১৯৭৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় নারীর প্রতি সব ধরণের বৈষম্য দূরীকরণ বিষয়ক সনদ বা কনভেনশন – United Nations Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women বা সংক্ষেপে সিডও (CEDAW)। ভারত সহ ১৫০টির বেশি দেশ এই সনদে স্বাক্ষর করে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বিশেষত ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও এই বৈষম্য দূরীকরণ কতটা সম্ভব হয়েছে সেই বিষয়ে কথা বললেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক তথা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান অফ উইমেন স্টাডিজ-এর সভাপতি ঈশিতা মুখোপাধ্যায় এবং দেশের প্রতিবন্ধী আন্দোলন ও নারী আন্দোলনের বরিষ্ঠ কর্মী শম্পা সেনগুপ্ত।
Groundxero | সৃজনী দাশমুন্সীর প্রতিবেদন
২৭ মার্চ, ২০২৪
বিশ্ব জুড়ে নারীর অধিকার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকল নাগরিককে সজাগ করে তুলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র প্রস্তুতের প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালকে ‘বিশ্ব নারী বর্ষ’ হিসাবে চিহ্নিত করে। এরপরেই নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য আরও কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা যেন আরও বেশি অনুভূত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় নারীর প্রতি সব ধরণের বৈষম্য দূরীকরণ বিষয়ক সনদ বা কনভেনশন। এটি United Nations Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women বা সংক্ষেপে সিডও (CEDAW) নামে পরিচিত। সকল ক্ষেত্রে নারী, পুরুষের বৈষম্য দূর করে সমতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক সব বিষয়ে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা এতে বলা হয়েছে। এছাড়াও নারী ও পুরুষের মধ্যে দ্রুত সমতা স্থাপন করে পরিস্থিতি উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি হিসাবে এটিকে গন্য করা হয়। ১৯৮০ সালের ১লা মার্চ এই সনদে স্বাক্ষর করা হয় এবং ১৯৮১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর থেকে এই সনদ কার্যকরী হয়। ভারত সহ ১৫০টির বেশি দেশ এই সনদে স্বাক্ষর করে।
একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে বিশেষত ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও এই বৈষম্য দূরীকরণ কতটা সম্ভব হয়েছে সেই বিষয়ে কথা বললেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক তথা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান অফ উইমেন স্টাডিজ-এর সভাপতি ঈশিতা মুখোপাধ্যায় এবং দেশের প্রতিবন্ধী আন্দোলন ও নারী আন্দোলনের বরিষ্ঠ কর্মী শম্পা সেনগুপ্ত।
নারীর সমানাধিকার
- মহিলাদের সমানাধিকারের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন এবং বর্তমান ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে এই বিষয়ে আপনাদের অভিমত কী?
