উত্তর থেকে দক্ষিণ: বাংলার ধর্মীয় সংস্কৃতি কি হিন্দিবলয়মুখী?


  • April 18, 2024
  • (2 Comments)
  • 794 Views

কাল আরও একটি ভোট। পরের বছর আরও একটা রামনবমীর জন্য অপেক্ষা। আরও ভয়ংকর কিছু প্রত্যক্ষ করার দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া। লিখলেন অনিমেষ দত্ত

 

ঘড়িতে তখন দুপুর সাড়ে বারোটা। মাথার উপর প্রকট সূর্যের তেজ। কোর্ট মোড় থেকে দু’পা হেঁটে এগোলেই শিলিগুড়ির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভেনাস মোড়। এই মোড়ের একটি কাগুজে নাম আছে, সফদর হাসমি চক। সেই হাসমি চকজুড়ে লাগানো রয়েছে বড় বড় গেরুয়া ঝান্ডা। ভেনাস হোটেলের সামনেই একটি স্টেজ, সেটাও গেরুয়া। সফদর হাসমি স্বয়ং হয়ত ওই রাস্তায় এসে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন না। চারিদিকে তখন হুংকার চলছে — জয় শ্রী রাম। একে একে শোভাযাত্রা আসছে, তারস্বরে বাজছে বক্স।

 

হাসমি চক পেরিয়ে হিলকার্ট রোডে উঠে রাস্তার বাঁদিক দিয়ে হাঁটতে শুরু করে হঠাৎ মনে পড়ে গেল কয়েকবছর আগে সিপিএমের একটি ভোট প্রচার —  ‘বামপথে হাঁটুন।’ শিলিগুড়ি বিধানসভায় বামে ফুটকি যুক্ত হয়ে রাম হয়েছে বছর তিনেক হতে চলল। এই প্রথম শহর শিলিগুড়িতে রামনবমীর জৌলুস প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হল।

 

হিলকার্ট রোডে আবার পরে আসব। আপাতত ফিরে আসি পুরনো শহর শিলিগুড়িতে। টাউন স্টেশন। এই স্টেশন দিয়ে কালেভদ্রে একটা দুটো ট্রেন যাতায়াত করে এখন। স্টেশন চত্বর খাঁ খাঁ করে। পরিত্যক্তও বলা যায়। এর একপাশে বস্তি, হোলসেল মার্কেট। অন্য পাশে রেল কলোনি। অবাঙালি অধ্যুষিত। রেল কলোনির পাশে রেলগেট পার করে এগোলেই কয়েকঘর মুসলিম পরিবারের বাস। পেশায় দিনমজুর, কারুর ছোট গুমটি। তাঁরা আজ দরজায় খিল এঁটেছিলেন। রেলগেট পেরিয়ে গেরুয়াসজ্জিত ছোটাহাতি, অযোধ্যার রামলালার মূর্তির ছবি, অনেকের হাতে লাঠিসোটা, ১৫-২০ বছর বয়সীদের হাতে তরোয়াল, তরুণীরাও শাড়ি পরে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বেধেছে। তারস্বরে বাজছে ‘ভারত কো হিন্দুরাষ্ট্র বানায়েঙ্গে’। যাই হোক। আবার টাউন স্টেশনে ফিরি।

 

এই টাউন স্টেশনের দুপাশে রামনবমীতে প্রত্যেক পাড়া থেকে বেরোচ্ছে শোভাযাত্রা। রবীন্দ্রনাথ যখন অসুস্থ, এই স্টেশন থেকেই তিনি ট্রেনে চেপে কলকাতায় ফিরেছিলেন। সেদিন রাতে স্টেশনের দুপাশের বাসিন্দারা তো বটেই, এমনকি শহর শিলিগুড়ির বাসিন্দারা বিদায় জানাতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। তিনি আজ নেই। স্টেশনের সেই ইতিহাসও বিস্মৃত। হোলসেল মার্কেটের সামনে একটা শোভাযাত্রার প্রস্তুতি চলছে। নানা সাইজের গেরুয়া ঝান্ডা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কানে এল ভগত সিংয়ের নাম। ভগত সিং শুনে খানিক চমকে উঠেছিলাম। তারপর ভালো করে শুনে বুঝলাম, বক্সে বাজছে —  “ভারতকো আজাদ করানে ওয়ালে শিবাজী, লক্ষ্মী বাই, সাভারকর, ভগত সিং…।”

