‘রাত দখল’ তো হল, দখলে এলো কি? 


  • August 22, 2024
  • (0 Comments)
  • 1293 Views

এই মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল বাঙালি সমাজ মেয়েদের চিরকাল ‘মাধবীলতা’ হিসেবেই দেখে অভ্যস্থ। ধন্যি ধন্যি করে অভ্যস্ত। এতদিনের অভ্যেস ভাঙার সাধ বা সাধ্য কোনওটাই আমাদের নেই। তাই সমঝোতার স্বাধীনতাতে ‘রাত দখল’ করেই আমরা খুশি। এর থেকে বেশি স্বাধীন নারী আবার আপনার সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। লিখলেন ঈশানী ধর। 

 

‘লাপাতা লেডিস’ সিনেমার একটি সংলাপে ছিল, ‘দেখা যায় তো অউরত লোগোকো মরদো কা কুছ খাস জরুরত হ্যায় নেহি, লেকিন ই বাত অগর অউরত কো পতা চল যায় তো মরদ লোগো কা বাজা না বজ যায়গা।’ আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত পিতৃতন্ত্র সফলভাবেই মেয়েদের জানতে দেয়নি যে ‘ওঁরা’ ছাড়াও তাঁদের চলে যায়। তাই মেয়েদের বিপ্লব, বিক্ষোভ, ক্ষমতায়ন এমনকি পুরুষের থেকে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইও হয় পুরুষেরই ছত্রছায়ায়। পিতৃতন্ত্র আমাদের মজ্জায় মজ্জায় এমনভাবে ঢুকে গিয়েছে যে পুরুষের প্যাসিভ অবস্থানটা ঠিক কীরকম হতে পারে তার ধারণাটুকুও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কারোর কাছে নেই। তাই ‘মেয়েদের রাত দখল’-ও হয় হাজার হাজার পুরুষের উপস্থিতিতে, তাঁদেরই স্লোগানে গলা মিলিয়ে।

 

১৪ অগস্টের রাতে বাংলা জুড়ে (বা বলা ভালো দেশ জুড়ে) এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হল। মাঝরাতে গ্রাম-শহর-মফস্বলের রাস্তায় প্রতিবাদী মানুষের এমন ভিড় বোধহয় সাম্প্রতিককালে আমরা এর আগে চাক্ষুষ করিনি। ডাক্তারদের আন্দোলনকে সেদিনের রাতটা একরকমভাবে দিশা দিয়েছিল। সেই রাতে হাজার হাজার আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের মধ্য দিয়েই যে এই আন্দোলন যথার্থ রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল সে বিষয় কোনও সন্দেহ আমার নেই।

 

কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও ‘রাত দখল’-এর প্রশ্ন থেকে গেল সেই একই জায়গায়। আরজি কর-এর ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মেয়েরা। পূর্ববর্তী ঘটনার বিশদ বিবরণের এখন আর প্রয়োজন নেই। বরং এই লেখায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে একটা প্রশ্ন, ‘রাতে একা কেন গিয়েছিল?’ অর্থাৎ রাতে একা মেয়েদের স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা (যদিও তিনি নিজের কর্মক্ষেত্রের মধ্যেই ছিলেন) করাই বুঝি ধর্ষণের ছাড়পত্র। তবে এই ঘটনা তো আর আমাদের অবাক করে না। প্রতিটি ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, যৌন হেনস্তার পরই পোশাকের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, নির্যাতিতার পুরুষ সঙ্গ, বাড়ি থেকে বেরোনোর সঠিক সময় নিয়ে কাঁটাছেঁড়ায় আমরা অভ্যস্ত। নারীবিদ্বেষে আমরা অভ্যস্ত। তবু আশার কথা আমরা প্রতিবাদ করি। নিয়ম ভাঙি, নিয়ম গড়ি। এবারও তার অন্যথা হল না।

 

প্রশ্ন উঠেছিল ‘রাতে একা কেন গিয়েছিল?’ উত্তরে ‘রাত দখল’ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মেয়েরা। রাতের শহরে পুরুষ সঙ্গ ছাড়া একা বেরিয়ে নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই মতো পথেও নামেন মেয়েরা। কিন্তু গোল বাঁধে এই ‘একা’ শব্দটায়। ছেলেদের অনুপস্থিতিতে মেয়েদের জমায়েত ব্যাপারটায় উষ্মা বাড়তে থাকে ছেলেদের মধ্যে। জনৈক এক ব্যাক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন “ওরা ডাক দিয়েছে আমরা কি থাকব না?” ছেলেরা রে রে করে ছুটে এল নিজেদের ‘অধিকার’ বুঝে নিতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ লিখলেন “মেয়েদের এই জমায়েতে নিজেদের মতো করে সমর্থন জানাতে আমরা যেতেই পারি।” কেউ আবার নিজের প্রগতিশীল ছবি বজায় রাখতে কিছুটা নরমভাবে বললেন, “আমরা জমায়েত স্থলে যাব না, কিছুটা তফাতে থাকব, বা মঞ্চ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে দেখব।” কেউ আবার ‘মেয়েদের জমায়েত’ কথাটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিজের স্বভাবসিদ্ধ পুরুষ দাম্ভিকতায় অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনটুকু না মনে করে বলে বেড়াতে থাকল, “অমুক জায়গার জমায়েতে থাকছি।!” আপত্তি জানাতে গেলে তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় জমায়েতে থাকা তাঁদের অধিকার, তাঁরা এই অধিকার কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। বারবার বাধা দেওয়ায় ‘ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে’ অনেকে আবার হুমকির স্বরেও বলে ওঠেন “ক্ষমতা থাকলে সিকিউরিটি দিয়ে ছেলেদের জমায়েতে আসা আটকান, আমরা আসবই।” পথে ঘাটে দেখা হলে চিৎকার করে তাঁরা বলে উঠেছেন, ‘রাতে থাকছি’। অর্থাৎ, “আমরা যাব, যা করার করে নে।”

