বরাক উপত্যকা নাট্য পরিক্রমা ২০২৩। মূল উদ্যোগ শিলচর কোরাস। দিলখুশের চোখে পরিক্রমার অনুভূতি।


  • May 30, 2024
  • (0 Comments)
  • 695 Views

সব্যসাচী, সৌমি (দিলখুশ)

 

অজানা জায়গায় অচেনা মানুষের সাথে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন আগেও ঘটেছে। তবু অনেক কিছু জানার ছিল। ইচ্ছে ছিল বুঝবার। আমরা দু’জন নিজেদের কতটা স্ট্রেচ করতে পারি । ইচ্ছে ছিল পুরোটা বোঝার, কিভাবে পুরো ব্যবস্থাটা রান করে। এত মানুষের মাঝে মানুষের খেলা, বিনিময়… কথা, ভাব, সময়, খাবার। ভারতবর্ষকে ভেতর থেকে ভালোভাবে চেনার একমাত্র উপায় আমাদের কাছে এটাই, নাটক নিয়ে প্রত্যন্ত পরিসরে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া। তাই এই পরিক্রমায় দিলখুশের অংশগ্রহণ।

 

লেখাটি ২০২৩-এর হলেও নানা বিভ্রাটে প্রকাশে দেরি হল। শিলচর কোরাস ও বরাক উপত্যকা নাট্য পরিক্রমার কথা আমাদের বন্ধুদের, সহকর্মীদের ও অন্যান্য পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই এই প্রয়াস। – দিলখুশ

 

২১ ফেব্রুয়ারি বেহালা কৃষ্টি সাংস্কৃতিক সংস্থা ও আদর্শ পল্লী ইয়ং অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মরণে আমাদের শো ছিল বেহালাতে। অনেক রাত হয়েছিল বাড়ি ফিরতে। রাত জেগে ব্যাগ গুছিয়ে অল্প ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সকাল ট্রেন, শিলচরের উদ্দেশ্যে।

 

২২ ফেব্রুয়ারি ট্রেন শিয়ালদা থেকে, শিলচর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। সকাল ৬.৩৫-এ রওনা। পৌছাবার কথা ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি দুপুর আড়াইটা নাগাদ। আমি আর সৌমি। সারাদিন ট্রেনে কাটানো খুব বিচ্ছিরি বেদনাদায়। দুজনের সিট-ই আবার ছিল আপার বার্থে। অনেক শুনেছি পরের দিনের যাত্রাপথ নাকি খুবই সুন্দর। সেটা মাথায় ছিল তাই কোনক্রমে এক সহৃদয় ব্যক্তির সঙ্গে একটা সাইড লোয়ার এক্সচেঞ্জ করা গেল।

 

আমার এক বন্ধু বলেছিল হাফলং স্টেশনের কথা। ট্রেনটা অনেকক্ষণ দাঁড়ায় সেখানে। নেমে বিশেষ খাবার খেতে। বন্ধুর সব বর্ণনা মিলে গেল। অপূর্ব সুন্দর একটা স্টেশন, চারিদিক পাহাড় ঘেরা। স্থানীয় মহিলারা মেখলা পরে সেই বিশেষ খাবার বিক্রি করছেন। একটা অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েলের বাক্সের মধ্যে হলুদ ভাত বা পোলাও, উপরে ঘুগনি আর তার ওপরে একটা কষা ডিম। দারুন। এক ঘন্টা লেট করে ট্রেন পৌঁছালো শিলচর, ঘড়িতে তখন দুপুর সাড়ে তিনটে। স্টেশনে স্বয়ং বিশ্বজিৎ কাকু অর্থাৎ বিশ্বজিৎ দাস, শিলচর কোরাস নাট্য গোষ্ঠীর কর্ণধার, অপেক্ষা করছিলেন অনেক আগে থেকেই। স্টেশনের বাইরে একটি ঐতিহাসিক মনুমেন্ট বা স্থাপত্য আছে – ভাষা আন্দোলনের প্রতীক। তার সামনে একটা ছবি তুলে রওনা দিলাম বিশ্বজিৎ কাকু ও স্নিগ্ধা কাকিমার বাসায়।

 

বিশ্বজিৎ দাস এবং স্নিগ্ধা নাথ দুজনেই কোরাস নাট্যগোষ্ঠীকে আগলে রেখেছেন। সঙ্গে রয়েছে এক ঝাঁক নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়ে। দুজনেই জীবন বীমা অফিসে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৫ সালে বাদল সরকার গিয়েছিলেন হাইলাকান্দিতে, সেখানে থেকেই বোধহয় ওঁদের দু’জনের তৃতীয় ধারার থিয়েটারের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়।‌ ১৯৮৬তে প্রতিষ্ঠিত হয় শিলচর কোরাস। ১৯৯৩-এ বাদল সরকার শিলচরে আসেন নাটকের ওয়র্কশপ করাতে। সেখান থেকে কোরাস আরো সমৃদ্ধ হয়।

 