ঈশিতা মুখোপাধ্যায়: মহিলাদের সমানাধিকারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল মহিলাদের কাজের অধিকার। ২০০৪-২০০৫ থেকে ক্রমাগতভাবে মহিলাদের কাজ কমে আসছে। প্রথম যখন মহিলারা কাজ হারাচ্ছিলেন, সংখ্যাটা কমে আসছিল, তখন বোঝা যাচ্ছিল না সমস্যাটা কী, কতদূর যেতে পারে। শিক্ষার অঙ্গনে যে সংখ্যক মহিলাদের পাচ্ছি কর্মক্ষেত্রে সেই একই সংখ্যক মহিলাদের আমরা পাচ্ছি না – এটা একটা ধাঁধার মতো যার সমাধান সম্মিলিতভাবে আমাদের করতেই হবে ভারতে। যতজন শিক্ষিত হচ্ছেন, তার চেয়ে অনেক কম কাজে আসছেন। তাহলে তারা কোথায় যাচ্ছেন। শিক্ষার প্রাঙ্গন থেকে মেয়েদের স্কুলছুটের সংখ্যা যে খুব বেশি বাড়ছে তা নয়, ছেলেদের স্কুলছুট বেশি। কিন্তু মেয়েদের কম বয়সে, ১৮-র নীচে বিয়ে আমাদের দেশে বেড়ে গেছে। কোভিডের পর থেকে বেড়েছে – এটা পুরোপুরি সত্যি নয়। আগে থেকেই বাড়ছিল, ওই সময়ে আরও দ্রুত হারে বাড়ল।
প্রথমদিকে বোঝা না গেলেও ২০২৩-এ দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে সংগঠিত ক্ষেত্র থেকে রেকর্ড পরিমাণে কাজ হারিয়েছেন মহিলারা। এখনই কেউ বলবেন হোয়াইট কলার জব-এ তো মেয়েরা আছেন, কিন্তু ভীষণ কম, সে অর্থে আসছেন না।
বেতনভুক্ত শ্রমিকের মধ্যে শ্রমজীবী মহিলা কমছেন, কিন্তু নানাভাবে মহিলারা কাজ করছেন। যেমন, বিনা বেতনে, কম বেতনে, অসংগঠিত ক্ষেত্র যেগুলি আমাদের চোখের আড়ালে থাকে সেখানে মহিলা কর্মীদের সংখ্যাই বেশি। ভারতে বেকারত্ব রেকর্ড ছুঁয়েছে। পুরুষ শ্রমিকরা পরিযায়ী হলে বা কাজ হারালে পরিবারের গ্রাসাচ্ছদনের জন্য মহিলাদেরই কাজ করতে হয়, যেকোনও মজুরিতে যতটা শ্রম দেওয়ার সম্ভব সবটুকু দিয়ে তারা কাজ করে চলেছেন। ঘরে বসে কাজ করছেন। এই মুহূর্তে গবাদি পশুপালন, হাঁস মুরগি চাষের সঙ্গে মেয়েরাই বেশি যুক্ত। আশ্চর্যজনকভাবে এই ক্ষেত্র থেকে আমাদের দেশের উৎপাদনও অনেকটা বেশি। কিন্তু এটা একেবারেই চোখের আড়ালে থাকে। অর্থাৎ মহিলারা যেখানে দেশের উৎপাদন ব্যাবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করছেন সেটা চোখের বাইরে আছে, সেখানেই তারা প্রাপ্য মর্যাদা ও মূল্য পাচ্ছেন না।
একটা বিতর্ক উঠে এসেছে, যেটাকে বলা হচ্ছে বিনা বেতনে কাজ। হ্যাঁ, বিনা বেতনে কাজ বেড়েছে। পারিবারিক কাজ শুধু নয়, পরিবারের মধ্যে যে উৎপাদনগুলো হচ্ছে, সেই কাজও বেড়েছে। আমাদের দেশে সমানাধিকারের ক্ষেত্রে সংসদে ৩০% এখনও করতে পারিনি। এগুলোও সমানাধিকারের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা। ভারতের মতো দেশে এই সমানাধিকার না এলে দেশ এগোবে না, পিছিয়ে যাবে।
শম্পা সেনগুপ্ত: মহিলাদের সমানাধিকারের কথা বলার অনেক আগেই আমরা মানবাধিকারের কথা বলা শুরু করেছি। এবং মানবাধিকারের বিষয়ে যখন কথা বলি, সেখানে পলিটিক্যাল রাইটস এবং সিভিল রাইটস অনেক গুরুত্ব পায়। তাছাড়াও তো কিছু অধিকার থাকে যেমন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার – এইগুলো নিয়ে হিউম্যান রাইটস ডিসকোর্সে খুব বেশি কথা থাকে না, কথা হয় না। সেক্ষেত্রে বলতে পারি, যখন আমরা মহিলাদের জন্য আলাদা করে কোনও অধিকারের কথা বলছি, সেখানে কিন্তু প্রাইভেট লাইফ ও পাবলিক লাইফ দুটো বিষয়েই কথা বলাটা জরুরি। কারণ মহিলারা ঘরে, বাইরে সব জায়গাতেই নির্যাতিত হতে পারেন, তার অধিকার খর্ব হতে পারে।
নারীর প্রতি সমস্ত বৈষম্য ও হিংসা প্রতিরোধ
- এই (UNCEDAW) কনভেনশন ছিল নারীর প্রতি সমস্ত বৈষম্য ও হিংসাকে প্রতিরোধ করার জন্য। ভারতও এতে স্বাক্ষরকারী। কিন্তু ভারতে এই বৈষম্য ও হিংসা প্রতিরোধ আদৌ কতটা কার্যকরী হয়েছে?
