মার্কসবাদের নির্মাতারা মার্কসের বহুবিধ বিচিত্র, এমনকি পরস্পরবিরোধী ভাবনাচিন্তা থেকে নিজেদের প্রয়োজনমতো গুটিকয়কে চয়ন করে সেগুলোকে “বৈজ্ঞানিক সত্যের’ বিভূতিতে ভূষিত করে তাঁদের মতবাদিক কাঠামোর ভিত্তিমূলক স্বতঃসিদ্ধে পরিণত করার মধ্য দিয়ে মার্কসের খ্যাতিকে হয়ত বাড়িয়েছেন, কিন্তু তাঁর মনোভাব ও চর্চাপদ্ধতিকে বিসর্জন দিয়েছেন। মার্কসবাদী মতবাদকাঠামোর ভিত্তিমূলক স্বতঃসিদ্ধগুলোকে সংশয়ের চোখে দেখা বা এমনকি বাতিল করার মধ্য দিয়ে তাই মোটেই মার্কসকে বিসর্জন দেওয়া হয় না, বরং তাঁর সংশয়ী চর্চায় ফিরে গিয়ে হয়ত তাঁর উপর মার্কসবাদীদের করা অবিচারের কিঞ্চিৎ সংশোধনের পথ খোলা যায়। লিখলেন বিপ্লব নায়ক।
১
মার্কসবাদীদের কাম্য এমন একটা বিপ্লব যা পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে পুঁজিবাদী (এবং স্থানবিশেষে প্রাক-পুঁজিবাদী) উৎপাদনী সম্পর্কের সঙ্গে বিরোধের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করে তার অবারিত বিকাশের মুখ খুলে দিতে পারে। মার্কসবাদী তত্ত্ব বলে মে উৎপাদনী শক্তির এই অবারিত বিকাশ সমাজতান্ত্রিক সমাজের বস্তুগত ভিত্তি তৈরি করবে, যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে শেষাবধি নানা উত্তরণপর্ব পেরিয়ে সেই কাম্য সমাজে পৌঁছানো যাবে যেখানে প্রত্যেকে (সেমাজকে) দেবে (অর্থাৎ উৎপাদনী শ্রম করবে) তার সাধ্য অনুযায়ী এবং নেবে (অর্থাৎ ব্যবহার্য বস্ত নেবে) তার চাহিদা অনুযায়ী। চাহিদার অন্তহীন বৃদ্ধির প্রবণতাকে এখানে সদর্থকভাবে দেখা হয় কারণ একদিকে যেমন তা উৎপাদিকা শক্তির অন্তহীন বিকাশের তাগিদকে ত্বরাণ্বিত করে, অন্যদিকে ব্যবহার্য বস্তুর প্রতুলতা মানব জীবন ও যাপনকে ঋদ্ধতর উন্ন ততর করে তোলে বলে মনে করা হয়।
কিন্তু উপরোক্ত ধারণগাগুলো এখন বাস্তব সংকট পেকে ওঠার মধ্য দিয়ে প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদের মধ্যে চলা উৎপাদনী শক্তির বিকাশ গোটা বিশ্বের বস্তগত উৎপাদনকে যে মাত্রায় তুলে নিয়ে গেছে সেখানে দুটো সংক্টবিন্দু গভীর থেকে গভীরতর ক্ষতের আকার ধারণ করছে –
১) পৃথিবীর সমস্ত জৈব ও অজৈব উপকরণকে উৎপাদনের কাঁচামালে পরিণত করে তাদের নিষ্কাশন ও ব্যবহার আরো ব্যাপ্ত আরো দ্রুত করতে থাকার মধ্য দিয়ে বহু উপকরণকে তা নাটকীয় দ্রুততায় নিঃশেষিত করে ফেলার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে যা প্রাকৃতিক বাস্ততত্ত্রকে ক্ষয়গ্রস্থ করে ভেঙে পরার নজিরবিহীন বিপদের মধ্যে এনে ফেলেছে। এই হারে আর কএক দশক চললে পৃথিবির বিস্তীর্ণ অঞ্চল এগোবে। কোনো মনুষ্যকল্পিত “উন্নততর বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি” এর অন্যথা করতে পারবে না কারণ প্রাণধারণের যোগ্য হয়ে ওঠার প্রাকৃতিক বহু বহু হাজার বছর ধরে জটিল প্রাকৃতিক বছরে বা কয়েকশো বছরেও কৃত্রিম মনুষ্যকৃত উপায়ে তা গড়ে তোলা যায় না। সুতরাং পৃথিবীকে সমাজতন্ত্রের সংসার পাতার মূঢ় কল্পসুখকল্পনাকে যদি আমরা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হাজির না করতে চাই, তাহলে পুঁজিবাদে চলতে থাকা উৎত্পাদনী শক্তির বিকাশকে অবারিত করার আকাঙক্লা আমাদের বর্তনে করতে হবে।
২) পুঁজিবাদে উৎপাদনী শক্তির বিকাশ শহরভিত্তিক বৃহৎ শিল্পোৎপাদনে (big industries/large-scale industries) বস্তুগত উৎপাদনকে কেন্দ্রীভূত করে ও তার চাহিদামতো বনসম্পদ-প্রাণসম্পদ-খনিসম্পদ দখল-খনন- আহরণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেই প্রক্রিয়াজাত মে পরিমাণ বর্জ্য ক্রমবর্ধমান হারে বমন করে যাচ্ছে, তা-ও প্রকৃতি-পরিবেশের সংকট ঘনিয়ে তুলছে। উদাহরণস্বরূপ কার্বন নির্গমন ও তজ্জনিত বিশ্ব উষ্ণায়নের সমস্যার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অব্যাহত রেখে কোনো প্রমুক্তি বা সংস্কার যে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে না তা গত অর্ধশতক জুড়ে কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণের বিবিধ বেকার চেষ্টা ও কার্বন-ট্রেডিং নামক জালিয়াতির ছড়িয়ে পড়াই প্রমাণ করে।
পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র নিয়ে মার্কসের নিজের লেখার আমরা যতটুকু পাই, সেখানে তিনি বলেছিলেন যে পুঁজিবাদ মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যের জৈবিক সম্পর্কটিকে ভেঙে দিয়ে এক বিপাকীয় ফাটল তৈরি করে যা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রগত সংকটকে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানের চেষ্টার মাধ্যমে একটা ক্ষেত্র থেকে আরেকটা ক্ষেত্রে স্থানান্তরিতই করে মাত্র, সমাধান করতে পারে না, বরং ক্রমশ আরও গভীর করে তোলে। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মান্য মার্কসবাদের সংস্করণে মার্কসের এইরূপ চিন্তাগুলি কোনো স্থান পায়নি। তার কারণ বোধহয় এই যে এই চিন্তা পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অবারিত করার অপর মার্কসীয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সংশয়ের জন্ম দেয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অভিপ্রেত ছিল যেহেতু এমন এক সংশয়-বর্জিত মার্কসবাদ যা অতিনিশ্চয়তার সঙ্গে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হাজির করে অনুসরণকারীকে ‘সর্ব-জ্ঞানের চূড়ান্ত ঘনরূপটির (বা বটিকাটির)’ অধিকারী হিসেবে সর্ব সংশয় থেকে মুক্তি দেয়, তাই তাঁরা বিপাকীয় ফাটল সম্পর্কিত ধারণাকে নির্বাসন দিয়ে পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের বস্তুভিত্তি গড়ার কর্তব্যকে প্রশ্নহীন করে হাজির করেছিলেন। যে লেনিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়াকে সাধারণত মার্কসবাদী তত্ত্ব প্রয়োগচর্চার সর্বোৎকৃষ্ট ঐতিহাসিক উদাহরণ হিসেবে গণ্য হয়, সেখানেও তাই পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশসাধনের উপর নিঃসংশয় জোর দেওয়া হয়েছিল, শহরকেন্দ্রীক বৃহৎ শিল্পোৎপাদনে বস্তুউৎপাদন কেন্দ্রীভূত করাকেই বিপ্লবী কর্তব্য হিসেবে ধার্য করা হয়েছিল, এমনকি পুঁজিবাদী দেশে বিকশিত উৎপাদন-ব্যবস্থাপনার উপায়কে (তৎকালীন বিশ্বে টেলরইজম নামে পরিচিত) প্রশ্নহীনভাবে অনুসরণ করার নির্দেশ জারি হয়েছিল। পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অবারিত করার কর্তব্য বর্জন করতে হলে তাই মার্কসবাদের মান্য বা প্রমিত রূপটিকেও ‘মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান কারণ ইহা সত্য’- এই সুরক্ষাবলয়ের বাইরে বের করে এনে নির্দ্বিধ সমালোচনাত্মক বিচারের মধ্যে দিয়ে অন্যতর ভাবনার বিকাশের পথ খোলার চেষ্টা করা দরকার।
২
উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশের প্রয়োজনীয়তা হাজির করা হয় এদিক থেকে যে তা সমাজতান্ত্রিক সমাজের বস্তুগত ভিত্তি তৈরি করে, কেননা যার যেমন চাহিদা তাকে তেমন (ব্যবহার্য বস্তু) দিতে হলে উৎপাদনকে যে শিখর থেকে উচ্চতর শিখরে তুলে নিয়ে যাওয়া চাই তা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকেও শিখর থেকে উচ্চতর শিখরে বিকশিত করা ছাড়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ, আমাদের চাহিদা সীমাহীনভাবে বাড়তে হলে উৎপাদনী শক্তিকেও সীমাহীনভাবে বাড়তে হবে। আর আমাদের চাহিদা সীমাহীনভাবে বাড়া জরুরী কেন? কারণ মনে করা হয় যে চাহিদার বৃদ্ধি হল উন্নততর ও পূর্ণতর জীবন ও যাপনের লক্ষণ, বা অন্ততপক্ষে তার আকাঙ্ক্ষার লক্ষণ। এখন এই বিষয়টিকে বিচার করে দেখা যাক।
চাহিদার বৃদ্ধি মানে উন্নততর জীবনের জন্য আকাঙ্খা এবং তদনুযায়ী পরিমাণে ও রকমে ভোগ্যবস্ত আহরণ ও ব্যবহার বাড়ার মধ্য দিয়ে জীবন ও যাপনের মান উন্নততর হয় – সত্যিই কি তাই? ভোগ্যবস্তর চাহিদা সেই ভোগ্যবস্ত পাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়না, বরং ঘিয়ের ছিটে দেওয়া আগুনের মতো আরো তীব্র হয়ে ওঠে। একই ভোগ্যবস্তু আরো বা নতুনতর ভোগ্যবস্তুর জন্য অকাঙ্ক্ষা প্রকট হয়। ফলত তা কোনো আকাঙ্ক্ষাতৃপ্তির বোধে পৌঁছে দেয়না, বরং তা নিরন্তর ভোগবুভুক্ষার এক তাড়নাগ্রস্ত অতৃপ্ত অস্তিত্বে বেঁধে রাখে। সেই তাড়না জন্ম দেয় অসংখ্য বিকারের, যেমন, ভোগব্যয় মেটানোর জন্য যে কোনো ভাবে হোক উপার্জনবৃদ্ধির পিছনে ছুটে নিঃশেষিত হওয়ার বিকার, সংবেদনহীন ভোগপ্রদর্শনীর প্রদর্শন ও আস্ফালন দিয়ে আত্মগরিমা জাহির করার অসুখ, ইত্যাদি। এই তাড়নগ্রস্ত অসুস্থ অস্তিত্বকে নিশ্চয়ই উন্নততর জীবন ও যাপন বলব না।
পুঁজিবাদের সঙ্গে এই তাড়নাগ্রস্ত অসুস্থ যাপনের কী সম্পর্ক তা নিয়ে মার্কস নানা ক্ষুরধার বিশ্লেষণ করে গেছেন। তার অন্যতম হল পণ্যভক্তিবাদ (commodity fetishism) নিয়ে তাঁর আলোচনা। মার্কসের আলোচনা অনুসরণ করলে বলা যায় যে সমাতজভুক্ত প্রত্যেক মানুষের জীবন অপরাপর মানুষদের সঙ্গে তার উৎপাদনী শ্রম ভাগ করে নেওয়ার সহযোগিতামূলক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই বাস্তব নির্ভরশীলতা আড়ালে চলে গিয়ে উপলব্ধির নাগালের বাইরে চলে যায় যখন পুঁজিবাদী সমাজে পণ্যবিনিময়-পণ্যআহরণের মধ্য দিয়ে গোটা সামাজিক সম্পর্ককে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা মানুষ পণ্যকেই দেখতে শুরু করে তার একমাত্র প্রয়োজনের বস্তু হিসেবে এবং তা আহরণের জন্য অন্য পণ্য বা অর্থ নিজ দখলে পুঞ্জীভূত করাকেই যথেষ্ট মনে করে। এর মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের বাস্তব সম্পর্ক আড়ালে চলে যায়, তা চেতনায় প্রতিস্থাপিত হয় পণ্যের সঙ্গে পণ্যের সম্পর্ক দিয়ে। পণ্যই জীবনের ও যাপনের উৎকর্ষের বা অপকর্ষের কারণ হিসেবে প্রতিভাত হতে থাকে।
এই পণ্যভক্তিবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিস্তৃতি ও গভীরতালাভের সঙ্গে সঙ্গে সর্বাত্মক আধিপত্য বিস্তার করে। সেই আধিপত্যের কাছেই চেতনাকে বন্ধক রাখা হয় না কি যখন ভোগ্যবস্তুর প্রতুলতা/অপ্রতুলতার উপর জীবন ও যাপনের উৎকর্ষ/অপকর্ষকে নির্ভরশীল বলে ভাবা হয়? যে সমাজতন্ত্রমুখী উত্তরণকালীন সমাজে পণ্যের বিলোপসাধনের প্রক্রিয়া সূচিত হওয়ার কথা, সেই সমাজে যখন জীবন ও যাপনের উন্নতির জন্য পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠিত পথেই বস্তু উৎপাদনকে আরো আরো বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে চাহিদা পূরণ ও সম্প্রসারণের কথা বলা হয়, পুঁজিবাদী দেশগুলোর সমস্তরে পৌঁছে তাকে ছাপিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঘোষিত হয়, তখন সামাজিক সম্পর্ক ও জীবন সম্পর্কে পণ্যভক্তিবাদী মনোভাবের ধারাবাহিকতা কি পণ্যবিলোপের বিপরীত পথেই হাঁটে না?