 

গতবছর রামনবমীর দিনটা হাওড়ায় কেটেছিল। হাওড়ার শিবপুর। সে এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা। অথচ এবছর শিলিগুড়ির সঙ্গে গতবছরের হাওড়ার অভিজ্ঞতা হুবহু মিলে গেল। বরং এবছর রামনবমীর ‘তেজ’ আরও বেশি। রামমন্দির প্রতিষ্ঠা, ভোট। হাওড়ায় রামরাজাতলায় অবশ্য অন্যরকম রামনবমী উদযাপন দেখেছি। সেখানকার রামমন্দিরে রামনবমীর দিন থেকে পুজো শুরু হয়। প্রায় চার মাস গোটা রামরাজাতলাজুড়ে মেলা বসে। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার ধুমধাম করে রাম শোভাযাত্রা বের করা হয়। এই রামমন্দিরের একটা বিশেষত্ব আছে। এখানে রাম একা পুজিত হন না, তাঁর সঙ্গে রয়েছে অনেকগুলি মূর্তি। রাম এবং সীতার মূর্তিটি সবচেয়ে বড়। এমনকি রামের গাত্রবর্ণ সবুজ, পেটের দিকে তাকালে দেখা যাবে ছোটখাটো একটা ভুড়ি। রামসীতার চারিপাশে রয়েছে লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, ব্রহ্মা, শিব এমনকি বিভীষণের মূর্তিও। ওই মন্দিরের ভিতরে রয়েছে হনুমান মন্দির, ‘অ্যাংরি হনুমান’ নয়, ভক্ত হনুমান। এই জনপদটির নামও এসেছে এই মন্দির থেকেই। প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো এই রাম পুজো সম্পর্কে কথিত আছে, এখানকার তৎকালীন জমিদার অযোধ্যারাম চৌধুরী স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন রামকে রাজা বেশে পুজো করার। সেই প্রথা আজও চলে আসছে। রামরাজাতলার রাম আসলে বাঙালির রাম।

 

প্রত্যেকবছর শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার রামচরণ শেঠ লেন দিয়ে শোভাযাত্রা বের হয়। সে শোভাযাত্রা চরিত্রগত ভাবে রাজ্যের অন্যান্য শোভাযাত্রা থেকে অনেক আলাদা। ৮ থেকে ৮০, শিশু কোলে মহিলা, আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই অংশ নেন। রাস্তার দুধারে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। কাঠামো সমেত প্রত্যেকটি মূর্তি পরপর নিয়ে যাওয়া হয় গঙ্গার উদ্দেশ্যে। অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ির কাছে সাত্রাগাছি মোড়ে প্রথমে দাঁড় করানো হয়। এরপর নতুন রাস্তা হয়ে নেতাজি সুভাষ রোড ধরে শোভাযাত্রা এগিয়ে চলে। গতবছর দেখলাম পুরো শোভাযাত্রার রাস্তাজুড়ে তৃণমূল ও বিজেপির তরফে পাল্লা দিয়ে জলছত্র খোলা হয়েছে। হাঁটতে গিয়ে কানে আসছিল, এগুলো বছর তিন-চারেক হল শুরু হয়েছে, আগে এমনটা ছিল না। তবুও সেই শোভাযাট্রে কোনও পেশিশক্তির আস্ফালন ছিল না। ছিল শুধুই ভক্তি।

 