ঈশিতা মুখোপাধ্যায়: আমরা যেটাকে বৈষম্য বলি, সেই বৈষম্য মহিলাদের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে প্রকট হচ্ছে, শিক্ষা, কাজ কোনওটাই তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। স্বাধীন ভারত যখন তার যাত্রা শুরু করে মনে করা হয়েছিল, শিক্ষা মহিলারাদের নিরাপত্তা-সম্মান-মর্যাদা দেবে। তাঁরা মর্যাদা-সম্মান নিয়ে তাদের সমানাধিকারের লড়াইতে থাকবেন। কিন্তু দেখা গেল, এই দু’টো হলেও তাদের নির্যাতন কমছে না, বিশেষ করে, পাবলিক প্লেস, লোকসমক্ষে তাদের নির্যাতন বাড়ছে। শুধু ধর্ষণ নয়, পাচার, ধর্ষণ করে খুন, তাদের উপর নৃশংসতা বাড়ছে।
আমাদের দেশে ২০১৪ সালে সিডও নির্দেশিত সরকারি রিপোর্টের পাশাপাশি বিকল্প রিপোর্ট পেশ করা হয়, যা তৈরি করে বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, যারা লিঙ্গ সমতা নিয়ে কাজ করে, আন্দোলন করে। এরজন্য প্রয়োজন হয় সরকারি রিপোর্ট প্রকাশ পাওয়া, যা খুঁটিয়ে দেখে বিকল্প রিপোর্ট তৈরি হয়। কিন্তু সরকার রিপোর্ট প্রকাশ না করলে তৈরি হয় শ্যাডো বা ছায়া রিপোর্ট। যা তারা নিজেদের প্রক্রিয়ায় তৈরি করে পেশ করে। ২০১৪ সালে সিডও কমিটি বিশেষ কিছু জায়গা চিহ্নিত করে বলে সরকারকে সেগুলির ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। তারপর থেকে ভারতে এই নিয়ে বিশেষ কোন আলোচনা হয়নি। সরকার রিপোর্ট পেশ করলে দেখা গেল, সরকার আইনগুলোর কথা বলেছে। সিডও-র ফলে অনেক আইন, যেমন – পারিবারিক নির্যাতন আইন, সম্মানরক্ষার জন্য হত্যার বিরুদ্ধে আইন, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা আইন, অনেকগুলো আইন হয়েছে, যেগুলো সিডও ও নারী আন্দোলনের ফল। আমাদের দেশে তো অনেক দিন থেকেই খুবই প্রগতিশীল আইন আছে। আইনগুলোকে চালু করতে মানুষের সচেতনতা দরকার ও আইনটা যে আছে, এটা জানানোও দরকার। এই পদ্ধতিটা আমাদের দেশে থিতিয়ে গেল। বর্তমানে সিডও-র রিপোর্ট সরকার কী দিয়েছে আমরা জানি না, দেশ কিছু জানে না, ছায়া রিপোর্ট তৈরির অনেক বৈঠক করেছে ছায়া সংস্থাগুলি। ২০১৪ সালের যে নির্দেশিকা ছিল তার কোনও প্রয়োগ দেখিনি, কোনও আলোচনা হয়নি। এক কথায় বললে সিডও-র প্রক্রিয়া আমার দেশে ব্যহত।
শম্পা সেনগুপ্ত: আবারও বলব বর্তমান ভারতে পাবলিক লাইফ বা প্রাইভেট লাইফ দু’টো জায়গাতেই মেয়েদের নানা রকম নেগেটিভ অভিজ্ঞতা হচ্ছে। সব জায়গায় মেয়েরা নির্যাতিত ও আক্রান্ত হচ্ছে, তার অধিকার খর্বও করা হচ্ছে। এবং সেটা শুধু পলিটিক্যাল নয়, তার প্রাইভেট লাইফ-এও সেটা হচ্ছে। আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যখন এক ধরনের মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে মেয়েদের জীবনে, সেখানে কোনও একটা রাজ্যে বলা হচ্ছে সে যদি লাভ ম্যারেজ-ও করে, নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে, বাবা-মা’র পারমিশন লাগবে, না হলে না কি রেজিস্ট্রি হবে না। বা এই যে বিয়ের বয়সটা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটাও কিন্তু একটা সমস্যাজনক বিষয়। কারণ মেয়েদের তো অ্যাডোলেসেন্স পিরিয়ড-টা এসে যায় ১৪-১৫ বছর বয়সে, এবার সে সময়ে যদি তার কারওর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়, সেটাকে যেভাবে দেখা হচ্ছে, বিয়ের বয়স বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্টিভ রাইটস মেয়েদের নিজেদের হাতে থাকছে না, সিদ্ধান্তটা অন্য কেউ নিচ্ছে, বা পলিটিক্যাল এরিনাতেও আমরা দেখছি, রিজার্ভেশন নিয়ে লড়াইটা চলেছে এবং সেই লড়াইটা অনেক বছর ধরে চলছে, ফলে আমি যখন সিডও-র কথা ভাবি, আমি এভাবেই ব্যাপারটা দেখতে পছন্দ করি।
ভারতবর্ষে প্রতিবন্ধী নারীদের অবস্থান
প্রতিবন্ধী আন্দোলন ও নারী আন্দোলনের সঙ্গে শম্পা সেনগুপ্ত দীর্ঘদিন যুক্ত। সেক্ষেত্রে স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও প্রতিবন্ধী নারীদের ভারতে অবস্থান এবং এই কনভেনশন-এর বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে তিনি জানান –
“সিডও-তে খুব আলাদা করে প্রতিবন্ধী মেয়েদের কথা কিছু বলা নেই। সিডও-কে বেস করে আমাদের ধরে নিতে হবে সব মেয়েদের জন্য যে অধিকার আছে, প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্যও সেই একই অধিকার আছে। এই কারণে, যখন সিআরপিডি ড্রাফট হচ্ছিল, অর্থাৎ কনভেনশন অন রাইটস অফ পার্সনস উইথ ডিসএবিলিটিস, এইটা যখন জাতিসংঘে আলোচনা হয়েছিল, তখন একটা বড় ডিবেট দেখা দিয়েছিল আলাদা করে প্রতিবন্ধী মেয়েদের কথা বলা হবে কি না। কারণ, সিডও তো আছে, মেয়েদের জন্য তো এত বড় একটা সনদ আছে, আবার কেন আলাদা করে এদের কথা বলা হবে। কিন্তু, তারপর পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, দেশ যখন জাতিসংঘের কাছে রিপোর্ট পাঠায়, কোনও দেশই আলাদা করে কেউই প্রতিবন্ধী মেয়েদের কথা লেখে না। কেউ কেউ কাস্ট বা অন্য কিছু লেখে, কিন্তু প্রতিবন্ধী মেয়েদের কথা লেখে না। সেইজন্য সিআরপিডি –তে আলাদা করে চ্যাপ্টার তৈরি করা হল যে, আলাদা করে ভাবা হল প্রতিবন্ধী মেয়েদের কথা। আর শুধু আলাদা করে চ্যাপ্টার নয়, বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্যেই উল্লেখ করা হল, অন্তর্ভুক্ত করা হল। সেই জায়গা থেকে ভাবলে সিডও তো আলাদা করে আমাদের কথা বলেনি, কিন্তু, আমি যে সময় থেকে সিডও-র কাজে যুক্ত হয়েছি, আমি সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রত্যেক দেশ যেমন তাদের একটা অফিশিয়াল রিপোর্ট পাঠায়, আবার অল্টারনেট রিপোর্ট যেটা আমাদের মতো সংগঠনরা এক হয়ে পাঠায়, সেরকম অল্টারনেট রিপোর্ট যখন তৈরি করা হয়েছে সিডও-র, সেই কাজে আমি ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত ছিলাম, প্রতিবন্ধী সংগঠনের মধ্যে অল্প কিছু সংগঠন যুক্ত ছিল, সেই অল্টারনেট রিপোর্ট-এ আমরা অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলাম প্রতিবন্ধী মেয়েদের কথা আলাদা করে। সরকারের উপরে চাপ দেওয়া হয়েছে তারা যাতে সিডও রিপোর্টে প্রতিবন্ধী মেয়েদের বিষয়টি রেখে পাঠায়। কিন্তু সেটা এখনও ভারত সরকার করেনি। যদিও কিছু কিছু দেশে সেটা এখন হচ্ছে। সিডও তো জাতিসংঘের কনভেনশন, তার লাইন ধরে ধরে ভারতবর্ষে সেটা মানা হবে, আইন হবে – ওরকম তো হয় না, ওরকম