বিগত পাঁচ বছরে দেশের তাবড় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর বার বার আঘাত নেমে এসেছে, আক্রান্ত মৌলিক অধিকার, সর্বোপরি ভারতীয় বোধ, ভারতীয়ত্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারণাটাই আজ সঙ্কটের মুখে। এই অবস্থায় নিউজক্লিকের অফিসে দিল্লি পুলিশের রেইড এবং সাংবাদিকদের হেনস্থা খুব নতুন ঘটনা নয়। লিখলেন অগ্নিশ্বর চক্রবর্তী।
“—অন্ধকার রাত অস্বস্তিকর…
—পথ যে চেনে না তার কাছে…
—আকাশ বড় মেঘলা…
—হ্যাঁ ঝড় আসছে।”
ভ্যালি অব ফিয়ার— কোনান ডয়েলের এই বিখ্যাত উপন্যাসটি অনেকেই পড়েছেন। পৃথিবী বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমসের এই উপন্যাসে প্রথম অংশে দেখা যায়, সাসেক্সের গ্রামের এক ব্যক্তি ডগলাসের খুনের তদন্তে জড়িয়ে পড়ছেন শার্লক হোমস। নির্মমভাবে এই খুনের তদন্ত করতে গিয়ে উন্মোচিত হয় এক নতুন সত্য। দেখা যায় ডগলাস গোটা ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন অতীতের এক অদ্ভুত ইতিহাসের জন্য। ডগলাস ওরফে বডি এডওয়ার্ডস আসলে ছিলেন কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা পিংকারটনের একজন এজেন্ট। তাকে পাঠানো হয়েছিল খনি অঞ্চলে গড়ে ওঠা শ্রমিকদের সংগঠনগুলিকে ভিতর থেকে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ধ্বংস করে দিতে। এই সূত্রেই খুন, এবং তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক আশ্চর্য থ্রিলার কাহিনী। আমাদের এই উপজীব্যও কোনও থ্রিলার কাহিনির চেয়ে কম নয়। সে প্রসঙ্গেই ঢুকব।
পিংকারটন কোনও কাল্পনিক গোয়েন্দা সংস্থা নয়, উনিশ শতকে মার্কিন রাষ্টপতিদের সুরক্ষার দায়ভারের জন্যই সারা পৃথিবী জুড়ে এরা বিখ্যাত হয়ে ওঠে। বহু সিনেমা, উপন্যাস তৈরি হয়েছে এদের নিয়ে। এমনকি ডয়েলের আর এক বিখ্যাত গল্প অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য রেড সার্কেলে-ও লিভারটন নামে এক পিংকারটন গোয়েন্দার উপস্থিতি আমরা দেখতে পাব। পুঁজিবাদের উত্থানের প্রথম যুগেই গড়ে ওঠা শ্রমিক বিদ্রোহগুলি দমন করতে এদের কাজে লাগাতেন সব মালিকরাই। হঠাৎ বাক-স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ‘পিংকারটন’ কেন? কয়েকদিন আগেই ড্যানিশ কোম্পানি সিকিউরিটাসের একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল যেখানে তাদের ভারতীয় শাখার কর্মকর্তা অর্জুন ওয়ালিয়া জানাচ্ছেন, “আগে দেশের শত্রু সীমানায় থাকত এখন দেশের ভিতরে নিজেদের লোকেরাই শত্রু।” একই কথা কিছুদিন আগে সদম্ভে উচ্চারণ করেছিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। অর্জুন নিজেই জানাচ্ছেন, তাদের কোম্পানি ভারতে প্রকাশিত সংবাদগুলির উপর নজরদারির কাজ সফলভাবে করেছে।
সিকিউরিটাস এবি-ই এই মূহুর্তে পিংকারটনের মালিক। যারা বছর খানেক আগেই আমাজনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে কর্মচারীদের উপর নজর রাখার জন্যে।
গতকালই নয়াদিল্লিতে পুলিশ ভারত সরকারের তদন্তের নামে বহুল পরিচিত একটি সংবাদ সংস্থার (নিউজক্লিক) সাথে যুক্ত বিশিষ্ট সাংবাদিকদের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। দিল্লি পুলিশ মিথ্যে মামলা সাজিয়ে সন্ত্রাসবাদ দমন আইন (ইউএপিএ)-এর ধারায় স্বাধীন নিউজ ক্লিক-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং এইচ আর হেড অমিত চক্রবর্তীকে গ্রেফতার করেছে। প্রবীরবাবু অতীতে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে জরুরি অবস্থার সময়েও গ্রেফতার হয়েছিলেন। এছাড়া, ভাষা সিংহ, অভিসার শর্মা, উর্মিলেশ সহ একাধিক সাংবাদিককে থানার আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দিল্লি পুলিশ। এছাড়াও ছেচল্লিশ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন’-এর অধীনে তদন্তের অংশ হিসাবে তাঁদের নানা ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস (ল্যাপটপ, মোবাইল) এবং নথিগুলি পরীক্ষার জন্য নিয়ে নেওয়া হয়। নিউজ ক্লিক একটি স্বাধীন ওয়েবসাইট যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের কঠোর সমালোচনার জন্য পরিচিত।