সম্ভবত ২০২০ সালে ওই রামমন্দির নতুন করে নির্মাণ করা হয়। তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক জটু লাহিড়ী একপ্রকার জোর করেই ওই মন্দিরের ভিতর মূল মূর্তিগুলি যেখানে থাকে, তার ঠিক উল্টোদিকে আরও একটি রামমন্দির তৈরি করান। সেখানে একটিতে রাম, একটিতে সীতা। মূর্তির ধরণ উত্তরভারতীয়। এলাকায় এনিয়ে ক্ষোভও ছিল। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে জটু লাহিড়ী বিজেপিতে যোগ দিয়ে ভোটে হারেন। বিজেপি একাধিকবার রামরাজাতলার রামকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছে। এখনও অবধি পারেনি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে পারবে।

 

যাই হোক, আবার হিলকার্ট রোডে ফিরি। এই রাস্তা দিয়ে অনেকটা হেঁটে খানিকটা অলিগলি দিয়ে গিয়ে ঘুরে এসে পড়লাম এয়ারভিউ মোড়ে। এখানে রামনবমীর তেজ যেন একটু বেশিই। ভক্তদের নাচের ধরণ, চোখে মুখে উগ্রতা হঠাৎ বেড়ে গেছে, তরোয়াল উঁচিয়ে স্লোগান চলছে —  ‘ভারত মে রেহনা হোগা, তো জ্যায়শ্রীরাম কেহনা হোগা…”। তারপর এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখি একটা মসজিদ। মুসলিম মহল্লা। গোটা শিলিগুড়ি শহর জুড়ে একটিও বাংলা গান বাজেনি, সব হিন্দি।

 

এই একই ছবি দেখেছিলাম গতবছর হাওড়ায়। রামনবমীর দিন। শোভাযাত্রা কাজিপাড়া মোড়ে এসে অভনী মলের দিকে ঘুরে যাওয়ার কথা থাকলেও তা হঠাৎই বাঁক নেয় জিটি রোডের দিকে। শিবপুর বাসস্ট্যান্ড হয়ে মোটামুটি হাওড়া ময়দান অবধি ওই এলাকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। রয়েছে মসজিদও। আর সেখানেই ঘটল অঘটন। তুমুল উত্তেজনা। গাড়ি, বাইক, সাইকেল পুড়ল। অঞ্জনী পুত্র সেনা নামক একটি সংগঠন ওই এলাকায় বেশ মজবুত। তারা তরোয়াল উঁচিয়ে হুংকার ছাড়ল। পরেরদিন সকালে গিয়ে দেখি পুরো এলাকা থমথমে। শিবপুর থানার বাইরে দু’তিনটে গাড়ি ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। ওগুলো নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা চলছে। এলাকার দু’জন আলতো করে হেসে উঠে বললেন, ‘ওগুলো ছয় মাস ধরে ওখানেই দাঁড় করানো থাকে।’ তারপর মূলধারার সংবাদমাধ্যমের কয়েকজন প্রতিনিধি সেই ভাঙা গাড়িগুলির ছবি তুলে চলে গেলেন। সেবারেও হাওড়ার ওই শোভাযাত্রা গুলোতে কোন বাংলা গান কানে আসেনি, সব হিন্দি।

