এ ভারতে বিগত ১০ বছরে শুধু সংসদ প্রধান রাজনীতি-অর্থনীতি, কর্পোরেট প্রধান সমাজ-সংস্কৃতি মানেই দুর্নীতি। এবং পুরো ব্যবস্থাটাই, একে অন্যের সঙ্গে জাপটে-জুপটে, লেপ্টে-লুপ্টে, নোংরা কাদা মাখামাখি এমনই “শুয়োরের খোঁয়ার” হয়ে আছে যে, সে বিষয়ে “চোরের মায়ের বড় গলা” শুনতে যাওয়া, অংশগ্রহণ করা, উপস্থিত থাকা, হাত তুলে হলেও “বাংলার দুর্নীতিতে ঘোর বিচলিত” হওয়া আসলে এই দুর্নীতির রাজনীতিকে সমর্থন করা। এই রাজনীতিকদের মদত জোগানো। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
প্রতিবেদক লিখছেন, “দেখা গেল, হাত তুলে ভোটে সভার মতের বিরোধীরাই পরাজিত। মালুম হল, দর্শকেরাও বাংলার দুর্নীতিতে বিচলিত।” কী সভা, কেন সভা?
দেশ পত্রিকা আয়োজিত ‘দেশ বিতর্ক সভা’। সভার বিষয়, ‘বাংলার রাজনীতি মানেই দুর্নীতি।’ তবে কি নির্বাচনমুখী রাজ্যে ‘দুর্নীতি’ এবার একটি প্রধান বিষয় কিংবা রাজনৈতিক ‘ইস্যু’ হয়ে উঠছে? তাই কি ‘দেশ’ মানে ‘দেশ’-এর সরকাররা এমন একটা রাজনীতিভোগ্য জ্বলন্ত বিষয়কে বিতর্ক সভার আলোচ্য বিষয় করেছেন? কারা এই বিতর্ক সভার শ্রোতা? কারাই-বা বক্তা? দেখা যাবে, আমন্ত্রিতদের মধ্যে রয়েছেন, লেখক, পাঠক বা আরও যাঁরা বুদ্ধিজীবী, মেধাজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার এবং বিশিষ্টজনেরা, মানে এক কথায় বাংলার মধ্যবিত্ত ‘সুশীল’ বা নাগরিক সমাজ।
আর যাঁরা, বাংলার রাজনীতি ও দুর্নীতি বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে, তর্কে-বিতর্কে, আলোচনায়-সমালোচনায় শ্রোতাদের সমৃদ্ধ করবেন বলে আমন্ত্রিত বক্তা, তাঁরা প্রায় সকলেই এই দুর্নীতিগ্রস্ত সংসদীয় রাজনীতির মানুষ। কেউ কেউ দুর্নীতির নাটের গুরু। আবার এঁরা নির্দিষ্টভাবে সেই মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত নাগরিক সমাজের মুখোমুখি হলেন, যাঁদের এক বড় অংশই এই দলগুলির মানে এই দুর্নীতিগ্রস্তদের নীরব ও সরব সমর্থক। বলা ভাল, এঁরাই সাধারণভাবে নয়ের দশকের পর পরবর্তী খোলা বাজার অর্থনীতি বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে বিশেষভাবে বিগত ১০ বছরের স্যাঙাৎ অর্থনীতির সুফলভোগকারীর উচ্চকোটির অংশটুকুর হরির লুঠের প্রসাদ ভোগ করে চলেছেন।
সত্যি কথা বলতে গেলে কী, এ ভারতে বিগত ১০ বছরে শুধু সংসদ প্রধান রাজনীতি-অর্থনীতি নয়, কর্পোরেট প্রধান সমাজ-সংস্কৃতি মানেই দুর্নীতি। এবং পুরো ব্যবস্থাটাই, একে অন্যের সঙ্গে জাপটে-জুপটে, লেপ্টে-লুপ্টে, নোংরা কাদা মাখামাখি এমনই “শুয়োরের খোঁয়ার” হয়ে আছে যে, সে বিষয়ে “চোরের মায়ের বড় গলা” শুনতে যাওয়া, অংশগ্রহণ করা, উপস্থিত থাকা, হাত তুলে হলেও “বাংলার দুর্নীতিতে ঘোর বিচলিত” হওয়া আসলে এই দুর্নীতির রাজনীতিকে সমর্থন করা। এই রাজনীতিকদের মদত জোগানো। সুনীতির রাজনীতির থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা। এমন স্বৈরাচারী, সংসদীয় একনায়কতন্ত্রের এমন বিভৎসতা যে আগে কখনও দেখা যায়নি।
সভায় সিপিএমপক্ষীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়, রাজ্যে তৃণস্তরে দুর্নীতির নিবিড় আবাদে যাঁরা কৃষকরত্নের মতোই ‘দুর্নীতিরত্ন’ শিরোপার অধিকারী হতে পারেন সেই তৃণমূল কংগ্রেসেরও ছিল সরব উপস্থিতি। বরঞ্চ, দুর্নীতির ‘বিশ্বগুরু’ প্রতিনিধিত্ব ছিল বড় দুর্বল (একদম শেষে ছবি দেখুন)।