গত পরশু, ২র অক্টোবর, মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন এবং ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের স্মরণে সরকারি অনুষ্ঠানের সময়, ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানা রাজ্যের ষাটটিরও বেশি স্থানে একযোগে অভিযান চালায়। এনআইএ ঝাড়খণ্ড এবং তামিলনাড়ুতে ২০২৩ সালের মে মাসে এবং উত্তরপ্রদেশে সেপ্টেম্বরে একই ধরনের হামলা চালায়। অন্ধ্র এবং তেলেঙ্গানায় ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কর্মী, আইনজীবী এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র-স্পনসর্ড অভিযান এবং হয়রানি করা হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশ কাল্পনিক মাওবাদী সমর্থকের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ৬৫ জন নেতৃস্থানীয় গণতান্ত্রিক অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল। অথচ এনআইএ-এর নেতৃত্বে তদন্তে অভিযুক্তদের কারও বিরুদ্ধে একদিকে যেমন কোনও অপরাধমূলক প্রমাণ পাওয়া যায়নি অন্যদিকে, ইউএপিএ আইনের অধীনে বিশেষ আদালত, যা অভিযুক্তদের জামিন দিয়েছে, পাশাপাশি অভিযোগের প্রকৃতি এবং সংগৃহীত প্রমাণের বিষয়ে কঠোর মন্তব্য করেছে।
এই ব্যর্থতা সত্ত্বেও, এনআইএ বিজয়ওয়াড়া, গুন্টুর, তিরুপতি, নেলোর, রাজামুন্দ্রি, অনন্তপুর, বিশাখাপত্তনম, কাদাপা, শ্রীকাকুলাম, প্রকাশম, তাদেপল্লীগুডেম, পালনাডু এবং হায়দরাবাদ এবং আন্ধ্রাসারা-সহ সমস্ত তেলেগু রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা জেলাগুলিতে একযোগে অভিযান চালিয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছেন পোন্নুরুর বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং গুন্টুর জেলা সিভিল লিবার্টিজ কমিটির সভাপতি রাজা রাও, তিরুপতির বিশিষ্ট আইনজীবী ও সিডিআরও সমন্বয়কারী ক্রান্তি চৈতন্য, হায়দরাবাদের অ্যাডভোকেট সুরেশ এবং অন্যান্য সম্মানিত বুদ্ধিজীবী এবং কর্মীরা। এইসব মানুষেরা সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য প্রকাশ্য ও আইনি কাজ করার জন্য সুপরিচিত। নিষিদ্ধ মাওবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে তাঁদের সংযোগ করার চেষ্টা নেহাতই সত্যের অপলাপ এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এর আগেও আমরা দেখেছি কীভাবে ভীমা কোরেগাঁও কেসে ভারতবর্ষ জুড়ে মানবাধিকার কর্মীদের উপর হামলা চালিয়ে তাঁদের সারাজীবন জেলে পচিয়ে মারবার চক্রান্ত করেছিল ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় পুণের গ্রামীণ পুলিশ প্রথমে গ্রেপ্তার করে আরএসএস-এর দুই মাথা শম্ভাজি ভিদে ও মিলিন্দ একবোতেকে, যাঁরা ২০১৮ সালের পয়লা জানুয়ারি দাঙ্গার সাথে যুক্ত ছিলেন। তারপর কীভাবে যেন তাঁদের নাম এফআইআর থেকে চলে গেল। বদলে জেলে গেলেন ১৫ বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী।
শুধু কেন্দ্রীয় সরকার নয়, যেখানে যেখানে বিজেপি শাসিত রাজ্য আছে সেখানেই আমরা এই চিত্র দেখেছি। উত্তরপ্রদেশে স্কুলের মিড-ডে মিলে নুন–রুটি খাওয়া শিশুদের ছবি প্রকাশ করায় এক সাংবাদিককে বিজেপি সরকারের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে৷ তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কাজে ত্রুটি দেখানো তথা সরকারের সম্মানহানি করবার ষড়যন্ত্র, সরকারি কাজে বাধা এবং দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা ইত্যাদি অভিযোগ তোলা হয়েছে৷ যে গ্রামবাসী ওই সাংবাদিককে মিড-ডে মিল নিয়ে খবর দিয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে– তিনি চাইলেই বাজার থেকে সবজি এনে দিতে পারতেন স্কুলকে৷ তা না করে সাংবাদিক ডেকে এনেছেন, অতএব সেটা ষড়যন্ত্র। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, সাংবাদিকরা সব ষড়যন্ত্রী!
