলকাতায় ডাক্তার, রোগীর রেশিও প্রতি ১ জন ডাক্তারে ৭০০-৮০০ রোগী। দিল্লিতে তা প্রতি ১ জন ডাক্তারে ৩০০ রোগী। পশ্চিমবঙ্গের যেসব জেলায় আমি গেছি, যেমন মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪ পরগণা সেখানে এই সংখ্যা বেশি। এবার যদি উত্তর ভারতের গ্রামাঞ্চলে যান এই রেশিও হল প্রতি ১ জন ডাক্তারে ৫১ হাজার রোগী। 

 

আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ৭০% এখন বেসরকারি সংস্থার উপর নির্ভরশীল। বেসরকারি সংস্থারা তাদের লাভ, আয় এইসব নিয়েই সবচেয়ে বেশি চিন্তা করেন। সেইজন্য তাঁরা অনেক বেশি নজর দেন হার্ট সার্জারি, ডায়াবেটিস, কার্সিনোমা-র চিকিৎসা ইত্যাদিতে। তারা কোনওভাবেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত নয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র সরকারের উপর নির্ভরশীল আর তা ভেঙে পড়েছে। ধরুন কারওর ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়া হয়েছে, তার তো প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই চিকিৎসা হয়ে যাওয়ার কথা, অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার কেন হবে?

 

একটি তথ্য-পরিসংখ্যান রয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ৭৫% নির্ভরশীল হল আমি যাকে বলে থাকি ‘নন-মেডিকো ট্রেইনড মেডিক্যাল প্রফেশনাল’-দের উপরে। যাঁদের বলা হয় ‘ঝোলা-ছাপ ডাক্তার’। তাঁরা এক ধরনের মেডিক্যাল সেট-আপ-এর মধ্যে কাজ করেন, কিন্তু তাঁরা হাতুড়ে নন। পুরো ব্যবস্থাটা তাঁদের উপর নির্ভরশীল। তাঁদের সরিয়ে নিলে পুরো ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়বে। 

 

ধরুন, কারওর খুব জ্বর হয়েছে, কারওর পেটের সমস্যা হয়েছে, কাওকে সাপে কামড়েছে, কারওর কোনও দুর্ঘটনা হয়েছে – তাঁরা রাত্রিবেলা কোথায় যাবেন? ভারতে দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা ৬ কোটি মানুষ প্রতি বছর এঁদের কাছে যান, চিকিৎসার ক্রমবর্ধমান খরচের জন্য। আর সরকার না কি (এখন বলছে) মোট বাজেট বরাদ্দর ১.৭৫% স্বাস্থ্য খাতে খরচ করছে। এটা অত্যন্ত কম। হয়তো তুলনা করা ঠিক নয়, কিন্তু আমরা কত শতাংশ সেনাবাহিনীর জন্য খরচ করি? তার পরিমাণ অনেক বেশি। 

 

জিএক্স: পশ্চিমবঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের যে আন্দোলন, তা গণ প্রতিবাদের রূপ নিল কি কেবল এক তরুণী জুনিয়র ডাক্তারের উপর ঘটা নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার জন্য বলে আপনি মনে করেন?

 

ডাঃ কাফিল খান: আমি মনে করি, একটা চোরাস্রোত কাজ করছিলই। মানুষ হতাশাগ্রস্ত, বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন নানা কারণে – বেকারত্ব, দুর্নীতি, বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মধ্যে বাড়তে থাকা ঘৃণা, খাবার না পাওয়া, স্বাস্থ্য পরিষেবা না পাওয়া, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা পশ্চিমবঙ্গে আদপেই ভালো নয়, দুর্নীতি যে চিকিৎসা ব্যবস্থার কতটা রয়েছে তা তো চিকিৎসকেরাই জানাচ্ছেন। এই ঘটনাটি সাধারণ মানুষকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। এই তরুণী জুনিয়র ডাক্তার যেভাবে কাজ করতে গিয়ে নৃশংসভাবে ধর্ষিতা হলেন, তাঁকে হত্যা করা হল – এটা সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সকলেই যেন অপেক্ষা করছিলেন কোনও একটা ঘটনা ঘটার জন্য যেখানে তাঁরা নিজেদের প্রতিবাদী স্বর তুলে ধরতে পারবেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হলেন সচেতন মানুষ। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই প্রতিবাদ, সচেতনতা যেন হারিয়ে গেছিল। আমি অত্যন্ত খুশি যে জুনিয়র ডাক্তারেরা সেই হারিয়ে যাওয়া সচেতনতার, নীতি-নৈতিকতা জাগিয়ে তোলার ব্যাটন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন। সাধারণ মানুষ এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদের বার্তা দিচ্ছেন – “এনাফ ইজ এনাফ” (যথেষ্ঠ হয়েছে আর নয়)।

 

জিএক্স: এই আন্দোলনের মূল কারণ কী বলে মনে করছেন?