আগামীকাল থেকে শুরু শিলচর কোরাস আয়োজিত অঙ্গন মঞ্চের নাট্যোৎসব। শিলচর সংগীত বিদ্যালয়, ট্রাঙ্ক রোড, কাছাড় কলেজের পাশে। জানতে পারলাম এখানে কালিকাপ্রসাদ আগে গানের স্কুল চালাতেন।

 

২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি 

কোরাস আয়োজিত অঙ্গনমঞ্চ নাট্যোৎসব 

“মুক্তমঞ্চে, মানুষের সাথে, মুক্তির লক্ষ্যে।”

 

এদিপ ইমনের (কোরাস-এর সদস্য) গান দিয়ে শুরু। এক ঝাঁক ইচ্ছে ডানা… যাদের আজ উড়তে মানা… গান মাঝ অবস্থায়, বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সব অন্ধকার মাইক বন্ধ, দর্শকরা হঠাৎ গান গেয়ে উঠলেন, গলা মেলালেন এদিপের সঙ্গে । অন্ধকারেই গান চলতে থাকলো। কিছু মানুষ বেরিয়ে গেলেন, আবার আলো ফিরতেই শুরু হলো প্রথম নাটক।

 

তিন পুতুলের গল্প । উপস্থাপনায় আজকের প্রজন্ম। খুব এনার্জি নিয়ে দারুন মুভমেন্ট করে, তরুণ কিশোরীদের নাটক শেষ হলো। গান নাটকের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল লাইভ পেইন্টিং। অরিজিৎ বণিক, আসাম ইউনিভার্সিটিতে ভিজুয়াল আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করছেন। অবলীলায় ভরিয়ে চলেছেন ক্যানভাস, দর্শকদের সামনে। আমরা দু’জনেই আগে কখনো দেখিনি এরকম। তারপর দ্বিতীয় নাটক শিলচর কোরাসের উপস্থাপনায়, বাদল সরকারের নাটক ওরে বিহঙ্গ  । “ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।”

 

দেখলাম অসাধারণ একটি উপস্থাপনা। যেটি এখনো বিশ্বাস করায়, আশার পাখায় ভর করে শুধু চলা আর চলা…। ঠিক তারপরেই আমাদের নাটকজ্বালাতনের অপেরা । সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে পেছনে কস্টিউম চেঞ্জ করে নেমে পড়া। আবার মানুষের সামনে। খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম, এই নাটকে একটু বাঁকড়ি ভাষার প্রয়োগ আছে। দক্ষিণবঙ্গের এই জেলাতে আগে মানুষ বাঁকড়ি ভাষাতে কথা বলতেন। সেই ভাষা আর নাই। ভাষাটা হারিয়ে যাচ্ছে ভেবেই ব্যবহার করা হয়েছিল। চিন্তা হচ্ছিল। শিলচরের মানুষের ঠিক কেমন মনে হবে? এসব কিছু আর ভাবতেই হয়নি কারণ নাটক শুরু হওয়ার মধ্যেই প্রচুর হাততালি পেয়েছি। হাততালি যত বেড়েছে আস্তে আস্তে ঠিক ততটাই বেড়েছে কনফিডেন্স। ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম দুজনেই।

 

শেষ হয় প্রথম দিনের নাট্য উৎসব। সবাই গিয়ে বসা হয় বিশ্বজিৎ কাকু আর স্নিগ্ধা কাকিমার বাড়ির মাঝে, কোরাসের রিহার্সাল স্পেসে। গল্প, আড্ডা, আলাপ, আলোচনা করতে করতেই অনেক রাত হয়ে যায়। পরের দিনের প্ল্যান করতে করতে খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুমিয়ে পড়া।

 

দ্বিতীয় দিনেরও দর্শক ভর্তি। অনেকের বসার জায়গা হয়নি, তারা দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথম নাটক বাদল সরকারের লেখা ক চ ট ত প, উপস্থাপনায় শিলচর কোরাস।‌ আপ্পি দিদি আর অপর্ণা – এই দুই চরিত্রকে নিয়ে কী সুন্দর স্পেসের খেলা! কি দারুন মুখোশ! গ্রোসক ও ভর্গম কি অসাধারণ! মানুষের নির্বোধ জীবনযাপন চোখে আঙুল দিয়ে আবার দেখিয়ে দেয়।

 

দ্বিতীয় নাটক ছিল আমাদের, বাদল সরকারের লেখা নাটক ভুল রাস্তা। ৫৬তম শো। আমি আর সৌমি ভুল রাস্তা শুরু করেছিলাম ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বের, আর তার পরে পরেই লক ডাউন। অঙ্কুরদা বলেছিল এই নাটক করা মাটি কাটার থেকে কোনো অংশে কম না। প্রত্যেকটা শো-র পরে বুঝতে পারি। ঠিক পরেই ছিল শিলচর কোরাসের নাটক সমরেশ বসুর লেখা আদাব । ৩১ বছর ধরে কোরাস এই নাটকটি করে চলেছে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে নাটকটি প্রচন্ড প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ১৯৪৬-এর বাংলা আর ২০২৩-এর বাংলার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