২০২৩ সালের মে মাসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) ২১-তম ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডমের মাপকাঠি প্রকাশ করে। তাতে জানা যায় ভারতে সাংবাদিকদের পরিস্থিতি খুব খারাপ। সাংবাদিকদের ভয়ঙ্কর ঝুঁকির মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়, এমন ৩১ দেশের মধ্যে ঠাঁই পেয়েছে আত্মনির্ভর ভারত (ইন্ডিয়া)। বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার মাপকাঠিতে (প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্স) গত বছরের তুলনায় ১১ ধাপ নীচে নেমে এই মুহুর্তে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৬১ নম্বরে। ২০২১ সালে মোদির ভারত ছিল ১৫০ নম্বরে।
২০২০ সালে করা সুইডেনের গোটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের প্রকাশ করা বিশ্বে গণতন্ত্রের হালচাল সম্পর্কিত রিপোর্টে ভারতকে রাখা হয়েছে “স্বৈরতন্ত্রমুখী দেশসমূহের” ক্যাটেগরিতে। কারণস্বরূপ বলা হয়েছে “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের অধীনে সংবাদমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং বিরোধী পক্ষের পরিসর তীব্র মাত্রায় সংকুচিত হয়ে গেছে।” প্যারিস ভিত্তিক রিপোর্টারস উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্স-এর ২০২০-র এপ্রিলের রিপোর্টে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার তালিকায় ভারতের স্থান ১৮০টা দেশের মধ্যে হয়েছে ১৪২ নম্বরে, যা ২০১৯-এর অবস্থানের দু-ধাপ নীচে। এত নীচে অবস্থানের কারণ হিসাবে রিপোর্টে সাংবাদিক-বিরোধী হিংসা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, মিডিয়ার ওপর সরকার ও রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা, ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই এর সঙ্গে আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হুবহু মিলে যায়। সাধারণভাবে মিডিয়ার টিকে থাকার জন্য তাদের সরকারি ও কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এরপর সরকার অনুগত হওয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে ছাপা ও বৈদ্যুতিন উভয় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন কার্যকলাপে বিপর্যয় না এসে পারে না। হুমকি ও ভীতির পরিমণ্ডলকে উপেক্ষা করে যে সমস্ত সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিক নিজেদের বিকিয়ে না দিয়ে, সরকারি প্রসাদের প্রলোভনকে তুচ্ছ করে নিজেদের পেশার নৈতিকতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেন, সরকারি রোষ তাদের শিক্ষা দিতে উদ্যত হয়। অনেকেরই ঠাঁই হয় জেলে, এফআইআর-এর মুখে পড়তে হয় বহু সংখ্যককে, কাউকে-কাউকে আবার দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়। গীতা সেসু ও উর্বশী সরকার তাঁদের “খুন করেও পার পেয়ে যাওয়া” শীর্ষক গবেষণামূলক রিপোর্টে জানিয়েছেন, ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে সাংবাদিকদের ওপর অন্ততপক্ষে ১৯৮টা গুরুতর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোতে ৪০ জন সাংবাদিক নিহত হন যার মধ্যে কম করে ২১টাই সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের কারণেই হয়েছে। দিল্লির রাইটস অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালিসিস গোষ্ঠীর সমীক্ষাও থেকে জানা যাচ্ছে— ২০২০- এর ২৫ মার্চ (যে দিন মোদি লকডাউন নামান) থেকে ৩১ মে-র মধ্যে মহামারি সংক্রান্ত রিপোর্ট করার কারণে রাষ্ট্রের ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাতে অন্ততপক্ষে ৫৫ জন সাংবাদিকের ওপর নিপীড়নের খাঁড়া নেমে এসেছিল।
