মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারের দায়িত্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের


  • August 18, 2024
  • (0 Comments)
  • 773 Views

নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা হিন্দুত্ববাদী শাসকদলের অভিসন্ধিমূলক আইনপ্রণয়নের বিরুদ্ধে এবং একইসাথে মুসলিম পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে অনড় থাকবে। লিখলেন আফরোজা খাতুন

 

ইসলামি আইনের জন্ম আরব দেশে। আরববাসীর মানসিকতা ও চরিত্র এবং তাদের সামাজিক ইতিহাসের ছাপ পড়েছে এই আইনের ওপর। সপ্তম শতকে ইসলামের আর্বিভাবকালে যে প্রথা ও রীতিনীতি প্রচলিত ছিল আরব ভূমিতে, ইসলামি আইন রচনার ভিত্তিও সেই প্রথা ও রীতিনীতি। ইসলামি আইনের উৎস কোরান, হাদিস, কিয়াস, ইজমা এবং উরফ। হজরত মহম্মদ যা বলেছেন এবং করেছেন তাই হল হাদিস। ইসলামি আইনতত্ত্বের মূলনীতির প্রণেতা আবু হানিফার প্রচেষ্টায় ‘কিয়াস’ গৃহীত হয় মুসলিম আইনতত্ত্বের গ্রহণযোগ্য উৎসরূপে। এই নীতির মূল কথা হল বাস্তবতার সঙ্গে আইনের সূত্রকে মানিয়ে নেওয়া। ইজমা হল ঐক্যমত। হজরত মহম্মদের সাহাবাগণ অর্থাৎ তাঁর সাহচর্যে থাকা ব্যক্তিরা কোন বিষয়ে একমত হলেই সেটা প্রামাণিক আইন বলে গ্রহণ করা হত। আইনতত্ত্ববিদ আবু হানিফা বলেছেন, যেকোন কালে কোন সমস্যার উদ্ভব হলে পূর্বতন ইজমার অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। উরফ হল স্থানীয় রীতিনীতি। আবু হানিফা আইনে উরফের অবদানকেও স্বীকৃতি দিয়েছেন। (তথ্য সংগ্রহ — গাজী শামছুর রহমান : স্যার আব্দুর রহীম – ইসলামী আইনতত্ত্ব, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, ঢাকা) তবে ইসলামি আইন নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মতানৈক্যও রয়েছে। অনেক মুসলিমপ্রধান দেশ মুসলিম পারিবারিক আইনের কিছুটা হলেও সংস্কার করেছে।

 

মিশরের বিশিষ্ট পণ্ডিত এবং সংস্কারক শেখ মুহম্মদ আব্দুহ (১৮৪৯- ১৯০৫) বলেছিলেন, সত্যিকারের ধর্ম হচ্ছে বাস্তব, আনুষ্ঠানিক কিংবা তাত্ত্বিক নয়। মানুষের উন্নতি তার মুক্ত চিন্তার ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। তাই সপ্তম শতাব্দীর প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা আইনকে সংস্কার করল তুরস্ক। ১৯২৭ সালে সুইস সিভিল কোড অনুসরণ করে বহু বিবাহ বন্ধ করেছে। ১৯৪৬ সালে ইজিপ্টে Law of Testamentary Disposition প্রবর্তন করা হলো, উত্তরাধিকারে মেয়েদের আরও সুবিধা দান করে। এই আইনের বিধান ১৯৫৩ সালে সিরিয়ায়, ১৯৫৭ সালে তিউনিসিয়ায় এবং ১৯৫৮ সালে মরক্কোতে গৃহীত হলো। (সা’ দ উল্লাহ্‌ : নারী অধিকার ও আইন, সময় প্রকাশন, বাংলাদেশ, ২০০২, পৃ ৮২) পাকিস্তানে ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন কিছুটা সংস্কার হয়। এই আইন বাংলাদেশেও চালু আছে। কিন্তু ভারতে মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার এক দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনও।

 