 

নাট্য উৎসবের দু’দিনই এদিপ ইমন গান গেয়ে মাতিয়েছেন। ছিল নাচ, পাঠ। নাজিম হিকমতের কবিতা জেলখানার চিঠি। শেষে ছিল কোরাসের উপহার সব্বাইকে। আর না বলে পারছি না – উজানভাটি-র গান। উফ্‌ আসাধারণ। একদম অজানা, মাটির কাছাকাছি গান। ‌এত আনন্দ পেয়েছি সবাই! গানগুলো শোনার পর আমাদের দু’জনেরই মনে হচ্ছিল আমাদের মন, মাথা যেন আবার রিবুট হয়ে গেল।

 

কোরাস আয়োজিত অঙ্গন মঞ্চের নাট্যোৎসব শেষ হলো। গন্তব্যে পৌঁছে ব্যাগ গোছানো, আগামীকাল সকালে বেরোনো। বরাক উপত্যকা নাট্য পরিক্রমার জন্য। শিলচর কোরাস প্রত্যেক বছরই বরাক উপত্যকা নাট্য পরিক্রমা করে। এবারে সঙ্গে থাকছি আমরা দিলখুশ।

 

২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ।

বরাক পরিক্রমা।

“দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে।”

 

কেন গ্রাম পরিক্রমা? কেন দিলখুশের অংশগ্রহণ? অজানা জায়গায় অচেনা মানুষের সাথে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তো আগেও ঘটেছে। কিন্তু তা ছাড়াও অনেক কিছু জানার ছিল। ইচ্ছে ছিল বুঝবার। আমরা দু’জন নিজেদের কতটা স্ট্রেইচ করতে পারি? ইচ্ছে ছিল পুরোটা বোঝার, কিভাবে পুরো ব্যবস্থাটা রান করে। এত মানুষের মাঝে মানুষের খেলা, বিনিমযয়… কথা, ভাব, সমযয়, খাবার। ভারতবর্ষকে ভেতর থেকে ভালোভাবে চেনার একমাত্র উপাযয় আমাদের কাছে এটাই, নাটক নিয়ে প্রত্যন্ত পরিসরে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া।

 

২০০৭ সালে বাঁকুড়া থেকে কলকাতা আসা। ২০১৫ সাল নিজেকে আড়াল করতে শিখেছি। ততক্ষণে শহরের শোষণ যন্ত্রের কবলে আমরা। বুঝেছি এইটা এক বিরাট ব্ল্যাক হোলের মত। যেই কাছে আসে তাকেই গিলে ফেলে কিন্তু শহরের সেটিই আশ্চর্য মায়াবী আকর্ষণ । সবাই ছুটে আসে। এখন ২০২৩ সাল মনে হয় কোনো গ্রাম আর গ্রাম নেই। বিশ্বায়নের দৌলতে সব সেমি টাউন। তাই ইচ্ছে হচ্ছিল চিৎকার করে বলতে, সমতলের মনের কথাগুলো পাহাড়ের মানুষের মনের কাছে গিয়ে। তোমাদের শোষণ যন্ত্র আর আমাদের শোষণ যন্ত্রের শেঠরা লুট করে খাচ্ছে সবটাই।

 

যাত্রা শুরু:

 

নাটকের সিজন হোক বা না হোক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা মাথায় ছিল কোরাসের সদস্যদের। তাছাড়া প্রায় সবাই চাকরি-বাকরি করেন, তাই রোববারটাতেই বেরোনো হয়েছিল। বাকি দিন দুটো সবাইকে ছুটি নিতে হয়েছিল নিজেদের মতো করে। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ এজাতীয় পরিকল্পনার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যাই হোক, মানুষের কাছে পৌঁছাতেই হবে। কচি গাছের মত – তুমি আমাকে আটকালেও আমি ঠিক একেবেঁকে যেভাবেই হোক আলোর উৎসর দিকে পৌঁছবই।

 

একটা বাস। জনা ৩০ বসতে পারে। বাসের মাথায় মাইক সেট করা আছে। একটা বড় ত্রিপল ভাঁজ করা থাকে বাসের মাঝখানে। দুটো বড় হ্যালোজেন, ফ্লেক্সিবল স্ট্যান্ড, পর্দা । আর একটা ছোট্ট জেনারেটর বাসের ভেতরে সেট করা আছে। যেখানেই যাওয়া হচ্ছে সেখানেই বাসটাকে পিছনের দিকে সেট করে, সামনে পর্দা ও ত্রিপল পেতে অ্যারেনা রেডি। রাত হলে হ্যালোজেন ও স্ট্যান্ডিও রেডি।

 

অসাধারণ একটা ব্যবস্থা – পোর্টেবল, ফ্লেক্সিবল, তবে একটু এক্সপেন্সিভও। যাই হোক, বাসের মধ্যে গান-বাজনা করতে করতে পৌঁছে যাওয়া হলো কোটামনি।

