থিম লিটল ম্যাগাজিন, স্মরণে ছোট পত্রিকার ভাণ্ডারী সন্দীপ দত্ত


  • October 21, 2023
  • (0 Comments)
  • 1679 Views

গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন : অনিমেষ দত্ত

 

বাংলা সাহিত্য এক বিরাট মহাসাগর। আর এই মহাসাগরেই নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে অধিষ্ঠান করছে লিটল ম্যাগাজিন। কলকাতা বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন কিংবা সারা রাজ্যে নানান জায়গায় লিটল ম্যাগাজিন মেলার মাধ্যমে এই ‘অন্যরকম’ সাহিত্য পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। বাংলা লিটল ম্যাগাজিন শুধু ‘অন্যরকম’ সাহিত্য নয়, বরং একটা আন্দোলনও বটে। আর এই আন্দোলনের অন্যতম প্রথম সারির সৈনিক, লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির জনক, ছোট পত্রপত্রিকার ভাণ্ডারী ছিলেন সন্দীপ দত্ত, যাঁকে কয়েকমাস আগেই আমরা হারিয়েছি। এবার সেই সন্দীপ দত্তের স্মৃতিতেই কলকাতার সন্তোষপুরে সার্ভে পার্ক সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির (নীলপুকুর) ৪৬তম বর্ষের দুর্গাপুজোর থিম ‘বাংলা লিটল ম্যাগাজিন’। 

 

নানান থিম, জাঁকজমকপূর্ণ আলোর রোশনাই পেরিয়ে দক্ষিণ কলকাতার সন্তোষপুর এলাকায় সার্ভে পার্ক নীলপুকুর অঞ্চলে প্রবেশ করে দেখা গেল অন্য এক স্রোতধারা। বাংলা সাহিত্যে মূলস্রোত বা মেইনস্ট্রিম বলে আমরা যেটা চিনি সেই মূলস্রোতকেই অস্বীকার করে বা বলা ভালো তার সাথে একরকম লড়াই করে টিকে থাকে বাংলা লিটল ম্যাগাজিন। আর ঠিক এইখানেই একবিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে সার্ভেপার্ক-এর পুজো ও লিটল ম্যাগাজিন।

 

পুজো মণ্ডপে ঢোকার আগেই বড় একটা হোর্ডিংয়ের দিকে চোখ যায় যেখানে লেখা ‘স্মৃতির আবহে লিটল ম্যাগাজিন’ এবং সঙ্গে সন্দীপ দত্তের ছবি। এরপর মূল মণ্ডপের প্রবেশদ্বারে লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে খ্যাত বেশকিছু পত্রিকার নাম। প্রবেশদ্বার পেরিয়েই একটা প্যাসেজ যেখানে ১৯১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ‘সবুজপত্র’ (বিতর্কিত) থেকে শুরু করে বর্তমানের এই দীর্ঘ যাত্রাপথকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। পুজো প্যান্ডেলটি গড়ে তোলা হয়েছে সন্দীপ দত্ত প্রতিষ্ঠিত টেমার লেনের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের আদলে। লাইব্রেরির আদলেই আরেকটি লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়েছে মণ্ডপের ভিতরে যেখানে একটি টেবিলে সন্দীপ দত্তের আবক্ষ মূর্তি, সামনে টেবিল ল্যাম্প ও পত্রিকা। যেন স্বয়ং সন্দীপ দত্ত নিজের কাজে ব্যস্ত। 

 

দুর্গা প্রতিমা যেখানে সেই স্থানটি সাজানো হয়েছে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের রেপ্লিকা দিয়ে। এখানে দুর্গা প্রতিমার হাতে ত্রিশূল নেই, আছে কলম। অন্যান্য হাতে বই। কলম দিয়েই অসুর বধ করছেন দুর্গা। কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী, লক্ষ্মী সকলের হাতেই বই। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স (পূর্বতন টুইটার)-সহ  ডিজিটাল মাধ্যমগুলি এখানে অসুররূপী। সমগ্র পুজো মণ্ডপটি নিজেদের হাতে সাজিয়েছেন সন্দীপ সাহা ও সুজিত সেন। উদ্যোক্তা কৃষ্ণগোপাল মল্লিক জানাচ্ছেন, “আমরা এর আগে থিম পুজো করতাম না, সাবেকি পুজোই করে এসেছি বরাবর। এবারেই প্রথম থিম পুজোর ভাবনা।” বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার সুবিশাল। তার মধ্যে লিটল ম্যাগাজিনই কেন বেছে নেওয়া হল? এ-প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা যখন সাহিত্য চর্চা করতাম তখন আমরা দেখেছিলাম লিটল ম্যাগাজিন হল প্রতিবাদের ভাষা। ভালো ভালো লেখক তৈরি হয়েছে এই লিটল ম্যাগাজিন থেকে। লিটল ম্যাগাজিন হল আমার মতে সাহিত্যের বীজ।” 

