টাকা, শিক্ষক, পরিকাঠামোর অভাবে শুকোচ্ছে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ, বিক্ষোভে হবু শিল্পীরা


  • June 28, 2023
  • (0 Comments)
  • 1145 Views

গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন : অনিমেষ দত্ত

 

পানীয় থেকে মাটি ছানার জল নেই। নেই শিক্ষক। কলেজ চালানোর মতো পুঁজিও নেই ভাঁড়ারে। হাতে-কলমে কাজ যাঁদের, রং-তুলি, মাটি-পাথর-কাঠ-ধাতু যাঁদের কাজের উপকরণ, দেশের সেই হবু শিল্পীদের অনলাইন ক্লাস করার নিদান দিচ্ছে অসহায় কর্তৃপক্ষ— এই হল ঐতিহ্যবাহী গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট বা সংক্ষেপে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের বর্তমান হাল। অনেক স্বপ্ন নিয়ে এখানে পড়তে আসেন ছাত্র-ছাত্রীরা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ এই প্রতিষ্ঠানেই এবার পরিকাঠামোগত নানান সমস্যার অভিযোগ তুলেছেন পড়ুয়ারা। কিছুদিন আগেই একটি খবর সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয় যে কলেজে খাবার জল নেই। তারপরই বিভিন্ন শিল্পীরা এবং কলেজের প্রাক্তনীরা এই ঘটনাকে ধিক্কার জানান। এ ব্যাপারে আমরা কথা বললাম কলেজের এক ছাত্রীর সঙ্গে।

 

স্নাতকোত্তরের ছাত্রী শ্রেয়সী ব্যানার্জি বলেন, “বেশকিছু দিন যাবত আমাদের কলেজে খাবার জল ছিল না। তার পর খবরটা প্রচার হতেই জলের ট্যাঙ্ক আসে। কিন্তু সেটা তো কোনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। খাবার জলের জন্য যে অ্যাকোয়াগার্ড আছে সেগুলি খারাপ। আমাদের কলেজে খাবার জল বাদেও প্রায় প্রত্যেকটা বিভাগে জল লাগে মাটির কাজের জন্য। সেই জলেরও ব্যবস্থা নেই।” কলেজে জল না থাকায় অনলাইনে পড়াশোনার কথা জানায় কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে শ্রেয়সী বলেন, “লকডাউনের পর থেকেই এই অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়টা শুরু হয়েছিল। অনলাইনে আমাদের সব পড়াশোনা হওয়া সম্ভবই নয়। আমাদের প্র্যাক্টিকাল ক্লাসই বেশি। তাই আমাদের কলেজে এসে ক্লাস করাটা অত্যন্ত জরুরি। এখন আপাতত ওই ট্যাঙ্ক-এর জলেই কাজ চলছে, আমরা কলেজে আসছি। আমরা যখনই সমস্যাগুলো নিয়ে বলতে গেছি আমাদেরকে একটাই কথা বলা হয়েছে যে কলেজের কাছে ফান্ড নেই।”

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রের দাবি, “কিছুদিন আগেই এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখা যায় আর্ট কলেজে। কলেজের উল্টোদিকে একটি পুকুর আছে। ছাত্ররা সেখান থেকে বালতি ভর্তি করে জল নিয়ে এসে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়াও কলেজের বাথরুমগুলো খুবই দুর্গন্ধযুক্ত, কয়েকটা বাথরুমে বেসিন পর্যন্ত নেই।” শুধুমাত্র জলের সমস্যার কারণেই পড়ুয়ারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন এমনটা নয়। জলের পাশাপাশি কলেজের বেশ কিছু জায়গায় আবর্জনার স্তূপ পড়ে আছে, যেগুলি পরিষ্কার হচ্ছে না।

 

আর্ট কলেজে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স পড়ানো হয় বেশ কয়েকটি বিষয়ে যেমন পেইন্টিং, পেইন্টিং (ইন্ডিয়ান স্টাইল), টেক্সটাইল ডিজাইন, সেরামিক পটারি, মডেলিং স্কাল্পচার ইত্যাদি। পড়ুয়াদের অভিযোগ একাধিক বিভাগে স্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা কম। যারা অবসর নিয়েছেন তাঁদের পদগুলি এখনও খালি। স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না বহুদিন। কিছু বিভাগ অতিথি অধ্যাপকদের দিয়েই কাজ চালাচ্ছে।

 

পেইনটিং (ইন্ডিয়ান স্টাইল) বা ভারতীয় চিত্রশৈলী বিভাগটি বেশ পুরোনো এবং জানা যায় যে গোটা ভারতবর্ষে আর কোনও আর্ট কলেজে এই বিভাগটি নেই। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে এই বিভাগের পড়ুয়ারা আন্দোলন করেছিলেন স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের জন্য। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত স্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা শূন্যই। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসুর মতো শিল্পীরা যে বিভাগের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, এমনকি এই বিভাগের জন্য একটা সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটির ভারত জোড়া খ্যাতি ছিল; আজ শিক্ষকের অভাবে তা ধুঁকছে! ছাত্রদের অভিযোগ বর্তমানে ভারতীয় চিত্রশৈলীর বিশেষজ্ঞ শিক্ষক নন যাঁরা, তাঁদের দিয়ে অস্থায়ী ভাবে চালানো হচ্ছে পড়াশোনা।

