উৎপাদন নীতি বদল ও ‘গেটবাহার’ শ্রমিকদের কাজে নেওয়ার দাবিতে শ্যামনগর জুটমিলে শ্রমিক বিক্ষোভ


  • March 22, 2024
  • (0 Comments)
  • 445 Views

বুকটান করে লড়ছেন শ্যামনগর জুটমিলের শ্রমিকরা। মহল্লায় তাঁদের স্বপক্ষে অন্য মজদুররা জড়ো হচ্ছেন। তাঁদের মূল দাবি অবিলম্বে এই চায়না মেশিনের মাধ্যমে কম শ্রমিক দিয়ে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া চলবে না। ১৫ জন গেটবাহার করে দেওয়া শ্রমিকদের কাজে নিতে হবে।

 

Groundxero | প্রতিবেদন

২১ মার্চ, ২০২৪

 

এক জন শ্রমিক চালাতেন দু’টি মেশিন, এবার চালাতে হবে ছ’টি। স্বাভাবিক ভাবেই শ্রমিক উদবৃত্ত হবেন। তাঁদের বদলি করা হবে অন্য বিভাগে। এমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শ্যামনগর জুটমিলের মালিকপক্ষ। আর এই সিদ্ধান্তকে ‘তানাশাহি’ আখ্যা দিয়েছেন শ্রমিকরা।

 

গত দশ দিন ধরে এই নিয়ে হুগলি জেলার শ্যামনগর জুটমিলে ঝামেলা চলছিল। তাঁত বিভাগের শ্রমিকদের অন্য বিভাগে বদলি করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন কারখানার মালিক। মজদুররা এর বিরুদ্ধে পালটা লড়াই করছিলেন। জানা গিয়েছে, তাঁত বিভাগের এক জন মজদুর আগে দুটো মেশিন চালাতেন, এখন নতুন ‘চায়না মেশিন’ বসিয়ে মালিক বলছেন এক-এক জনকে ছ’টা মেশিন চালাতে হবে। তার ফলে, সরাসরি শ্রমিকদের সংখ্যা তিন গুণ কমে যাবে। ফলত, অন্য বিভাগে বদলি করার যুক্তি হাজির করছেন মালিকপক্ষ। শ্রমিকরা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাঁরা শর্ত দেন খুব বেশি হলে তিনটি নতুন মেশিন চালাতে তাঁরা প্রস্তুত। এর বেশি নয়। এবং যে কোনও বিভাগে বদলি করা চলবে না, কিছু নির্দিষ্ট বিভাগেই বদলি করা যেতে পারে। আলোচনা এখানেই থমকে যায়।

 

এর আগে হুগলির অ্যাঙ্গাস জুট মিলে ৩ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট করেন শ্রমিকরা। ধর্মঘটের কারণ, মিলে নতুন মেশিন বসিয়ে সেই বিভাগের বাড়তি শ্রমিকদের অন্য বিভাগে বদলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মালিক। তাঁত ঘরে নতুন চায়না মেশিন বসিয়ে এক জন শ্রমিককে বলছেন ছ’টা করে মেশিন চালাতে হবে। এই শ্রমিকরা দুটো করে পুরনো মেশিন চালাতেন। শ্রমিকরা বলছেন, “ভাবুন কী পরিমাণ শোষণ বাড়ছে, ভয়ঙ্কর হচ্ছে! এর মানে শ্রমিক পিছু উৎপাদন সরাসরি তিন গুন বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন বেড়ে গেলেও শ্রমিকদের রোজ বাড়ছে না, কাজের সময়ও কমছে না। যখন মালিকের সামান্য মুনাফা কমে যায় তখন কিন্তু সপ্তাহে কাজের দিন কমিয়ে দেওয়া হয়, নানা কায়দায় শ্রমিকদের রোজগারে কোপ পড়ে।” মানে কী দাঁড়াল? তাঁদের কথায়, “মুনাফা বাড়লে পুরোটাই মালিকের, মুনাফা কমলে শ্রমিকদের বইতে হবে তার বোঝা।” শুধু অ্যাঙ্গাসে নয়, জানা গিয়েছে, প্রতিটা জুটমিলে চলছে এই দস্তুর। তাঁদের প্রশ্ন, “এক দিকে মালিকের জুলুম, আর মালিকের সঙ্গে আছে ইউনিয়নগুলো ও সরকার, এটা কি ভয়ঙ্কর অন্যায় নয়, ভয়ঙ্কর শোষণ নয়?”