তাছাড়া একটি বস্তুগত সীমার প্রশ্নও এই একুশ শতকে এসে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পশ্চিম ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার কোনো নাগরিকের এখন যে প্রাত্যহিক গড় ভোগ-চাহিদা, সেই মাপে পৃথিবীর বর্তমান সমস্ত মানুষকে তুলে আনতে হলে সেই চাহিদা পূরণের জন্য কাঁচামাল যোগান দিতে একটি পৃথিবী নয়, খান-দশেক পৃথিবী কয়েক দশকের মধ্যেই নিঃস্ব পতিতভূমিতে পরিণত হবে। সুতরাং চাহিদা ও ভোগবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সামূহিক জীবন ও যাপনের ‘উন্নতিসাধন’ বস্তুগতভাবেও অসম্ভব। বরং তার বিপরীতটাই বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। মানুষ যদি গোটা পৃথিবীর বাস্ততন্ত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক অবিমৃষ্যকারী প্রজাতি হিসেবে নিজেদের যাত্রা শেষ না করতে চায়, তবে মানুষকে তার চাহিদা ও ভোগ বাড়ানোর বদলে ব্যাপকভাবে কমাতে হবে এবং ভোগবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সুখের আলেয়ার পশ্চাদ্বাবন করার বদলে জীবনের উৎকর্ষ/তাৎপর্য সম্বন্ধে বিকল্প ধারণার সন্ধান করতে হবে। পৃথিবীর সমস্ত জৈব ও অজৈব উৎপাদন, সমস্ত অন্যান্য প্রাণীপ্রজাতি কেবল মানুষের বস্তু-উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে মানুষের ভোগচাহিদা মেটানোর জন্যই উৎসর্গিত, এই স্থূল সংকীর্ণ কর্তৃত্ববাদী অহমিকা ছেড়ে মানুষকে প্রকৃতির অন্য সমস্ত বস্তু ও প্রাণের সঙ্গে নিজের জৈবিক সম্পর্কবন্ধনটিকে পুনরাবিষ্কার করতে হবে। কোনও এক কল্পসুখস্বর্গে (অর্থাৎ সমাজতন্ত্রে) পৌঁছানোর পর আপনা থেকেই (অর্থাৎ সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তনের ফলস্বরূপ) এই সব হয়ে যাবে এমন ছদ্মনিশ্চয়তা নিয়ে আমরা যদি কেবল ওই অর্থনৈতিক “উন্নতি” বা পরিবর্তনসাধনেরই করণিকগিরি করি তাহলে কল্পসুখস্বর্গে পৌঁছানোর বদলে পুঁজিবাদের গর্ভেই চরকিপাক ঘুরে যাব। সুতরাং পুঁজিবাদের বিরোধিতা বা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে কোনো প্রচেষ্টায় আজই পণ্যভক্তিবাদ ও মানুষের প্রজাতিগত অন্ধ অহংকারকে বর্জন করে বিকল্প ভাবনা-অবস্থানে পৌঁছানোর তাত্ত্বিক-ব্যবহারিক সংগ্রাম জারি করা দরকার। মান্য মার্কসবাদের স্থুল-বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তার বস্তুবাদের দোহাই দিয়ে এসবকিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে নারাজ। তাই মান্য মার্কসবাদ পুঁজিবাদ-বিরোধিতাকে কেবল একটি পার্টির কর্মসূচী নির্ধারণের পরিসরে সীমায়িত করে দিয়েছে, জীবন ও যাপনের বহুভাঁজ পরিসরে পুঁজিবাদ-বিরোধিতার সমস্ত অতি জরুরী প্রশ্নগুলোই ‘এখন বিবেচ্য নয়?’-এর পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। তাই তা এত যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ সম্পর্কে মার্কসের সমালোচনাত্মক বিচারে আমরা সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া আবেগের স্ফুরণ দেখতে পাই, অথচ তাঁর নাম করে, তাঁর উত্তরাধিকার বওয়ার আছিলায়, তাঁর চিন্তার “বিশুদ্ধতা” রক্ষার ছলে প্রচলিত ঘরানার মার্কমবাদীরা বিমূর্ত কিছু ধূসর ফরমুলার স্তোত্রকারী হিসেবে নিজেদের ক্রমশঃ এক মতবাদসর্বম্ব আচার-অনুষ্ঠান-পালনকারী প্রাণহীনতায় নিমজ্জিত করছে।
৩
মার্কসবাদের মতবাদিক গঠনকাঠামোয় সমাজবিকাশের ধারা বা প্রগতি সম্পর্কে তত্ত্ব অন্যতম প্রধান খুঁটি হিসেবে বিরাজমান। এই তত্ত্বানুষায়ী সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিকে হাজির করা যায় একটি সারণির আকারে। সারণিটি এইরকম:
সারণির দুদিকের মধ্যে একদিককে “অনুন্নত” আর অপরদিককে “উন্নত” বলে নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে যেমন দুদিককে একটা আপেক্ষিক তুলনামূলক নিকৃষ্ট-প্রকষ্ট সম্পর্কে বাঁধা হয় (যেমন: সভ্যতার তুলনায় প্রকৃতি নিক্ষ্ট, ইওরোপীয় সভ্যতার তুলনায় ইওরোপ-বহির্ভূত সভ্যতা নিকৃষ্ট, ইত্যাদি) তেমনই কাঙ্খিত পরিবর্তন বা বিবর্তনের একটি ক্রমকে স্বাভাবিক হিসেবে হাজির করা হয় (যেমন: প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ/আধিপত্য কায়েম করে সভ্যতায় ‘বিবর্তিত’ হওয়া, ইওরোপ বহির্ভূত সভ্যতা থেকে বিবর্তিত হয়ে ইওরোপীয় সভ্যতায় “উন্নত” হওয়া ইত্যাদি)। এই পরিবর্তন বা বিবর্তনের একধরনের ক্রম হাজির হয়, যেমন:
ক্রম ১: বনাঞ্চল – গ্রাম – নগর
ত্রম ২: অরণ্য/চারগভূমি – কৃষিক্ষেত্র – কল-কারখানা
ক্রম ত: শিকার-সংগ্রহজীবিকা/পশুচারণ – কৃষিকাজের অর্থনীতি – শিল্প-অর্থনীতি
ক্রম ৪: বনবাসী শিকারী/সংগ্রহজীবী – কৃষক – শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক/কর্মচারী/আধিকারিক
ক্রমোন্নতির স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ ক্রম হিসেবে, অর্থাৎ যে কোনও সমাজের বিকাশের স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে এটি উপস্থিত হয়।
