১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ রাজা মণীন্দ্র রোডের উপর এক নির্মম অভিযান চালায় কলকাতা পুরসভার উদ্যান বিভাগ। মইয়ের প্ল্যাটফর্মে চেপে মসৃণ গতিতে বৈদ্যুতিক করাত নিয়ে ২৫-৩৫ ফুট উঠে গেলেন কলকাতা পুরসভার উদ্যান বিভাগের কর্মীরা। হাত নাড়িয়ে সদ্য উড়তে শেখা আর বাপ-মা পাখিদের তাড়ালেন। তার পর বাসা, বাচ্চা, উড়তে না-শেখা সদ্য পাখা ও লোম গজানো কৈশোরেও পা না-দেওয়া অসহায়দের-সহ ডালপালা ছেঁটেকেটে ৩০-৪০ ফুট উঁচু ছাতিম, শিমূল, কদমগাছ-সহ পাঁচটি গাছ একেবারে ন্যাড়া করে দেওয়া হল। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
ঠিক যেন বুলডোজার নামিয়ে বস্তি উচ্ছেদ। এখানে বুলডোজারের বদলে নামল ট্রাকবাহিত হাইড্রলিক ল্যাডার, বৈদ্যুতিক করাত এবং দড়িদড়া-সহ পুরসভার লোকলস্কর। শুধু কাতারে কাতারে পুলিশ ছিল না। ছিল না জলকামান, র্যাফ, লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, রাইফেলের আড়ম্বর। প্রতিবাদ, প্রতিরোধের কোনও সম্ভাবনাই ছিল না যে। তবে, বস্তি উচ্ছেদের মতোই সন্ত্রাস সৃষ্টির কোনও কমতি ছিল না। মইয়ের প্ল্যাটফর্মে চেপে মসৃণ গতিতে বৈদ্যুতিক করাত নিয়ে ২৫-৩৫ ফুট উঠে গেলেন কলকাতা পুরসভার উদ্যান বিভাগের কর্মীরা। হাত নাড়িয়ে সদ্য উড়তে শেখা আর বাপ-মা পাখিদের তাড়ালেন। ঝটপট ঝটপট শব্দে আওয়াজ উঠল। প্রতিবাদের নয়, আতঙ্কের বোধহয়। তার পর বাসা, বাচ্চা, উড়তে না-শেখা সদ্য পাখা ও লোম গজানো কৈশোরেও পা না-দেওয়া অসহায়দের-সহ ডালপালা ছেঁটেকেটে ৩০-৪০ ফুট উঁচু ছাতিম, শিমূল, কদমগাছ-সহ পাঁচটি গাছ একেবারে ন্যাড়া করে দেওয়া হল। যেন আগামীতে বেশ কয়েক বছর এ তল্লাটে এক ফুট বাই এক ফুট বাসা বাঁধার ডালপালাও না-জোটে ওদের।
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ রাজা মণীন্দ্র রোডের উপর এমনই নির্মম অভিযান চালায় কলকাতা পুরসভার উদ্যান বিভাগ। ‘অপারেশন পরিবেশকল্যাণ’ শেষে সরুসরু ডালপাতা, ছয় থেকে আট ইঞ্চি ব্যাসের মোটা মোটা ডালের স্তূপের নীচে ঠিক কত বাসা, মোট কটা মৃতদেহ চাপা পড়ে রইল তার কোনও হিসাব খোঁজেনি কেউ। তবে, এমন স্তূপের পাশে একটিকে দেখা গেছে হাঁ করে চিত হয়ে পড়ে থাকতে আরও দুটো সদ্য লোম গজানো শিশু মুখ গুঁজে মরে পড়েছিল। আশ্রয় হারিয়ে শিমূল গাছের গোড়ায় গুটিসুটি মেরে বসে ছিল উড়তে না-শেখা একটা, আর একটা কোনওরকমে