 

ডাঃ কাফিল খান: আমার মনে হয় প্রত্যেকেরই এই আন্দোলনে শরিক হওয়া উচিত। কলকাতায় যবে আর জি কর-এ জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটল ঠিক তার পরের দিনই উত্তরাখন্ডে এক নার্স-এর উপরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমরা পুরো বিষয়টাকে ডাক্তার, প্যারা মেডিকস, আশা কর্মী এইভাবে ভাগই করতে পারব না। আমার যেটা সব সময়েই এখন মনে হয় যে এই সব আন্দোলনের মূলে রয়েছে মহিলাদের উপরে শোষণ, অত্যাচার অত্যন্ত বেড়ে গেছে।

 

জিএক্স: এই আন্দোলনে কি সামগ্রিকভাবে নার্স, আশা কর্মীদের মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কর্মীদের নিরাপত্তা, অধিকারের কথা সঠিকভাবে উঠে আসছে?

 

ডাঃ কাফিল খান: না, না। সত্যিই আমরা তাঁদের বিষয়ে কথা বলি না। যদি আপনি দেখেন, নার্সদের সঙ্গে ডাক্তাররা যে ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করেন, তার উদাহরণ প্রচুর। আমি আমার পেডিয়াট্রিকস-এ কীভাবে একটি শিশুকে ইনকিউবেটর-এ রাখতে হয়, কীভাবে আইভি লাইন দিতে হয় তা শিখেছি নার্সিং স্টাফ-এর কাছ থেকে। আমি যেখানে পড়েছি সেই ‘মনিপাল’-এ নার্সিং স্টাফরা এত ভালো ছিলেন, আমি ফোন করে বলতাম, “আমি কোনও প্রি-টার্ম বেবি, যার ওজন মাত্র এক কিলোগ্রাম, তাকে নিয়ে আসছি,” আর সিস্টার ভেন্টিলেটার, বাকি সব সিস্টেম পুরো তৈরি রাখতেন। তারা আইভি লাইন লাগাতেন। তাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন। 

 

আমি দেখেছি ওয়ার্ক কালচার (কাজের পরিবেশ) প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতালে। নার্সিং স্টাফদের অধস্তন কর্মী হিসাবে দেখা হয়, যেন তাঁরা চিকিৎসকদের সমান নন, নার্সরা ডাক্তারদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন আর ডাক্তারেরা বসে থাকেন – এইসবই চলে। কিন্তু এই নার্স-ই যদি একজন ‘ওয়ার্ড বয়’ হন, তাহলেই ডাক্তারের ব্যবহার বদলে যায়। তিনি তখন আর চিৎকার করেন না, তাঁর আচরণ বদলে যায়। এমনকি যদি হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট একজন মহিলা হন আর তিনি কোনও কারণে একজন পিজি রেসিডেন্সিয়াল পুরুষ পড়ুয়া চিকিৎসককে বকা দেন, তাহলে সেই ছাত্র কোনও না কোনও খারাপ কথা ঠিকই সেই এইচওডি-কে বলবেন, কারণ যেহেতু তিনি একজন মহিলা। একজন পুরুষ এইচওডি হলে এটা কখনওই হবে না। মানে আমি বলতে চাইছি একজন মহিলা তিনি যে পদেই থাকুন না কেন পুরুষদের দ্বারা হেনস্থা, বৈষম্য তাঁর প্রতি হবেই। এর মূলে রয়েছে পিতৃতন্ত্র। যা শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে বাড়ি থেকে স্কুল, কলেজ, কাজের জায়গা সর্বত্র। 

 

আজ যখন আমরা আরও ভালো স্বাস্থ্য পরিষেবা, আরও ভালো নিরাপত্তা, আরও ভালো পরিকাঠামোর দাবি জানাচ্ছি, তখন তার মধ্যে অবশ্যই নার্সদের কথা থাকতে হবে, আশা কর্মীদের কথা থাকতে হবে। তাঁরাই তো স্বাস্থ্য পরিষেবার মেরুদন্ড। আমরা আসলে একটা ‘টিম’। নার্সিং স্টাফ, আশা কর্মী, ওয়ার্ড বয়, নিরাপত্তাকর্মী, সাফাইকর্মী। আমরা সাফাইকর্মীদের কেন ভুলে যাচ্ছি? তাঁদেরও কাজের জন্য ধন্যবাদ বলা উচিৎ, আমাদের কোনও ভুল তাঁদের প্রতি হলে দুঃখিত বলা উচিত। কিন্তু ডাক্তারেরা অনেক সময়েই তাঁদের নীচু চোখে দেখেন। কেন তা হবে? আমাদের আসলে একটা আরও ভালো, বৈষম্যহীন কাজের পরিবেশ প্রয়োজন।  