১৮৫৮ সালে ব্রিটিশরা ভারতের শাসনভার সরাসরি গ্রহণ করে। এরপরই  তারা নিজেদের ফৌজদারি আইন (Indian Penal Code) প্রবর্তন করে ১৮৬১ সালে। ব্রিটিশ আইনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি এই দণ্ডবিধি ভারতীয় ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে। ফলে ভারতের মুসলিমরাও ইসলামি ফৌজদারি আইনের পরিবর্তে ব্রিটিশ তৈরি ফৌজদারি আইনের আওতায় চলে এল। কিন্তু পারিবারিক আইন (বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার, দত্তক) সব ধর্মের ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে চালু থাকে। ১৯৩৭ সালে ইংরেজরা ‘মুসলিম পার্শোনাল ল অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট’ প্রবর্তন করে। যার মাধ্যমে মুসলিমদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়গুলোতে ইসলামি আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়।

 

স্বাধীনতার পর হিন্দু ব্যক্তিগত আইন সংস্কার হলো ভারতে। ১৯৫৫ সালে হিন্দু বিবাহ আইনের সাহায্যে বহু বিবাহ আইনত রোধ হল। ১৯৫৬ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারী-পুরুষের বৈষম্যকে দূর করা হল। একইভাবে পাকিস্তানেও সংখ্যাগুরু মুসলিমদের পারিবারিক আইন সংস্কার করে বিবাহ, তালাক, হালালা বিয়ে ও উত্তরাধিকারে লিঙ্গবৈষম্য দূর করার চেষ্টা কিছুটা হল। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ইচ্ছেমত মৌখিক তালাক গ্রাহ্য নয়। বাংলাদেশের মুসলিমরা বিবাহ-বিচ্ছেদ করতে চাইলে চেয়ারম্যানের কাছে (ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র/প্রশাসক ইত্যাদি) লিখিত আবেদন করেন। বহুবিবাহের ক্ষেত্রেও আইনি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। হালালা বিয়ে আইনত বন্ধ। স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার পর পুনরায় প্রাক্তন স্বামীকে প্রাক্তন স্ত্রী সরাসরি বিয়ে করতে পারে। মাঝে অন্য কোন পুরুষকে বিয়ে করে আবার তালাক নিয়ে শুচিশুদ্ধ হয়ে প্রাক্তন স্বামীকে বিয়ে করতে হয় না। উত্তরাধিকারেও একটি আইনের সংস্কার হয়েছে। জীবিত পিতামাতার কোন সন্তান মারা গেলে সেই মৃত সন্তানের পরিবার (ছেলে, মেয়ে, স্বামী, স্ত্রী) দাদু, ঠাকুরদার সম্পত্তির অংশীদার হয় না শরিয়ত অনুসারে। বাস্তু ভিটে, কৃষি জমি কোন কিছুতেই হক বর্তায় না। এই আইন ভারতে এখনও রয়েছে। কিন্তু ১৯৬১ সালে আইয়ুব খানের সময় পাকিস্তান এই আইনের সংস্কার করে মৃত সন্তানের পরিবারকে সরাসরি উত্তরাধিকারী হিসেবে গ্রাহ্য করে আইন প্রণয়ন করেছে। মুসলিম পারিবারিক আইনে লিঙ্গবৈষম্যের সংস্কার করা ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে এক জটিল আকার ধারণ করে আছে।

 

