গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন : সুদর্শনা চক্রবর্তী
একটি ১২ বছরের মেয়ে। ঠিক যে বয়স থেকে একটি মেয়ে ধীরে ধীরে নিজের শরীরটাকে শরীর বলে চিনতে ও বুঝতে শেখে। একটা বিস্ময় ও জানা-বোঝার দরজা খুলে যেতে থাকে একটি এরকম বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় দাঁড়ানো মেয়ের সামনে। এবং এই সময়েই তাঁর শরীরের প্রতি ঠিক যেরকম আচরণ সে পায় সমাজ থেকে তেমনটাই তাঁর নিজস্ব বোধ তৈরি হয় শরীর ঘিরে। যে কারণে শিশুদের, বিশেষত শিশু মেয়েদের শরীরের প্রতি ইতিবাচক মানসিকতা তৈরির উপর জোর দিতে বলা হয়ে থাকে, যাতে কোনও কুসংস্কার বা ঐতিহ্যের দোহাই তাঁর শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও জৈবিক ক্রিয়ার প্রতি তাঁর মধ্যে কোনও নেতিবাচক মনোভাব তৈরি না করে।
এইরকম এক ১২ বছরের মেয়েকে তাঁর অভিভাবক নিশ্চিন্ত মনে পৌঁছে দেন এক নাটক শিক্ষকের প্রশিক্ষণশালায়। মধ্যবিত্ত বাঙালি মা-বাবা বড় ভালবাসেন নিজের সন্তানের সুকুমার বৃত্তিগুলিকে যত্নে বিকশিত করতে। যে পরিবারগুলিতে সাংস্কৃতিক চর্চা আছে বা হয়তো নেইও, তাঁরাও ভালবেসে এই নাটকের দলে নিশ্চিন্তে সঁপে দেন নিজেদের একরত্তি শিশুদের। কারণ এরকম কোনও শিক্ষক তাঁদের সন্তানদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারেন তা যেন তাঁরা ভাবতেও পারেন না। এবং এই ভাবতে না পারার সুযোগ নিয়েই নাট্য প্রশিক্ষণ দলের তথাকথিত নামজাদা পরিচালক একটি ১২ বছরের মেয়েকে টানা চার বছর ধরে অকথ্য যৌন নির্যাতন চালিয়ে যেতে পারেন।
সেই মেয়েটি আজ যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডীতে পৌঁছেছেন তখন অবর্ণনীয় মানসিক ট্রমার সঙ্গে লড়াই করে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পুরো ঘটনাটির বিবরণ দিয়েছেন। যৌন হেনস্থার সার্ভাইভার হিসাবে তাঁর এই সামনে আসা ও যৌন হেনস্থাকারী চিহ্নিত করাকে কুর্নিশ জানাব না কি সহ-নাগরিক হিসাবে, তাঁর অগ্রজ হিসাবে, তাঁরই মতো এক নারী হিসাবে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেব – কারণ তাঁকে একটা ‘সেফ স্পেস’ দিতে পারিনি আমরা – তা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। এতটাই ট্রমাটিক সেই অভিজ্ঞতা যা পুরোটা পড়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কিন্তু তবু গায়ের মধ্যে যে জ্বলেপুড়ে যাওয়ার মতো অস্বস্তি, মাথাটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হওয়ার মতো যে রাগ তা নিয়েই লেখাটা পড়তে হয়, যাতে একটি ১২ বছরের সদ্য কিশোরী মেয়েকে কি নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তা একটু হলেও বুঝতে পারা যায়। টানা চার বছর এই অত্যাচার সে সয়েছে কাওকে কিচ্ছুটি না বলে, দলে পৌঁছে রিহার্সাল দিয়ে, দলের কাজ করে, মঞ্চে নাটকে অভিনয় করে। তারপরেও সে হাসি মুখে স্কুল গেছে, পড়াশোনা করে জীবনের বড় পরীক্ষাগুলো পেরিয়েছে, পরিবারে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে। এই যৌন হেনস্থায় তাঁর শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির উপর কী ভয়ঙ্কর নেতিবাচক চাপ পড়েছে তা এই সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট-এই লেখা রয়েছে।
আজ যখন মেয়েটি সেই পরিচালকের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, এই কথা সর্বসমক্ষে আনার কথা বলছেন, নিজের ভেতরেই আর সহ্য করতে না পেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন তখন তাঁকে শুধু ‘স্যরি’ বলছেন অভিযুক্ত, চাকরি চলে যেতে পারে বলে মিনতি করছেন যাতে তা পোস্ট না করা হয়, তাঁর স্ত্রী সবকিছু মিটমাট করে নেওয়ার জন্য যে মহড়াকক্ষে চার বছর অভিযোগকারীকে নির্যাতিত হতে হয়েছে, সেখানেই তাঁকে দেখা করতে বলছেন – এই সমস্ত কিছু অভিযোগকারীর উপর নতুন করে কতটা মানসিক ট্রমা তৈরি করতে পারে, কতটা সাহস নিয়ে তাঁকে সত্যিটা সামনে আনতে হয় তা অনুমেয়।
এবারে প্রশ্নটা হল – এরপর কী? মেয়েটি তাঁর নিজের দায়িত্বে তথাকথিত সামাজিক সম্মান, কেরিয়ার, নিজের মানসিক স্বাস্থ্য সবটুকু বাজি রেখে এই ঘটনাটি সামনে আনলেন। কয়েক দিনের ফেসবুক পোস্ট আর সোশ্যাল মিডিয়ার সাময়িক উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে ‘পাবলিক মেমোরি’ থেকে আ্গের ঘটনাগুলির মতোই এই ঘটনাটিও হারিয়ে যাবে। অভিযুক্ত তাঁর নাটকের দলের প্রযোজনা দিয়ে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ করবেন, তাঁর হেফাজতেই নিজের সন্তানদের নাটক শিখতে পৌঁছে দেবেন অভিভাবকেরা। এবং সেই শিশুরা হবে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন। মঞ্চে উঠে নাটক করতে চাওয়ার মতো, নিজের মতো করে নাট্যচর্চা করার মতো স্বপ্ন দেখা আরও কত মেয়ে এই অভিযোগকারী ‘থিয়েটারের মেয়ে’দের অভিজ্ঞতার কথা মনে করে হয়তো গুটিয়ে যাবেন। এবং এই ট্র্যাডিশন চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে।
বাংলা থিয়েটার বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে কয়েক জন নামজাদা পরিচালক, নাট্য প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে তুলনায় কম বয়স এমন মেয়েদের যৌন হেনস্থা করে যাওয়ার খবর প্রকাশ্য এসেছে সেই মেয়েরা #মিটু করার পর। প্রতিবাদ, সাময়িক আন্দোলন হয়েছে, একটি ক্ষেত্রে কিছুটা আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা বর্তমানে মুক্ত হয়ে বাংলা নাটকের মঞ্চ ও বাংলা নাটককেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী মহলে বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, গুণমুগ্ধ পরিবৃত হয়ে বিরাজ করছেন। অভিযোগকারীদের প্রতিনিয়ত এই মেনে নেওয়া, ভুলে যাওয়াকে চোখের সামনে দেখতে হচ্ছে, তার মধ্যেই নাট্যচর্চা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এই বৈষম্য, যৌন হেনস্থাকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা চোখের সামনে দেখে যাওয়া তাঁদের মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে কি না সে খবর নেওয়ার দায় অবশ্য বাংলা থিয়েটারের জগত নেয়নি, নেননি সেখানকার বয়োঃজ্যেষ্ঠ পরিচালক, অভিনেতারা (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে)। দেশ ও রাজ্যের যাবতীয় অন্য বিষয়ে দলনির্দিষ্টভাবে তাঁদের অনেক বক্তব্য থাকলেও এক্ষেত্রে অভিযোগকারীদের পাশে একমাত্র এসে দাঁড়াচ্ছেন সম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নাটকের মেয়েরা বা তাঁদের সংহতিতে থাকা হাতে গোনা কয়েক জন নাট্যকর্মী।
এই নীরবতা আশ্চর্যজনক। তারচেয়েও অবাক করে কিছুদিন পরে পাবলিক মেমোরি শুধু নয় বাংলা নাট্যজগত থেকেও এই অভিযোগগুলির স্মৃতি ভুলে যাওয়া। আয়নার সামনে কী দিনশেষে একবারও দাঁড়াতে হয় না আমাদের?
