হিমালয় শুধুমাত্র হিমালয়বাসীর নয়, তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের : অতুল সতি 


  • June 16, 2023
  • (0 Comments)
  • 1121 Views

উত্তরাখণ্ড রাজ্যের জোশীমঠ হিমালয়ের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যম থেকে সমাজমাধ্যমের একাধিক ছবি ও ভিডিও এই মর্মে ‘ভাইরাল’ হল। যেখানে দেখা গেল এলাকার সাধারণ মানুষের বাড়িঘর, বাগান, দোকানে ছোট-বড়ো ফাটল। বেশ কয়েকটি জায়গায় নেমেছিল ধস। গাড়োয়াল পাহাড়ে অবস্থিত এই জনপদ সেই ১৯৩৯ সাল থেকেই প্রশ্নের মুখে। তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। আজ জোশীমঠ বড় শহর। ২০০৯ সালে টানেল বোরিং মেশিন বা সুরঙ্গ খোঁড়ার যন্ত্র দিয়ে জোশীমঠের কাছেই একটি পাহাড়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সুরঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে এক বিরাট প্রাকৃতিক জলাধারে (অ্যাকুইফার) আঘাত করে এবং সেখানে ফাটল ধরে যায়। এই সুরঙ্গ খোঁড়া হচ্ছিল ‘বিষ্ণুপ্রয়াগ হাইডো ইলেকট্রিক প্রকল্প’র জন্য।

 

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, সেই জলাধারটি থেকে প্রবল বেগে জল বেরিয়ে এসে মাটি আলগা করে দেয়। যার ফলাফল আজকের এই জোশীমঠ। এ ছাড়াও আরও নানান কারণ আছে জোশীমঠের আজকের অবস্থার। তা আমরা গ্রাউন্ডজিরোতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আজ জোশীমঠ মানুষের বসবাসের জন্য অনুপযুক্ত। আর ঠিক এমন একটা সময়েই আমরা পেয়েছি জোশীমঠের পরিবেশ রক্ষা ও সেখানকার সাধারণ মানুষের মৌলিক দাবিদাওয়া নিয়ে লড়াই করে এমন এক সংগঠন ‘জোশীমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি’র আহ্বায়ক অতুল সতিকে। গত ২৮ মে কলকাতার সুজাতা সদনে পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন তিনি। সেখানেই জোশীমঠের বর্তমান অবস্থাটা ঠিক কী, এলাকার মানুষের ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের বিষয়টাই বা কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে, উত্তরাখণ্ড রাজ্যের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরিবেশের প্রশ্নটি কতটা হাজির এমন বেশকিছু প্রসঙ্গে কথা বললেন গ্রাউন্ডজিরো‘র প্রতিনিধি অনিমেষ দত্ত‘র সঙ্গে।

 

 

প্র: প্রথমেই যেটা আপনার থেকে জানতে চাইব ঠিক এই মুহূর্তে জোশীমঠের অবস্থাটা ঠিক কী?

 

উ: অবস্থা বলতে যা আগে ছিল মোটামুটি একই রকম আছে, কোনও পরিবর্তন আসেনি। ঘরবাড়ি, দোকানগুলির দেওয়ালে যে সব ফাটল তৈরি হয়েছিল তা এখনো আছে। নিচের মাটি সড়ে যাচ্ছিল, ঘরবাড়ি কাঁপছিল, এখনও একই অবস্থা চলেছে। এলাকার সাধারণ মানুষ তখনও ভয়ের মধ্যে ছিলেন, এখনও আছেন। মানুষের পুনর্বাসনের কোনও পরিকল্পনা এর আগেও সরকারের কাছে কিছু ছিল না, এখনও নেই।

 

প্র: এলাকার মানুষ এখনও পর্যন্ত কোনও ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন?