একটা পাঁচ ফুটের ফুলগাছের মাথায় বসেছিল। ওড়ার ক্ষমতা নেই তারও। মোটা মোটা ডাল কুড়িয়ে-বাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল হাইড্রলিক ল্যাডার-ট্রাক। সরু ডালপাতা গেছে ধাপায়। এতক্ষণ চক্কর কেটে কেটে উড়ছিল যারা, এবার নেমে এল ফের। কোথায় বাসা, কোথায় বাচ্চারা? বসার ঠাঁইটুকুও যে প্রায় নেই। ওদের কি বুক ফাটে? চোখের জলে বুক ভেসে যায়? কপাল চাপড়িয়ে তারস্বরে কান্নার আওয়াজ মেলেনি। শোনা যায়নি বাছা বাছা গালিগালাজ। আছাড়িপিছাড়ি খায়নি কেউ। শুধু নীরবে গাছে গাছে অবশিষ্ট জায়গাটুকুতে দলা পাকিয়ে বসে ছিল। আর একদম মগডালে যে কয়েকটি বাসা, বাচ্চা বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছে, সেখানে মায়েরা ডানার ঘেরাটোপে বুকের ওমে ভরিয়ে দিচ্ছিল বাছাদের। ২৪ ঘণ্টা পরে দেখা গেল পাতাভরা ডালপালার শামিয়ানায় যেখানে ছিল অজস্র বাসা, বাসায় শিশু কিংবা উড়তে বা নিজে খেতে না-শেখা সদ্য কিশোর সেখানে পাচটি গাছে্র শীর্ষে রয়ে যাওয়া ডালপালায় কোথাও দুটি, কোনটায় চারটি, কোনটায় ছ’টি এভাবে খান ১৪ বাসা। আর তার তিন চারটিতে বসে আছে মা পানকৌড়ি। ডিমে তা দিচ্ছে কি? কিংবা সদ্যজাতকে ওম? বাচ্চাদের খাওয়াতেও দেখা গেল কোনও, কোনও মাকে। গুনে দেখা গেল নাবালক ও তাদের বাপ-মা মিলিয়ে ২৫টি শামুকখোল এবং প্রায় ৪০টি পানকৌড়ি সংকীর্ণ স্থানে জড়িয়ে-মরিয়ে রয়ে গেছে। দু’টি শামকখোলকে দেখা গেল পাতা শুদ্ধু কচি, সরু ডাল ঠোঁট দিয়ে ভেঙে নিতে। ফের বাসা বানাবে। কী আস্পর্ধা! এর পর কি “…শোকসভা হবে বিধানসভায়?”
বিগত কয়েক বছর ধরে উত্তর কলকাতার দত্তবাগান মোড় থেকে পাতিপুকুর পর্যন্ত, যশোর রোডের একপাশে ঝাঁকড়া মাথার তিরিশ-চল্লিশ ফুট উঁচু গাছগুলিতে শামুকখোল, পানকৌড়ি ও নাইট হেরনদের বাসা বাঁধতে দেখা যায়। মূলত পুজোর আগে থেকে শীতের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় চার মাসের জন্য গড়ে ওঠে এই পাখিরালয়। বাসা বাঁধা, ডিম পাড়া, ছানাপোনা বড় করা ব্যস। তার পরই উড়ে যায় তাঁরা। এবারও চলে যাবার সময় এসে গিয়েছিল। ২০২১-২২ সালে এলাকা ও পাখির সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। যশোর রোডের ওই অংশ, দত্তবাগান মোড় থেকে বেলগাছিয়া রোড এবং রাজা মণীন্দ্র রোড, এই দুই রাস্তার প্রায় সিকি কিলোমিটার এলাকা; বেলগাছিয়া ভিলার স সামনের দিকের অংশ এবং রাজা মণীন্দ্র রোডের এলআইজি হাউজিং এস্টেটের ক্যাম্পাসে ব্যাপক হারে বড়, উঁচু, শক্তপোক্ত শিমূল, কদম, কাঠবাদাম, নাগলিঙ্গম গাছে শামুকখোল বাসা বাঁধে। একই গাছে বা রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, খিরিশের মতো গাছগুলোতে বাসা বাঁধে পানকৌড়িরা। এই ভীড়ে কিছূটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে নাইট হেরনরা। অথচ, এই অঞ্চলটায় তাদের ও পানকৌড়িদের একচেটিয়া মৌসুমি দখলদারি ছিল। এমনকি প্রায় ২০-২৫ বছর আগে নাইট হেরন ও গো-বকরা বেলগাছিয়ার ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অব অ্যানিম্যাল অ্যান্ড ফিশারিজ সায়েন্সেস-এর সমগ্র চত্বর জুড়ে এক হেরনরি গড়ে তুলেছিল। পরিবেশ নোংরা করার অজুহাতে প্রায় গাজোয়ারি করে তাদের তাড়ানো হয়। এর পর থেকে তারা ওই এলাকা আজও সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে। (পড়ুন: আকাশ জুড়ে ডানা বিস্তার করেছে শামুকখোল, গাছে গাছে বেঁধেছে বাসা)
প্রশ্ন হল, এমন জনবহুল এলাকায়, ব্যস্তসমস্ত রাজপথের ধারে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গাঁকগাঁক করে ধেয়ে চলা বাস, ট্রাক, অজস্র প্রাইভেট কার, অটোর রাস্তায়, হর্নের কর্কশ আওয়াজ, ধুলোকালিধোঁয়া ভরা পরিবেশে বাসা বাঁধতে এরা এল কেন? তবে কি তাদের যে স্বাভাবিক চারণভূমি, খাদ্যসংস্থানের স্থান যে জলাভূমি, পুকুর, মাঠঘাট, ধানখেত সেখানে বা তার আশপাশে কি নেই তেমন দীর্ঘ, মজবুত, মাথায় শামিয়ানার মতো ছড়ানো ডালপালাওয়ালা গাছ? গুলতি, এয়ারগানের হাত থেকে নির্ভয়ে গড়ে তোলার মতো কোনও আঁতুড়ঘর? তাই-কি এই অঞ্চলে পাড়ি দেওয়া। দেখতে দেখতে গড়ে ওঠা কলকাতা মহানগরে? কলকাতায় সম্ভবত এমন বড় আকারের একমাত্র হেরনরি বা পাখিরালয়? খাবার—মাছ, ব্যাঙ, শামুক, কাঁকড়া—জোগাড়ের তেমন সম্ভাব্য স্থান—গুগলের হিসাব মতো—পূর্ব কলকাতা জলাভূমি এই অঞ্চল থেকে ১৩.৬ কিলোমিটার, ধাপা ১০.৭ কিলোমিটার, নেই নেই করেও জলাভূমি যা আছে সেই সেক্টর ফাইভ ৮.৮ কিলোমিটার এবং রাজারহাট ৮.৫ কিলোমিটার। আকাশপথে তা অবশ্য আরও কম হবে। আধা কিলোমিটারে দূরে রয়েছে টালা ঝিল পার্ক, মাঠে-ময়দান। এখানে ওরা যায় কি? কিংবা নামে কি ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ফিশারিজ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের ছোট-বড় তিনটি পুকুরে?
