সংসদ থেকে রাহুল গান্ধীর নির্বাসন ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রকে উলঙ্গ করে দিয়েছে। বিরোধী দলগুলি এখনও যদি লজ্জা না পায়, প্রতিস্পর্ধী ক্রোধে একযোগে এখনই ফেটে না পড়ে, তবে তারাও মোদীর হস্তিনাপুর থেকে অচিরেই বিতারিত হবে। সেদিন পরনের কৌপীনটুকুও থাকবে না। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
তাহলে ‘পাপ্পু’রই সাংসদপদ খারিজ করতে হল! এতটাই দুর্বল বিজেপি? এতটাই দুর্বল মোদী! এতকাল যাঁকে ‘পাপ্পু’ সম্বোধনে উপহাস করে এসেছেন বিজেপি’র বড়ো, মেজ, ছোট নেতারা, সেই ‘বাচ্চা ছেলে’, ‘নাদান’ রাহুল গান্ধীর সংসদীয় পদ খারিজ করতে প্রবল পরাক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীকে এত ছলাকলার আশ্রয় নিতে হল!
ভক্তরা দেখাবেন আদালত, মোদী-শাহরা দেখাবেন লোকসভার অধ্যক্ষকে—বলবেন যা হয়েছে আইনি পথে, সংসদীয় নিয়মকানুন মেনে। সত্যিই কী তাই? আদালত দু’বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে বটে, একই সঙ্গে উচ্চ আদালতে আবেদন করার সুযোগ দিয়ে তিন মাসের জন্য রায় স্থগিত রেখেছে। সেই একই সুযোগ লোকসভার অধ্যক্ষ দিলেন না কেন? অপেক্ষা করতে পারলেন না কেন উচ্চ আদালতের রায়ের জন্য? তবে কি এই সুযোগ ও সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলেন মোদী-শাহ?
কেউ যদি মনে করেন—ঠিক তাই, তবে তাঁকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। না হলে ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিলের একটি মানহানি মামলা যা ২০২২সালে অভিযোগকারী স্বয়ং উচ্চ আদালতে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ চেয়ে বসেন এবং পেয়ে যান। হঠাৎই সেই আবেদনকারী গুজরাতের এক প্রাক্তন মন্ত্রী ও বর্তমান বিধায়ক পূর্ণেশ মোদী ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ওই স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ার জন্য ফের হাই কোর্টে আবেদন করেন এবং তার আবেদন গ্রাহ্যও হয়। ঠিক কখন ফের নিম্ন আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য মামলা করলেন? পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাহুল গান্ধী যখন লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর বন্ধু শিল্পপতি আদানির সম্পর্ক কী তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং আদানি-হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট নিয়ে মোদী মুখ না খোলার জন্য, তুমুল সমালোচনা করেন, তার এক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ণেশ মোদী হাই কোর্টের রায়ের বলে নিম্ন আদালতে যান। ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপ্রক্রিয়া ফের শুরু হয়। মানহানির এই মামলাটির বিষয়ে ২৪.০৩.২০২৩ দ্য ওয়ার একটি বিশ্লেষণমূলক আর্টিকেল প্রকাশ করে। আগ্রহীরা তা পড়ে দেখতে পারেন।
কী বলেছিলেন রাহুল গান্ধী যার জন্য এই মানহানির মামলা? ১৩ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে কর্নাটকের কোলারে এক নির্বাচনি জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় রাহুল শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আচ্ছা, একটা ছোট প্রশ্ন, এই সবার নাম, এই সব চোরেদের নাম, মোদী মোদী মোদী কী করে হল? নীরব মোদী, ললিত মোদী, নরেন্দ্র মোদী। আরও একটু খোঁজ করলে দেখা যাবে আরও অনেক মোদী বেরিয়ে পড়বে।” (দ্য ওয়ার, ২৪.০৩.২৩)
এখানে কী কোথাও পূর্ণেশ মোদীর নাম রয়েছে? সামগ্রিকভাবে মোদী পদবিভুক্ত জনসম্প্রদায়কে চোর অপবাদ দেওয়া হয়েছে? না। তবে, যাঁদের নাম নেওয়া হল তাঁরা মানহানির মামলা না করে সুরাতের এক জনৈক মোদী মামলা করতে গেলেন কেন? এবং মোদী সম্প্রদায়ের মানহানি হয়েছে—কেনই-বা এই যুক্তি আদালতে স্বীকৃত হল? স্বীকৃত হল, তাও আবার মানহানির মতো মামলায় দু’বছরের জেল! ঠিক যেন মাপ মতো। কেননা, এক জন সাংসদের যদি দু’বছর বা তার বেশি কারাদণ্ড হয়, তবে তিনি সাংসদ পদ হারাবেন।