১৯৩২ সালে ইন্দোর-এর একজন আইনজীবী মহম্মদ আহমেদ খাঁ-এর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল শাহবানুর। ১৯৭৫ সালে তিনি শাহবানুকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। ১৯৭৮ সালে শাহবানু ফৌজদারি আদালতে ১২৫ ধারা অনুযায়ী মাসিক ৫০০ টাকা খোরপোশ দাবি করেন। স্ত্রীর খোরপোশ দাবির কারণে মহম্মদ আহমেদ শাহবানুকে তালাক দিয়ে আদালতে জানিয়ে দেন, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী শরিয়ত অনুসারে আর খোরপোশ দাবি করতে পারেন না। শাহবানুর তালাক হয়ে যাওয়ায় ফৌজদারি কোর্টের রায় আহমেদ খাঁর পক্ষে গেল। শাহবানু ওই রায়ের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টে আবার আবেদন করেন। সেখানে শাহবানুর খোরপোশ বাবদ ১৭৯ টাকা ২০ পয়সা স্থির হয়। কিন্তু এই রায়ের বিরুদ্ধে আহমেদ খাঁ আবার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল শরিয়ত অনুযায়ী তালাকের পর তিনমাস পর্যন্ত খোরপোশ দেওয়ার নিয়ম তিনি পালন করেছেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৫ ধারা মুসলিম স্বামীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। যদিও ১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায় শাহবানুর পক্ষে গেল। কিন্তু এই মামলার জের টেনে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল বিতর্কে। শরিয়তের বিধান অনুযায়ী চালু মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে পারে না —  রক্ষণশীলদের এই মতের সঙ্গে আধুনিকমনা মুসলিমদের সংঘাত বাধে। এবং শেষ পর্যন্ত রাজীব গান্ধী সরকারের নির্দেশে ১৯৮৬ সালের ৫ মে মুসলিম মহিলা বিল পাস হয়। তালাক দেওয়া স্ত্রীকে খোরপোশ দিতে হবে না এই ছিল মুসলিম মহিলা বিল। এই প্রথম ভারতবর্ষে প্রশ্ন ওঠে মুসলিম পারিবারিক আইনকে কেন্দ্র করে। সুপ্রিম কোর্টে জিতেও শাহবানু ন্যয্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেন রাজনৈতিক কৌশলে। নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার মুসলিম রক্ষণশীলদের তুষ্ট করল। দেশের সংখ্যালঘু মুসলিম মহিলাদের অধিকার এভাবেই রাজনৈতিক অভিসন্ধির মধ্যে তলিয়ে গেল।

 

