নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের টাকায় ক্ষতিপূরণ ‘মেলা’ 


  • June 7, 2023
  • (0 Comments)
  • 1179 Views

এই যে বাহানাগা-কাণ্ডে ক্ষতিপূরণের অর্থ, তা আসবে কোথা থেকে? মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে কি দেওয়া হচ্ছে অর্থ? অর্থ দপ্তর কি টাকা মঞ্জুর করেছে? এর উত্তর হল—না। কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার্স ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি এবং নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল বোর্ডের সদস্য দেবাঞ্জন চক্রবর্তী জানান, “নিহতদের পরিবার এবং আহতদের যথাক্রমে যে পাঁচ লক্ষ ও এক লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, তা আসবে নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল থেকে। যা সম্পূর্ণ ভাবে বেআইনি।” দেবাশিস আইচের রিপোর্ট।

 

এখনও নিষ্প্রাণ দেহ ফিরছে ঘরে। ভয়াবহ স্মৃতি ও শারীরিক আঘাত নিয়ে ফিরছেন আহতরা। এখনও নিখোঁজের জন্য কন্টেনার মর্গে লাশ হাতড়াচ্ছেন আত্মজনেরা। এরই মাঝে ক্ষতিপূরণের ‘মেলা’ বসানোর তোড়জোড় সম্পূর্ণ। যদিও নিহত ও আহতদের পূর্ণ তালিকা হাতে আসার আগেই স্থির করা হয়েছিল, ৭ জুন কলকাতার ইন্ডোর স্টেডিয়ামে নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং আহতদের হাতে ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দেবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং, সদ্য বিধবা বধূ, সন্তানহারা পিতা-মাতা, পিতৃহীন পুত্র-কন্যারা একে একে সারি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে গ্রহণ করবেন অনুগ্রহ। কলকাতাই কেন? পাল্টা প্রশ্ন হতে পারে কেন কলকাতা নয়? গ্রাম ছেড়ে নগরের দিকেই ধাবমান যে অজস্র অদৃশ্য মানুষ, একমাত্র বিপর্যয়ই যাঁদের দৃশ্য করে তোলে, তাঁদের দৃশ্যমানতা আরও বাড়িয়ে তুলতে হলে মহানগরই আদর্শ মঞ্চ—সে নিন্দুকরা যতই বলুক না কেন দয়া, দাক্ষিণ্য, সহমর্মিতার নামে এ এক নিষ্ঠুর দেখনদারি।

 

এতো গেল একটা দিক, অন্য দিকটা হল, এই যে বাহানাগা-কাণ্ডে ক্ষতিপূরণের অর্থ, তা আসবে কোথা থেকে? মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে কি দেওয়া হচ্ছে অর্থ? অর্থ দপ্তর কি টাকা মঞ্জুর করেছে? এর উত্তর হল—না। কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার্স ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি এবং নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল বোর্ডের সদস্য দেবাঞ্জন চক্রবর্তী জানান, “নিহতদের পরিবার এবং আহতদের যথাক্রমে যে পাঁচ লক্ষ ও এক লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, তা আসবে নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল থেকে। যা সম্পূর্ণ ভাবে বেআইনি।” একে পরের ধনে পোদ্দারি বললে বোধহয় ভুল বলা হবে না। আর এতো নতুন কিছু নয়। এমনটা হয়েই চলেছে। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দেন এবং আধিকারিকরা মুখ্যমন্ত্রীর কথা রাখতে গিয়ে যাবতীয় বেআইনি পথে অর্থ জোগাড়ের ফন্দিফিকিরের সন্ধান দিয়ে যান। এই যে অভিযোগ উঠেছিল, বগটুই গণহত্যার ক্ষতিপূরণের অর্থ এসেছিল মিড ডে মিল তহবিল থেকে, নীরবতা দিয়েই তা এক রকম স্বীকার করে নিয়েছে সরকার। আধিকারিকরা ঠারেঠোরে জানিয়েও দিয়েছিলেন এমনটাই ঘটেছে। এতো ছোট ছোট দুঃস্থ শিশুদের খাবার থালায় থাবা মারা। আমরা এতটাই দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে উঠতে পেরেছি যে, আদালতে যাওয়া দূরে থাক, মৌখিক প্রতিবাদটুকুও করে উঠতে পারলাম না।

 

নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের টাকা এই প্রথম সরানো হল তা নয়। ২০২০-২১ রাজ্য বাজেটের আগে এই তহবিল থেকে দু’দফায় ১৪০০ কোটি টাকা সরকার তুলে নেয়। এ বিষয়ে ‘কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড’-এর চরম আপত্তি সত্ত্বেও অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বোর্ডের সদস্যদের অনুমান ছিল, বাজেটে অর্থসংস্থান বাড়িয়ে কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার জাতীয় প্রকল্পগুলিতে টাকা ঢালার জন্যই এমনটা করা হয়েছে। জানা গিয়েছে, সে টাকা ফেরত আসা দূরে থাক, সুদটুকুও দেওয়া হচ্ছে না।