বিগত ৬ বছরে ভারতে সাংবাদিকতার নিম্নমুখীনতার পর্যায়টি এরকম – ২০১৬: ১৩৩; ২০১৭: ১৩৬; ২০১৮: ১৩৮; ২০১৯: ১৪০, ২০২০:১৪৭, ২০২১:১৫০। বিগত পাঁচ বছরে দেশের তাবড় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর বার বার আঘাত নেমে এসেছে, আক্রান্ত মৌলিক অধিকার, সর্বোপরি ভারতীয় বোধ, ভারতীয়ত্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারণাটাই আজ সঙ্কটের মুখে। এই অবস্থায় নিউজক্লিকের অফিসে দিল্লি পুলিশের রেইড এবং সাংবাদিকদের হেনস্থা খুব নতুন ঘটনা নয়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডের রাজনীতিক ও দ্য ডেইলি এক্সপ্রেস-সহ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের মালিক লর্ড বিভারব্রুক একবার রয়্যাল কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমি ডেইলি এক্সপ্রেস শুধুমাত্র মুনাফার জন্য চালাই না। প্রভাব বিস্তার করাটাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য।” বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম সংবাদশিল্পের (সংবাদপত্র, টিভি ইত্যাদি) মালিক রুপার্ট মার্ডকও বলেছেন, মুনাফা অর্জন তাঁরও একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সেই সঙ্গে জনসাধারণের মনে প্রভাব বিস্তার করাটাও তাঁর লক্ষ্য। নোয়াম চমস্কি এটাকেই বলেছেন, “ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ অর্থাৎ সংবাদ ও তথ্যকে এমনভাবে পরিবেশন করা হয় যাতে রাষ্ট্র, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি এবং কর্পোরেট দুনিয়ার গৃহীত কর্মকাণ্ডের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে ইতিবাচক মনোভাব জন্ম নেয়। শাসকশ্রেণির পক্ষে এই জনসাধারণের এই ‘অনুমোদন’(কনসেন্ট) পাওয়া খুবই জরুরি। ফেসবুক, ট্যুইটার-সহ সামাজিক মাধ্যমগুলির রাজনীতি আদতেই একটি নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি। এনিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন জেয়েনেপ তুফেক্সি তার “ট্যুইটার অ্যান্ড টিয়ার গ্যাস— দ্য ফ্র্যাজিলিটি অব নেটওয়ার্কড প্রোটেস্ট’ বইটিতে। আজ ভারতবর্ষে বেশিরভাগ মিডিয়াই এইভাবে শাসকের অনুগত ও আরএসএস/ বিজেপির প্রচার চালাবার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যাদের এককথায় ‘গোদি মিডিয়া’ বলা হচ্ছে।
“গোদি মিডিয়া” শব্দবন্ধটি এখন আর খুব অচেনা নয় প্রায় কারুর কাছেই। এমনকি যাঁরা তথাকথিত “অরাজনৈতিক”, তাঁরাও এসব জেনে বসে আছেন। “গোদি” শব্দটি হিন্দিতে ব্যবহৃত হয় “কোল” অর্থে – আর এর অন্ত্যমিল রয়েছে মোদির সঙ্গে। মোদির গোদিতে (কোলে) বসে এই নিষ্পাপ ভারতীয় মিডিয়া (বৃহদংশ) ডুডু খায়— তারা এতই ‘ইনোসেন্ট’ যে দেখলে চোখে জল চলে আসে। রাজনীতির কলুষ তাদের স্পর্শ করতে পারে না— তারা সাচ্চা ভক্ত। মোদিজি যা বলেন, যেভাবে বলেন, সেভাবেই তারা মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দেন চির অনুগত সেবকের মতন।
