তিন মাস বন্ধ রাজ্যের ৮৫ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ির শিশুর ডিম, সবজি; দুর্গাপুজোর অনুদান ২৮০ কোটি


  • September 4, 2023
  • (0 Comments)
  • 1440 Views

দুর্গাপুজার জন্য ৪২,০০০ ক্লাবকে গত বছরের তুলনায় আরও ১০,০০০ টাকা বাড়িয়ে এবছর ৭০,০০০ টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। এখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ২৮০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, রাজ্যের প্রান্তিক এলাকাগুলিতে যাঁরা অঙ্গনওয়াড়ি পরিষেবা দিয়ে চলেছেন তাঁদের ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি দূরে থাক, রাজ্যের ৮৫ লক্ষ শিশুর ডিম-সব্জির টাকাটুকুও দিচ্ছে না রাজ্য সরকার। অনিমেষ দত্ত’র রিপোর্ট।

 

 

তিন মাস বরাদ্দ অর্থ মেলেনি। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের প্রসূতি মা ও শিশুদের আর ডিম সিদ্ধ ও সবজি দেওয়া সম্ভব নয়। রাজ্য সরকার ডিম ও সব্জি কেনার টাকা না দিলে চাল, ডাল ফুটিয়েই দিতে হবে মা ও শিশুদের। এক সপ্তাহের বেশি হয়ে গেল, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের এই চেতাবনির পরও রাজ্য সরকারের তরফ থেকে তেমন কোনও হেলদোল দেখা যাচ্ছে না।

 

কীভাবে চলল তবে এই তিন মাস? আইসিডিএস কর্মীরা গত তিন মাস ধরে বরাদ্দ অর্থ না পেলেও নিজেদের উদ্যোগে পরিষেবা চালু রেখেছিলেন। কেউ নিজের টাকা খরচ করে আবার কেউ ডিমের দোকানে ধার করে সেন্টারে আসা শিশুদের মুখে সিদ্ধ ডিম তুলে দিচ্ছিলেন। কিন্তু এভাবে আর টানতে না পেরেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ১ সেপ্টেম্বর থেকে ডিম ও সবজি রান্না বন্ধ রাখবেন। আইসিডিএস কর্মী ও অঙ্গনওয়াড়ি ওয়ার্কাস অ্যান্ড হেল্পার্স ইউনিয়নের সম্পাদক মাধবী পণ্ডিত বলেন, “লকডাউনের পর থেকে আইসিডিএস সেন্টারগুলোতে রান্না করা খাবার দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আমরা লাগাতার আন্দোলন করার পর ২০২২ সাল থেকে আবার রান্না করা খাবার দেওয়া চালু হয়। কিন্তু এখন টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার।”

 

পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার আইসিডিএস কেন্দ্র রয়েছে যেখানে প্রতি সপ্তাহে সোমবার, বুধবার ও শুক্রবার গোটা ডিম সিদ্ধ ও বাকি দিনগুলি অর্ধেক ডিম সিদ্ধ দেওয়ার কথা। তার জন্য দিনপিছু ৬ টাকা ৫০ পয়সা বরাদ্দ শিশুদের জন্য বরাদ্দ। ওই একই দিনে কেন্দ্রগুলিতে মায়েদের জন্য সবজি ও ডিম খাতে বরাদ্দ ৭ টাকা ৫০ পয়সার কাছাকাছি। আলুর জন্য বরাদ্দ আরও ৮৪ পয়সা। কিন্তু কর্মীদের অভিযোগ গত জুন মাস থেকে রাজ্য সরকার ডিম ও সবজি খাতের বরাদ্দ টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে গর্ভবতী মায়েদের ও শিশুদের মুখে পুষ্টিকর খাবার তুলে দেওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। বরাদ্দ টাকা দেওয়ার দাবিতেই গত ২৯ তারিখ আইসিডিএস কর্মীরা বিধাননগরে নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখান এবং আইসিডিএস প্রকল্পের শীর্ষ আধিকারিককে একটি স্মারকলিপি জমা দেন। দপ্তরে সেইদিন উপস্থিত ছিলেন না নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা। এই নিয়ে তিন বার মন্ত্রী এবং পাঁচ বার প্রকল্পের ডিরেক্টরের দরবারে ধরনা দিলেও বকেয়া বরাদ্দ কবে থেকে দেওয়া হবে তার কোনও নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি মেলেনি।

 