শাহবানু মামলার তিনদশক পর আবার আবেদন জমা পড়ল সুপ্রিম কোর্টে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক অর্থাৎ একসঙ্গে তিনবার তালাক (তালাক-এ-বিদ্দত) বলার ফলে যে বিবাহ বিচ্ছেদ হত তাঁর বিরুদ্ধে আবেদনকারী ছিলেন সায়রা বানু, ইসরাত জাহান, গুলশান পারভিন, আফরিন রহমান ও আতিয়া সাবরি। আবেদনকারী মহিলারা কেউ ফোনে, কেউবা চিঠিতে তালাক পেয়েছিলেন। মুসলিম নারীদের নিরাপত্তা চেয়ে উচ্চ আদালতের কাছে তাঁরা আর্জি জানিয়েছিলেন। আবার দেশ উত্তাল হল। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে আদালতের হস্তক্ষেপ? ২০১৭ সালের ১১ মে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে শুরু হয়েছিল শুনানি। অল ইন্ডিয়া পার্সোনাল ল বোর্ডের আইনজীবী কপিল সিব্বাল বলেন, তিন তালাকের সঙ্গে ধর্ম পালন বা মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন জড়িত। এটি মুসলিম ল বোর্ডের এক্তিয়ারে পড়ে। আদালতের এতে নাক না গলানোই ভালো। শেষপর্যন্ত ২২ আগস্ট ২০১৭ সালে ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক অসাংবিধানিক’ এই রায় ঘোষণা করল সুপ্রিম কোর্ট। সাধারণ নাগরিকদের ধারণা ভারতে মৌখিক তালাক বন্ধ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে সরকার আইনপ্রণয়ন করার ফলে। প্রথমত মৌখিক তালাক (তিন মাসে তিন তালাক দেওয়ার বিধি) বন্ধ হয়নি। এই নিয়ে কোনও আইন হয়নি। একসঙ্গে পরপর তিন তালাক দেওয়া বন্ধের আইন হয়েছে। দ্বিতীয়ত তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধের আইন নানা জটিলতায় জড়িয়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় শাসকের অভিসন্ধিতে। তাৎক্ষণিক তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু করতে পারে। তাতে স্বামীর তিন বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা হবে। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছিলেন, ‘নারীদের অধিকার রক্ষার্থে এ এক তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ’। এই নাকি মুসলিম নারীদের ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত! স্বামী জেলে গেলেও সেই পরিবারের (তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী এবং তাঁর সন্তানদের) খোরপোশ স্বামীকেই বহন করতে হবে। এই নির্দেশের মধ্যে বাস্তবতা নেই, আছে চাতুর্য। জেলবাসীর উপার্জন বন্ধ থাকলে সেই মুসলিম পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে? যে বাড়ির ছেলে জেলে গিয়েছে সেই শ্বশুরবাড়ির লোকজন কি খোরপোশ দেবে? এছাড়া খোরপোশের আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা সরকারের তরফ থেকে করা হয়নি। তাছাড়া তাৎক্ষণিক তিন তালাক তো অবৈধ। অন্যায় ভাবে তালাক দিতে চাইলে গার্হস্থ্য হিংসা আইনেই স্বামীকে শাস্তি দেওয়া যেত। ফৌজদারি আইন কেন? জেলে পাঠানোর পর সেই স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী সম্পর্ক না রাখতে চাইলে তার কী সমাধান হবে? যদি আইনের ভয়ে সম্পর্ক রেখেও আবার আর একটি বিয়ে করে তখন কী প্রতিবিধান? তালাক বলে দেওয়ার পর আবার একসঙ্গে থাকতে চাইলে যদি হালালা বিয়ের চাপ আসে আঞ্চলিক ধর্মগুরুদের পক্ষ থেকে? ষড়যন্ত্রমূলক এই আইনে মুসলিম মেয়েদের নিরাপত্তার নামে প্রহসন তৈরি হয়েছে। শতকরা কজন নারী উপার্জন করেন যে স্বামীকে ফৌজদারি ধারায় জেলে পাঠিয়ে সংসারের হাল ধরবেন?

 

এটা ঠিক, তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধের আইন হওয়ায় মৌখিক তালাক (যেটা আইনত বন্ধ নয়, তিন মাসে তিনবার তালাক বলে বিবাহ বিচ্ছেদ করা যায়) দিতেও মুসলিম পুরুষরা দ্বিধা করছেন। কিন্তু তাতে যে অন্যভাবে বিপদ বাড়ছে সেই খবরও পাওয়া যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মেদিনীপুরের তনিমা খাতুন (নাম পরিবর্তিত) জানালেন, বাড়ির অমতে তাঁরা বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর স্বামীর অনুশোচনা হয়েছে বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হওয়ায়। সেটা সংশোধনের একমাত্র পথ তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ। কিন্তু স্বামী বিবাহ বিচ্ছেদ চাইলে দেনমোহর শোধ করতে হবে এবং অন্যদিকে যদি কোনভাবে স্ত্রী আইনের সাহায্য নিয়ে তাকে ফৌজদারি কেসে জড়িয়ে দেয়। বিপদের আশংকা করে তনিমার স্বামী তনিমাকে চাপ দিতে থাকে তাঁর কাছে তালাক চাওয়ার জন্য। মেয়েরা তালাক উচ্চারণ করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। ওটা পুরুষদের অধিকার। মেয়েরা বিবাহ বিচ্ছেদ নেওয়ার জন্য স্বামীর কাছে তালাক চাইতে পারে। স্ত্রী তালাক চাইলে আর দেনমোহর দেওয়ার চাপ থাকে না। ফৌজদারি আইনের আওতা থেকেও নিরাপদ। তাই তনিমার ওপর স্বামীর মানসিক পীড়ন শুরু হয়। তনিমা তালাক নিতে রাজি না হওয়ায় তিনি তালাক দিলেন না। কিন্তু আবার আর একটা বিয়ে করলেন। এই বিয়ে আটকানোর আইন এ দেশের মুসলিম মেয়েদের নেই।