 

রাস্তার ধারে একটু ঘেরা ছোট মাঠ। সুপুরি বাছাইয়ের কাজ হয় ওই জায়গাটিতে। ভিড় থিক থিক করছে। বুঝলাম, পুরো বিষয়টাই আগে থেকে দারুণভাবে প্রচারিত।

 

সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে ত্রিপল পাতা হয়ে গেল, পর্দা টান হয়ে গেল। দুপুর প্রায় সাড়ে বারোটা। আমাদের প্রথম নাটক করতে হবে। আমরা তৈরি হচ্ছি। আমাদের সঙ্গে এসেছিল বন্ধু সায়ন্তন মুর্শিদাবাদ থেকে, তার গান দিয়ে শুরু হল পরিক্রমার প্রথম দফার অনুষ্ঠান। প্রথমে জ্বালাতনের অপেরা-র শো। তারপরেই শিলচর কোরাসের আদাব

 

নাটক শেষ হতে হতে সবার খিদে পেয়ে গেছে। শুনলাম ওখানে উনারা খাবার ব্যবস্থা করেছেন। আমরা সবাই ছোট ছেলেদের মত লাইন দিয়ে এগিয়ে গেলাম একটি স্কুলের দিকে। সেখানেই খাবার ব্যবস্থা। ঝটপট খাওয়া-দাওয়া সেরে বাসে ওঠা হল। মোল্লাগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা।‌ প্রায় সন্ধ্যা নামবে নামবে, আজানের সময় হয়ে এসেছে। হাতে সময় ছিল তাই শুরু হল অ্যারেনা প্রস্তুতি। মাগরিব-এর আজান শেষ হতেই শুরু হল নাটক।

 

পর্দা, টাঙানো, ত্রিপল পাতা, দর্শকরা গোল করে বসে পড়েছেন, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে। সায়ন্তনের গান দিয়ে শুরু হলো, তারপর বাদল সরকারের ক-চ-ট-ত-প। দারুন আনন্দ পাচ্ছেন দর্শকরা। মাঝে মাঝে হাততালি দিয়ে উঠছেন। তারপরজ্বালাতনের অপেরা। প্রথম দিনের পরিক্রমা এখানেই শেষ। শুনলাম আজ থাকাও এখানেই।

 

কোটামনি ও মোল্লাগঞ্জে গ্রামবাসীদের মতামত:

 

  • দাঙ্গা করে সাধারণ মানুষেরই ক্ষতি বাড়ে।
  • ‘ভজগন্ত’ দারুন লেগেছে।
  • বর্ষাতি পরে বল খেলাটা খুব ভালো লেগেছে।

 

দর্শকদের সঙ্গে কথোপকথন করতে করতেই পৌঁছে গেলাম স্থানীয় উদ্যোক্তা কামরুল লস্করের বাড়িতে। বিরাট বড় একটা ঘর, তার মধ্যে আমাদের সবার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। উনার সঙ্গে আলাপ করে বুঝলাম অত্যন্ত মাটির মানুষ।

 

প্রথম দিনের অভিজ্ঞতায় একটা প্রশ্ন বারবার আমায় নাড়া দিচ্ছিল। আমরা পৌঁছানোর আগেই সমস্ত জায়গায় সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত এবং এত মানুষের সমাগম। কীভাবে? আলাপ-আলোচনা কথাবার্তার পরে বুঝলাম।

 

কোরাসের অন্যতম বন্ধু সংগঠন ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনি এবং অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন। ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনি, পুরো বরাক উপত্যকা জুড়ে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়ানোর পরিবেশ ছিল, তখন থেকেই এখানে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে চলেছেন। অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন আসামের চা বাগান ও সুপুরি চাষিদের সঙ্গে। তাঁরাই মূলত উদ্যোগ নিয়ে আগে থেকে নাটক করার ব্যবস্থা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছিলেন।

 

২৬/২/২০২৩। শেষ হলো প্রথম দিনের নাট্য পরিক্রমা: শিলচর থেকে কোটামনি, করিমগঞ্জ ১১০ কিমি। কোটামনি থেকে মোল্লাগঞ্জ ৪২ কিমি। প্রথম দিন পরিক্রমা: ১৫২ কিলোমিটার।

 

সকালে উঠেই অসাধারণ পোলাও খেয়ে রওনা করিমগঞ্জ বাজারের উদ্দেশ্যে।

 

একটি স্কুলের কাছে রাস্তার ধারে ছোট্ট জায়গা। স্কুলের কচিকাচারা গান, আবৃত্তি শোনালো। তারপর শুরু হলো আদাব। নাটক শেষে খানিক এগিয়ে আমরা পৌঁছালাম করিমগঞ্জ আম্বেদকর পার্ক। বাজারের মাঝখানে ছোট পার্ক, পাশেই আম্বেদকরের মূর্তি, শুরু হলো সমবেত গান দিয়ে, “কোন দিক সাথী কোন দিক বল কোন দিক বেছে নিবি তুই।”