 

আন্দোলনের কেন্দ্রে না থাকতে পারা, ছেলেদের আত্মগরিমায় এমন আঘাত দিল যে মেয়েদের পথে নামার ডাকে দলে দলে পুরুষও পথে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন। মেয়েদের অধিকারের লড়াইতে ‘পাশে’ দাঁড়ানোর উদ্দেশে৷ যে মেয়েরা বাধা দিল তাদের পুরুষ বিদ্বেষী বলা হল, তাঁরা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যকে খর্ব করতে চাইছেন বলেও অভিযোগ করা হল, এমনকি ‘সংকীর্ণ’, ‘অরাজনৈতিক’ বলতেও বাকি থাকল না। মেয়েরা বুঝলেন যে ছেলেদের তাঁরা ঠেকাতে পারবেন না, তাই তাঁরা সমঝোতার পথে গেলেন। ঠিক হল ছেলেরা আসুক তবে মঞ্চ থেকে যেন দূরে থাকেন। সেই রাতের ছবি অবশ্য তেমন ছিল না। বরাবরের মতো এবারও প্রথম সারিতে দেখা গেল একঝাঁক পুরুষকে।

 

মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছাতে যে পরিমাণে ছেলেদের ভিড় ঠেলতে হল, প্রতিনিয়ত নিজের শরীরে যেন কোনও অনভিপ্রেত স্পর্শ না লাগে সেবিষয় সচেতন থেকে এগোতে হল, তাতে অনেক মহিলাই মূল মঞ্চ পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা ত্যাগ করলেন। রাত বাড়তে থাকল পুরুষ আধিক্যও বাড়তে থাকল। এখানে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায়, আমাদের এ দেশে বহু মহিলা সাংবাদিক আছেন, তবু এই জমায়েতে পুরুষ সাংবাদিকদেরই আসতে হল। যাক গে, মূল আলোচনায় ফেরা যাক। রাত যত বাড়তে থাকল ‘মেয়েদের জমায়েত’-এ পুরুষ আধিক্যও বাড়তে থাকল। সময়ের সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্লোগানের দখল গেল ছেলেদের হাতে। মানববন্ধন করে মিছিল পরিচালনার দায়িত্বও নিলেন তাঁরা। এগিয়ে এলেন, দখল নিলেন রাস্তার, পোস্টারের, স্লোগানের। এগিয়ে এলেন, ‘পাশে’ দাঁড়ালেন মেয়েদের। অজস্র পুলিশের ঘেরাটোপে হাজার হাজার পুরুষের সংহতি ও সহযোগিতা মিলিয়ে দারুণ সফল জমায়েত, কর্মসূচি। শুধু ক্ষতির মধ্যে এ যাত্রায়ও মেয়েদের ‘একা’ রাতে রাস্তায় বেরনো হল না। তাঁরা রাতে বেরোলেন বটে, তবে হাজার হাজার পুরুষকে পাশে নিয়েই, ঠিক যেমনভাবে সমাজ মেয়েদের দেখতে চায় সেই নিয়ম মেনেই।

 

আগেও বলেছি পিতৃতন্ত্র আমাদের মজ্জাগত। আর এতটাই মজ্জাগত যে মেয়েরা নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে চাইলে হাত ধরে সেই রাস্তায় এগিয়ে দিতে ছুটে আসেন ‘নারীবাদী’ পুরুষেরা। পিতৃতন্ত্র আমাদের এতটাই মজ্জাগত যে পুরুষের অঙ্গুলি ধরে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বিপ্লবের পথে এগোতে ভালোবাসি আমারা মেয়েরা। তাই ‘রাত দখল’ করতে জমায়েত স্থলে পৌঁছনোর জন্য আমাদের পুরুষ সঙ্গ প্রয়োজন হয়। জমায়েতে ছেলেদের উপস্থিতি প্রসঙ্গে বহু মহিলাই প্রশ্ন তুলেছেন, রাতে কোনও পুরুষ তাঁদের পৌঁছে না দিয়ে এলে তাঁরা যাবেন কীভাবে? জমায়েত ভাঙার পর ফিরবেনই বা কী করে? এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে শহরতলী থেকে আসা মহিলাদের রাতের রাস্তায় যাতায়াতের অসুবিধা সত্যিই থাকে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সমাধান হতে পারত মেয়েদের হাতেই, ছেলেদের হাত ধরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজন হয় না৷