২০১৯ –এ লোকসভা ভোটের ঠিক আগে অর্থনীতির প্রশ্নে, কৃষিনীতির প্রশ্নে যখন মোদি সরকার জেরবার, হারছে একের পর এক রাজ্য এবং উপনির্বাচন, তখন লোকসভা নির্বাচনের আগে আগে দেশের অন্য সমস্ত সমস্যাকে পাশে সরিয়ে ঢক্কানিনাদে প্রচারিত হয়েছিল মোদিজির সার্জিকাল স্ট্রাইক। পুলওয়ামার জবাবে (যে পুলওয়ামায় ফৌজিরা কাদের অপদার্থতায় শহিদ হয়েছিলেন তা নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে) ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তানের মাটিতে ঢুকে নাকি উড়িয়ে দিয়ে এসেছে জঙ্গিঘাঁটি। সে এক্কেরে হইহই রইরই মারমার কাটকাট ব্যপার।
গোদি মিডিয়া যখন এই সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে ফেলেছে, দেশদ্রোহী আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম কিন্তু পুরো ব্যপারটাকে পাত্তাই দিল না। ভারতীয় বাদে প্রায় সারা পৃথিবীর মিডিয়া রিপোর্ট করল যে ভারত হামলা করেছে ঠিকই, কিন্তু তা একটা ফাঁকা, পরিত্যক্ত জায়গায়, এবং কেউ হতাহত হয়নি। কোনও জঙ্গি ঘাঁটিও ধ্বংস হয়নি, তবে দু-তিনটি পাইন গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাতে পাকিস্তানের তেমন কিছু ক্ষতি না হলেও ভারত একজন দক্ষ পাইলটকে প্রায় হারাতে বসেছিল, তাদের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সও বেশ ভালমাত্রায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল এবং সর্বোপরি, আবহাওয়া বুঝে এই অভিযানের পরিচালনা যিনি করছিলেন, যুদ্ধ ও অ্যাভিয়েশন, উভয় বিষয়েই তাঁর অভিজ্ঞতা শূন্য— এসব অন্য গপ্প। আসল গপ্প হল, এই সর্বনাশা সার্জিকাল স্ট্রাইক কিন্তু তার মূল লক্ষ্য ভেদ করেছিল সাফল্যের সঙ্গেই— ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের ফলে বেশ ভালমত প্রভাব ফেলে।
“ফ্যাক্ট চেক” শব্দবন্ধটি ভারতীয় ইলেকট্রনিক মিডিয়া কোনওদিনই তেমন জরুরি মনে করেনি। খবরের সূত্র, তার নির্ভরযোগ্যতা নিয়েই বা কে মাথা ঘামায়? নতুন যুগের ভারতীয় খবর সৃষ্টি করে চলেছে এক নতুন ঘরানা—খাঁটি বৈদিক সাংবাদিকতার এক নতুন ধারা। একে বৈদিক ধারার পাশাপাশি গৈদিক ধারা বললেও কিছু অত্যুক্তি হয় না। দু হাজার টাকায় চিপই বলুন বা কোভিডের ভ্যাক্সিন কিংবা সার্জিকাল স্ট্রাইক আর তিনশো জঙ্গির মৃত্যু—এই ‘গোদি’য় সাংবাদিকতা কোথাও আপনাকে হতাশ করবে না।
উলটোদিকে যেকটি মুষ্টিমেয় সংবাদমাধ্যম সরকারের বিরুদ্ধে গলা ফাটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধতার কণ্ঠরোধ করার জন্যেই এই আয়োজন তা বুঝে নিতে আমাদের অসুবিধা হয় না। ভারতবর্ষের আইটি অ্যাক্টকেও ঢেলে সাজানো হয়েছে এই লক্ষ্যেই। এই গোদি মিডিয়ার দালালি এত দূর অবধি পৌঁছেছে যে নিউজ ব্রডকাস্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (এনবিএ)-এর প্রেসিডেন্ট রজত শর্মা ২০২১-এর মে মাসে তৎকালীন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরকে চিঠি দেন এবং আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সময় চান—
“২০০০ সালের তথ্য প্রযুক্তি আইনে ডিজিটাল নিউজ মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের কথা বলা নেই। কিন্তু, গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকার যে আইটি রুলস (২০২১) অনুযায়ী, সেই সমস্ত নিউজ টেলিভিশন চ্যানেল যাদের ডিজিটাল নিউজ ফিড এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উপস্থিতি রয়েছে তারাও এই নিয়মের আওতায় আসবে। আমাদের মনে হয়, এটা ২০০০ সালের তথ্য প্রযুক্তি আইনের পরিপন্থী। এনবিএ প্রধান উদ্বেগের বিষয় হল, নয়া আইটি রুলসের (২০২১) আওতায় সনাতনী নিউজ টেলিভিশন চ্যানেলগুলির ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলিকেও নিয়ে আসা।”