অর্থাৎ, বিশেষভাবে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে আঙুল তোলা যাবে না। বিগত ন’বছরে গুজরাত গণহত্যার প্রধান মদতদাতা বলে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর ডান হাত অমিত শাহের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই আইনের দরবারে ধোপে টেকেনি। নানাবতী কমিশন গুজরাত গণহত্যায় মোদীকে বেকসুর বলেছে। উল্টে, এই মোদীর দিকে আঙুল তোলায় পুলিশ আধিকারিক সঞ্জীব ভাটের বিরুদ্ধে তদন্তের সুপারিশ করে। সঞ্জীব ভাট বিনাবিচারে এখন জেলে কাটাচ্ছেন। গুলবার্গ সোসাইটিতে ৬৯ জনকে কেটে পুড়িয়ে হত্যা করার মামলায় এসআইটি ‘ক্লিনচিট’ দেয়, এমনকি পরবর্তীতে এই মামলা থেকে সুপ্রিম কোর্টও মুখ ফিরিয়ে নেয়। যাঁরা মুখ খুললে বিপদ হতে পারে, তাঁরা হয় খুন হয়ে গিয়েছেন, না হয় বিনাবিচারে জেলে আটক। বিলকিস বানুর ধর্ষণকারী, খুনি ও দাঙ্গাবাজরা কেন্দ্রীয় সরকার, বলা ভালো, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অমিত শাহের সৌজন্যে যাবজ্জীবন সাজা থেকে মুক্তি পেয়েছে। (এই মামলাটি সম্প্রতি ফের গ্রহণ করেছে শীর্ষ আদালত।) উল্টে গণ-সংখ্যালঘু-হত্যাকাণ্ড মোদী ‘হিন্দুত্ববাদীদের কাছে ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ হয়ে উঠেছেন।
মোদী ও গুজরাত গণহত্যা নিয়ে অভিযোগের সুর চড়া করলে ঠিক কী হতে পারে তার সাম্প্রতিকতম নিদর্শন বিবিসি’র গুজরাত দাঙ্গার তথ্যচিত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং অবব্যহিত পরেই বিবিসি’র ভারতীয় দফতরে ইডি হানা। সাম্প্রতিক আরও কয়েকটি ঘটনার কথা মনে করতে হবে। (এক) মঙ্গলবার, ২১ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের যে কোনও প্রতিবাদ, মিছিল ও ধর্মঘটের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি। বুঝতে অসুবিধা হয় না, পুরনো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে দেবার দাবিতে ন্যাশনাল জয়েন্ট কাউন্সিলের প্রতিবাদ কর্মসূচি বানচাল করা। ওইদিনই ছিল প্রতিবাদ কর্মসূচি।
(দুই) লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম দুর্দশা নিয়ে বানানো অনুভব সিনহার চলচ্চিত্র ‘ভিড়’-এর ট্রেলারে কোপ। ছবির ট্রেলার শুরু হয়েছিল মোদীর লকডাউন ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এবং পরিযায়ীদের গৃহমুখী উল্টো পরিযাণের ছবি দেখিয়ে পার্টিশান, দেশভাগের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। ইউটিউব থেকে সেই ট্রেলার সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এবং দেশভাগের তুলনার অংশটি বাদ দেওয়ার পরই ট্রেলার দেখানোর অনুমতি মেলে বলে জানা গিয়েছে।
(তিন) ‘হিন্দুত্ব’ নিয়ে সমালোচনামূলক টুইট করায় কন্নড় অভিনেতা চেতন কুমারকে মঙ্গলবার, ২১ মার্চ গ্রেফতার করে কর্নাটক পুলিশ। বজরঙ দলের কাছ থেকে হিন্দু ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগ পেয়ে বেঙ্গালুরুর শেষাদ্রিপুরম থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। টুইটে চেতন লিখেছিলেন:
“হিন্দুত্ব মিথ্যার ওপরেই নির্মিত।
সাভারকর: যখন রাবনকে হারিয়ে রাম অযোধ্যা ফিরলেন, তখন থেকেই ‘ভারত’ রাষ্ট্র শুরু হল — একটি মিথ্যা।
১৯৯২: বাবরি মসজিদ ‘রামের জন্মভূমি’—একটি মিথ্যা
২০২৩: উরিগৌড়া-নানজিগৌড়া টিপুর ‘হত্যাকারী’— একটি মিথ্যা
হিন্দুত্বকে পরাস্ত করা সম্ভব সত্যের দ্বারা— সত্যই সমতা।”
(৪) জম্মু-কাশ্মীরের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, ক্যারাভান, আল জাজিরা, আর্টিকেল ১৪-র সংবাদ প্রেরক ইরফান মেহরাজকে ডেকে পাঠিয়ে গ্রেফতার করে এনআইএ। তাঁর বিরুদ্ধে দানবীয় ইউএপিএ-সহ একগুচ্ছ ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কাশ্মীরের পরিস্থিতি দেশ- বিদেশের সংবাদমাধ্যমে লেখার অভিযোগেই যে তাঁকে রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদী সাজিয়েছে, এ নিয়ে মতভেদের কোনও কারণ নেই। সোমবার ২০ মার্চ তাঁকে গ্রেফতার করার পর ২১ মার্চ দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়।
বিগত ন’বছর ধরে এমনই একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। বিজেপি’র রাজসভায় এ যেন মোদী-শাহ জুটির গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন বস্ত্রহরণ পালা। এই দুর্যোধন-দুঃশাসনরাজের সামনে বিরোধী দলগুলি শুধু ছিন্নবিচ্ছিন্ন অসহায় দর্শক নয়, স্বার্থপর আত্মঘাতী রাজনীতিতে মগ্ন। রাজধর্ম ধুলোয় লুটোচ্ছে অথচ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ এদের অনেকেই কংগ্রেস দলটির ধ্বংস দেখতে চায়। সংসদ থেকে রাহুল গান্ধীর নির্বাসন ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রকে ন্যাংটো করে দিয়েছে। বিরোধী দলগুলি এখনও যদি লজ্জা না পায়, প্রতিস্পর্ধী ক্রোধে একযোগে এখনই ফেটে না পড়ে, তবে তারাও মোদীর হস্তিনাপুর থেকে অচিরেই বিতারিত হবে। সেদিন পরনের কৌপীনটুকুও থাকবে না।
গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ পালা এই উপমাটি দিয়ে মাটি হল। কন্ঠরোধ লেখা উচিত ছিল বা হত্যা করার একের পর এক চক্রান্তও লেখা যেতে পারত।