 

উ: প্রথম দিকে সাধারণ মানুষেরা কিছুই পাননি, এখন এই দীর্ঘ আন্দোলনের পরে কিছু ক্ষতিপূরণের ঘোষণা সরকারের তরফ থেকে করা হয়েছে। যাঁদের ঘরবাড়ি, দোকান ভেঙে পড়েছে বা ভাঙছে, যে যে বাড়িতে ফাটল আছে তাঁরা ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু টাকাপয়সা পাচ্ছেন। যদিও সেই ক্ষতিপূরণের অর্থ পর্যাপ্ত নয়, যদিও সেই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রক্রিয়াটাই বেশ জটিল, সেই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার গতিও বেশ শ্লথ, তবুও ক্ষতিপূরণের সামান্য অর্থ মানুষ পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা আগামী দিনে কোথায় ঘর বানাবেন? যেখানে এই মুহূর্তে বসবাস করছেন অর্থাৎ জোশীমঠে সেই জায়গাটি তাঁদের জন্য কতটা সুরক্ষিত? প্রবল ভয়, আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন এলাকার মানুষ, কারণ এখনও তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁদের কাছে কোনও স্বচ্ছ ধারণা নেই।

 

প্র: এত এত সংস্থা রয়েছে, এত গবেষণা হচ্ছে, তারপরেও এলাকার মানুষ ধোঁয়াশায় কেন?

 

উ: আন্দোলনের পরে দেশের বিভিন্ন বড় বড় সংস্থা যেমন জিএসআই (জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া), আইআইটি-রুরকি, এনজিআরআই (জিওফিজিকাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট), সিবিআরআই (সেন্ট্রাল বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট), ইসরো (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন) দ্বারা যে গবেষণা, অধ্যয়ন হয়েছে তার রিপোর্টগুলো এখনও সর্বজনীন হয়নি, পাবলিক ডোমেইনে উপলব্ধ নয়। এই কারণেই সাধারণ মানুষ জানেন না তার এলাকা সুরক্ষিত কি না, জোশীমঠ সুরক্ষিত কি না। আর সেই কারণেই ধোঁয়াশা এখনও আছে, ভয় আছে, আশঙ্কা আছে। আর আমাদের লড়াইও একইভাবে জারি আছে। যতক্ষণ না সঠিকভাবে পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত হচ্ছে আমাদের আন্দোলন চলবে।

 

প্র: ‘জোশীমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি’ সংগঠনের মাধ্যমে আপনারা লড়াই করছেন। এই সংগঠন কীভাবে গড়ে উঠল?

 

উ: ২০০৩ সালে জোশীমঠে হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট-এর জন্য সার্ভে শুরু করে এনটিপিসি (ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড), আর এই সার্ভের সময় থেকেই আমরা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করা শুরু করি। আমরা জানতাম যে যোশীমঠের নীচে যদি সুরঙ্গ হয় তা এই এলাকার জন্য ভয়ঙ্কর হবে। কারণ জোশীমঠ এমনিতেই ভঙ্গুর এলাকা, আর এখানে যদি এই ধরনের ভারী নির্মাণ কাজ হয়, বিস্ফোরণ হয় তাহলে ভবিষ্যতে যোশীমঠ আর সুরক্ষিত থাকবে না। আন্দোলনের ফলে ২০০৫ সাল নাগাদ এই প্রকল্পের জনশুনানি হওয়া শুরু হল, আমাদের মনে হয়েছিল যে এই আন্দোলন দীর্ঘ সময়ের জন্যই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। আর ঠিক এই সময়েই আমরা আমাদের সংগঠন ‘জোশীমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি’ বানাই। আমাদের সংগঠন তৈরি হয় এই ভাবনা থেকেই যে শুধুমাত্র এই হাইড্রো পাওয়ার প্রকল্পটিই নয়, বরং জোশীমঠ অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিবেশকে কেন্দ্র করে যা যা লড়াই করা সম্ভব সেই লড়াইগুলিও করব।

 

প্র: যে হারে নগরায়ন হয়েছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে তা কী কোনওভাবে এই ধস ও ফাটলের কারণ? উত্তরাখণ্ড রাজ্য হওয়ার পর এখানকার মানুষের নূন্যতম যে চাহিদা তা কতটা পুরণ হল?

