শীর্ষ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও মাথার উপর ছাদ মেলেনি ফুটপাথের বাসিন্দাদের


  • February 14, 2023
  • (0 Comments)
  • 889 Views

২০১১ সালের কলকাতায় মোট যত সংখ্যক গৃহহীন মানুষ অথবা ফুটপাথবাসীকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাতে প্রকৃত তথ্য আড়াল করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারা। ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্ট প্রকাশের পরে দেখা গিয়েছে, কলকাতায় গৃহহীন মানুষের সংখ্যা মোটে ৭০ হাজার। এরপর থেকেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারা অভিযোগ  জানায়, গৃহহীন মানুষের সংখ্যাটা জনগণনার রিপোর্টে ব্যাপক কমিয়ে দেখানো হয়েছে। লিখছেন অর্ণব দত্ত

 

 

মহানগরীর নানান প্রান্তে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তরভাবে বেড়ে চলেছে। হাজার হাজার মানুষ বেঁচে থাকার আস্তানা হিসেবে বেছে নিয়েছেন কলকাতার ফুটপাথ। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় ওঁদের ঠিকানা ফুটপাথই। এ মুহূর্তে কলকাতার ফুটপাথগুলিতে ঠিক কতজন মানুষ বসবাস করেছেন, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য সরকারের হাতে নেই। কারণ শেষবার জনগণনা হয়েছে ২০১১ সালে। এরপর আর জনগণনা না হওয়ার দরুণই কলকাতা শহরের ফুটপাথগুলিতে কতজন মানুষ বসবাস করছেন, সেটা সঠিকভাবে জানা যায় না।

 

তবে স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংস্থার হিসেব-নিকেশ অনুযায়ী কলকাতার ফুটপাথগুলির বাসিন্দাদের সম্পর্কে ধারণা করা যায়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির দেওয়া হিসেব অনুসারে, এখন মহানগরীর ফুটপাথের বাসিন্দার সংখ্যা ৫ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষের মতো। এঁদের অনেকেই ফুটপাথে ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন।

 

ফুটপাথ যে বসবাসের জায়গা হিসেবে অনুপযুক্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া ফুটপাথে বসবাস বেআইনিও। পথচারীরা যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারেন, এ জন্যে ফুটপাথ নির্মিত হলেও সেখানে অতিদরিদ্র লক্ষ লক্ষ মানুষের বসবাস পথচারীদের হাঁটাচলা করার পরিসরটাই সঙ্কুচিত করেছে। এর পাশাপাশি অনুন্নয়নের ছবিও স্পষ্ট। যদিও মাথার ওপর ছাদ থাকা যে কোনও ভারতীয় নাগরিকের সংবিধানসম্মত মৌলিক অধিকার। কলকাতার ফুটপাথের বাসিন্দা লক্ষ লক্ষ হতদরিদ্র মানুষ সেই অধিকার থেকেও বঞ্চিত।

 

এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো কেবল কলকাতাই নয়, ভারতের অন্য বড় শহরগুলিতেও বহু মানুষ ফুটপাথে বসবাস করছেন। স্বেচ্ছাসেবীদের মতে, ভারতে ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষ ফুটপাথের বাসিন্দা। এঁরা যে সকলেই হতদরিদ্র শ্রেণির মানুষ, সে কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পরিস্থিতি বছরের পর বছর ধরে বিদ্যমান। এই অবস্থাতে সারা ভারত জুড়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে চলছে দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন। কার্যত যা প্রহসনের মতো।

 

২০১১ সালে সর্বশেষ যে জনগণনা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ নাগরিকের মাথার ওপর কোনও ছাদ নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ যাঁরা ফুটপাথে বসবাস করেন সর্বশেষ জনগণনার রিপোর্ট অনুসারে, তাদের মধ্যে রয়েছে অন্তত ২ লক্ষ ৭০ হাজার শিশু। সদ্যোজাত থেকে শুরু করে এই শিশুদের বয়স ৬ বছরের মধ্যে। আর এই গৃহহীন মানুষের মধ্যে নারী ও পুরুষের অনুপাত যথাক্রমে ৬৯৪ জন ও ১০০০ জন। এঁদের মধ্যে অনেকেই নিজের নাম পর্যন্ত সই করতে পারেন না। অন্যদিকে, জাতীয় স্বাক্ষরতার হার ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে যেখানে ছিল ৭৪ দশমিক ০৪ শতাংশ, গৃহহীন মানুষের ক্ষেত্রে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৫৬ দশমিক ০৭ শতাংশে।

 