 

মুর্শিদাবাদের রাকিবার আট বছর ও তিন বছরের দুটি সন্তান। উচ্চমাধ্যমিক পাস রাকিবার বিয়ে হয়েছিল অবস্থাপন্ন পরিবারে। স্বামী অন্য রাজ্যে ব্যবসার কাজে যুক্ত। রাকিবা মুর্শিদাবাদের বাড়িতেই থাকতেন। করোনার সময় রাকিবা টের পেলেন কর্মস্থলে স্বামী অন্য আর একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এই নিয়ে মনোমালিন্য হতেই স্বামীর অত্যাচার শুরু হল। রাকিবা স্থানীয় সমাজপতিদের কাছে বিচারের আবেদন করলেন। তেমন সাড়া না পাওয়ায় থানায় নালিশ ঠুকলেন। স্ত্রীর এই অভিযোগের প্রতিদান দিলেন রাকিবার স্বামী। দ্বিতীয় স্ত্রীকে মুর্শিদাবাদের বাড়িতেই পাকাপাকি থাকার জন্য নিয়ে এলেন। শুরু হল রাকিবার প্রতিবাদের প্রতিশোধ নেওয়া। বাড়ির লোক, প্রতিবেশী, গ্রামের মোড়ল রাকিবাকে মানিয়ে নিতে বললেন। উপার্জনহীন রাকিবা চেয়েছিলেন দুটি সন্তান নিয়ে আলাদা বাস করতে। স্বামীর কাছে শুধু খোরপোশের দাবি ছিল। রাকিবার স্বামী এই প্রস্তাব নস্যাৎ করে দেন। বলেন, একই বাড়িতে দুই সতীনকে থাকতে হবে। নানারকম নির্যাতনের ফলে রাকিবা মানসিক ভারসাম্য হারান। বাধ্য হয়ে রাকিবার দাদা রাকিবার স্বামীর কাছ থেকে তালাক করিয়ে নেন। রাকিবা এখন দাদাদের আশ্রয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। সুবিধাবাদীরা কীভাবে মুসলিম পারিবারিক আইনকে প্রয়োগ করে সেটা বোঝানোর জন্যই মাত্র দুটো দৃষ্টান্ত দিলাম।

 

এবার বিতর্ক শুরু হবে। বাস্তবে যেমনটা হয়। বহুবিবাহ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে মুসলমানদের থেকে বেশি। মুসলমানদের বহুবিবাহ কমে গিয়েছে। হ্যাঁ। অর্থনৈতিক কারণে বা শিক্ষা-সচেতনতার জন্য বহুবিবাহ কমেছে। কিন্তু বন্ধ তো হয়নি। কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে শতাংশের হিসেব মিলিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করে আত্মতুষ্টির মধ্যে সমস্যাকে চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে। আইন থাকলেই সমাজে অপরাধ বন্ধ হয়ে যায় না। আইন দরকার অপরাধীকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার জন্য। হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য)  হওয়ার জন্য ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষ তাঁর স্ত্রী থাকাকালীন পুনরায় বিয়ে করলে তাঁকে আইনত শাস্তি দেওয়ার উপায় আছে। কিন্তু মুসলিম পুরুষদের ক্ষেত্রে কোন শাস্তির আইন নেই। তাই অপরাধ কম ঘটলেও (বহুবিবাহজনিত অপরাধ) তাকে রোধ করার জন্য আইন দরকার। তাছাড়া পুরুষের বহুবিবাহ করার অধিকারের মধ্যে রয়েছে বৈষম্য। নারী-পুরুষের সম-অধিকারের জন্য এই বৈষম্য দূর করার আইনি পদক্ষেপ অতি দ্রুত নেওয়া দরকার।

 