 

উ: উত্তরাখণ্ড রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর স্বাভাবিক নিয়ম ও গতিতেই নগরায়ন হয়েছে। রাজ্য হওয়ার পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভালো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রোজগার ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল। গ্রামে এই সুযোগ সুবিধাগুলি পৌঁছায়নি। এমনকি গ্রামগুলোতে যে ছোট ছোট স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি ছিল সেগুলোও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। যার ফলে শিক্ষার জন্য, স্বাস্থ্যের জন্য, রোজগারের জন্য গ্রামের মানুষেরা একরকম পালিয়েই গেল শহরে। শহরকেন্দ্রীক যে বিকাশ হয়েছে, তার ফলে মানুষ সেখানে সুযোগ সুবিধা বেশি দেখেছে, তাই সেখানেই চলে এসেছে। গ্রামেই যদি রোজগারের বন্দোবস্ত করা যেত, কৃষিকে আরও মজবুত করা যেত, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করা যেত তাহলে হয়ত এত সংখ্যক মানুষ নিজেদের গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসতেন না। যার ফলে শহরে জনসংখ্যা বেড়েছে, চাপও বেড়েছে। শহরে পরিবেশের বিরুদ্ধে গিয়ে তথাকথিত উন্নয়ন হয়েছে।

 

প্র: এই ‘উন্নয়ন’ কি সমস্ত নিয়মনীতি মেনে হয়েছে?

 

উ: না না। কোনও নিয়মনীতি মানা হয়নি। পরিবেশের ক্ষেত্রে যে নিয়মনীতির মাপক রয়েছে তার বিরুদ্ধে গিয়েই এই তথাকথিত বিকাশ হয়েছে।

 

প্র: এর আগেও ধসের ফলে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সরকারের তরফে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?

 

উ: জোশীমঠের কথা যদি বলি, এর আগেও সেখানে ভূমিধস, ফাটল ধরার ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৭৬ সালে সরকার একটি কমিটি গঠন করে (মিশ্র কমিটি)। মিশ্রা কমিটির পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ ছিল যে, জোশীমঠ ভালনারেবেল অবস্থায় আছে, গ্লেসিয়ার থেকে আসা মাটি দিয়ে তৈরি, নরম মাটি যা একেবারেই মজবুত নয়। আর হিমালয় নবীন পর্বত। যদি এই অঞ্চলে ভারী নির্মাণ কাজ চলতে থাকে তাহলে এই শহরের আয়ু কমতে থাকবে। সুপারিশে আরও বলা হয়েছিল যে, এখানে বোল্ডারগুলির উপর কোনও রকম আঘাত যেন না আসে, গাছ যেন কাটা না হয়, জলনিকাশি ব্যবস্থা ঠিকঠাক করা, সুয়ারেজ ব্যবস্থা ঠিকঠাক করা ইত্যাদি। কিন্তু এই সমস্ত সুপারিশের বিরুদ্ধে গিয়েই এখানে বিকাশ হয়। আর এই সবের পরিণামেই ২০২১-২২ সালের ভয়ঙ্কর ভূমিধস, ঘরবাড়ি দোকানগুলিতে ব্যাপক ফাটল। যার ফলে এই দেড় হাজার বছরের এই নগর সভ্যতা আজ তীব্র সঙ্কটের মুখে।

 

প্র: উত্তরাখণ্ডের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জোশীমঠ-সহ সামগ্রিকভাবে পরিবেশের প্রশ্নটি কতট হাজির ছিল? এখন কতটা উপস্থিত?