 

অন্যদিকে বহু ‘প্রগতিশীল’ নারীবাদী পুরুষই শুনলাম নির্দ্বিধায় তাঁদের স্ত্রী, কন্যা, প্রেমিকা, বোনকে মাঝরাতে রাস্তায় বেরনোর ‘অনুমতি’ দিয়েছেন। যাঁরা সযত্নে নিজের পরিবারের ‘মেয়ে-বৌ’-দের সমস্ত রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে দূরে রাখেন, তাঁরাও এবার বাড়ির মহিলাদের অনুমতি দিয়েছেন। ‘অনুমতি’ পেয়ে নিজের আশপাশের পুরুষটির প্রতি এক বুক গর্ব নিয়ে ‘রাত দখল’-এর অভিযানে বেরিয়েছেন মেয়েরা। জমায়েত শেষে আবার পুরুষ সঙ্গীটির নিরাপত্তাতেই ফিরে গিয়েছেন বাড়িতে। মেয়েদের দীর্ঘদিনের প্যাসিভ লৈঙ্গিক অবস্থান এতটাই তীব্র যে প্যাসিভ থেকে অ্যাক্টিভ জেন্ডার হয়ে ওঠার যাত্রাতে তাঁরা অজান্তেই নিজেদের প্রত্যক্ষ অবস্থানের বদলে পরোক্ষ অবস্থানকেই বেছে নেন। অপরদিকে পিতৃতান্ত্রিকতা পুরুষকে এমন এক অ্যাকটিভ জেন্ডারে পরিণত করেছে যে পরোক্ষ অবস্থান ঠিক কী তা ছেলেরা বুঝেই উঠতে পারেন না। তাই হামলে পড়ে সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে নিজের নিরাপত্তার ঘেরাটোপে মেয়েদের নারী স্বাধীনতার পথে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যান। একটা মুহূর্তের জন্যও একা ছাড়েন না।

 

এখন প্রশ্ন উঠবে মেয়েদের এমন এক বিপ্লবী পদক্ষেপে ছেলেরা যদি পাশে এসে না দাঁড়ায় যদি সমর্থন না জানায় তাহলে হয় কীভাবে? তাঁদেরও তো সমাজের প্রতি সর্বোপরি মেয়েদের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে। যদি রাত দখলের জমায়েতে ছেলেরা এসেও বা থাকেন, তাতে ক্ষতি কী?

 

কখনও শুনেছেন ছেলেদের ‘রাত দখল’ করতে হয়েছে? বা কোনও ছেলে সারারাত রাস্তায় একা ঘুরে বেড়ালে সেটাকে ‘সাহসী পদক্ষেপ’ বলা হয়। শোনেননি। শুনবেনও না। কারণ রাতে নিরাপত্তার প্রশ্ন ওঠে লিঙ্গভেদে। আর লিঙ্গভেদে যে প্রশ্ন ওঠে সেই লড়াইও লিঙ্গভেদেই করতে হয়। অথচ আমাদের প্রগতিশীল পুরুষেরা এইটুকু বুঝতে পারলেন না যে, ‘রাত দখল’-টা তাঁদের উপস্থিতিতে হওয়া সম্ভব নয়। মেয়েদের এই লড়াইয়ের আসল সমর্থন জানানোর অর্থ তাঁদের ‘একা’ বাইরে বেরোতে দেওয়া। কিন্তু পুরুষের অবচেতনের সুপিরিয়রিটি তাঁকে এইটুকু বুঝতে দিল না যে পরজীবীরা কখনও স্বাধীন হতে পারে না। তাই নারী স্বাধীনতার কথা যদি বলতেই হয় তাহলে প্রথমে নারীকে স্বাধীন স্বতন্ত্র হতে দিতে হবে। আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নারী স্বাধীন হবে না, হবে বিপ্লবের সেবাদাসী।

 

কিন্তু ছেলেরা এটা বুঝলেন না, মেয়েরাও বুঝলেন না। কারণ এই মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল বাঙালি সমাজ মেয়েদের চিরকাল ‘মাধবীলতা’ হিসেবেই দেখে অভ্যস্থ। ধন্যি ধন্যি করে অভ্যস্ত। এতদিনের অভ্যেস ভাঙার সাধ বা সাধ্য কোনওটাই আমাদের নেই। তাই সমঝোতার স্বাধীনতাতে ‘রাত দখল’ করেই আমরা খুশি। এর থেকে বেশি স্বাধীন নারী আবার আপনার সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক।

 

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

 

Share this
Leave a Comment