 

স্থায়ী শিক্ষক না থাকার পাশাপাশি অশিক্ষক কর্মচারীরও অভাব রয়েছে এখানে। এক্ষেত্রেও সেই নিয়োগ বন্ধের অভিযোগ তুলছেন পড়ুয়ারা। পাশাপাশি শিল্প ও ভাস্কর্য পড়াশোনার জন্য প্রয়োজন হয় বিভিন্ন ধরণের কাঁচামাল। সেই কাঁচামাল নিয়মিত ভাবে আসছে না কলেজে। ফলে ব্যাঘাত ঘটছে পড়াশোনায়। আর্ট কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ইউনিয়নের সহ-সম্পাদক ঋষিত দত্ত বলেন, “২০০৮ সালে শেষবার ‘ন্যাক’ ভিজিট (ন্যাশানাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল) হয়েছিল। তারপর যা টাকা এসেছিল তা কয়েক বছরেই শেষ হয়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত নতুন করে ন্যাক ভিজিট হয়নি। ফলে টাকা আসছে না। আমরা ইউনিয়নের তরফ থেকে একাধিকবার অধ্যক্ষের কাছে অসুবিধাগুলি নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বারবার একই কথা বলেছেন যে, আমাদের কাছে ফান্ড নেই! কলেজের কাছে সত্যিই যে ফান্ড নেই তার একাধিক প্রমাণ আমরা পেয়েছি। বিকাশ ভবন (শিক্ষা দফতর) থেকে এই ফান্ড আসার কথা, কিন্তু তা আসছে না। আমরা পড়াশোনা করতে এসেছি সরকারি কলেজে, ফান্ড দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। আমরা কেন পড়তে এসে এই সমস্যাগুলির সম্মুখীন হব?”

 

ঋষিত আরও বলেন, “আমরা সেমেস্টার সিস্টেমে পড়াশোনা করি। আমাদের সিলেবাসে বেশ কিছু ‘স্কিল এনহান্সমেন্ট’ এর ক্লাস হওয়ার কথা। শুধুমাত্র প্রদর্শনী ছাড়া আমাদের কোনওরকম স্কিল এনহান্সমেন্ট -এর ক্লাস নেওয়া হয় না। প্রায় ১০-১২ বছর ধরে স্থায়ী অধ্যাপকের পদ খালি, একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ হচ্ছে না। অনেকক্ষেত্রেই অস্থায়ী শিক্ষকরা নির্দিষ্ট বিষয় পড়াতে অক্ষম, তাও অস্থায়ী শিক্ষকদের দিয়েই ক্লাস করানো হচ্ছে দিনের পর দিন ধরে। তাই একরকম দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মত অবস্থায় পড়েই আমরা আন্দোলন করতে বাধ্য হয়েছি।” কলেজের মধ্যে এই সমস্যাগুলির সুরাহা না হলে এরপর বিকাশ ভবনে গিয়েও আন্দোলন করবেন বলে জানিয়েছেন পড়ুয়ারা। চিন্তামণি কর, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো শিল্পীরা যেখানে এক সময় শিক্ষকতা করেছেন সেই প্রতিষ্ঠানের এই বেহাল দশায় ক্ষুব্ধ কলেজের প্রাক্তনীরাও।

 

গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ অ্যালুমনি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও শিল্পী অসিত পালের মতে, “জলের সমস্যার কারণে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল ঠিকই, এখন তা সামাল দেওয়া হয়েছে। একথা সত্যিই যে বেশ কিছু বিভাগে ফ্যাকাল্টি না থাকার সমস্যা রয়েছে। বিকাশ ভবন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সকলে মিলে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ফ্যাকাল্টি নিয়োগের ব্যবস্থা করবেন এই আশাই করি। কলেজ কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন অ্যালুমনি অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতা প্রয়োজন সেখানে সর্বদা আমরা এগিয়ে এসে সহযোগিতা করব।”

 

কলেজে বছরে একবার প্রদর্শনী হয় খুব বড় করে। সেই সময় একটা মোটা অঙ্কের অর্থ আসে। তা বাদ দিয়ে কলেজের নানান ন্যূনতম অসুবিধাগুলি মেটানোর জন্য যে অর্থ দরকার তা শিক্ষা বিভাগ বরাদ্দ করছে না। কলেজ সূত্রে খবর, বর্তমানে কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আলোচনা চলছে। কোনও সমাধানসূত্র বের হবে কি না তা সময়ই বলবে। বেসরকারি আর্ট কলেজগুলিতে যেখানে অনেকটা পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে পড়ুয়ারা পড়াশোনা করেন, ঠিক তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে তুলনামূলক অনেক কম খরচেই পড়াশোনা করার সুযোগ পান ছেলে-মেয়েরা। কিন্তু কলেজের পরিকাঠামোর দিকে যদি বছরের বছর ধরে নজর দেওয়া না হয় তাহলে কি ভবিষ্যতে শিল্প ও ভাস্কর্য পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে? ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার দায় তো সরকারেরও।

 

Share this
Leave a Comment