 

এইসব কর্মীদেরও আলাদা শৌচালয়, বিশ্রামের জায়গা থাকা দরকার। নার্সরা, সাফাইকর্মীরা তাঁরা রাত্রিবেলা আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে, বিপদের মধ্যে থাকেন। আমরা যদিও বেশি কথা বলি না এই বিষয়ে – কিন্তু চিকিৎসকদের দ্বারা নার্সদের যৌন হেনস্থার কত ঘটনা ঘটে চলেছে। 

 

রোগীর বাড়ির মহিলারা তাও একটু নিরাপদ থাকেন, কারণ তাঁরা ওয়ার্ডের ভেতরে অনেকের সঙ্গে থাকেন। কিন্তু নার্সদের ডাক্তারের সঙ্গেই থাকতে হয় – সেটাই কালচার। আর আমাদের মানসিকতাই এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন হয়ে গেছে যে, যে মুহূর্তে একজন পুরুষ একজন মহিলার সঙ্গে একা হন, সঙ্গে সঙ্গে যেন অন্য মানুষ হয়ে যান। আমাদের কাছে তো কোনও তথ্যই নেই যে কতজন নার্স, ডাক্তাদের দ্বারা যৌন হেনস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন এবং কেউ অনুমতি দেবেন না এই বিষয়ে কথা বলতে। আমরা তো এও জানি না যে কতজন মহিলা কনস্টেবল পুরুষ আইপিএস অফিসারদের দ্বারা যৌন হেনস্থার মধ্যে পড়েন। এই সব তথ্য সংগ্রহের কেউ অনুমতিও দেবেন না। কীভাবে এই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার অবসান করা যায় তা নিয়ে আমাদের ভাবতেই হবে।

 

জিএক্স: এই সরকার, কর্পোরেট, ফার্মা কোম্পানির দুর্নীতি চক্র চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে সে বিষয়ে কী বলবেন?  

 

ডাঃ কাফিল খান: এসব ক্ষেত্রে মূলত আধিকারিকেরা দায়ী হন। আচ্ছা, আপনি বড় টেন্ডারগুলির কথা বলতে পারেন। সম্প্রতি আপনি নিশ্চয় দেখেছেন ৬৫টি ওষুধ, যার মধ্যে জীবনদায়ী ওষুধও রয়েছে সেগুলি যোগ্যতা মানের নীচে (সাব-স্ট্যান্ডার্ড) বলে ধরা পড়েছে। আমার গোরখপুরে একটা মার্কেট আছে, সেই মার্কেটে বলে এক মাসে একশ কোটি টাকার টার্ন ওভার হয়। আর তারা বলেছে ৫০% ওষুধ জাল ওষুধ। ৫০%! ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার ঘুমিয়ে আছেন, স্লিপিং মোড-এ আছেন। তাঁরা কোনও রকম চেক করেন না। ঠিক যেমন কখনও-সখনও, কোনও এক মাসে, কোনও হোটেলের কিচেন-এ, ফুড ইন্সপেক্টর যান, কিছু চেক-টেক করেন। বাকি সময় ঘুমিয়ে থাকেন। তাঁরা কেয়ারও করেন না আমরা কী খাচ্ছি। ঠিক একই কাজ ড্রাগ ইন্সপেক্টর-রাও করছেন। এগুলো ভীষণ বিপজ্জনক।

 

কোনও তথ্য-পরিসংখ্যান নেই যে কত ওষুধ আসছে আর কত ওষুধ তাঁরা চেক করছেন। যা কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান পাচ্ছি তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু থেকে। কিন্তু তারও কতটা ফিল্টারড আমরা তো জানিও না। নিশ্চয়ই দেখেছেন সম্প্রতি হু জানিয়েছে ভারতের ৫০% শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। এই কথা দিল্লিতে গিয়ে বললে, সেখানে বলবেন – “না, না, ভুল কথা। আমাদের দু’টি সন্তান আর দু’জনেই খুবই স্বাস্থ্যবান।” আপনি এবার বিহারে, ঝাড়খন্ডে চলে যান। তাঁদের চার-পাঁচটা সন্তান আর সেই সব বাচ্চা-ই অপুষ্টিতে ভুগছে। তথ্য-পরিসংখ্যান ম্যানিপুলেট করা হল সরকারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র, যে কোনও সরকার নির্বিশেষে। 