মুসলিম নারীদের প্রতি চরম অপমানের আইন নিকাহ হালালা। নিকাহ হালালা নিয়ে শোরগোল কম শোনা যায়। প্রান্তিক অবস্থানে বিচ্ছিন্নভাবে এখনও ঘটে চলেছে নিকাহ হালালার শরিয়তি আইন। তালাক হয়ে যাওয়ার পর অনেক স্বামী-স্ত্রীর অনুশোচনা হয়। তাঁরা পুরনো দাম্পত্যে ফিরতে চান। কিন্তু ফিরতে চাওয়ার ব্যাপারটা সহজেই হবে, নাকি ঘৃণ্য, অসম্মানিত পথ পরিক্রমার পর ফিরতে পারবে তা নির্ভর করে সেই অঞ্চলের বিচারসভার ওপর। কোনো বিচারে বিবাহ বিচ্ছিন্ন সেই দম্পতিকে সরাসরি বিয়ে করার অনুমতি দেওয়া হয়। কোনো অঞ্চলের ধর্মীয় নেতা তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে তিনমাসের জন্য অন্য পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে বলেন। নতুন স্বামীর সঙ্গে সেই স্ত্রীকে যৌন জীবন পালন করতে হবে। তিনমাস পর নতুন স্বামী তালাক দেবেন। নির্ধারিত সময়ের পর তখন সেই স্ত্রী তাঁর পূর্ব স্বামীকে বিয়ে করতে পারবেন। এই শরিয়তি আইন পাকিস্তান, বাংলাদেশে সংস্কার করা হয়েছে। আমাদের দেশে ধর্মপ্রধানদের মর্জির ওপর নির্ভর করছে। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের নাসিমা খাতুনের জীবনে হালালা বিয়ের ফতোয়া ধার্য্য হয়েছিল। নাসিমা খাতুন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁর স্বামী রাগের মুহূর্তে তালাক দিয়েছেন। পরে অনুতপ্ত হন এবং দাম্পত্যে ফিরতে চান। স্বামী ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেললেন অথচ তাঁকেই কেন পুরনো সম্পর্কে ফেরার জন্য অশ্লীল জীবন পালনের মধ্যে যেতে হবে? নাসিমার সঙ্গে ছিলেন কিছু নারী সংগঠন। চাপের মুখে নাসিমার দাবি আদায় হয়। তিনি সরাসরি তাঁর দাম্পত্য জীবনে ফিরে যান। জঙ্গিপুর এলাকায় হালালা বিয়ে প্রতিরোধের অন্যতম মুখ এখন নাসিমা খাতুন। তাঁর চেষ্টায় আরও হালালা বিয়ে আটকেছে। কিন্তু যেখানে এইরকম প্রতিরোধ বা মুক্তচিন্তার সমাজপতি নেই সেসব এলাকার মুসলিম নারীকে এই জবরদস্তি মেনে নিতে হয়। নারী বিদ্বেষী এই ধর্মবিধি আইন করে বন্ধ না হলে রক্ষণশীলদের চাপিয়ে দেওয়া ফতোয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যাবে না।

 

২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ, হিন্দু আইন বা ব্যক্তিগত আইনের আওতায় না গিয়ে ‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট, ২০০০’  অনুযায়ী দত্তক নিতে পারেন। ধর্মীয় বিধি অনুসারে মুসলিম দম্পতি দত্তক সন্তানের পিতামাতা হতে পারেন না। অভিভাবক হতে পারেন। তাই শবনম হাসমি মুসলিম দম্পতির পিতামাতার অধিকার চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন। উচ্চ আদালতের রায় মুসলিম দম্পতির পক্ষে গিয়েছে। কিন্তু আইন এখনও হয়নি। সচেতন দম্পতি সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে দত্তক সন্তানের পিতামাতা হওয়ার আবেদন জানাচ্ছেন। যাঁরা এখনও এই রায়ের কথা জানেন না তাঁদের দত্তক সন্তান বিপদে পড়বে তাঁদের মৃত্যুর পর। কারণ অভিভাবকের সম্পত্তির অধিকারী তারা হতে পারবে না। পিতামাতার সন্তান হলে তবেই সম্পত্তির ওপর হক বর্তাবে। মুসলিম দম্পতি ও তাঁদের দত্তক সন্তানের জন্য এই আইন লাগু করা জরুরি।