তার উপর বলা হয়, যেসব শ্রমিক বাড়তি হবে তাঁদের অন্য বিভাগে বদলি করা হবে। যে শ্রমিক ১৫/২০ বছর একটি বিভাগে কাজ করেছেন, তাঁকে হুট করে অন্য বিভাগে বদলি করাকে ‘তানাশাহি’ আখ্যা দিয়ে শ্রমিকদের ব্যাখ্যা, “একটা ডিপার্টমেন্টে দীর্ঘদিন কাজ করার পর অন্য বিভাগে বদলি হলে বয়স্ক শ্রমিকদের পক্ষে মানিয়ে নেওয়া খুব মুশকিল। ঠিক মতো মেশিন চালাতে না-পারলে জুটবে সুপারভাইজারদের গালাগালি, অপমান, অসম্মান। মানে একজন দক্ষ অভিজ্ঞ শ্রমিকের জুটবে লাঞ্ছনা। অন্য বিভাগে তিনি তো একজন অদক্ষ শ্রমিক।” তাঁদের প্রশ্ন, “এটা কি আপনিও মেনে নিতেন?”

 

শ্যামনগর জুটমিলের তাঁতঘরের শ্রমিকরা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, সবাই মিলে মিল থেকে বেড়িয়ে আসেন। কোনও সংগঠিত নেতৃত্ব ছাড়াই শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দেন। এক এক করে অন্য ডিপার্টমেন্টগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখ থেকে মিল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমন ঘটনা হুগলিতে ইদানীং আকছার ঘটছে।

 

এর মধ্যে জুট মিলে ৫ বছর পর নতুন চুক্তি হয়েছে। শ্রমিকদের মতে, “চুক্তি না-বলে তাকে বলা উচিত নতুন শোষণের চাবুক। সবচেয়ে বড় বিষয়, এই চুক্তির বিষয়ে শ্রমিকরা কিছুই জানে না, কবে হয়েছে, কী আছে চুক্তিতে এই নিয়ে নানা কথা উড়ে বেড়াচ্ছে। এটাই তো হবে, কারণ চুক্তি-তো হয়েছে মালিকদের সংগঠন, ইউনিয়নগুলো (পুরো দালাল) এবং সরকারের মধ্যে। সেখানে শ্রমিকরা কী চাইছন, তাঁদের কী দাবি দাওয়া তা নিয়ে কারোর চিন্তা নেই। মনোভাবটা হল যা দেব, যতটুকু দেব তাই যথেষ্ট।” কারণ, ইউনিয়ন, মালিক, সরকার সবাই জানে শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠন নেই, অতএব যা ইচ্ছে তাই করা যাবে।

 

এই মুহুর্তে হুগলি অঞ্চলে বেশ কিছু শ্রমিক বুঝতে পারছেন কিছু একটা করা দরকার। তাঁরা বলছেন, “এভাবে পড়ে পড়ে মার খেতে খেতে এক দিন যদি মরতেই হয় তাহলে লড়াই করে মরাই ভাল।” আরও একটা জিনিসও বুঝতে পারছেন শ্রমিকরা, শুধু নিজের কারখানায় লড়ে লাভ নেই, সব কারখানা মিলিয়ে লড়াইটা গড়ে তুলতে হবে। মালিকরা একসঙ্গে চুক্তি করছেন, প্রত্যেকটা কারখানায় এক রকমের শোষণের নীতি চালু হচ্ছে ফলে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের একজোট হওয়া খুব জরুরি।

 