মানুষ যখন মাথা গোঁজার মতো কোনও আশ্রয় খুঁজে পায় না, সেই পরিস্থিতি মানবিকতার পক্ষে্ই লজ্জার। ফুটপাথে বসবাস করতে বাধ্য হওয়া শিশু ও মহিলারা অনেকক্ষেত্রেই নিপীড়ন-নিগ্রহেরও শিকার হন।কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া হিসেব অনুসারে, সর্বশেষ জনগণনা পর্যন্ত গত ৫০ বছরের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৬১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত গৃহহীন মানুষের সংখ্যা এই দেশের শহরাঞ্চলগুলিতে ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। যদিও গ্রামাঞ্চলে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা সেই তুলনায় কমছে। ১৯৬১ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ৯ লক্ষের চেয়ে কিছু বেশি। সেই সংখ্যা কমে দাঁডিয়েছে ৮ লক্ষ ৩৪ হাজারে। এদিকে শহরাঞ্চলগুলিতে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, এই সংখ্যা বেড়়ে দাঁড়িয়েছে ৯ লক্ষ ৩৮ হাজারে।

 

২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এক দশকের মধ্যে ভারতের শহরাঞ্চলে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়েছে বলেও সর্বশেষ জনগণনার রিপোর্টে জানা গিয়েছে। আরেকটা কথা হল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যতবার জনগনণা হয়েছে, সেই নিরিখে ১৯৮১ সালে ধরা পড়েছে সারা দেশে সর্বাধিক সংখ্যক গৃহহীন মানুষের খতিয়ান। সংখ্যার হিসেবে এটা ২৩ লক্ষ ৪৩ হাজার। এরপর ২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্টে ধরা পড়ে, গৃহহীন মানুষের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ লক্ষ ৭৩ হাজারে।

 

২০১১ সালের কলকাতায় মোট যত সংখ্যক গৃহহীন মানুষ অথবা ফুটপাথবাসীকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাতে প্রকৃত তথ্য আড়াল করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্ট প্রকাশের পরে দেখা গিয়েছে, কলকাতায় গৃহহীন মানুষের সংখ্যা মোটে ৭০ হাজার। এরপর থেকেই স্বেচ্ছাসেবীরা অভিযোগ জানাচ্ছেন, গৃহহীন মানুষের সংখ্যাটা জনগণনার রিপোর্টে ব্যাপক কমিয়ে দেখানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতা এবং বৃহত্তর কলকাতা মিলিয়ে মোট জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪০ লক্ষের ওপরে। এর মধ্যে মূল কলকাতার জনসংখ্যা ৪০ লক্ষাধিক। এদিকে কলকাতা ছাড়াও ভারতের বড় বড় শহরগুলিতেও পরিস্থিতি দুর্বিষহ। ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্ট অনুসারে, রাজধানী দিল্লিতে সেইসমযে ফুটপাথবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লক্ষ। বাণিজ্যনগরী মুম্বইয়ে এই সংখ্যা ছিল রাজধানীর সমসংখ্যকই। এছাড়া চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, লখনউ এবং আমেদাবাদে ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্ট ফুটপাথবাসীর সংখ্যা দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ৪০ থেকে ৫০ হাজার, ৫০ হাজার, ৬০ হাজার, ১৯ হাজার এবং ১ লক্ষ। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ভারতের যে কোনও শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে অন্তত এক শতাংশ রাস্তায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

 

ভারতের বড় শহরগুলিতে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলার কারণ খতিয়ে দেথেছেন গবেষকরা। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বন্যা ও খরার সঙ্গে যুঝতে না পেরে গ্রাম থেকে পরিবার-সহ মানুষজন শহরে ঢুকে পড়েছেন জীবিকার আশায়। পরিচারক-পরিচারিকার কাজের মতো অন্যান্য কাজ যেমন মুটেমজুরের কাজ জুটে যাচ্ছে। তাতে গ্রাসাচ্ছাদন হচ্ছে কোনওমতে। কোনওমতে কেটে যাচ্ছে জীবন। এছাড়া নির্বিচার নগরায়নের ফলেও একশ্রেণির মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম হয়ে ফুটপাথে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

 