 

সব সম্প্রদায়ের মেয়েদের মধ্যে প্রথম মুসলিম মেয়েরা পান সম্পত্তির অধিকার। কিন্তু সেখানে নারী ও পুরুষের সমান হক নেই। আরবদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে সম্পত্তির বাঁটোয়ারা পদ্ধতি তৈরি হল। কাজী আবদুল ওদুদ কোরান অনুবাদের ব্যখ্যায় লিখেছেন, টীকাকারদের মতে কোরান শরীফের চতুর্থ সুরা আন-নিসা-র অবতরণকাল চতুর্থ হিজরি। মুসলিম নারীদের সম্পত্তিতে হক পাওয়ার কারণ হিসেবে লিখেছেন, ‘ওহোদের যুদ্ধে ৭০০ মুসলমান যোদ্ধার মধ্যে ৭০ জন নিহত হয়। এর ফলে নারী আর অভিভাবকহীন ছেলে-মেয়ে একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। এই সূরায় বিবাহের বিধি নিষেধ সম্বন্ধে আর নারীদের ও অনাথদের সম্পত্তির অধিকার সম্বন্ধে অনেক কথা আছে। প্রাচীন আরবীয় সমাজে নারীদের আর অনাথদের সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হত না, কেন না, তারা যুদ্ধ করতে অপারগ।’ (কাজী আব্দুল ওদুদ রচনাবলী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৫, পৃ ২৪১)

 

চতুর্থ হিজরি মানে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার বছর আগে নারীর সামাজিক-আর্থিক নিরাপত্তার দিকে তাকিয়ে যখন সম্পত্তিতে কিছুটা অধিকার এল, তাহলে বর্তমান সমাজের বাস্তবতার দাবিতে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার আসবে না কেন? বাস্তবতার সূত্রে আইনের সমস্যাকে মানিয়ে নেওয়া (কিয়াস) এবং যেকোন যুগে কোন সমস্যার উদ্ভব হলে আলোচনার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করার (ইজমা) ইঙ্গিত তো ইসলামি আইনের উৎসেই রয়েছে। রক্ষণশীল পিতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী বাস্তবকে অস্বীকার করেন কেবল নারীদের ক্ষেত্রেই। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সংখ্যালঘু মুসলিম মাথাগুলো ভোটার হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই রক্ষণশীল গোষ্ঠীকে দলগুলো তুষ্ট রাখতে চায়।

 

পৈতৃক সম্পত্তিতে মুসলিম পুরুষের অংশ কেন মুসলিম নারীর দ্বিগুণ হবে? কেবল কন্যা সন্তান থাকলে পৈতৃক সম্পত্তির ষোলভাগের ছভাগ আত্মীয়দের দিতে হবে কেন? স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির আটভাগের এক ভাগ পাবে অথচ স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামী কেন স্ত্রীর সম্পত্তির চারভাগের এক ভাগের শরিক হবে? পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় সেই পিতার কোন সন্তান মারা গেলে মৃত সন্তানের পরিবার মৃতের পৈতৃক ভিটে থেকে কৃষিজমি বা অন্য সম্পদ কিছুরই অংশীদার থাকবে না শরিয়ত অনুসারে। অথচ এই ধর্ম-আইন পাকিস্তানে আয়ুব খানের সময় সংস্কার করে পৈতৃক সম্পত্তিতে মৃতের পরিবারের পুরো অধিকার আইন চালু হয়েছে। এই আইন বাংলাদেশেও প্রয়োগ হয়। এদেশে কেন এখনও আইন হয়নি?