১৯৭৫ সালে সারা দেশে এই আইসিডিএস প্রকল্প চালু হয়েছিল। ৪৮ বছর ধরে রাজ্য তথা দেশের লক্ষ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী গরিব প্রান্তিক এলাকার শিশুদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষার দেখাশোনা করে আসছেন। কিন্তু কম মজুরিতে দিনের পর দিন আর কাজ নয়, জানিয়ে দিয়েছেন অঙ্গনওয়াড়ির ‘দিদিরা’। তিন মাসের বকেয়া টাকা না দেওয়ায় যেখানে যেখানে ধার করে ডিম সবজি কিনেছিলেন তাঁরা, সেখানেও ধার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু কিছু সেন্টারে দোকানিরা এসে টাকা না দিতে পারায় অপমান করে চলে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অঙ্গনওয়াড়ির দিদিরা। তাই তাঁরা একপ্রকার বাধ্য হয়েই রান্না বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বকেয়া তিন মাসের টাকা না পাওয়ায় আপাতত আইসিডিএস সেন্টারে বন্ধ পরিষেবা। তিন মাসের টাকা যদি সরকার দিয়েও দেয় তার পরের মাসে যদি আবার একই পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে কী করবেন? মাধবী পণ্ডিত হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “আমাদের দাবি শুধু বকেয়া টাকা দিতে হবে তা নয়, প্রতি মাসেই এই টাকাটা দিতে হবে। আমাদের ন্যূনতম বেতন ২৬০০০ টাকা করতে হবে, কাজের স্বীকৃতি, পিএফ, পেনশন, ফোন কেনার টাকাও দিতে হবে, না হলে আমরা আরও বৃহত্তর আন্দোলনে নামব।”

 

আইসিডিএস সেন্টার গুলিতে বরাদ্দ বন্ধ করার পাশাপাশি সেখানকার কর্মীদের উপর বঞ্চনার অভিযোগও একাধিক। ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ন্যুনতম বেতন ৮,২৫০ টাকাই রয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। সরকারি কাজ করলেও তাদের সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতিটুকুও নেই। নিয়োগ প্রক্রিয়া অস্থায়ী। ফলে সরকারি পিএফ, গ্র‍্যাচুইটি, পেনশনের কোনও সুযোগ সুবিধাও এই কর্মীরা পান না। আইসিডিএস সেন্টারে আসা মা ও শিশুদের নিয়মিত রান্না করা খাবার দেওয়া, শিশুদের বিকাশ, পুষ্টি কতটা হচ্ছে, স্বাস্থ্য, মাতৃত্বকালীন অবস্থায় মায়েরা কতটা পুষ্টি পাচ্ছেন সেটা দেখা, ততত্ত্বাবধানের বিভিন্ন কাজ করেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। সেই কাজের নিয়মিত তথ্য, কতজন মা, কতজন শিশু, তাদের নাম, ঠিকানা ইত্যাদি লিখে রাখতে হয়। ২০১৮ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘পোষণ’ ট্র‍্যাকার অ্যাপে এই সমস্ত তথ্য নথিভুক্ত করার নিয়ম চালু হয় দেশের প্রত্যেকটি আইসিডিএস সেন্টারে। কিন্তু অ্যাপের জন্য তো প্রয়োজন স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট পরিষেবা। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশে ও এরাজ্যের আইসিডিএস কর্মীদের স্মার্টফোন কেনার জন্য ৮,০০০ টাকা করে বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু “আজ অবধি আমরা ফোনের জন্য সেই টাকা পাইনি” বলে অভিযোগ করেন মাধবী পণ্ডিত। রাজ্য সরকার এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয় করতে ব্যস্ত। আর এখানেই অভিযোগ উঠছে বেলাগাম দুর্নীতির। “কেউ গয়না বন্ধক দিয়ে, কেউ ধার করে ফোন কিনেছে। আমরা ফোন কেনার পরেও অসুবিধায় পড়েছি কাজ করতে গিয়ে, আমরা তো সবাই ফোনের অ্যাপ ব্যবহার করতে পারি না”, বলেন মাধবী। তিনি আরও অভিযোগ করেন ফোনের পাশাপাশি প্রতিমাসে ইন্টারনেট খরচ বাবদ ১৬৬ টাকা করে দেওয়া হয়, যা অপর্যাপ্ত। এই সমস্তটাই বহন করতে হচ্ছে কর্মীদের।

 

কেন্দ্রীয় সরকার ‘পোষণ’ অ্যাপের মাধ্যমে আঁধার লিঙ্ক করিয়ে নজরদারি চালালেও আইসিডিএস সেন্টার গুলির বেহাল দশা নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। অন্যদিকে রাজ্য সরকার আইসিডিএস কর্মীদের কাজের স্বীকৃতি, ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা এবং এখন খাবারের বরাদ্দও বন্ধ রেখেছে। দুর্গাপুজার জন্য ৪২,০০০ ক্লাবকে গত বছরের তুলনায় আরও ১০,০০০ টাকা বাড়িয়ে এবছর ৭০,০০০ টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। এখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ২৮০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, রাজ্যের প্রান্তিক এলাকাগুলিতে যাঁরা এই অঙ্গনওয়াড়ি পরিষেবা দিয়ে চলেছেন তাঁদের ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি দূরে থাক, রাজ্যের ৮৫ লক্ষ শিশুর ডিম-সব্জির টাকাটুকুও দিচ্ছে না রাজ্য সরকার। এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠলেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছে সরকার।

 

Share this
Leave a Comment