 

মণ্ডপের লাইব্রেরি ঘরটিকে লাইব্রেরির রূপ দিতে সংগ্রহ করা হয়েছে কয়েক হাজার বই। “আমরা প্রথম চেষ্টা করেছিলাম লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে। কিন্তু পুজো মণ্ডপে সন্দীপবাবুর লাইব্রেরি থেকে এতো ম্যাগাজিন নিয়ে আসাটা বড্ড ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তাই আমরা কলেজ স্ট্রিট, গড়িয়াহাট থেকে, বিভিন্ন পুরনো বইয়ের দোকান থেকে, বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে, আমাদের নিজেদের লাইব্রেরি থেকে এমনকি যারা কাগজ বিক্রি করেন বড় বড় হোলসেলার তাদের থেকেও বই কিনে এনে আমরা লাইব্রেরিটা সাজিয়েছি। গত একমাস ধরে এই বই সংগ্রহের কাজটা চলেছে। লিটল ম্যাগাজিনের পাশাপাশি একটা চিন্তাকে আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি যেটা হল বই পড়ার ভাবনা। আমাদের পুথি থেকে বই পড়ার যে হাজার বছরের ইতিহাস তাকে একরকম চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমগুলি। আমরা চাই মানুষ বই পড়ুক। লিটল ম্যাগাজিন পড়ুক, সন্দীপ দত্তকে চিনুক” বলেন কৃষ্ণগোপাল মল্লিক। 

 

সময়টা আশির দশক। কলকাতার ন্যাশানাল লাইব্রেরির মেঝেতে অবহেলায় পড়ে আছে, গাদাগুচ্ছের লিটল ম্যাগাজিন। এক তরুণ তা দেখে সহ্য করতে না পেরে সেগুলি নিজের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এবং তার পরেই তৈরি করেন টেমার লেনে নিজের বাড়িতে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র৷ সেদিনের সেই তরুণ সন্দীপ দত্ত আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন গত ১৫ মার্চ ২০২৩। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয়, সংগ্রহ, হাজার হাজার লিটল ম্যাগাজিন, বহু ছাত্র-গবেষকদের জন্য অমূল্য সম্পদ। 

 

আজ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞাও বদলেছে। অনেক লিটল ম্যাগাজিন বন্ধ হয়েছে নানা কারণে। ডিজিটাল যুগে প্রচারের সুবিধা বেড়েছে। অনেক লিটল ম্যাগাজিন তাদের ডিজিটাল সংস্করণ বের করছে। এক সময়ের বেশ কিছু পরিচিত লিটল ম্যাগাজিন আকারে বৃহৎ হয়ে এখন নিজেরাই মূলধারা হয়ে উঠেছে। লিটল ম্যাগাজিন মহলেই রয়েছে নানান বিতর্ক। আবার একই সঙ্গে ‘কাউন্টার কালচারের চর্চা’ও অব্যাহত রয়েছে, রয়েছে প্রতিবাদের ভাষাও। লিটল ম্যাগাজিন, নামে ‘লিটল’ হলেও ভাবনায় বৃহৎ। কম পুঁজিতে এবং কম দামে আজও পাঠকদের মধ্যে বৃহৎ চিন্তার সঞ্চার ঘটাচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন। পুজো মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে ও আনন্দ কর‍তে আসা জনগণ যদি একটু সাহিত্যের স্বাদ পায়, কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনের নাম জানে, সামান্য হলেও যদি কাউন্টার কালচার, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নির্যাস নিয়ে ফেরে তাতেই সন্তুষ্ট উদ্যোক্তারা।

 

Share this
Leave a Comment