পরপর #মিটু-র ঘটনা বাংলা নাটকের জগতে উঠে আসায় একটা বিষয় স্পষ্ট এই ট্রেন্ড নতুন নয়। বাংলা নাটকে মেয়েদের প্রতি দীর্ঘ বৈষম্যের ফলশ্রুতিই এই চূড়ান্ত যৌন হেনস্থার ঘটনাগুলি। ক্ষমতার রাজনীতিতে একটা ‘গুরুঠাকুর’ জাতীয় স্তরে পৌঁছে গেলেই তুলনায় কম অভিজ্ঞ, সদ্য নাটক শিখতে আসা মেয়েদের নির্দিষ্টভাবে ‘টার্গেট’ করে নিচ্ছেন এই ‘পারপিট্রেটর’রা। কারণ তারা জানেন কেউ মুখ খুলবেন না আর খুললেও তারা রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগতভাবে এতটাই শক্তিশালী যে কিছুই যাবে-আসবে না।
বাংলা নাটকে গত কয়েক বছরের এই ধরনের ঘটনাগুলির একটি ক্ষেত্রেও আইনিভাবে কোনও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আইনি প্রক্রিয়ার ফাঁক গলে অভিযুক্তরা বেরিয়ে গেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা গ্রেফতার পর্যন্ত হননি। প্রেক্ষাগৃহের সামনে প্রতিবাদ, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের পরেই থিতিয়ে গেছে আন্দোলন। অথচ কড়া আইনি পদক্ষেপ নিলে এমনটা হওয়ার ছিল না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি একজন অভিযুক্ত পেলে বাকিদের ক্ষেত্রেও একই পথ নেওয়া সহজ হত। অভিযোগকারীরা সাহস পেতেন, চাপের মুখে অভিযোগ প্রত্যাহার করতেন না বা চোখের সামনে নিজের অভিযোগগুলিকে এভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখতেন না। এই প্রতিটি অভিযোগই আসলে একেকটি সতর্কবার্তা, যে, এরকমটি ঘটে, ঘটেই চলেছে। মহিলাদের যৌন হেনস্থা যে দেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যেখানে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধে আইন রয়েছে, সেখানে নাটকের জগতের মহিলা কর্মীরা সম্পূর্ণ অসুরক্ষিতভাবে এই ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। আইনের ন্যায় থেকে বঞ্চিত রয়ে যাচ্ছেন। শেষতম ঘটনায় অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আসলেই একজন নাবালিকাকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনা হয়েছে। আইন আছে। তার প্রয়োগ হয় কি না সেটাই দেখার।
বাংলা নাটকের ঐতিহ্য, তার রাজনৈতিক ইতিহাস ও গুরুত্ব যেন ‘থিয়েটারের মেয়েদের’ যৌন নির্যাতনের কদর্যতায় ঢাকা না পড়ে যায়, আইনি পদক্ষেপ যেন দ্রুত নেওয়া হয় তার দায় বাংলার প্রতিটি নাট্যকর্মী, নাট্যঅনুরাগীর উপরেই বর্তায়।
ধিক্কার জানাই!