 

শুরু হলো জ্বালাতনের অপেরা । নাটক শেষ হতে হতে পর্দার পেছনে গিয়ে জিনিসপত্র গোছাচ্ছি, শুরু হয়েছে আদাব । হঠাৎ করে দেখি দুই গাড়ি পুলিশ এসেছে। তাদের নানান জিজ্ঞাসা। নাটক করার পারমিশন আছে কিনা? আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? আপনাদের নাটকের বক্তব্য কি? মানে ঠিক যেমনটি আশা করা যায় প্রশাসনের থেকে। স্থানীয় উদ্যোক্তা বন্ধুরা বেশিরভাগই উকিল। তারাই ব্যাপারটা সামলে নেন।

 

দুপুর ঘনিয়ে এসেছে, প্রত্যেকেরই পেটে দারুন খিদে। গেলাম একটি হোটেলে। নতুন  খাবারের সঙ্গে পরিচিতি হল যার স্বাদ অদ্ভুত। এক ধরনের চাটনি, একটু গন্ধ হলেও খেতে দারুন। ইড়ম্বা/ইরম্বা মাছ শুকিয়ে/পচিয়ে তার সঙ্গে আলু টমেটো লঙ্কা আরো নানান কিছু ছিল, মূলত মনিপুরের বিশেষ চাটনি। সমস্ত খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যায়। খাওয়া-দাওয়া শেষ। প্রচণ্ড গরম, বাসে উঠে পড়া হলো বরথল বাজারের উদ্দেশ্যে।

 

রাস্তাটা অসাধারণ। রাস্তার দুদিকে দেখা যাচ্ছে সুপুরি জঙ্গল। সারি সারি সুপুরি গাছের চাষ। দূরে পাহাড়। কোরাসের বন্ধুরা বললেন, ওগুলো নাগাল্যান্ডের পাহাড়।

 

উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম বরথল বাজার। হাট বসেছে, নানান মানুষ নানান কিছু বিক্রি করছে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে।

 

বাস এসে দাঁড়াতেই, লোকজন জড়ো হয়ে গেল। আবার ত্রিপল পেতে লাইট লাগিয়ে শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান। সায়ন্তন ও এদিপের মন ভুলানো গান, সৃঞ্জিনীর কবিতা দর্শকদের শান্ত করল। তারপরজ্বালাতনের অপেরা আর আদাব

 

পাহাড়ের কোলে ছোট জায়গা। আমাদের খাবার ব্যবস্থা হয়েছে অন্য আরেক জায়গায়। আবার পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে দেখি এক দারুন দৃশ্য। পাহাড়ের মাঝে ফাঁকা জায়গায় লাইট লাগিয়ে ত্রিপল পেতে বিশাল খাবার আয়োজন। মাংস, ভাত। কোরাসের বন্ধু সংগঠনের সাথীরাই আয়োজক। খাওয়া-দাওয়ার পর বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে আমাদের আজকের রাত্রি যাপন লালাটাউনে। রাত হয়েছে অনেক। সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে। এরকম সময় কোরাসের সদস্য টুপুর একটি অসাধারণ র‍্যাপ গান চালিয়ে সবাইকে চাঙ্গা করে দিল – “আমরা কুন টাউনে থাকি?  আমরা লালাটাউনে থাকি!”

 

আজ সারাদিনের অভিজ্ঞতায় আমার আর সৌমির দুজনেরই মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা আর সরল নেই। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতার নানান পর্দা তৈরি হয়েছে।  তাই এই সময়ে সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে বেশি করে জুড়ে না থাকলে মানুষের নাটক, তৃতীয় ধারার নাটক টিকিয়ে রাখাটা একটু মুশকিল। এটা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু চোখের সামনে দেখছিলাম, বুঝছিলাম, অনুভব করছিলাম যে, শুধু নাটক নিয়ে গ্রামের অভ্যন্তরে প্রবেশ, হাটের মাঝখানে নাটক, স্কুল বাড়ির মাঠে রাত কাটানো এখন কঠিন। তাই পরিক্রমার জন্য সামাজিক আন্দোলনের কর্মী-সাথীদের সাথে আসার প্রয়োজন ছিল।

 

হলঘরে ঘুমোবার ব্যবস্থা। তখন কোরাসের সদস্য সঞ্জীব, ডাকনাম কালি, আমাকে ডাক দিল। দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে বিশ্বজিৎ কাকু আদাব করে এসেছেন, এই প্রথমবার সঞ্জীব এবং শুভজিৎ নাটকটা করছে। তাই মনে নানান জিজ্ঞাসা।

 

নাটকটা আরো ভালো কিভাবে করা যায়?