এই বিশ্ববীক্ষাকে এর ঐতিহাসিক উৎস বা জন্মসূত্রের সূত্রে আমরা ‘পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’ বলতে পারি। পশ্চিম ইওরোপে তথাকথিত “শিল্পবিপ্ল ও পুঁজিবাদী শিল্পোৎপাদন জুড়ে এই বিশ্ববীক্ষা দানা বেঁধেছিল। প্রকৃতিকে কেবলমাত্র কাচামালের ভাণ্ডার হিসেবে গণ্য করে কীভাবে তা আরও দ্রুত ও আরও ব্যাপক ভাবে নিঙড়ে নিয়ে শিল্পোৎপাদন যজ্ঞকে অন্তহীন বিস্তারের পথে ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটাই হয়ে উঠেছিল চালিকাশক্তি। প্রথমে পশ্চিম ইওরোপের দেশগুলোর মধ্যের গ্রামীণ সংস্কৃতি এর ধাক্কায় ভেঙে পড়েছিল, গ্রামের মানুষ দলে দলে সর্বহারা আশ্রয়হীন ভবঘুরে, হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছিল আর তাদের সহায়সম্বল প্রকৃতির সমস্ত ধনকে নিঙড়ে, উপড়ে, পুঞ্জীভবন করে যন্ত্র-শিল্পোৎপাদনের ভিত পাতা হয়েছিল। তারপর এই পাশ্চাত্য দেশগুলির উপনিবেশ বিস্তারের মধ্য দিয়ে ক্রমে এই প্রক্রিয়া অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী সমাজ-সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করার কাজে ইওরোপীয় উপনিবেশ-বিস্তারকদের গোলা-বারুদ-বন্দুকের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি লাখ লাখ আদিবাসীদের “শিকার” করে জনজাতির পর জনজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সেই মূগয়াক্ষেত্রে পশ্চিম ইওরোপের প্রতিবিম্ব হিসেবে “নয়া আধুনিক সমাজের” পাট বসিয়েছিলেন ইওরোপীয় দখলদাররা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে, আফ্রিকা মহাদেশে এবং ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে। মানুষ মারার অস্ত্রকে অত্যুন্নত করে ও মানুষ মারাকে নিঃসংকোচ করে মহাদেশের পর মহাদেশে দখলদারি কায়েম করা এই পশ্চিমী ইওরোপীয়রা নির্ধারণ করলেন যে তাদের এই ‘সাফল্যের’ কারণ তাঁদের নিজ সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্টতা। অর্থাৎ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও অসংখ্য দ্বীপপুঞ্জের জনজাতিরা তাঁদের খুনে আক্রমণের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এই কারণে যে সেই সব জনজাতিগুলো ছিল পশ্চাৎপদ, সেই সব জনজাতিদের সভ্যতা ছিল নিকৃষ্ট মানের। অর্থাৎ, পশ্চিমা ইওরোপীয়রা এই অসংখ্য মানুষকে খুন করে, মানবসমাজ-সভ্যতার এই অসংখ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপকে ধ্বংস করে আসলে সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্ট রূপটাকেই প্রতিষ্ঠিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করছেন! (এভাবে যুক্তিনির্মাণ করার মধ্য দিয়েই বুঝি কোনও খুনি স্বভাবঘাতক হয়ে ওঠে!)
এভাবে এক উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামোয় সাজিয়ে মানবসমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপকে দেখাটাকেই “স্বাভাবিক” বলে হাজির করেছে এই বিশ্ববীক্ষা। এই নির্মিত “স্বাভাবিকতা” অনুযায়ী পশ্চিম-ইওরোপীয় সমাজ-সংস্কৃতি উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামোর শীর্ষে অবস্থিত এবং অন্যান্য সমাজ-সংস্কৃতিগুলো “অনুন্নতি”-র বিভিন্ন চিহ্ন বহন করে তলাকার ধাপগুলোয় ত্রমবিন্যস্ত। আর এই ধাপবন্দি কাঠামোর গতিসূত্র হলো অনুন্নতি থেকে উন্নতির দিকে যাত্রা। ফলে অন্য সমস্ত সমাজ-সংস্কৃতি নিজেকে লোপ করার মধ্য দিয়ে পশ্চিম-ইওরোশপীয় সমাজ-সংস্কৃতির অনুকরণে নিজেকে পুনর্বিন্যস্ত করবে, এটাই হলো নিয়ম। আর এই নিয়ম অনুযায়ী গতিকে ত্বরাণ্বিত করার জন্য কিছু গাজোয়ারি-খুনখারাপি-ধ্বংস-তাগুব চালাতে হলে সংকোচের কিছু নেই কারণ লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে সঠিক-বেঠিক আলোচনার কি কোনও মানে হয়? এই বিশ্ববীক্ষাকে জপের মালা করেই চলেছে কালাপাহাড়ি তাণ্ডব। বিভিন্ন আদি জনজাতির প্রকৃতিলগ্ন সমাজ-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে, তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অধিকার খর্ব করে জল, জঙ্গল, জমি, মাটি, মাটির তলদেশ সমস্তকিছু গোষ্ঠীগত অধিকার বা গোষ্ঠীগত মালিকানা থেকে কেড়ে নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধীনে দখল করা হয়েছে – যে ব্যক্তি বা রাষ্ট্র সেই সম্পদ নিঙড়ে বাণিজ্যিক পুঁজিবাদী উৎপাদন করতে উন্মুখ। পরিবর্তন বা বিবর্তনের যে চারটি ক্রমকে (ক্রম-১ থেকে ক্রম-৪) উপরে উল্লিখিত হয়েছে তা এই লুন্ঠনেরই চারটি পথ। তথাকথিত সমাজতন্ত্র-অভিমুখী রাশিয়া বা চীনেও কৃষক ও অ-পুঁজিবাদী সমাজরূপে অভ্যস্ত বিভিন্ন জনজাতির উপর রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে এই লুন্ঠন-নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া চলেছে।