ফুটপাথের বাসিন্দাদের জন্যে শেল্টার হোমের বন্দোবস্ত করতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সেই ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, ভারতের শহরগুলিতে প্রতি এক লক্ষ বাসিন্দাপিছু যেন গৃহহীনদের জন্যে যেন অন্তত একটি শেল্টার হোম থাকে। কিন্তু সেই কাজ আজও বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু সুপ্রিম কোর্টের ওই নির্দেশের দু’বছরের মাথায় ২০১৪ সালে মাত্রাতিরিক্ত শীতে রাজধানী দিল্লিতে শতাধিক গৃহহীনেৱ রাস্তাতেই মৃত্যুর হয়। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ‘আরবান হোমলেস স্কিম’ নামে একটি প্রকল্প চালু করে। ওই প্রকল্পে গৃহহীনদের জন্য নির্মিত শেল্টার হোমগুলিতে পানীয় জলের ব্যবস্থা, শৌচাগার থেকে লকার, রান্নাঘর, ব্ল্যাঙ্কেট ইত্যাদির বন্দোবস্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ভারতের মোট ৭৯০টি শহরকে ‘আরবান হোমলেস স্কিম’-এর আওতায় আনা হয়। এই স্কিমে প্রত্যেক ফুটপাথবাসীর আশ্রয়ের জন্যে শেল্টার হোমে বাধ্যতামূলকভাবে ৫০ বর্গ ফুট জায়গা রাখার কথা বলা হয়।

 

এদিকে ১০ বছর পরও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি বলে অভিযোগ ফুটপাথবাসীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার। বরং ৯০ শতাংশ গৃহহীন মানুষের মাথার ওপর কোনও ছাদ নেই আজও। এছাড়া নেই স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা। নেই কর্মসংস্থানের সুযোগও।

 

মহানগরী কলকাতায় গৃহহীনদের জন্যে নামমাত্র যে শেল্টার হোমগুলি রয়েছে, সেগুলি মূল শহর থেকে দূরে হওয়ার দরুণ ফুটপাথবাসীরা সেখানে থাকতে অনিচ্ছুক। কারণ এই শেল্টার হোমগুলি শহর থেকে দূরবর্তী হওয়ার কারণে এখানে বসবাস করে জীবিকার্জন করাটা কঠিন। শহরে যাতায়াতের জন্যে যানবাহন চেপে গাঁটের কড়ি খরচ করার মতো সামর্থ্য প্রায় কারোরই নেই। ফলে শেল্টার হোমগুলি বানিয়ে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এদিকে ফাঁকা শেল্টার হোমগুলিতে অবাধে চলছে নানা ধরনের অসামাজিক কাজ। অনেকক্ষেত্রেই ওই শেল্টার হোমগুলিতে রমরম করে চলেছে নেশাড়ুদের আড্ডা, মদগাঁজার আসর।

 

দারিদ্রসীমার তলায় বসবাসকারী ফুটপাথবাসীরা না পান রেশন, এছাড়া ফুটপাথবাসী পরিবারগুলির শিশুরা শিক্ষার অধিকার থেকেও বঞ্চিত। ঠিকানা না থাকায় প্রাপ্তবয়স্ক ফুটপাথবাসীরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। আর সর্বক্ষণের সঙ্গী খিদে।

 

একবিংশ শতাব্দীতে এই দারিদ্র্য এবং বঞ্চনার ছবিটা আদতে মানবিকতার পক্ষেই লজ্জার। তবে পরিস্থিতি বদলের কোনও সম্ভাবনাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং সমস্যা যে তিমিরে ছিল আজও সেই তিমিরেই পড়ে রয়েছে। ঘর ছেড়ে পরিবার-সহ ফুটপাথে আশ্রয় নেওয়া তথাকথিত উন্নত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও এক গুরুতর সমস্যা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা অন্তত ১০ লক্ষ। অন্যদিকে, ভারতের যে রাজ্যগুলিতে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েছে, সেই রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট এবং অন্ধ্রপ্রদেশ। আর সবচেয়ে কম গৃহহীন মানুষের বসবাস আন্দামান-নিকোবরে। সমীক্ষা অনুসারে এখানে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা একশোরও কম।

 

ভারতে ফুটপাথবাসীরা ব্যাপক দূষণেরও শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে করা একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দূষিত ১০টি শহরের ভিতর ৯টি শহরই ভারতে অবস্থিত। এই শহরগুলিতে বায়ুদূষণের হার মাত্রা ছাড়িয়েছে, কার্যত যা বিপর্যয়ের চেহারা নিয়েছে। এর জেরে বহু ফুটপাথবাসী বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি ভুগছেন মানসিক সমস্যাতেও। এছাড়া নিরাপত্তাহীনতা তো রয়েইছে। ফুটপাথবাসী মহিলাদের একাংশ যৌন নিপীড়নেরও শিকার।

 

কলকাতার বাসিন্দা ফুটপাথবাসীদের মধ্যে মোটে ২ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেছেন। বাকিদের সেই সুযোগটুকুও জোটেনি।

 

সারা ভারতজুড়েই এই পরিস্থিতি। ব্যতিক্রম নয় কলকাতাও।

 

প্রচ্ছদ ছবি: নীলাঞ্জন কর্মকার

 

Share this
Leave a Comment