অর্থাৎ যে বিধিনিষেধ ও কড়াকড়ি ওটিটি এবং স্যোশাল মিডিয়াওগুলির উপর লাগু হয়েছে তা লাগু হোক ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের উপরেও।
কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছিলাম পেগাসাস নিয়ে খুব হইচই চলেছিল। বাকি সংসদীয় পার্টিগুলো এই নিয়ে আলোচনা দাবি করে সংসদ অচল করে রেখেছিল, আর সরকারপক্ষও কোনও আলোচনা করেনি। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশাল সহ আরও বেশকিছু সংবাদসংস্থা দাবি করেছিল পেগাসাস সফটওয়ার দিয়ে নজরদারি চালানো হতে পারে এমন সম্ভাব্য তালিকায় ভারতের প্রায় ১০০০টি ফোনের নম্বর ছিল। এর মধ্যে দেড়শোরও বেশি কিছু ফোন চিহ্নিত করা গেছিল। তার মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, সরকারের সমালোচক হিসাবে পরিচিত সাংবাদিক-সহ নাম আছে গণ-আন্দোলনের কর্মীদের। ইতিমধ্যেই যাদের অনেককে সরকার মিথ্যে মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলে আটকে রেখেছে। অবাক করার মতো ব্যাপার হল, এই তালিকায় বিভিন্ন শিল্পপতি, আমলা এমনকি সংঘ পরিবারের কিছু লোকের নামও রয়েছে!
এই সফটওয়্যার যারা বিক্রি করেছে সেই ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিল যে এই সফটওয়ারটি তারা শুধুমাত্র সরকারগুলোকেই বিক্রি করে, কোনও ব্যক্তি বা বেসরকারি সংস্থাকে বিক্রি করে না। আর এই সফটওয়ার চালাতে কোটি কোটি টাকা খরচ, আর দেখাই যাচ্ছে ভারতের যে লোকেদের নাম রয়েছে তাদের প্রায় প্রত্যেকে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের কট্টর বিরোধী হিসাবে পরিচিত। সে কারণে, এই নজরদারির পেছনে তাদের স্বার্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আপনি ভাবতে পারেন, ফৈয়াজের লেখা একটি কবিতা ‘অ্যান্টি-হিন্দু’ কিনা তা দেখার জন্য আইআইটি কানপুরের অধ্যাপকেরা প্যানেল বসিয়েছেন! আইআইটি, যাকে ধরাই হয় ভারতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম, যা আমাদের দেশকে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, পরিসংখ্যান সমস্ত ক্ষেত্রেই নিয়ে যায় বিশ্বের দরবারে। আমাদের দেশের মুখ বলা চলে। তো, সেই মুখ কীভাবে ফ্যাসিস্টদের মতো হয়ে গেল, শাসকদের মতো হয়ে গেল যে, একটি কবিতাকে বিচার করতে হচ্ছে তা ‘অ্যান্টি-হিন্দু’ কিনা?
স্বৈরাচারী এক শাসকের এবং তার দোসরের যে সব আচমকা ধেয়ে আসা পরিকল্পনা আমাদের জীবনকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে, আমরা সেই ধ্বংসস্তূপের হাত থেকে স্বাধীনতা চাই। আমরা দিল্লিতে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের উপর আক্রমণকে এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারি না। একে অপরের প্রতি একধরনের বিদ্বেষ বিভেদ তৈরি করার এই সংস্কৃতির থেকে স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতা চাই সব বিষয়ে ফ্যাসিস্টদের হিন্দুদর্শন গুঁজে দেওয়ার জঘন্য সংস্কৃতির থেকে। ফ্যাসিস্টরা যেভাবে সারা দেশে অর্থনীতিকে ভাঙচুর করে, মানুষে মানুষে সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে, উগ্র জাতীয়তাবাদের খুড়োর কল ঝুলিয়ে নেশায় উন্মত্ত করে বিষাক্ত করে দিচ্ছে ভারতীয় মানবাত্মাকে, আমরা সেই জঘন্য ফ্যাসিস্ট প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র থেকে স্বাধীনতা চাই। আমরা স্বাধীনতা চাই গলা খুলে কথা বলার।
( লেখক সামাজিক আন্দোলনের কর্মী )