 

উ: উত্তরাখণ্ডে পরিবেশের প্রশ্নটি বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে থেকেছে। চিপকো আন্দোলনের কথা আমরা সকলেই জানি, অনেকটা চিপকোর জন্যই পরিবেশের প্রশ্নটি গুরুত্ব পেয়েছে। এমনকি যখন উত্তরাখণ্ড রাজ্যের দাবিতে যে লড়াই তা তৈরির পিছনেও এই জল-জঙ্গল-জমির প্রশ্নটি মূল প্রশ্ন হিসেবে থেকেছে। আর তার সঙ্গে থেকেছে জীবিকার প্রশ্নটিও। উত্তরাখণ্ডে বরাবরের প্রশ্ন হিসেবে পরিবেশ থাকায় আজ সাধারণ মানুষের দিক থেকে দাবি উঠছে ভূমি আইনের; আমাদের জমি, জঙ্গল, জলের উপর আমাদের অধিকার দিতে হবে আর এই পরিবেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আটকানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

তবে হ্যাঁ একথাও সত্যি যে মূলধারার রাজনীতিতে পরিবেশ প্রশ্নটি হাজির থাকলেও রাজনীতিকে নির্ধারণ করার জায়গায় থাকেনি। সোজা কথায় বললে পরিবেশ ইস্যুকে সামনে রেখে কেউ ভোট জিততে পারবে না। জল-জঙ্গল-জমির প্রশ্নকে সামনে রেখে কোনও রাজনৈতিক দল ভোটে লড়েনি। এটা একপ্রকার দুর্ভাগ্যই বটে যে হয়নি, কিন্তু হওয়া উচিত ছিল।

 

প্র: রাজ্যের বেশিরভাগ জমি কাদের দখলে?

 

উ: রাজ্য হওয়ার পর এখানকার অনেক জমিই জমি-মাফিয়াদের হাতে চলে যায়। এর পাশাপাশি বাইরে থেকে আসা পুঁজিপতিরা হাজার হাজার একর জমি কিনে নেয়। জমি কেনার ক্ষেত্রে কোনওরকম নিয়মনীতি এখানে নেই। যে কেউ যেখান থেকে খুশি এসে যত খুশি ইচ্ছে জমি কিনে ফেলতে পারে। বর্তমানে এখানে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ মাত্র ৫% এরও কম। প্রায় ৬৫% জমিই জঙ্গল। হিসেব করে দেখা গেছে পরিবার প্রতি চাষের জমির পরিমাণ ৩-৪ নালিরও (৬০০ স্কোয়ার মিটারের কাছাকাছি) কম। এত কম জমিতে কীভাবে বিকাশের ইমারত গড়া সম্ভব? জমির প্রশ্নটি তাই এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়েছে।

 

অন্যদিকে জঙ্গলের উপরেও মানুষ বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল। চিপকো আন্দোলনের পরে জঙ্গলের অধিকারও সেখানকার মানুষের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তাই এখন জঙ্গলের পুনরাধিকারের দাবিও উঠছে। বর্তমানে যে শাসক দল উত্তরাখণ্ডে ক্ষমতায় আছে অর্থাৎ বিজেপি তারা জঙ্গলবাসী মানুষদের সেখান থেকে তাড়ানোর অভিযান চালাচ্ছে। ফরেস্ট রাইট অনুযায়ী অরণ্যবাসীদের জঙ্গলের উপর অধিকার থাকা সত্ত্বেও তাকে অস্বীকার করেই এই অভিযান চলছে। এমনকি ধর্মের দোহাই দিয়ে অরণ্যবাসী মানুষদের তাদেরই জমি থেকে বেদখল করে দেওয়া হচ্ছে। তবে ইদানীং সেখানকার যুবরা জমির অধিকারের প্রশ্নটি তোলা শুরু করেছে। আশা করি আগামী দিনে জল-জঙ্গল-জমির প্রশ্নটি উত্তরাখণ্ডের রাজনীতিকে নির্ধারণ করার মতো একটি ইস্যু হয়ে উঠবে।

 

প্র: সমস্ত ধরণের বাম দলগুলি পরিবেশের প্রশ্নটিকে একটা সময় অবধি খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি, যদিও গত ৫-১০ বছরে এই দৃশ্যটির বদল ঘটেছে, উত্তরাখণ্ডে বাম দলগুলির ভূমিকা কেমন থেকেছে পরিবেশের প্রশ্নটিকে রাজনৈতিক ভাবে হাজির করার ক্ষেত্রে?

