গ্রাউন্ডজিরো-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেবাশিস (বাচ্চু) আইচ, গত ২১ জুন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। গ্রাউন্ডজিরো ১৩ জুলাই কলকাতার থিওসফিকাল সোসাইটি হল-এ তাঁকে মনে রেখে এক স্মরণসভার আয়োজন করে। সেখানে দেবাশিস আইচের পরিবার, রাজনৈতিক সহকর্মী, সাংবাদিক বন্ধু, গণ আন্দোলনের সাথী সহ বহু মানুষ উপস্থিত হন। তাঁদের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে দেবাশিস আইচের চেনা-অচেনা এক বর্ণময় জীবনের টুকরো ছবি। ছাত্র রাজনীতি থেকে মানবাধিকার কর্মী, জনতার কন্ঠস্বর হয়ে ওঠা সাংবাদিক, গদ্যকার, কবি — স্বল্প সময়ে যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে বহু কাজ অসমাপ্ত রেখে যাওয়া দেবাশিস আইচের জীবন। এদিনের অনুষ্ঠানে তাঁর লেখা কবিতা পড়েন ঊর্মিমালা, রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন সংহিতা।
স্মরণসভার উপলক্ষে গ্রাউন্ডজিরো থেকে প্রকাশিত করা হয় একটি ফোল্ডার।
দেবাশিস (বাচ্চু) আইচ-কে মনে রেখে…
দেবাশিস (বাচ্চু) আইচ গ্রাউন্ডজিরোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। তার আগে বাচ্চুদা কাজ করেছে প্রায় সব ধরনের মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে। সেইসব সংবাদমাধ্যমগুলির সাথে গ্রাউন্ডজিরোর একাধিক প্রভেদ আছে। গ্রাউন্ডজিরো কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক অনুদানের ওপর চলে না, সেই অনুদানের রাজনীতিতে বিশ্বাসও করেনা। এখানে কেউই বেতনভূক কর্মচারী নন। বরং, কাজ হয় যূথবদ্ধতার নিয়ম মেনে, পুঁজিচালিত কর্মক্ষেত্রের ক্রমাধিকারতন্ত্র মেনে নয়। গ্রাউন্ডজিরোতে কাজ করতে আসা মানে একধরনের রাজনৈতিক বক্তব্যের সপক্ষে দাঁড়ানো। এখানে লেখা মানে বিকল্পের অনুসন্ধান, পুঁজিরাষ্ট্রের মেলবন্ধনের স্থিতিস্থাপকতাকে প্রশ্ন করা।
মূলস্রোতের সাংবাদিকতার যে মতাদর্শগত বাঁধুনি, সেখান থেকে এই উল্লম্ফন ঘটানো এক ব্যক্তির পক্ষে সহজ নয়। কিন্তু, বাচ্চুদা খুব সহজেই এটা ঘটাতে পেরেছিল। আবার সেটাই বা বলি কী করে? যেটাকে আমরা “উল্লম্ফন” বলছি, সেটাই তো ছিল আসলে বাচ্চুদার সহজাত জায়গা। আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, যারা হয়তো অনেকেই বাচ্চুদাকে দেখেছে, আড্ডা মেরেছে, এমনকি হয়তো হাতেকলমে বাচ্চুদার কাছে কাজ শিখেছে, তারাও হয়তো অনেকেই জানে না যে বাচ্চুদা দীর্ঘদিন ছিল প্রখ্যাত মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন অফ সিভিল লিবার্টিজ (পিউসিএল)-এর পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক। মানে, বাচ্চুদা আসলে ছিল আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক মানুষ। সাংবাদিক হিসাবে জনপ্রিয়তার অনেক অনেক আগে ছিল বাচ্চুদার রাজনৈতিক কর্মীর পরিচয়, মানবাধিকার কর্মীর পরিচয়।
উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া অঞ্চলে এক সরকারি আবাসন “এলআইজি হাউসিং”-এ বামপন্থী পরিবারে বেড়ে ওঠা বাচ্চুদা শৈলেন্দ্রনাথ স্কুল পেরিয়ে স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হন ১৯৮০ সালে। বাচ্চুদা ছিল সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যাঁরা শৈশবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন নকশালবাড়ির ঘটনা ও পরবর্তী রাজনীতির উন্মেষ। তাঁর মতন অনেকে তরুণতরুণীই, যাঁরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন নকশালবাড়ির রাজনীতির দ্বারা, তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি খুঁজেছিলেন ও পেয়েছিলেন কলেজে কলেজে এসএ-ডিএসএ আন্দোলনের ভেতরে। এসএ-ডিএসএ সংগঠনগুলির চরিত্র ছিল মূলত প্রগতিশীল–গণতান্ত্রিক, ছাত্র পরিষদ ও ভারতের ছাত্র ফেডারেশন, এই দুই প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র সংগঠনের বাইরে একটি বিকল্প, স্বাধীন বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির সংস্কৃতি গঠন ছিল তার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য। স্কটিশচার্চ কলেজ এ ভর্তি হবার পর বাচ্চুদা ডিএসএ তে যোগ দেয়। স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র-সংসদের সম্পাদক ও সভাপতিও নির্বাচিত হয়।
বাস্তবিক ক্ষেত্রে, নকশালবাড়ির পথে অনুপ্রাণিত বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপগুলি এসএ-ডিএসএ গুলির ভিতরে কাজ করেছে। এবং, সেই ধারাবাহিকতার হাত ধরেই বাচ্চুদার পিসিসি-সিপিআইএমএল-এর সদস্য হয়। কিন্তু স্বাধীনচেতা বাচ্চুদাকে কমিউনিস্ট পার্টির কঠোর অনুশাসনের মধ্যে বেঁধে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই পার্টির পরামর্শেই একটা সময়ে সে মানবাধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে এবং দীর্ঘদিন ভারতবর্ষের প্রখ্যাত মানবাধিকার সংগঠন পিইউসিএল এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ভাগলপুর দাঙ্গার পাশাপাশি কাটরা মসজিদ দাঙ্গা সহ তাঁর বিভিন্ন অন্তর্তদন্তমূলক রিপোর্টাজ আলোড়ন ফেলে। তাঁর সম্পাদক থাকাকালীন সময়েই পশ্চিমবঙ্গ পিইউসিএল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতো নাগরিক অধিকার নামে একটি পত্রিকা। কলকাতার মানুষ হলেও গ্রামের সঙ্গে ছিল তাঁর নাড়ির টান। একদিকে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের জঙ্গলভূমি থেকে চা বাগানের শ্রমিক আর অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের কথা বলতেন বাচ্চুদা। বাচ্চুদার সমসাময়িক অনেকের মুখেই শুনেছি, ভারতবর্ষের জরুরি অবস্থা পরবর্তী সময়ে, পশ্চিমবঙ্গের যে গুরুত্বপূর্ণ বন্দিমুক্তি আন্দোলন, সেখানেও তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু নকশালপন্থী গ্রুপ-রাজনীতির সংকীর্ণতার কারণে ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়া বাচ্চুদার সাংবাদিকতার প্রতি আকর্ষণ বাড়ে মূলত গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনযুদ্ধের পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের করুণ কাহিনীগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষায়। বাচ্চুদা কাজ করেছে বাংলার একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলে, সংবাদমাধ্যমে, এনজিও-ধর্মী ভিডিও ম্যাগাজিনে। চাকরি করেছে অসম ও পুরুলিয়ায়। কলকাতায় তো বটেই।
কিন্তু বাচ্চুদা ক্রমশ আস্থা হারাচ্ছিলেন মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায়। মাঝে মাঝেই বলতেন এখানে তো মূর্খের পণ্ডিত্য। ২০১৮র এপ্রিল মাসে গ্রাউন্ডজিরো যখন তৈরি হয়েছে, তখন আমরা যে বাচ্চুদাকে পেয়েছি, সেই বাচ্চুদা এইসব অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা বাচ্চুদা। গ্রাউন্ডজিরোর অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের সাথে বাচ্চুদার বয়সগত, প্রজন্মগত ফারাক থাকলেও কতগুলো জায়গায় ছিল অভিজ্ঞতার মিল – কমিউনিস্ট গ্রুপ করা, কমিউনিস্ট গ্রুপ রাজনীতিতে নিজেকে খুঁজে না পাওয়া, এবং তৎসত্ত্বেও, বামপন্থী রাজনীতির প্রতি সার্বিকভাবে বিশ্বাস রাখা। মিল ছিল এই ভাবনায় যে, গণমাধ্যমকে হয়ে উঠতে হবে সামাজিক আন্দোলনের খবর এবং তত্ত্বায়ন জনসমক্ষে উপস্থিত করার আধার। এবং, অবশ্যম্ভাবীভাবে, মিল ছিল এই ভাবনাতেও যে, এই কাজগুলি বাজারি, প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া বা জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র, কোথাওই সম্ভব নয়। তাই কি বাচ্চুদা এতটা একাত্ম হয়ে কাজ করতে পেরেছিল এই পর্যায়ে? নিজের অর্থকষ্ট, শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও বাচ্চুদা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন গণআন্দোলনে? তাঁর কলম বারবার ঝলসে উঠেছে যারা নিপীড়িত এবং অবহেলিত তাদের স্বপক্ষে আর রাষ্ট্রশক্তির প্রাণপণ বিরোধিতায়।