মার্কস পুঁজিবাদের উৎপত্তি বর্ণনা করতে গিয়ে এই প্রক্রিয়াকে ‘আদিম পুঞ্জীভবন’ (primitive accumulation) বলে অভিহিত করেছেন। পুঁজি কেন্দ্রীভূত করার এই পদ্ধতি রুশ বিপ্লবের পর সমাজতন্ত্র গঠনের জন্যও এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছিল যে বলশেভিক অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞ প্রিওব্রাঝেনস্কি তাঁর মান্য বইয়ে “সমাজতান্ত্রিক আদিম পুঞ্জীভবন” (socialist primitive accumulation) নাম দিয়ে তা কীভাবে মূলত কৃষকদের সম্পদ রাষ্ট্রের অধীনে কেন্দ্রীভবন ও শিল্পপণ্যের তুলনায় কৃষিপণ্যের দামকে জোর করে নামিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে হতে পারে তা আলোচনা করেছিলেন। পার্টির মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাভূত হয়ে প্রিওব্রাঝেনস্কি পরবর্তীতে অবাঞ্চিততে পরিণত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেও, তার “সমাজতান্ত্রিক আদিম পুঞ্জীভবনের” নিদান অবাঞ্ছিত হয়নি। ১৯৩০-এর দশকে স্তালিনের নেতৃত্বে রুশ কম্যুনিস্ট পার্টি সোভিয়েত রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও লুন্ঠন বল্গাহীন করে কৃষিতে যে ‘সমবায়িকরণ’ (collectivisation) প্রক্রিয়া হাসিল করেছিল, তা এই ‘সমাজতান্ত্রিক পুঞ্জীভবন’ তত্ত্বেরই প্রয়োগ বলা যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রধানত ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে এই ‘পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’ ও তার লুঠের রাজ কায়েম হয়েছিল। এই শাসনের মধ্য দিয়ে এমন এক রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় নীতি ও কলাকৌশল, উন্নয়নী দিশা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, জ্ঞানচর্চা ও তার প্রয়োগের এমন এক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা ইংরেজ শাসকরা চলে যাওয়ার পরেও নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। বিভিন্ন ধুয়োর জাতীয়তাবাদকে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় শাসকরা বা প্রভাবশালীরা নিজেদের হাতিয়ার করলেও উন্নয়নী বীক্ষায় তারা পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা-কেই প্রশ্নাতীত ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ে চলেছেন। কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদী মহলেও এই বিশ্ববীক্ষাকে প্রশ্নাতীত ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ে চলা হচ্ছে।
পুঁজিকে কেন্দ্রীভূত করার এই বিবংসী প্রক্রিয়াকে মতবাদিক নির্ধারণের মাধ্যমে আপন করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রচলিত মার্কসবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকল্প অনুসন্ধান ও গঠনের অনুশীলনের বদলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই একটি অন্যতর রূপ নির্মাণের অনুশীলনে পরিণত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে রুশ বিপ্লবী ভেরা জাসুলিচের চিঠির পত্যুত্তরে লেখা মার্কসের চিঠিতে আমরা মার্কসের এমন ভাবনার প্রকাশ দেখতে পাই যেখানে মার্কস বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় (তখনও রুশ বিপ্লব হয়নি) পশ্চিমী কেন্দ্রীভূত বৃহদায়তন শিল্পের পরিবর্তে কৃষকদের বিকেন্দ্রীভূত গ্রামীণ কমিউনগুলোর উপর ভিত্তি করে সমাজতন্ত্রের পথে এগোনোর সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। সুতরাং মার্কসের ভাবনায় পশ্চিমী পুঁজিবাদী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার প্রভাবই কেবল ছিল না, তার দিকে সংশয়ী চোখে তাকানো অন্যতর উপাদান ছিল। মার্কসবাদীরা অবশ্য মার্কসের ভাবনার এই সংশয়ী অনেকান্ততাকে উপেক্ষা করেই তদের “বৈজ্ঞানিক মতবাদ” নির্মাণ করেছে।
৪
পশ্চিমী পুঁজিবাদী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ সমাজে কেন্দ্রীভূত বৃহদায়তন শিল্পই সর্বাত্মক হয়ে উঠবে, অন্যান্য উৎপাদন-রূপ (যেমন, বিকেন্দ্রীভূত কৃষি, ক্ষুদ্রশিল্প, হস্তশিল্প) নিশ্চিহ্ন হয়ে বৃহদায়তন শিল্পের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাবে। তাই ছোট-মাঝারি কৃষক সহ সব ছোট-মাঝারি উৎপাদকদের নিয়তি হল নিজ পেশা ও উৎপাদন-উপকরণ খুইয়ে কেন্দ্রীভূত বৃহদায়তন শিল্পের শ্রমিকে পরিণত হওয়া। এই গতি বা প্রবণতা যেহেতু “ইতিহাসের নিয়ম” দ্বারা নির্ধারিত, তাই এর বিরোধিতা বা অন্যথা করতে চাওয়া একদিকে যেমন অসম্ভব, অন্যদিকে তেমনই প্রতিক্রিয়াশীল। এই বিশ্ববীক্ষাকে আত্মীকৃত করা মার্কসবাদী মতবাদিক নির্ধারণে তাই শ্রমিকই হল একমাত্র সামাজিক বর্গ যা পুঁজিপতিদের মুখোমুখি চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য পড়ে থাকবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন উৎপাদকরা বৃহদায়তন শিল্পে কেন্দ্রীভূত হয়ে ক্রমশ নিজেদের সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়ে উঠে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলবে, যে সংগ্রাম পুঁজিবাদের শেষ ডেকে আনবে।