 

উ: দেখুন, এই মুহূর্তে যে যে বামপন্থী দলগুলির উপস্থিতি আছে উত্তরাখণ্ডে যার মধ্যে সিপিআই অনেক আগে থেকে ছিল। এমনকি পূর্বে সিপিআই এর প্রার্থী বিধানসভা ভোটেও জিতেছিল (তখন অবিভক্ত উত্তরপ্রদেশ)। উত্তরকাশী কেন্দ্রে বেশ ভালোভাবেই লড়াই করে খুব সামান্য মার্জিনে হেরেছিল সিপিআই প্রার্থী। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সিপিআই উপস্থিত ছিল বেশ জোরেসোরেই। এমনকি রাজশাহীর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল তাতেও মুখ্য ভূমিকায় ছিল সিপিআই নেতারা। কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজনের পরবর্তীতে সিপিআই(এম)-র একটা বড় পর্যায় ধরে হোল্ড থেকেছে। সিপিআই (এমএল) বিশেষ করে একটি অঞ্চলে জমি দখল করে সাধারণ মানুষদের সেখানে বসবাসের যে আন্দোলন হয় তাতে ভূমিকা নিয়েছিল। আশির দশকেও সিপিআই নেতা গোবিন্দ সিং রাওয়াত পরিবেশকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন তাতে ভূমিকা নিয়েছিলেন। চিপকো আন্দোলনেও সিপিআইয়ের রাজ্য কমিটি আন্দোলনের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে সিপিআই (এম)-এর পক্ষ থেকে পরিবেশকে কেন্দ্র করে লড়াই খুব একটা চোখে পড়েনি। বরং শহরকেন্দ্রিক যা যা প্রকল্পগুলি হয়েছে তাতে শ্রমিকদের ইউনিয়ন (সিটুর ইউনিয়ন) বানিয়ে নেওয়াতে বেশি ঝোঁক থেকেছে। এই যেমন এখন রেলওয়ের প্রকল্প চলছে তো প্রকল্প পরে আসলেও সিটুর ইউনিয়ন ওখানে আগে তৈরি হয়ে গেল। এনটিপিসির যে প্রকল্প সেখানেও সিটুর ইউনিয়ন আছে। কিন্তু পরিবেশকে কেন্দ্র করে কোনও লড়াই গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের খুব বেশি ফোকাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সিপিআই (এমএল)-এর প্রসঙ্গে বললে সেই ২০০৩-০৪ সালের আন্দোলন কিংবা বর্তমানের যে আন্দোলন তা নিয়ে লেখালেখি চলছে, আমার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপা হচ্ছে মুখপত্রে। এমনকি পার্টি কংগ্রেসেও আলাদা করে পরিবেশ ইস্যুটিকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে, ডকুমেন্ট তৈরি হয়েছে, প্রস্তাব এসেছে। সামগ্রিক ভাবে বিশ্বের পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনায় এসেছে সিপিআই (এমএল)-এর দ্বারা। উত্তরাখণ্ডে এই মুহূর্তে পরিবেশ ইস্যুতে সবচেয়ে ভোকাল যাঁরা তাদের মধ্যে সিপিআই (এমএল) অন্যতম।

 

প্র: আমরা আলোচনার প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আমার পরের প্রশ্নটি থাকবে যে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক সময়ই পাহাড়, জঙ্গল, জলকে দেবতার চোখে দেখা কিংবা তাকে মায়ের রূপকে কল্পনা করা, ধর্ম কিংবা সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করার যে ধারণা তা উত্তরাখণ্ডের বাস্তবতায় কীভাবে হাজির?