এখন কথা হল, জলে নামব চুল ভেজাব না, একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করব, অথচ দুর্নীতির পাঁক-কাদা গায়ে মাখব না এমনটা হয় না। মাত্রার রকমফের হতে পারে কিন্তু ওই একাধিপত্যের রাজনীতিতে এ রাজ্যের সরকারি বামপন্থীরাও দুষ্ট। আজ যে যে দুর্নীতি বিষয়ে কথা হচ্ছে— সেই পঞ্চায়েত থেকে শিক্ষা— সবক্ষেত্রেই এই বামপন্থীরাও কলঙ্কিত। তফাত শুধু মাত্রার। এবং তা তৃণমূলের সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাত হলেও। এই তফাত তখনই বলার মতো তফাত গড়ে তোলে যখন, নিজেদের অপরাধ স্বীকার করা যায় এবং সর্বস্তরে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের এক প্রধান মুখ হয়ে উঠতে পারা যায়। বাংলার বামফ্রন্ট বা সিপিএম সে ক্ষেত্রেও চরম ব্যর্থ। রাজ্যটা অনুব্রত মণ্ডল, শাহজাহানের হাতে চলে যাওয়ার জন্য বিরোধীদেরও দায় রয়েছে।
শেষের কথা এই যে, “বাংলার রাজনীতি মানেই দুর্নীতি’ র বিতর্ক সভায় বিতর্ক কোথায়? এতো সূচ ও চালুনির পারস্পরিক বাদ-বিবাদ। জল ঘোলা করা এবং মাছধরা। বাংলার কেন ভারতের রাজনীতি মানেই দুর্নীতি নয়। আজ লাদাখের সোনম ওয়াংচুকের দিকে তাকান যাক, বিধ্বংসী ‘বিশ্বগুরু’ রাজনীতির বিরুদ্ধে এক প্রতিস্পর্ধার রাজনীতি। উত্তরাখণ্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ ও নদী বাঁচাও আন্দোলনের দিকে তাকান যাক; তাকান যাক এ রাজ্যের ডুয়ার্স, অযোধ্যা পাহাড়, ওড়িশার নিয়মগিরি, মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলি, ছত্তীশগঢ়ের হসদেওর প্রাণপ্রকৃতি বাঁচানোর লড়াইয়ের দিকে; বাংলা তো বটেই সারা দেশজুড়ে মিড-ডে মিল কর্মী, একশো দিনের কাজ, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের আন্দোলন, যা শুধু নিজেদের আত্মমর্যাদার নয়, শিশু ও মায়েদের পুষ্টি ও শিশুশিক্ষার অধিকারের লড়াই— এ সবই তো রাজ্য ও কেন্দ্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুনীতির রাজনীতি। আর সর্বোপরী ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন। স্যাঙাৎ অর্থনীতি ও সর্বগ্রাসী ক্ষমতার দুর্নীতির বিরুদ্ধে এত বড় চলমান আন্দোলনকে উপেক্ষা করা যাই-বা কীভাবে? এ কথা মেনেই বলা যাক, এ রাজ্যে সিপিএমের কৃষক সভা কুটোটি না-নাড়লেও, এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি সেই কৃষক সভাই। আর এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলন? সে কথাও বলতে হবে। এই আন্দোলনের জেরে কী মূল্য দিতে হয়েছে, এখনও দিতে হচ্ছে উত্তরপূর্ব দিল্লির মুসলমানদের, উত্তরপ্রদেশে— সে কথাও তো বলতে হবে। এ রাজ্যেও সে আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ নিয়েছিল।
এই আন্দোলনগুলিই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের, গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রাণভোমরা। “বাংলার রাজনীতি মানেই দুর্নীতি” নয়। বাংলার “সংসদীয়” রাজনীতি মানেই দুর্নীতি। সেতো ভারতের ক্ষেত্রেও এক।