 

আমি দেখেছি, কোনও কোনও ডাক্তার একই প্রেসক্রিপশন-এ দু’টো করে মাল্টিভিটামিন লিখছেন। কোভিড-এর সময় তাঁরা ১১টা করে এমন ওষুধের নাম লিখেছেন প্রেসক্রিপশন-এ যা কোভিড-এর আগেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছিল। আমি এটা দেখেছি নিজের চোখে, আমার বইতে এমন ৭-৮টা ওষুধের নাম লিখেছি, যা হু ২০১৯ সালের অক্টোবর নাগাদ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। রেমডেসিভির লাখ লাখ টাকার বিক্রি হয়েছে। অথচ হু বলেছিল রেমডেসিভির ব্যবহার করবেন না, এর কোনও উপকারিতা নেই। সুতরাং একটা বড় নেক্সাস বা দুর্নীতি চক্র রয়েছে যেখানে বহু মানুষ যুক্ত। 

 

ভেবে দেখুন, রেমডেসিভির-এর জন্য মানুষ কত কত টাকা ব্যয় করেছেন। হু বলেছিল, রেমডেসিভির দেওয়া উচিতই নয়। অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও আইভার ম্যাকটিন – এই দু’টি ওষুধের কম্বিনেশন হার্ট-এর জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। মানুষের হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এবং সেই ওষুধই ব্যবহার হয়েছে। প্রতিটি প্রেসক্রিমশন-এ অ্যাজিথ্রোমাইসিন, আইভার ম্যাকটিন, আরও কত রকমের ওষুধ ছিল যেগুলো ব্যানড বা ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছিল হু। 

 

এটা প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার থেকে শুরু হয়ে, সেখান থেকে প্রাইভেট হসপিটাল আর হ্যাঁ, তারপর সেখান থেকে সরকারি হাসপাতাল। যেমন বলা হয় ফার্মেসিস্ট থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত চলে এই টাকার খেলা। আমি এই টাকা যে পথে চলে সেটা নিজের চোখে দেখিনি, কিন্তু এই পথটা আমি জেলে দেখেছি। জেলে থাকত ‘কাচ্চি বৈটকি’ আর ‘পক্কি বৈটকি’। মানে আপনি প্রতি দিন ২০০ টাকা দিলে আপনাকে টয়লেট পরিষ্কার করতে হবে না, ধোয়া-মোছার কাজ করতে হবে না। আপনি ২০০০ টাকা দিলে ৭ দিনের জন্য এসব করতে হবে না। ২০,০০০ টাকা দিলে কখনওই করতে হবে না। কে এই টাকা নেয়? একজন বন্দী, যে মনিটর। এই টাকা কোথায় যায়? জেলার-এর কাছে। জেলার নিজে বলেছেন, “এই টাকার ব্যাগ আমাকে নিয়ে যেতে হয় জেল সেক্রেটারির কাছে। তারপর তা যায় মন্ত্রীর কাছে।” সুতরাং এই পথটা আমি দেখেছি।

 

আমি জানি ফার্মা কোম্পানিগুলো কীভাবে কাজ করে। তারা আপনার কাছে আসবে। বলবে, “আমরা আপনাকে দু’দিনের মালদিভস, বালি-র ট্যুর করাব। লাক্সারি হোটেলে রাখব।” ডাক্তারেরা সেই সুযোগ নেন, পুরো পরিবারকে নিয়ে ছুটি কাটাতে যান, সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ছবি পোস্ট করেন। এখান থেকেই শুরু হয়ে উঁচু স্তর পর্যন্ত পৌঁছায়। 

 

একই জিনিস ঘটে পরীক্ষা-নীরিক্ষার ক্ষেত্রেও। আমি দেখেছি, ইচ্ছাকৃতভাবে সিটি স্ক্যান মেশিন সরকারি হাসপাতালে কাজ করে না। সিটি স্ক্যান বাইরে থেকে করাতে হয়। ৬০০ টাকা কমিশন চলে আসে সরকারি চিকিৎসকের কাছে। এক্স-রে মেশিন কাজ করে না, লিখে দেওয়া হয় বাইরে থেকে করাতে। আলট্রা-সাউন্ড কাজ করে না, বাইরে থেকে করাতে হয়। এসব কী? শুধু স্বাস্থ্য পরিষেবা নয়, এই দুর্নীতি সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে।

  

Share this
Leave a Comment