 

উ: উত্তরাখণ্ডে প্রকৃতির যে ধারণা যা সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগতভাবে হাজির তার প্রাথমিক ধারণাটাই হল প্রকৃতিকে রক্ষা করা। যদিও প্রকৃতি সংরক্ষণের নিয়মগুলি তাদের নিজের নিজের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত। যেমন ধরুন জঙ্গলে যদি যেতে হয় তাহলে রংচঙে কাপড় পরে যাওয়া যাবে না। বিশেষ করে উচ্চ হিমালয়ের অঞ্চলে ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় গেলে খুব চিৎকার করা যাবে না। না হলে যিনি ওখানকার বনদেবী আছেন তিনি নিজের সঙ্গে করে নিয়ে চলে যাবেন, অর্থাৎ জীবন চলে যাবে। এরকম নানান বিশ্বাস সেখানকার মানুষের আছে। এই সমস্ত বিশ্বাসকে খতিয়ে দেখলে দেখা এগুলি সংরক্ষণের সাথে জুড়ে আছে। এবারে আমরা যে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করি বা বলা ভালো পরিবেশ সম্পর্কে যে জ্ঞান আমরা পেয়েছি তার্কিক ভাবে তা আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করার কাজে আমরা ব্যবহার করে থাকি। আর এই পুরানো ঐতিহ্য ও বিজ্ঞানের জ্ঞানের মধ্যে সেভাবে দেখলে কোনও দ্বন্দ্ব কিন্তু নেই। এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য হওয়াও সম্ভব। অর্থাৎ আমাদের পুরানো যে ঐতিহ্যগত বিশ্বাস যার মাধ্যমে জঙ্গল-পাহাড় রক্ষার উপাদান আছে এবং বিজ্ঞানের দ্বারা কারিগরির দ্বারা যে জ্ঞান আমাদের আছে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এই দুইয়ের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানোই জরুরি বলে মনে হয়। বরং সেই সমস্ত মানুষদের আমাদের এটা বোঝানোর প্রয়োজন আছে বনদেবী কাউকে নিয়ে যায় না, জঙ্গল না থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা পাহাড়-জঙ্গলের সঙ্গে জুড়ে আছি, আমাদের অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়বে।

 

প্র: শেষ প্রশ্ন, জোশীমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতির পক্ষ থেকে আপনারা যে দাবিগুলি রেখেছেন সরকারের কাছে তার কয়েকটা দাবি যদি তাৎক্ষনিক বিচারে সরকার পূরণ করেও দেয়, তাতে কী এই সমস্যার সমাধান মিলবে? দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনা আছে আপনাদের?

 

উ: এটা ঠিকই যে জোশীমঠ থেকে এই লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়েছে। কিন্তু আমাদের লড়াই শুধুমাত্র জোশীমঠেই সীমাবদ্ধ নয়। গত ২০-২২ বছরে রাজ্যে যখনই কোথাও বিদ্যুৎ প্রকল্প হয়েছে, যেখানেই সাধারণ মানুষ ও পরিবেশের উপর আক্রমণ নেমেছে, অন্যায় হয়েছে সেখানে সেখানে আমরা লড়াই করেছি, রুখে দাঁড়িয়েছি। জোশীমঠের লড়াইয়ের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে চেতনার সঞ্চার ঘটেছে এমনকি আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে কলকাতায় এসেছি সেখানে একটাই কথা বলব যে জোশীমঠ তথা হিমালয় শুধুমাত্র হিমালয়বাসীদের নয়, আমাদের সকলের। আমাদের দেশের, গোটা বিশ্বের সম্পদ। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হিমালয়কে বাঁচানোর। এই আশা ভরসা, কিছু কথা ও অভিজ্ঞতা নিয়েই আমি এসেছি। আমরা যাতে সরকারের কাছে চাপ তৈরি করতে পারি এমন নীতি বানানোর যাতে আমাদের হিমালয় বাঁচে, পরিবেশ বাঁচে তথা পৃথিবী বাঁচে। সরকার দাবি পূরণ করবে কি করবে না জানি না, কিন্তু আমাদের লড়াইটা দীর্ঘমেয়াদী, এটা জেনেই আমরা এই লড়াইতে নেমেছি।

 

পড়ে দেখুন : 

Fragile geomorphology, and unplanned uncontrolled infrastructure development are key to Uttarakhand disaster

 

Share this
Leave a Comment