 

লকডাউনের সময় কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন রাজ্য নিজেদের ‘বিল্ডিং অ্যান্ড অদার কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের হাতে থাকা নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের জমা অর্থ থেকে রেজিস্ট্রিকৃত নির্মাণ শ্রমিকদের ১০০০ থেকে ৫০০০ টাকা আর্থিক সাহায্য দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক পয়সাও দেয়নি। উলটে সেই তহবিল ভেঙে রাজ্যের নথিভুক্ত অসংগঠিত শ্রমিক, যাঁরা রাজ্য সরকারের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আওতায় আছেন সেই ১ কোটি ২০ লক্ষ শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১০০০ টাকা এককালীন সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এর মধ্যে নির্মাণ শ্রমিক ছাড়াও পরিবহন, বিড়ি শ্রমিক, দর্জি এমন নানা পেশার শ্রমিকদের যুক্ত করা হয়। এখানেই শেষ নয়, দেবাঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারের চা বাগানগুলিতে শিশুদের জন্য ক্রেশ এবং শ্রমিকদের জন্য হেলথ সেন্টার গড়া হবে বলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে ৩০০ কোটি টাকা সরানো হয়েছে। সরকারের অজুহাত চা শ্রমিকরা সব নির্মাণ শ্রমিক হয়ে যাচ্ছেন তাই এই তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে। দেবাঞ্জনবাবু বলেন, বাগানে ক্রেশ ও হেলথ সেন্টার গড়ার দায়িত্ব বাগান মালিকদের। সেখানে আজব অজুহাত দিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের তহবিলের অর্থ নয়ছয় করা হচ্ছে।

 

আইন অনুযায়ী ১০ লক্ষ টাকার নির্মাণ প্রকল্পের উপর এক শতাংশ হারে সেস বসিয়ে যে অর্থ আদায় হয় তা এই শ্রমিক তহবিলে জমা করা হয়। এই অর্থ শুধুমাত্র নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়। এই মুহূর্তে তহবিলে রয়েছে ৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। রাজ্যে নির্মাণ শিল্পে নথিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা ৩১ লক্ষ ৯৭ হাজার। এই অর্থে নির্মাণ শ্রমিকরা দুর্ঘটনাগ্রস্ত হলে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া মহিলা শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন আর্থিক সহায়তা, সন্তানদের পড়াশোনায় সাহায্য করা হয় এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করার সংস্থান রয়েছে। এবং তা কোনও ভাবেই অন্য কোনও প্রকল্পে খরচ করা যায় না। ক্যাগ কিংবা সুপ্রিম কোর্ট বার বার পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্যান্য রাজ্যগুলিকে তহবিলের অর্থ নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণে খরচ না করার জন্য তুমুল সমালোচনা করেছে। এর পরও টনক নড়েনি রাজ্য সরকারের।

 

বাহানাগা বিপর্যয়ে এককালীন ক্ষতিপূরণ ছাড়াও রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিহত বা আহত না হলেও আতঙ্কগ্রস্ত যাত্রীদেরও এককালীন ১০ হাজার টাকা এবং আগামী তিন মাস পরিবারগুলিকে তিন হাজার টাকা দেওয়া হবে। সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী এ টাকা আসবে রাজ্যের ৩৮ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্যের জন্য সদ্য গঠিত শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের তহবিল থেকে? প্রশ্ন উঠেছে, সকল আতঙ্কগ্রস্ত যাত্রীরাই কি পরিযায়ী শ্রমিক? দ্বিতীয়ত, আতঙ্কগ্রস্তদের চিহ্নিত করে তাঁদের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে তিন মাসে ন’হাজার টাকা ধরিয়ে দিলেই তাঁরা সব ট্রমা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন? না কি এ সবই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে সহানুভূতির রাজনীতি? আরও প্রশ্ন, যেখানে পরিযায়ী শ্রমিক উপভোক্তাদের এখনও চিহ্নিতকরণ বা নথিভুক্ত করার কাজই শুরু করা গেল না, সেখানে এমন এক সিদ্ধান্ত কেন? এই অর্থই বা কোথা থেকে আসবে? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই টাকার সংস্থানের জন্য সম্ভবত নির্মাণকর্মীদের তহবিল ভাঙা হবে। দেবাঞ্জন জানান, বার বার বোর্ডের শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা আপত্তি জানালেও সরকার কোনও কথা শুনছে না। বিভিন্ন খাতে জোর করে টাকা সরিয়ে নিচ্ছে। আমরা এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আদালতে যাব।

 

Share this
Leave a Comment