 

এই প্রশ্ন তার মধ্যে উপস্থিত হওয়ার কারণ, সে জানে, যে সে আরো বেশি দিতে পারে, কিন্তু পারছে না। বেশিদূর যেতে হবে না, গত ১০ বছর এবং বর্তমান সময়ের কথা যদি ভাবেন আপনি দেখবেন যে তৎকালীন আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এবং এখনকার পরিস্থিতির আকাশ পাতাল তফাৎ। মানুষের জীবন আরও বেশি জ্বালাময় হয়ে উঠেছে। কাজকর্ম, আকাশছোঁয়া দাম, সমস্ত সামাজিক জীবনযাপনের যুদ্ধ মিটিয়ে রিহার্সাল করার সময় হয়ে ওঠে না। অঙ্কুরদার থেকে শিখেছি, রিহার্সাল কতটা জরুরী, তার ফলও পেয়েছি।

 

ঠিক এইখানে আমি বিশ্বজিৎ কাকু আর স্নিগ্ধা কাকিমাকে ধন্যবাদ দিতে, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে চাই। কোরাসের দীর্ঘকালব্যাপী কর্মকান্ডের জন্য। বর্তমান দৈনন্দিন জীবনে সমস্ত ফর্মের ইলেকট্রনিক বিনোদনের দৌলতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ব্যক্তিবাদী ও স্লথ হয়ে পড়েছে। আমরা যারা নাটক করতে আসি, তারাও আলাদা নই। এই অবস্থায় কোরাসের অভিযানকে সংবর্ধনা জানাই। তাঁদের কাজ সহজ নয়। যেখানে ভাত জোগাড় হয় না, সেখানে কোরাস সবাইকে নাটকের জোরে একত্রিত করে। তীরের ফলার মত বাধা কাটিয়ে পৌঁছে যায় প্রত্যন্ত বরাক উপত্যকার গভীরে।

 

২৭/২/২০৩। শেষ হলো দ্বিতীয় দিনের বরাক উপত্যকা নাট্য পরিক্রমা। মোল্লাগঞ্জ থেকে করিমগঞ্জ বাজার হয়ে আম্বেদকর পার্ক ৫৫ কিলোমিটার। করিমগঞ্জ বাজার থেকে বরথল বাজার ২৭ কিলোমিটার। বরথল বাজার থেকে যাওয়া লালা, হাইলাকান্দি আজকের রাত্রি যাপন ৩৩ কিলোমিটার। দ্বিতীয় দিন নাট্য পরিক্রমা: মোট ১১৫ কিলোমিটার।

 

দ্বিতীয় দিনে নাটকের পর দর্শকদের অনুভূতি:

 

  • সবথেকে ভালো কি লেগেছে? “উদাস দুপুর বেলা সখি আসবে কি একেলা…”
  • ওই লুঙ্গি পরা মাঝি ভাইয়ের গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে নাই। উর গলাতে ব্যাঙ ঢুকেসে।

 

এক চাচা বললেন: তোমরা কুন পার্টির?

 

অন্য একজন: তোমরা যে বললে তোমরা দুজনে নাটক করছো ।কিন্তু আমরা তো দেখলাম যে, ওই দিদিটা ভেতরে ঢুকলে আরেকজন আসছে ঐ দিদিটার মতই দেখতে। পর্দার পিছনে কি আরেকজন লুকিয়ে থাকে?

 

সকাল হলেই শুরু হবে তৃতীয় দিনের নাট্য গ্রাম পরিক্রমা। ব্যাগ বোঁচকা গুছিয়ে আবার বাসে উঠে পড়া। আজ তৃতীয় অর্থাৎ শেষ দিনের বরাক উপত্যকা নাট্য পরিক্রমা। শুরু হল বাসের মধ্যেই আমাদের নাচ গান দিয়ে। বাস এগিয়ে চলেছে, গন্তব্য হাইলাকান্দি হয়ে কারিছড়া। আমার আর সৌমির একটু বাড়তি আনন্দ হচ্ছিল, কারণ আজ আমাদের ৫০তম শো উপস্থাপিত হবে।

 

কারিছড়া বাজার, প্রচন্ড রোদ। লোকজন একটু কমই, কিন্তু কোরাসের সম্মিলিত গণসংগীত, এদিপের গান, সৃঞ্জিনীর কবিতার পর মানুষের ভিড় বাড়তে থাকলো। উপস্থাপিত হলো আদাব

 

সবার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ওখানেই হয়েছে। পোলাও গরম গরম। বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধলেশ্বরী নদী। বরাক নদী থেকে বেরিয়ে এই নদী এগিয়ে গেছে মিজোরামের দিকে। মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডের পাহাড় দেখা যাচ্ছে।

 

এবার গন্তব্য টেমপুর। সূর্য মাথার ওপর, বেশ ভালই গরম। সারিসারি সুপুরির বন, উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে বাস দাঁড়ালো রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট মাঝারি উঁচু টিলার উপরে। সেখানেই নাটক হবে।

 

গান দিয়ে শুরু হল অনুষ্ঠান। তারপর বক্তব্য রাখলেন শ্রমিক কৃষক সংগঠনের অন্যতম কর্মী এবং আয়োজক পারভেজ লস্কর। নাটক হলো শিলচর কোরাসের উপস্থাপনায় ওরে বিহঙ্গ। তারপরেই আমরা, ভুল রাস্তা নিয়ে।