রামরাজাতলার রামমন্দির

এবছর রামনবমীর ‘ক্রেজ’ একটু বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। বিজেপির তরফে সবরকম কসরত করা হয় রাম হাওয়া তুলতে। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারে প্রথম দফায় ১৯ এপ্রিল ভোট। শিলিগুড়িতে দ্বিতীয় দফায় ২৬ এপ্রিল ভোট। তার আগে এমন রাম ঝড় তুলতে পারলে যে বিজেপির পালেই হাওয়া বইবে, তা নেতারা বিলক্ষণ জানেন। তাই সব জায়গায় আদর্শ আচরণবিধির ফাঁক খুঁজে রাজু বিস্তের জোড় হাত ছবি দিয়ে রামনবমীর শুভেচ্ছা জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে বিজেপি। অন্যদিকে বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে তৃণমূলও রামনবমী উদযাপন করেছে। মমতা বন্দোপাধ্যায় এবারই প্রথম রামনবমীতে সরকারি ছুটি দিয়েছেন। যদিও সরকারি চাকুরিজীবীরা কমই ছিলেন শোভাযাত্রায়। কাজ থেকে ছুটি নিয়ে কিংবা কামাই করে, দোকান বন্ধ রেখে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, বস্তিবাসী তরুণদের ভিড় ছিল সর্বত্র। সমস্ত জায়গায় ঘাসফুল প্রার্থীরা রাম বন্দনায় মেতেছিলেন। এবারে যদি গোটা চারেক আসন বেশিও আসে, ভবিষ্যতে বাংলাকে কোনদিকে ঠেলে দিচ্ছি, তা ভাবার বালাই নেই তৃণমূলের। তাদের কাটমানি পেলেই হল।

 

উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় রামনবমী শোভাযাত্রা শিলিগুড়িতে নয়, বের হয় ইসলামপুর ও নকশালবাড়িতে। শুনলাম ইসলামপুরে এবার প্রায় ৬০,০০০ মানুষ শোভাযাত্রায় ছিলেন। অন্যদিকে নকশালবাড়িতে প্রায় ৫০,০০০ মানুষের জমায়েত হয়েছিল। কানু সান্যালের বাড়ি হাতিঘিষায় বিজেপি পঞ্চায়েত ভোট, বিধানসভা ভোট, এমনকি গতবারের লোকসভা ভোটেও লিড পেয়েছে। নকশালবাড়ি-মাটিগাড়া কেন্দ্রের বিধায়ক বিজেপির আনন্দময় বর্মন। তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত দক্ষিণ দিনাজপুরের খাঁপুরেও রামনবমীর শোভাযাত্রা ছিল বেশ জাঁকজমক। বাদ যায়নি মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুরও।

 

২০১৭ সালে কলকাতার সেন্ট্রাল এভিনিউতে যে রামমন্দির আছে, সেখানকার লাইব্রেরিয়ান শ্রীরাম তিওয়ারি দ্য টেলিগ্রাফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “Traditionally Ram Navami is known for the reading of Ramcharitmanas over nine days… This is the first time in Calcutta I am seeing a procession with people in red and gerua, wielding swords, shouting and on motorbikes. The feeling of bhakti was missing…. It was so different…. It was not something we are used to.”

 

বাংলার রাজনীতি এই দশকে যত তাড়াতাড়ি বদলে গিয়েছে, তার তুলনায় অনেক দ্রুতগতিতে বদলাচ্ছে বা বদলে দেওয়া হচ্ছে বাংলার সংস্কৃতির ভূ-মানচিত্র। রিষড়া কিংবা রঘুনাথপুর, নৈহাটি কিংবা নিমতি, হাওড়া কিংবা হাতিঘিষা, শিলিগুড়ি কিংবা শিয়ালদহ, ব্যারাকপুর কিংবা বারুইপুর, আসানসোল কিংবা আরিয়াদহ, নকশালবাড়ি কিংবা নদিয়া উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সর্বত্র ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক ভাবে হেরে যাওয়ার ছবি। হিংস্র চোখ, উগ্র শারীরিক ভঙ্গি, গ্রাস করে নেওয়ার উদগ্র বাসনা। রবীন্দ্রনাথ শুধুই ‘ঠাকুরের’ ছবি, সফদর হাসমি সাইনবোর্ড, ভগত সিং যেন হয়ে গেছেন সাভারকরের বন্ধু! রামরাজাতলার রাম নয়, হিন্দি বলয়ের রাম।

 

কাল আরও একটি ভোট। পরের বছর আরও একটা রামনবমীর জন্য অপেক্ষা। আরও ভয়ংকর কিছু প্রত্যক্ষ করার দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া।

 

Share this
Recent Comments
2
Leave a Comment