মার্কসবাদী নির্ধারণ অনুযায়ী এই যে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম বিপ্লবের মূল বল, তা বিকশিত হয় কীভাবে? দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পর্বে কাউটস্কির তত্ত্বায়ন ও তা অনুসরণ করে তৃতীয় আন্তর্জাতিক পর্বে লেনিনের সূত্রায়ন অনুযায়ী, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকরা নিজে থেকে কেবল ট্রেড- ইউনিয়ন সচেতনতা (অর্থাৎ, পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে তার মধ্যে শ্রমশক্তির বিক্রেতা হিসেবে ক্রেতা পুঁজিপতিশ্রেণির সঙ্গে দরকষাকষি করার সচেতনতা) অবধি অর্জন করতে পারে, পুঁজিবাদকে নিকেশ করে নতুন ব্যবস্থা তৈরির বিপ্লবী সচেতনতা অর্জন করতে পারে না। এই বিপ্লবী সচেতনতা কম্যুনিস্টরা (বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী এবং শ্রমিকদের মধ্যের একটি অগ্রণী অংশ) বহন করে শ্রমিকদের মধ্যে নিয়ে যায়, শ্রমিকদের শিক্ষিত করে তোলে এবং নেতৃত্ব দিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলে। এই কম্যুনিস্টরা শ্রমিকদের মধ্যে অনুসরণকারী সমর্থকদল সংগঠিত করে পার্টি গড়ে তোলে, যে পার্টি শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের মাথা (অর্থাৎ, চিন্তা-চেতনার উৎস, রণনীতি-রণকৌশলের উদ্ভাবক, আন্দোলনের খুঁটিনাটির ব্যবস্থাপক, যে কোনো বিচ্যুতির সংশোধক) হিসেবে কাজ করে।
এই প্রচলিত মার্কসবাদী নির্ধারণ অনুসরণকারী অনুশীলন কম্যুনিস্ট ও শ্রমিকদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে তোলে তার বৈশিষ্ট্যগুলো এইরকম:
ক) শ্রমিকদের যে কোনো ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে সন্দেহের চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে কম্যুনিস্টরা, কারণ মতবাদিক নির্ধারণ অনুযায়ী তা বুর্জোয়া- পেটিবুজোয়া প্রবণতার প্রকাশ হতে বাষধ্য। শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের উপর কম্যুনিস্টদের নেতৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও শোধনকারী প্রভাব প্রতিষ্ঠা করাই তাই কম্যুনিস্টদের প্রথম করণীয় হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের অংশ হয়ে (অংশ হওয়া মানে নিজ সচেতনতা, সংশয়, সমালোচনা বাদ দিয়ে নয়, সেই সব নিয়েই) তার আপন গতিতে বিকাশের পথ থেকে শেখার বদলে কম্যুনিস্টদের কাজ হয়ে দীড়ায় সেই আন্দোলনের মধ্যে অন্য মমস্ত সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে কেবলমাত্র নিজেদের মতবাদিক-চিন্তা-প্রসূত একটি পথেই চালিত করার, কারণ বিপ্লবী পথ তো কম্যুনিস্ট মতবাদধারী ছাড়া আর কারো ভাবনায় উদয় হতে পারেনা!
খ) উপরোক্ত প্রবণতার জন্য কম্যুনিস্টরা শ্রমিকদের মধ্যে সম্পর্কবিস্তারের মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতার জাল বিস্তার করার চেষ্টা করে। এই ক্ষমতা প্রধানত দুই প্রকার — অভিভাবকীয় ক্ষমতা ও শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা। ক্ষমতার এই দুই প্রকারকে বর্ণনা করা যায় এইভাবে :
অভিভাবকীয় ক্ষমতা – কম্যুনিস্টরাই যে শ্রমিকদের আন্দোলনের একমাত্র সাচ্চা চিন্তক/ পরিকল্পক/ সংশোধক এবং কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব ছাড়া শ্রমিকদের যে কোনো আন্দোলনই যে বিপথগামী ও ব্যর্থ হতে বাধ্য এই ভাবনা সঞ্চারিত করার মধ্য দিয়ে আন্দোলন নিয়ে মাথা খাটানোর ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কম্যুনিস্টদের বা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখাপেক্ষী করে তোলা। এক কথায় বললে শ্রমিকদের নিজেদের ভাবনা-চিন্তার সক্ষমতাকে নস্যাৎ করে নিজেদের অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা— দৈনিক প্রাত্যহিকতা থেকে শুরু করে আন্দোলনের প্রতিটি পরিসরে ও প্রতিটি পর্যায়ে শ্রমিকরা কম্যুনিস্টদের বেঁধে দেওয়া ‘বিপ্লবী’ আচরণ, নীতি-নৈতিকতা, কৌশল, কর্মসূচী পালন করছে কি না তার উপর নজরদারি কায়েম করা, বিচ্যুতির জন্য সমালোচনা থেকে শুরু করে বহু-ধাপ দণ্ডব্যবস্থা জারি করার মধ্য দিয়ে শৃঙ্খলা আরোপ করতে চাওয়া হয়, বলা হয় যে এই শৃঙ্খলা ব্যতীত শ্রমিকশ্রেণির কোনো আন্দোলন এগোতে পারে না। এই ক্ষমতার গেঁড়ে বসার মধ্য দিয়ে এক আংশিক পক্ষাঘাত ছড়িয়ে পড়ে। প্রাত্যহিকতার অভিজ্ঞতার বহুমুখ প্রশ্ন ও সম্ভাবনার মধ্যে থেকে সৃজনশীলভাবে নিজস্ব পথ তৈরি করার প্রয়াসের বদলে মতবাদিক বাঁধা পথে নির্ধারিত একমেবাদ্বিতীয়ম পথটিকে প্রশ্নহীনভাবে অনুসরণ করার যান্ত্রিকতা বোধকে ভোঁতা করে দিতে থাকে।
শ্রমিকদের সঙ্গে কম্যুনিস্টদের এই সম্পর্ক কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে নেতৃত্ব ও কর্মীদের সম্পর্কের মধ্যে পুনরুৎপাদিত হয়। পার্টি নেতৃত্ব পার্টির কর্মীদের উপর একই রকম অভিভাবকীয় ক্ষমতা ও শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা বিস্তার করে। কখনো কখনো এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কাঠামো পার্টির নেতৃত্ব স্তরেও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। পার্টি নেতৃত্বের মধ্যে এক বা জনাকয় মহান অদ্বিতীয় পার্টিনেতা বিপ্লবী চেতনার একমাত্র সাচ্চা উৎস হিসেবে এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকাঠামোর শীর্ষে বিরাজ করে।