করা যায় না। আমার কাছে সিডও, সিআরপিডি অ্যাসপিরিশেনাল ডকুমেন্ট, যেটা আমরা চাই, যে, এটা হোক। কিন্তু সেটা কবে পাব আমরা জানি না। সুদূর ভবিষ্যতে কোনও দিন পাব তো নিশ্চয়ই। কিন্তু কাজটা যত দিন যাচ্ছে তত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, সরকারি সাহায্য আমরা এখন পাই না বললেই চলে। আমি মনে করি, ভারতবর্ষে এখন নারীমুক্তির ব্যাপারে আমরা যে জায়গায় ছিলাম তার থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি, পেছনে যাচ্ছি, আমাদের এখন কাজ, সেই পিছিয়ে যাওয়াটাকে বন্ধ করে আবার সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।”
আগামীদিনে শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মহিলাদের লড়াইয়ের অভিমুখ
এই প্রসঙ্গে ঈশিতা মুখোপাধ্যায় জানান – “আমাদের দেশের দিকে তাকালে নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রটা ভীষণ ভাবে শ্রমজীবী মহিলাদের আন্দোলন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। খবরে দেখা যাচ্ছে সারা দেশেই আশা কর্মীরা, অঙ্গনওয়াড়ী কর্মীরা, মিড-ডে মিল কর্মীরা বিক্ষোভ করছেন। দেশের কোথাও নেই যে তারা বিক্ষোভ জানাচ্ছেন না। আমাদের মনে রাখতে হবে বিশাখা গাইডলাইন বা যে ঘটনাগুলির প্রেক্ষিতে এই প্রতিটি আইন এসেছে তা কিন্তু শ্রমজীবী মহিলা আশা কর্মীর নির্যাতন নিয়েই প্রথম এসেছে। ভারতবর্ষে ধর্ম-জাতপাত-জনগোষ্ঠীগত বিভাগ রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে যে জনগোষ্ঠীগুলি অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে, তাদের মহিলারা বিশেষ ভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই ভাগগুলো মহিলাদের নির্যাতন বিশেষ করে চিহ্নিত করছে। মণিপুরের ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে জনগোষ্ঠীর বিবাদ দাঁড়িয়ে যায় মহিলাদের নির্যাতনে। আমাদের সংবিধানকে পিছনে ফেলে কোথাও যেন এই বিভাজনগুলি, নারীর প্রতি সহিংসতাই সত্যি হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি জাতীয় ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো দেখি, সেখানে যদি ধরিও যে সব কথা রেকর্ডেড হয় না, সবাই গিয়ে অভিযোগ জানান না, তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে আমাদের হিংসা সর্বক্ষেত্রে বাড়ছে। হিংসা, বৈষম্যকে সম্যক ভাবে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এই বিভাজন অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
গণতান্ত্রিক বাতাবরণ স্তব্ধ হয়ে যায় যদি ধর্ম-জাতপাত-জনগোষ্ঠীর লড়াই বেঁধে যায়। আমরা স্বাধীনতার সময় থেকে যখনই নারী আন্দোলনের কথা বলি তার সঙ্গে গণতন্ত্রও জুড়ে থাকে। গণতন্ত্র না থাকলে যেকোনও আন্দোলনের মতোই নারী আন্দোলনও বিকশিত হয় না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যহত হলে নারী আন্দোলনের স্বরটাও সকলের কাছে পৌঁছায় না। সরকার এবং সাধারণ মানুষ উভয় পক্ষেরই সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে হবে যাতে নারী আন্দোলনের স্বর আরও জোরালো হয়।”
ভীষণ ভালো লেখা।