ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ঠুঁটো জগন্নাথ, চলছে দলতন্ত্র 


  • July 2, 2023
  • (0 Comments)
  • 632 Views

সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা কার্যকর করার মাধ্যমে জনগণের স্থানীয় সরকার গড়ার যে কথা ছিল , তা আজ কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়েছে। লিখেছেন প্রতীপ নাগ

 

‘দুয়ারে সরকার’- গালভরা নাম। সরকারি পরিষেবা ও জনকল্যাণমুখী প্রকল্প মানুষের ঘরের দরজায় পৌঁছাবার উদ্দেশ্যে ১ ডিসেম্বর, ২০২০ এই প্রকল্প চালু হয় গ্রাম পঞ্চায়েত ও শহরের ওয়ার্ডগুলিতে। আমাদের দেশে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা অতি প্রাচীন। এই রাজ্যেও ষোলআনা প্রভৃতি ব্যবস্থা ছিল। সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতিতে অনুচ্ছেদ ৪০-এ পঞ্চায়েতিরাজের কথা বলা হয়েছিল। এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে আরও সুদৃঢ় করতে ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনী আইন সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হয়। এর ফলে পঞ্চায়েতি প্রতিষ্ঠানগুলি সাংবিধানিক সংস্থায় পরিণত হয় এবং রাজ্যগুলিতে পঞ্চায়েতি প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলক হয়। পঞ্চায়েতের মেয়াদ ৫ বছর। রাজ্য নির্বাচন কমিশনগুলি পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। এই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ২৯টি সরকারি দপ্তরকে পঞ্চায়েতের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

 

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৩ সালে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আইন চালু হলেও, তা প্রথম কার্যকর হয় ১৯৭৮ সালে। গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজ ছিল গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, উন্নয়ন, স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার প্রভৃতির মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি সার্বিক মানোন্নয়ন ঘটানো। এই কাজে পঞ্চায়েতের প্রতি সংসদে বছরে দুইবার গ্রাম সংসদ সভা করার কথা বলা হয়। এই গ্রাম সংসদ সভা থেকে প্রতিটি সংসদে গ্রামবাসীদের সমস্যা ও সমস্যা নিরসনে পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা। সব সংসদের সভা শেষ করে গ্রাম পঞ্চায়েতভিত্তিক গ্রাম সভা ডেকে সামগ্রিক পরিকল্পনা রূপায়ণ ও পর্যালোচনা করার কথা আইনে বলা হলেও কার্যত তা এখন শিকেয় উঠেছে।

 

১৯৭৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে কিছুকাল সীমিত হলেও, এই ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ পঞ্চায়েতকে নিজেদের বলে ভাবত। আস্তে আস্তে পঞ্চায়েতগুলির উপর দলতন্ত্র কায়েম হতে শুরু হয়। সাধারণ জনগণের ইচ্ছার বিপরীতে পার্টির ইচ্ছায় পঞ্চায়েত চলতে থাকে। অন্যদিকে পরিকল্পনা খাতে আর্থিক বরাদ্দের বদলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার প্রকল্পভিত্তিক আর্থিক বরাদ্দ করতে থাকে। ফলে গ্রাম সংসদ স্তর থেকে মানুষের সার্বিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ ও কার্যকর করার যে ব্যবস্থা প্রথম দিকে ছিল, তা ক্রমেই পরিষেবা বিতরণের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। গ্রাম সংসদ ও গ্রাম সভা কার্যত উঠে যায়। ফলে মুষ্টিমেয় দলীয় লোকের হাতে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কুক্ষিগত হয়।

 

৯৩ তম সংবিধান সংশোধনে ২৯টি সরকারি দপ্তরকে পঞ্চায়েতের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হলেও, নির্দিষ্টভাবে তা বলা হয়নি। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের আর্থিক স্বনির্ভরতার কথাও নেই।

 

ফলে, আর্থিকভাবে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতকে নির্ভর করতে হয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উপর। বিশেষ করে ২০১১-এর  পরবর্তী সময়ে দলতন্ত্র ও দুর্নীতি চরম সীমায় পৌঁছে যায়। পঞ্চায়েতি রাজের ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাত থেকে অনেকাংশে চলে যায় বিডিও, এসডিও, জেলাশাসকের হাতে। আর দুয়ারে সরকার ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করে পরিকল্পনার বদলে গোটা দেশের মত আমাদের এই রাজ্যে প্রকল্পভিত্তিক কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তাই ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতকে সহজেই এড়িয়ে ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প চালু করা হল। ভাবখানা এমন যে এতে দলতন্ত্র ও দুর্নীতি কমবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও কার্যকর করার মাধ্যমে তৃতীয়স্তরে জনগণের স্থানীয় সরকার গড়ার যে কথা, তা কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়েছে।

 

কাজ ও খাদ্যের নেটওয়ার্ক, পশ্চিমবঙ্গের এক সমীক্ষায় জানা যায় যে, ৭১ শতাংশ মানুষদের পরিষেবা ও জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের সুবিধা পেতে এক বারের বেশি দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পে উপস্থিত হতে হয়। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশ মানুষকে দু’বারের বেশি ক্যাম্পে যেতে হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে দ্রুত পরিষেবা প্রদান, কিন্তু সমস্যা সেই তিমিরেই। এই সমীক্ষায় আরও জানা যায় যে প্রকল্পের জন্য আবেদন করেছিল, তাও তারা পাননি বা বাদ পড়েছেন। ফলে, পরিস্থিতি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।

 

ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার এই প্রয়াস আসলে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করে দলতন্ত্র ও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে।

 

(সৌজন্য: পৌর ও গ্রামীণ সংবাদ)

 

Share this
Leave a Comment