ক্ষমতাকেন্দ্রীক এই ধাপবন্দি কাঠামোস্থাপন বিপ্লবী সমাজ-সক্রিয়তার পরিসরকে সংকীর্ণ, শীর্ণ ও রুগ্ন করে তোলে। ধাপে ধাপে একের পর এক অংশের স্বতক্রিয়ার অধিকারকে নাকচ করে তা বিশেষ কিছু স্বতক্রিয়ার অধিকারীকে বিশেষ অধিকারসম্পন্ন হিসেবে হাজির করে। প্রথম ধাপেই তা শ্রমিক ছাড়া অন্য সামাজিক বর্গ (যেমন কৃষক, ক্ষুদ্র-উৎপাদক, আদিবাসী-জনজাতি ইত্যাদি)-দের স্বতক্রিয়ার অধিকার নাকচ করে, পরের ধাপে কম্যুনিস্ট ছাড়া অন্য শ্রমিকদের স্বতক্রিয়ার অধিকার নাকচ করে, তার পরের ধাপে পার্টির সর্বময় নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কম্যুনিস্ট কর্মীদের স্বতক্রিয়ার অধিকার নাকচ করে।
এই কেন্দ্রীভূত চরিত্রের ক্ষমতাতান্ত্রিক কাঠামোর মূর্ত রূপগ্রহণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে নানা তাৎক্ষণিক ঐতিহাসিক বিশেষত্বের দ্বারা পরিপুষ্ট হলেও এভাবে তার বীজ মান্য মার্কসবাদী মতবাদের মতবাদিক রূপের মধ্যেই রয়েছে। এই মতবাদিক রূপের প্রাথমিক স্বতঃসিদ্ধগুলোকে তাই সংশয়াত্মক চোখে পুনর্বিচার করা খুবই জরুরী। একটি মূল স্বতঃসিদ্ধ, অর্থাৎ, পশ্চিমী পুঁজিবাদী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার স্বতঃসিদ্ধটিকে আমরা এর আগেই বিচার করেছি। অন্য দুটি মূল স্বতঃসিদ্ধ হলো শ্রমিকদেরই একমাত্র অবিচলিত বিপ্লবী শ্রেণি হওয়া এবং কম্যুনিস্টদের সংগঠনী ভূমিকা ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারার কথা। বেশ কিছু ঐতিহাসিক উদাহরণ স্বতঃসিদ্ধগুলোর বিপরীত কথা বলে। ১৯৩৬-৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আতালোনিয়া-আরাগঁ প্রদেশ জুড়ে শ্রমিক ও কৃষকদের যে নৈরাষ্ট্রপন্থী কালেকটিভগুলো পুঁজিবাদের বিকল্প সমাজগঠনচর্চার উজ্জ্বল উদাহরণ রেখে গেছে সেখানে বার্সেলোনার মতো শহরাঞ্চলের শ্রমিকরা ছাড়াও ব্যাপক গ্রামাঞ্চলের কৃষক ও ক্ষুদে উৎপাদকরা স্বাধীন সৃষ্টিশীল ভূমিকা নিয়েছিল। কোনো অভিভাবক কম্যুনিস্ট তাদের নেতৃত্ব দেয়নি। যে নৈরাষ্ট্রবাদী পার্টিগুলোর প্রভাব তাদের উপর ছিল, তারা অভিভাবকীয় ক্ষমতা ও শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা আরোপ করার সচেতন বিরোধী ছিল। রাশিয়াতেও ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের যে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল, তা কোনো কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বা পরিকল্পনামাফিক হয়নি। এমন উদাহরণ আরও অনেক পাওয়া যাবে। পূর্বোক্ত ধারণা-সিদ্ধান্তগুলো তাই আন্দোলনের নীতি-কৌশল নির্ধারণের প্রশ্নে কোনো স্বতঃসিদ্ধ হতে পারে না।
৫
ক্ষমতাতান্ত্রিক কাঠামো আরোপ করে ধাপে ধাপে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর অংশের স্বতক্রিয়ার অধিকার হরণ করা হলো এক ধরনের হিংসা। এই হিংসা প্রায়োগিক ফলিত চর্চায় বিভিন্ন মাত্রায় মূর্তরূপ গ্রহণ করে। মতবাদিক স্বতঃসিদ্ধগুলো থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয় এবং সেই সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে অন্য সমস্ত সিদ্ধান্তকে বিভ্রান্তি বা বিচ্যুতি হিসেবে দেখা হয়। আন্দোলনের বিকাশের জন্য কেবল সেই একমেবাদ্বিতীয়ম সঠিক সিদ্ধান্তটির প্রয়োগ ও অনুশীলনই কাম্য ধরে নিয়ে অন্যতর সব ভাবনাচিন্তা-প্রবণতা-ক্রিয়াকে বিভ্রান্তি বা বিচ্যুতি দূর করার নামে দমন করার প্রক্রিয়া জারি হয়। এর মধ্য দিয়ে মতবাদ-অনুসরণকারীরা সংশয়হীন নিশ্চয়তার জোর অর্জন করতে পারে বটে, কিন্তু ক্রমশ সেই সংশয়হীন অনুশীলন এক আবর্ত চক্রে (vicious circle)-য়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাস্তবতা থেকে উঠে আসা বিভিন্ন অসামঞ্জস্য, প্রতিভাষ্য, বিপরীত ইঙ্গিত সম্পর্কে অনাগ্রহী হয়ে উঠে (বা সেসবকে কেবল ভ্রমাত্মক চিন্তার উপজাত আলেয়া বলে নস্যাৎ করে দিয়ে) তা কেবল স্বতঃসিদ্ধের সঠিকতা থেকে সিদ্ধান্তের সঠিকতা এবং সিদ্ধান্তের সঠিকতা থেকে আবার স্বতঃসিদ্ধের প্রতি আস্থায় চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে তা এমন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ মতবাদিক বিশ্ব গড়ে তোলে যা বাস্তবতায় নিত্য নতুনের আবির্ভাব থেকে চোখ ফিরিয়ে রোমন্থনপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সর্বদা সর্ব প্রশ্নের মীমাংসক হিসেবে নিজের অমোঘতা বজায় রাখে। এই আবর্তচক্রে বন্দি অনুশীলনকারী প্রবৃত্তিগতভাবেই যে কোনো অনুশীলনক্ষেত্রে ধারণা-সংবেদনের বহুত্ব ও বিভিন্নতাকে আপদ বা ত্রুটি হিসেবে দেখে তার উপর ‘সঠিক’ ধারণাটির আধিপত্য কায়েম করে সমরূপতা তৈরি করতে চায়। এই প্রবৃত্তিই তার অনুশীলনকে চালনা করে। অথচ, বিভিন্ন মানুষের চেতনায় বাস্তবতার অভিঘাতে যে বিভিন্ন ও ফারাকসম্পন্ন ধারণা-সংবেদনা তৈরি হয়, তার সবগুলোই কি আংশিকতার চরিত্রসম্পন্ন হওয়া অবধারিত নয়? সেই সব আংশিক ধারণাসমূহকে সমমর্যাদায় অনুশীলনের ক্ষেত্রে স্থান করে দিলে তবেই সামগ্রিক অনুশীলনের মধ্য থেকে একে অপরের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার মাধ্যমে আংশিকতা থেকে তুলনামূলক সম্পূর্ণতার দিকে যাত্রা সম্ভব নয় কি? তাই মতবাদ-নির্ণীত “সত্যে” অনড়-আস্থা আবর্ত চক্রে বন্দি অনুশীলন একটি অসম্পূর্ণ ভাবনাকেই হিংসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ বলে আধিপত্যকারী করতে চায়, বিবিধ-বহুত্বের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণতার দিকে অন্তহীন যাত্রা তার নাগালের বাইরে।