বাচ্চুদা আমাদের সাথে কাজ করে কী পেয়েছিল জানি না, কিন্তু তার থেকেও বড়ো সত্য যেটা, তা হল, আমরা বাচ্চুদার কাছে শিখেছিলাম অনেক অনেক কিছু। আমরা শিখেছিলাম, তথ্যবিহীন তত্ত্বের কোনো মূল্য নেই। তথ্য নিজের পরিচিত গন্ডির ভিতরেই বাস করে আহরণ করা যায় না। তথ্য কী, তা মূলগতভাবে অনুধাবন করতে হলে, প্রয়োজন সমাজকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা। সেই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা একমাত্র তৈরি হতে পারে মানুষের মধ্যে গেলে, আন্দোলনের সংস্পর্শে গভীরভাবে এলে। এবং, সর্বোপরি, এই যে তথ্য থেকে তত্ত্বের যে যাত্রাপথ, সেখানে একজন জনমুখী, রাজনৈতিক সাংবাদিকের কাজ নিজের পর্যবেক্ষণকে যথাযথ তথ্যনিষ্ঠ ভাবে উপস্থাপন করা। সেই বাস্তবতা যদি সাংবাদিকের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতামতের পরিপন্থী হয়, তাহলেও। শিখেছিলাম জনমুখী, বিকল্প সাংবাদিকতায় রিপোর্টিং-এর অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শিখেছিলাম, কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনীতিচর্চা ও সংস্কৃতিচর্চার বাইরে পদার্পণ করার প্রয়োজনীয়তা। নিজের সাংবাদিক জীবনে, বাচ্চুদা পেরেছিল এই কলকাতাকেন্দ্রিকতা থেকে বেরোতে। পেরেছিল কলকাতার মানুষ হয়েও। এবং তার ফলে, পেয়েছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসাও।
হ্যাঁ, বাচ্চুদা পেয়েছিল কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারও – গ্রামকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার জন্য পেয়েছিল স্টেটসম্যান পত্রিকার বেস্ট রুরাল জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ডও। কিন্তু, সেসব ছাড়িয়েও, বাচ্চুদা জীবিত অবস্থাতেই পেয়েছিল তার চেয়ে অনেক বড়ো পুরস্কার – সংগ্রামী মানুষের ভালোবাসা। বাচ্চুদার “ভাত দে হারামজাদা” বই হাতে নিয়ে বিডিও অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন মিড-ডে মিল কর্মীরা। আজীবন মানুষের মিছিলে পা মেলানো বাচ্চুদার কাছে এর থেকে বড়ো সম্মান বা পুরস্কার আর কী-ই বা হতে পারে?
ভাগলপুর দাঙ্গার উপর তাঁর লেখা “দহননামা” আর কাটরা মসজিদের দাঙ্গার উপর লেখা রিপোর্টাজের খোঁজ বারবার মানুষ করবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দুটি অমূল্য দলিল হিসেবে। বাচ্চুদার বিচরণ সীমাবদ্ধ থাকেনি রিপোর্টাজ বা প্রবন্ধমালায়। ভালবাসা ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত আর কবিতায়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তাঁর কবিতার বই “আমাকে জাগিয়ে রাখো” আর “রাত্রিকাল রাত্রিকথা”, “মায়াবন্দরের রূপকথা”র মত উপন্যাস বা “নিমকাঠির জীবন”এর মত গদ্য তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে বাংলার অপাংক্তেয় সাহিত্য জগতে।
আমাদের কাছে বাচ্চুদার এই অকালমৃত্যু একটি অপূরণীয় ক্ষতি। ব্যক্তিগতভাবেও, সাংগঠনিকভাবেও। তা সত্ত্বেও, মেনে নিতে হয় মৃত্যুকে। জানি, বাচ্চুদার স্মৃতিকে সম্মান জানানোর জন্যই কাজ করে যেতে হবে আমাদের। যেভাবে পারি, যতটুকু পারি।
গ্রাউন্ডজিরো টিম
১৩/০৭/২০২৪