 

নাটকের আগে, নাটক চলাকালীন এবং নাটকের পরেও দেখছিলাম, মহিলারা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। বারবার ডাকা সত্ত্বেও সামনে এগিয়ে আসছেন না। দর্শক ও পারফর্মার দু’জনেরই অস্বস্তি বাড়ে। নিজেকে আবারও নিজের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। আরও অনেক কাজ করতে হবে।

 

প্রচন্ড গরম, খিদেও পেয়েছে প্রবল । কারোরই আর শরীর দিচ্ছিল না। এমন সময় দেখলাম ঠান্ডা পানীয়, মুড়ি, চানাচু্র,‌ কেক ইত্যাদি এসে পৌঁছলো আমাদের কাছে। কাছেই একটা বহু পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি ছিল। পেটে অল্প দানা পড়তে চাঙ্গা হয়ে পুরোনো বাড়ির সামনে গিয়ে ছবি তোলার উৎসাহে মাতলাম।

 

নাটকের সমস্ত জিনিস গুছিয়ে বাসে উঠে এগিয়ে গেলাম নারায়ণপুর, হাইলাকান্দি। ওখানেই আজ সন্ধ্যেয় নাট্য পরিক্রমার শেষ উপস্থাপনা।

 

দারুণ আয়োজন করেছে কোরাসের বন্ধুরা। একটা চাঁদোয়া উপরে ঝোলানো, চারিদিকে চেয়ারপাতা, লাইট লাগানো। গরম গরম ভাত আর ডিমের ঝোল। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে কিন্তু খিদে চরমে, প্রত্যেকেই বেশ আয়েশ করে খেয়ে নিলাম। খানিকক্ষণ রেস্ট।

 

জ্বালাতনের অপেরা-তে একটা পান ব্যবহার হয়, প্রপ হিসেবে। প্রত্যেকটা শোয়ের আগেই পানের দোকান খুঁজতে হয় আমাদের। খানিক এগিয়ে উল্টোদিকে একটা দোকানে পান কিনতে গিয়ে দেখলাম, রাস্তার ওপরে বিরাট বড় একটা হোর্ডিং – বিমল গুটখা।

 

বিজ্ঞাপনে তিন সুপারস্টার অক্ষয় কুমার, শাহরুখ খান ও অজয় দেবগন বসে আছেন। কি অদ্ভুত লাগছিল ওই মুহূর্তটা। এই পুরো বরাক উপত্যকা পরিক্রমাতে দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি, তাঁরা মূলত চাষি ও খেতমজুর। প্রধানত সুপুরি চাষ ও চা বাগান – এটাই উপার্জন ক্ষেত্র। চোখের সামনে দগদগ করছে ভারতবর্ষের খোকলা অভ্যন্তর।

 

“বলো জুবান কেশরী” অক্ষয় কুমার, শাহরুখ খান, অজয় দেবগন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, আর সারা ভারতবর্ষের মূল সুপুরি উৎপাদনকারী চাষিরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। চিত্রটা সর্বত্র এক। সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ, বঞ্চনা, নিপীড়নের নেই কোন শেষ।

 

তাড়াতাড়ি তৈরি হলাম জ্বালাতনের অপেরা-র পঞ্চাশতম শো করতে। কোরাসের সদস্যরাও তৈরি আদাব নিয়ে। পর পর দুটো নাটক। মাঠ ভর্তি লোক। হাততালি। মানুষ এসে কথা বলে যাচ্ছেন, হাত মিলিয়ে যাচ্ছেন। কোরাস ও দিলখুশ আনন্দে মাতোয়ারা। বাসে ওঠা হল। ঠিক হলো শিলচর ঢোকার আগে একটি বিখ্যাত মাড়ওয়ারি ধাবা আছে সেখানে চা, মিষ্টি ইত্যাদি খাওয়া হবে।

 

দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে আস্তে আস্তে আমরা ফিরে চললাম শিলচরের দিকে। মনটা ভারি হয়ে আসছিল, কারণ সৌমির সামনে একটি বিশেষ পরীক্ষা আছে, আমাদের পরদিনই বেরিয়ে যেতে হবে। আরো একটা দিন একসঙ্গে থাকতে পারলে ভালো হতো।

 

২৮/২/২০২৩। শেষ হলো তৃতীয় দিনের নাট্য পরিক্রমা এবং তৎসহ শেষ হলো বরাক উপত্যকা নাট্য পরিক্রমা। লালা, হাইলাকান্দি থেকে কারিছড়া ৩৫ কিলোমিটার, কারিছড়া থেকে টেমপুর ৩৫ কিলোমিটার, টেমপুর থেকে নারায়ণপুর, হাইলাকান্দি ১৪ কিলোমিটার, নারায়ণপুর, হাইলাকান্দি থেকে শিলচর ফেরা ৪৫ কিলোমিটার। তৃতীয় দিনের নাট্য পরিক্রমা মোট ১২৯ কিলোমিটার।