একমেবাদ্বধিতীয়ম “সত্যকে” হিংসার মাধ্যমে আধিপত্যকারী করার এই প্রবৃত্তি পার্টির বাইরের অন্যতর/ অপর/ ফারাকসম্পন্ন মতামতধারীদের শাসকশ্রেণির লেজুড় বলে আক্রমণ করা এবং পার্টির মধ্যের ভিন্নমতাবলম্বীদের সংশোধনবাদী/ বিশ্বামঘাতক/ পুঁজিবাদের-পথিক বলে আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। আর সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতাগ্রন্থি অর্থাৎ রাষ্ট্রে অধিষ্ঠিত হলে তা যে কী ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে তা স্তালিনযুগের পুনঃপুনঃ কত ‘পার্জ’, ‘গুলাগের’ বংশবিস্তার, ও হিংস্র সর্বাত্মকবাদী (totalitarian) রাষ্ট্রযন্ত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমরা দেখেছি।
প্রচলিত মার্কসবাদী মতবাদিক কাঠামো তাই পুঁজিবাদের বিকল্প সন্ধানকারী আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর ও পক্ষাঘাতজনক। এই মতবাদিক কাঠামো এবং তার সঙ্গে যে কোনো মতবাদিক কাঠামো পরিহার করেই পুঁজিবাদবিরোধী প্রতিরোধ ও বিকল্প সমাজ প্রতিষ্ঠার চর্চা করা কাম্য ৷
৬
জামাই পল লাফার্গের কাছ থেকে তৎকালীন ফরাসি মার্কসবাদীদের কীর্তিকলাপের বিবরণ শুনে ক্রুদ্ধ মার্কস লাফার্গকে বলেছিলেন: “Je ne suis pas marxiste” (“আমি মার্কসবাদী নই”)। তিনি অবশ্য মান্য মার্কসবাদের এই মতবাদিক কাঠামো নির্মাণ ও হিংসাত্মক অনুশীলনের পাকাপোক্ত রূপটি দেখে যাননি। দেখলে যে কী বলতেন কে জানে! অবশ্য মার্কস যে সংশয়হীন নিশ্চয়তা অর্জনের জন্য মতবাদিক আবর্ত চক্র নির্মাণের পক্ষে ছিলেন না তার আঁচ তার আরেকটি বিখ্যাত মন্তব্য থেকে পাওয়া যায়। তার মেয়ের দেওয়া একটি প্রচলিত রীতিসন্মত প্রশ্নাবলীর অন্তর্গত তার জীবনের মূলনীতি সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেছিলেন: “De omnibus dubitandum” (‘সবকিছুকেই সন্দেহ করতে হবে”)। তিনি নিজে যেভাবে তার নিজের লেখায় আমৃত্যু ধারাবাহিকভাবে পরিমার্জনা ও পরিবর্তন করে গেছেন, যার ফলে তাঁর সিংহভাগ লেখাই তার মৃত্যুকালে অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি হিসেবে রয়ে গিয়েছিল, তাও তার সংশয়ী চর্চার একটা প্রমাণ বটে। সুতরাং মার্কসবাদের নির্মাতারা মার্কসের বহুবিধ বিচিত্র, এমনকি পরস্পরবিরোধী, ভাবনাচিন্তা থেকে নিজেদের প্রয়োজনমতো গুটিকয়কে চয়ন করে সেগুলোকে “বৈজ্ঞানিক সত্যের’ বিভূতিতে ভূষিত করে তাঁদের মতবাদিক কাঠামোর ভিত্তিমূলক স্বতঃসিদ্ধে পরিণত করার মধ্য দিয়ে মার্কসের খ্যাতিকে হয়ত বাড়িয়েছেন, কিন্তু তাঁর মনোভাব ও চর্চাপদ্ধতিকে বিসর্জন দিয়েছেন। মার্কসবাদী মতবাদকাঠামোর ভিত্তিমূলক স্বতঃসিদ্ধগুলোকে সংশয়ের চোখে দেখা বা এমনকি বাতিল করার মধ্য দিয়ে তাই মোটেই মার্কসকে বিসর্জন দেওয়া হয় না, বরং তাঁর সংশয়ী চর্চায় ফিরে গিয়ে হয়ত তাঁর উপর মার্কসবাদীদের করা অবিচারের কিঞ্চিৎ সংশোধনের পথ খোলা যায়। প্রচলিত মার্কসবাদী মতবাদিক কাঠামো পুঁজিবাদের বিকল্প সন্ধানকারী আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর ও পক্ষাঘাতজনক হিসেবে পরিত্যাগ করলে তাই মার্কসকে পরিত্যাগ করা হ্য়না। মার্কসের পুঁজিবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষণের নানা দিক, পণ্যভক্তিবাদ (commodity fetishism), পরকীকরণ (alienation), এবং আরো অনেক কিছুই মতবাদহীন অনুশীলনের পথেও বিচার-গ্রহণ-পুনর্ভাবনার উৎস হিসেবে কাজ করে এসেছে এবং এখনও করবে। অবশ্য সেখানে মার্কস একা “সত্যের আবিষ্কারক’ বলে কোনো তুষারশূঙ্গে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত (নাকি বরফে কবর দেওয়া!) নন, সেখানে তিনি অন্যতর ভাবনার, এমনকি বিরোধী ভাবনারও অনেক চিন্তক-অনুসন্ধানকারী যেমন তার সমকালীন নিৎশে (দ্বান্দ্বিক বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা এবং সমাজ ও ইতিহাস বিশ্লেষণে তার বিক্ল্প দৃষ্টিভঙ্গি যার চিন্তায় স্বচ্ছরূপ ধারণ করেছিল), পরবর্তী প্রজন্মের হানা আরেন্ট (মতবাদিক কাঠামোর সমালোচনা এবং বিশ শতকে সর্বাত্মকতাবাদী রাজনীতি ও রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিস্তার বিশ্লেষণ যিনি করেছেন), তারও পরবর্তীকালের মিশেল ফুকো সমাজে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভূত বিস্তার, ক্ষমতার বিভিন্ন রূপ ও কাঠামো এবং প্রতিরোধের প্রশ্ন নিয়ে যিনি নতুনভাবে ভাবিয়েছেন), বা অন্য মহাদেশের গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের (যাঁদের চিন্তায় ও কাজে ইউরোপীয় প্রগতির ধারণার সমালোচনা করে বিকল্প ভাবনা বিকাশ করা, সর্বজনের আত্মশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে স্বতক্রিয়ার পরিসর উন্মুক্ত করা, বৈচিত্র্য বহুত্বকে ধারণ করে অহিংসার পথে সমাজ গড়ে তোলা, বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতা পরিহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ নানা দিক চর্চিত হয়েছে) মতো বহুজনের সঙ্গে বিরোধে-বিবাদে-বিনিময়ে জীবন্ত ও পরিবর্তমান।
লেখক একজন সামাজিক কর্মী।