 

মেয়েদের অধিকারের দাবি সব থেকে পেছনের সারিতে জায়গা পায়। সমাজের অন্য সমস্যাকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, মেয়েদের প্রতি বঞ্চনা, শোষণের দাবি ততটা গুরুত্ব বহন করে না। এবং সেটা যদি ধর্মীয় আইনের আওতায় থাকে তাহলে নিশ্চুপ থাকার প্রবণতা আরও বেশি। এদেশের বর্তমান অবস্থায় হিন্দু মৌলবাদ আর মুসলিম মৌলবাদের দড়ি টানাটানি বেড়েছে। অস্তিত্বের সংকটে পড়ে ধর্মের পরিচিতিকে আরও বেশি করে অবলম্বন করতে চাইছে সংখ্যালঘু মুসলিমরা। শিক্ষিত মুসলিমরা সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য নানা জনসেবামূলক কাজের প্রকল্প নিয়েছেন। শিক্ষা, চাকরি বা উপার্জনে মুসলিম সমাজের অগ্রগতির কথা ভেবে তাঁদের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ প্রশংসনীয় অবশ্যই। কিন্তু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আইন সংস্কার করে লিঙ্গবৈষম্য দূর করার দাবি তুললে সেই তাঁদের মধ্যে অধিকাংশের সমর্থন পাওয়া যাবে না। কারণ যুক্তি হল, হিন্দু মৌলবাদ মুসলিম ধর্ম-বিধি নিয়ে বিরূপ প্রচারের সুযোগ পাবে। ফলে সংখ্যালঘুরা আহত হবে। কথা খুব অযৌক্তিক নয়। হ্যাঁ, সুবিধে বুঝে মুসলিম সম্প্রদায়কে আঘাত হানতে পারলেই হিন্দু মৌলবাদের সন্তুষ্টি। কিন্তু এই সুযোগ তাদের করে দিচ্ছে কে? সম্প্রদায়ের উন্নতির সঙ্গে লিঙ্গসাম্যের একটা সম্পর্ক রয়েছে সেটা সেই সম্প্রদায়কেই বুঝতে হবে। এই সাম্য শুধু নীতিবাচক মৌখিক কথা দিয়ে হবে না। তার জন্য আইন অবশ্যই প্রয়োজন। এবং সংস্কারের জোরালো দাবি সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে উঠে আসলে হিন্দু মৌলবাদের অবজ্ঞাকে উপেক্ষা করা যাবে।

 

এদেশে হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই সতীদাহ প্রথা রদ আইন, বিধবা বিবাহ আইন আনতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর হিন্দু কোড বিল, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে হিন্দু নারী-পুরুষের সম-অধিকার আইন আনার জন্যও হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল। ফলে সব সম্প্রদায়ের ধর্ম বিধির মধ্যেই রয়েছে লিঙ্গবৈষম্য। তাকে সংস্কার করতে হলে মৌলবাদের বিরুদ্ধে যেতেই হবে। ভারতের মুসলিমরা সবক্ষেত্রে শরিয়ত মেনে আর চলেন না। তাঁরা ইসলামি বিধি অনুযায়ী ফৌজদারি আইনে চলেন না। কই তখন তো ধর্মে আঘাত লাগছে না! সুদ দেওয়া এবং সুদ নেওয়া হারাম। সেও তো দেওয়া নেওয়া চলছে। ব্যাংক, জীবনবিমা, পিএফ ইত্যাদি থেকে সুদ নেওয়ার সময় কজন মুসলিমের ধর্ম নির্দেশের কথা মনে থাকে? গৃহঋণ নিলে সুদ দিতে হয়। তখন কোন পথে চলেন, সম্প্রদায়ের সেই তাঁরা, যাঁরা মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার করে লিঙ্গসাম্য আনার দাবিকে ধর্মের যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করতে চান? নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা হিন্দুত্ববাদী শাসকদলের অভিসন্ধিমূলক আইনপ্রণয়নের বিরুদ্ধে এবং একইসাথে মুসলিম পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে অনড় থাকবে।

 

Share this
Leave a Comment