 

মানুষের মতামত:

 

  • সিলেটি ভাষায় নাটক নাই আপনাদের?
  • কোন পার্টি?
  • নাটকগুলো দারুন লেগেছে, এরকম তো অনেকদিন দেখতে পাই না। একটু আগে থেকে প্রচার করে রাখলে আরো বেশি লোক দেখতে পেত। তবে আমরা খুবই আনন্দ পেয়েছি।
  • গানের সময় মাইকটা বাজছে, নাটকের সময় বাজলে তো দূরের লোক গুলো শুনতে পায়। সবাই তো ভিড়ের মাঝে ঢুকে নাটকটা দেখতে পাচ্ছে না।

 

শিলচর শহরের বহু ইতিহাস রয়েছে, সবাই জানেন। সেখানে নাট্যপ্রেমী, নাট্যদরদী মানুষরা আছেন। শহরের অনুষ্ঠানে মানুষের সমাগম অনুমান করা যায়, কিন্তু পরিক্রমাতে মানুষের জোয়ার হিংসে করার মতো। উদ্যোক্তা বা যাঁদের যোগাযোগে যাওয়া হয়েছে, তাঁরা রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কর্মী। তাঁদের সাথীরা অবশ্যই সঙ্গে ছিলেন, কিন্তু যেসব জায়গায় যাওয়া হলো, সেখানকার সাথে তাঁদের বাস্তব যোগাযোগ কতটা, তা একবার হলেও ভাবায়। বরাক উপত্যকা জুড়ে বেশিরভাগ দর্শকই ছিলেন মূলত খেতমজুর। সুপুরি এবং চা বাগানের। দিনের বেলা তাঁদের প্রত্যাশা করাটা নিরর্থক। কিন্তু যখন এদিপ ইমন লালন ফকিরের গান গেয়ে উঠেন, “যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে/ এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে,” তখন দেখি, মানুষের ভিড় এগিয়ে আছে।

 

চা বাগানের কর্মীরা ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন না, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া, স্কুলশিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, কাজ নেই। ভারতবর্ষের রাজার বদল ঘটলেও সবকা সাথ সবকা বিকাশ ডুমুরের ফুল। সাধারণ মানুষ জর্জরিত। তবু তখন কোরাসের বিশ্বজিৎ কাকু গেয়ে ওঠেন, “কোন দিক বল সাথী কোন দিক, কোন দিক বেছে নিবি তুই?” তখন ভিড় এগিয়ে আছে। মানুষ একত্ববোধ করেছেন, এগিয়ে এসেছেন, নাটক দেখেছেন, অংশগ্রহণ করেছেন। গোটা পরিক্রমা জুড়ে মানুষের জোয়ার এসেছে।

 

অন্যদিকে আবার সমস্ত জায়গাতেই মহিলা দর্শক ভীষণ কম। দূর থেকে দেখেছেন, যেখান থেকে শোনা মাত্র সম্ভব, অথবা ফোনে রেকর্ড করা ভিডিও দেখেছেন। রাতের বেলা তাঁদের বাড়িতে যখন থাকতে গেছি, এত ছেলেমেয়েকে একসঙ্গে দেখে, আর নিজেদের আটকে রাখতে না পেরে বলেছেন, “আমরা তো যেতে পারিনি, আমাদের একটা গান শোনাবেন সবাই মিলে?” হ্যাঁ, আমরা গান গেয়েছি। অনেকক্ষণ ধরে গানের আড্ডা চলেছে। তাঁরা আনন্দও পেয়েছেন। এখানে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। কাজ এখনো অনেক বাকি। আমাদের আরও আরও অনেক কাজ করতে হবে সম্মিলিত ভাবে। সমাজে দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া সমস্যার শেষ নেই। সেগুলোই উপাদান।

 

ভীষণ দরকারি এজাতীয় নাটকের উপস্থাপনা। জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া প্রতারণাকে নাটকে দেখলে হয়তো মানুষ প্রতিবাদের সাহস পাবেন। নিজেকে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও সতর্ক করার কথা ভাববেন।

 

বছরে একটা নাট্য পরিক্রমা প্রত্যেককেই ডিসিপ্লিন্ড হতে শেখায়। আমি থেকে আমরায় রূপান্তরিত হতে শেখায়। ভারতবর্ষকে জানাবোঝা তখনই আরও ভালোভাবে সম্ভব, যখন বহু মানুষের সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করা যাবে, সবকিছু ছাড়তে ছাড়তে গিয়ে মাটির কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব হবে। ঘটবে মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্মবোধ মিলন‌। সেখান থেকে শুরু হবে নতুন বোধ, নতুন চিন্তা, নতুন রাস্তা।

 

দিলখুশ দলে আছেন সব্যসাচী ও সৌমি – পশ্চিমবঙ্গ নিবাসী নাট্যকর্মী।

 

Share this
Leave a Comment