সন্দেহ নেই, যতদিন তারা থাকে পাখির বিষ্ঠায় অতিষ্ঠ হয় মানুষ। গাছপালা, ফুটপাথ, রাস্তা বিষ্ঠায় সাদা হয়ে যায়। ছড়ায় দুর্গন্ধ, শুকিয়ে যাওয়া বিষ্ঠা হাওয়ায় ওড়ে, ফুটপাথ ঘেঁষা দোকানপাট কিংবা ফুটপাথের দোকানিরা দোকানের মাথায় তারপলিন টাঙিয়ে ব্যবসা চালায়, পথচলতি মানুষের মাথায়, গায়ে পড়ে বিষ্ঠা। পাউডারের মতো গুঁড়ো নাকে-মুখে ঢুকে শ্বাসকষ্ট হয় বলে অভিযোগ রয়েছে হাউজিংয়ের বাসিন্দাদের। গাছ লাগোয়া ফ্ল্যাটগুলো জানালা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। এই সমস্যাগুলো মূলত রয়েছে হাউজিং এবং রাজা মণীন্দ্র রোডের ১০০ মিটার এলাকায়। ওই ১০০ মিটার এলাকাতেই উচ্ছেদ অভিযান চলে। স্থানীয় কিছু মানুষের সমর্থন এবং আর্থিক জোর ও রাজনৈতিক যোগ রয়েছে এমন কিছু লোকের চাপের জন্যই এই অভিযান অনুমান করা যায়। অথচ এমন একটা হেরনরি রক্ষা করা উচিত ছিল পুরসভা ও বন দফতরের। এলাকাটি প্রতিদিনের রুটিন পরিচ্ছন্ন রাখার কাজের বাইরে নিয়মিত ফুটপাথ, সংলগ্ন রাস্তা, গাছের গোড়া-কাণ্ড জল দিয়ে ধোয়া, ব্লিচিং পাউডার ছড়ানোর মতো বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারত পুর কর্তৃপক্ষ। এই সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল পরিবেশবিদ অমিতাভ আইচ এমন কিছু যে ঘটবে তা আগেই অনুমান করেছিলেন। কারণ, তাঁর মতে মানুষের বসতির আশেপাশে এমন হেরনরি থাকাই মুশকিল। এবং তিনি মনে করেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা যখন খুব কম তখন ‘নেচার ক্লাব’ জাতীয় সংগঠন এই অঞ্চলে থাকলে পুরসভা ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করা, দূষণ রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করতে পারত। তিনি জানান, “ওদের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। সমস্যা সমাধানে পুরসভাকে এই চার মাস লোকের যাতায়াতের রাস্তায় শেড নেট লাগাতে হবে। বন দফতর বা কোনও ওয়াইল্ড লাইফ এনজিওকে ধরে এ কাজ করা যেতে পারে।”
তার বদলে যা হয়েছে তার বিরুদ্ধে সর্বস্তরে প্রতিবাদ জানানো উচিত বলে মনে করেন পরিবেশ, গাছ, বন্যপ্রাণপ্রেমী মানুষ। শামুকখোল, পানকৌড়ি, নাইট হেরনরা বিপন্ন প্রজাতির না হলেও বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, যা ঘটেছে তা পরিষ্কারভাবে বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন, ১৯৭২-এর ১৬ (গ) ধারা অনুযায়ী দণ্ডযোগ্য অপরাধ। ১৬ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, বন্যপ্রাণীকে আহত করা, মেরে ফেলা বা তাদের অঙ্গের কোনও অংশ হস্তগত করা অথবা পাখি, সরীসৃপদের ক্ষেত্রে ডিম নষ্ট করা অথবা পাখি ও সরীসৃপদের ডিম বা বাসস্থান লণ্ডভণ্ড করা অপরাধমূলক দণ্ডযোগ্য অপরাধ। সন্দেহ নেই কলকাতা পুরসভার উদ্যান বিভাগ এই অপরাধে অপরাধী।
(পড়ুন: আকাশ জুড়ে ডানা বিস্তার করেছে শামুকখোল, গাছে গাছে বেঁধেছে বাসা)
Only big big talks the authority utters !! They do not have any idea about the environment and the associates !! Each one keeps balance staying together. If we can tolerate these birds for a fraction of the year, they would have been given chance for survival by the “inhuman humans”. One day they will punish (these humans) in some way or other, who knows !!!!!!
I am really feeling pain in my heart for those deserted and dead helpless, innocent birds. Local enthusiasts could have saved them !!!