নতুন ভাবে সংগঠিত শ্রমিকদের এক প্রতিনিধি জানালেন, “যে নতুন চুক্তি হয়েছে সেটা নিয়ে শ্রমিকরা বসেছেন, আলোচনা করেছেন, কেউ বেশি বুঝেছেন, কেউ কম। কিন্তু তা নিয়ে লজ্জা পাননি। তর্ক হয়েছে, বোঝাবুঝি করতে সময় লেগেছে, কিন্তু শেষ পর্যম্ত চুক্তির প্রতিটি ধারা নিয়ে আলোচনা শেষে নিজেরাই সহজ করে সেটা নিয়ে পোস্টার, লিফলেট বানিয়েছেন। যে ভাষায় তাঁর শ্রমিক সাথিরা বুঝবেন তেমন করেই লিফলেট তৈরি করেছেন। অ্যাঙ্গাসের শ্রমিকরা এতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। একবার ভেবে দেখুন— যাঁদের নিজেদের কারখানা বন্ধ, যাঁরা জানেন না কবে কারখানা খুলবে, কবে হাতে পয়সা পাবেন তাঁরাই বুকে অসীম সাহস নিয়ে বেড়িয়েছেন অন্য মিলে পোস্টার মারতে, শ্রমিক মহল্লাতে ঘুরে ঘুরে অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলছেন, বোঝাচ্ছেন। আসলে ওঁরা বুঝে গেছেন এই চরম শোষণ, অত্যাচার, অসম্মান থেকে বাঁচতে হলে নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদেরই সংগঠন তৈরি করতে হবে। অন্য সব রাস্তা বন্ধ। একদিকে সমাজের তাবৎ সব পুঁজিপতি, সরকার, ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলো অন্যদিকে শ্রমিকদের একতা, সংগঠন, লড়াই। এটা ঠিক, ওরাই এখনও শ্রমিকদের দাবিয়ে রেখেছে। কিন্তু এটাও ঠিক, অনেকদিন পর আবার লড়াই চালু হয়েছে।” এই সংগঠনের এক শ্রমিকের সঙ্গে আমরা কথা বলছিলাম। তিনি বললেন “দাদা এই প্রথম বুঝলাম শ্রমিকরাও মানুষ, শ্রমিকদেরও ইমান আছে, ইমানের মানে যে বোঝে, সে লড়াই থেকে কোনও দিন সরে আসবে না। আমরা এক বার, দু’বার হারতেও পারি কিন্তু লড়াই চলতে থাকলে ওরা শেষ অবধি পারবে না। হামলোগোকে অন্দর বহুত জান হ্যায়।”

 

শ্যামনগর জুট মিলে চায়না মেশিন নিয়ে গন্ডগোল চলাকালীন কি শাসকপক্ষের কেউ হস্তক্ষেপ করেননি? এর উত্তরে শ্রমিকরা বলেন, “যখন শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করেন, এক তৃণমুল কংগ্রেসের নেতা এসে পুরো বিষয়টা মিটিয়ে নিতে বলেন, তাঁর তরফে বলা হয় কাজ শুরু হলে এই ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়া যাবে, কিন্তু দেখা যায় কাজ শুরু হতেই ১৯ তারিখ সকালে ১৫ জন শ্রমিককে গেটবাহার করে দেয় এবং তাঁরা কারখানায় গন্ডগোল পাকিয়ে প্রোডাকশান বন্ধ করছে এই মর্মে নোটিস দিয়ে কারখানা লকআউট করে দেয়।” তিনি আরও জানান,  শ্রমিকরা এর উত্তর দেয় কারখানার গেটে লাগাতার অবস্থান শুরু করে। তাঁদের মা, বউ, বাচ্চারাও গেটের বাইরে অবস্থানে বসে পড়েন। তাঁর মতে, জুটশিল্পে এই জিনিস একেবারে নতুন। জুটমিলে মাঝে মাঝে ধর্মঘট হয় কিন্তু শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবাররা এমন ভাবে লড়াইয়ে নামতে পারেননি। এটা হয়েছে শ্রমিকদের একতার জন্য। কোনও সংসদীয় দল, কোনও ইউনিয়ন কারও উপর নির্ভর করে নয়।

 

বুকটান করে লড়ছেন শ্রমিকরা। মহল্লায় তাঁদের স্বপক্ষে অন্য মজদুররা জড়ো হচ্ছেন। তাঁদের মূল দাবি অবিলম্বে এই চায়না মেশিনের মাধ্যমে কম শ্রমিক দিয়ে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া চলবে না। ১৫ জন গেটবাহার করে দেওয়া শ্রমিকদের কাজে নিতে হবে।

 

Share this
Leave a Comment