হিমাংশু কুমার – গান্ধীবাদী মানবাধিকার কর্মী। তিনি ও তাঁর স্ত্রী ১৯৯২ সালে ছত্তিশগড়ে চলে যান আর সেখানে দন্তেওয়াড়া জেলার এক গ্রামে গাছের নীচে থাকতে শুরু করেন, শুরু করেন সেবার কাজ। ধীরে ধীরে সেই কাজ বেড়েছে। সব মিলিয়ে ১০০০ জনের দল নিয়ে তাঁরা চারটি জেলায় কাজ করতেন মহিলাদের ক্ষমতায়ণ, মানুষের জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে। ১৯৯২ থেকে ২০০৯ হিমাংশু চালিয়েছেন বনবাসী চেতনা আশ্রম। তিনি আদিবাসী মানুষদের মৌলিক অধিকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সরব হয়েছেন তাঁদের উপর রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর নৃশংস শোষন-পীড়নের বিরুদ্ধে। আজ থেকে ১৩ বছর আগে তিনি একটি জনস্বার্থ মামলা করেন দান্তেওয়াড়া জেলায় নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে নিরীহ আদিবাসী গ্রামবাসীদের হত্যার ন্যায় চেয়ে। গত জুলাই মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাঁর বক্তব্যকে সর্বৈব মিথ্যা বলে ও তাঁকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা দিতে হবে বলে রায় দেয়। হিমাংশু তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেন এই জরিমানা তিনি দেবেন না। বলেন – “আমি জরিমানা দেব না। আমি জেলে যাব। হাসতে হাসতে যাব। গান গাইতে গাইতে যাব। জেলে যাব, জেল ভরব আর দেখব, এদের বলে দেব যে ভারতের লোক ভয় পেয়ে যাওয়ার মতো নয়, তোমাদের এই স্বৈরাচার আর ফ্যাসিবাদী নীতিতে তারা ভয় পায় না। আমি একে বদলিয়েই ছাড়ব, একে গদি থেকে নামাবই, একে শেষ করেই ছাড়ব। কোনও ভুল, অন্যায় সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কোনওরকম যাচাই না করে বিচারক স্বপ্ন দেখে ফেলছেন না কি যে এ (নিজের প্রতি ইঙ্গিত করে) মিথ্যেবাদী? এত ভীতু? মোদীকে ভয় পেয়ে পেয়ে রায় দিচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট সরকার, রাষ্ট্রকে ভয় পাওয়া কিছু মানুষের নয়। সুপ্রিম কোর্ট ভারতের মানুষের জন্য। এটি আমাদের কোর্ট। আমরা একে বাঁচাব। জুডিশিয়ারি (বিচারব্যবস্থা)-কে আমরা বাঁচাব। গণতন্ত্রকে আমরা বাঁচাব।” ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে হিমাংশু কুমার-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় সুদর্শনা চক্রবর্তী।
প্র: ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে, যেখানে সাধারণ নাগরিক থেকে মানবাধিকার কর্মী সকলেরই মানবাধিকার বিপর্যস্ত, সেখানে এই দিনটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
উঃ ভারতবর্ষে মানবাধিকার বিপদের মধ্যে রয়েছে (খতরেঁ মে হ্যায়), যা অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতি। যে গোষ্ঠীগুলি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক – দলিত, আদিবাসী, মুসলমান, ক্রিশ্চান তাঁরা প্রত্যেকে বিপন্ন। তাঁদের উপর রাষ্ট্র শোষন-পীড়ন নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছে, তাঁদের মৌলিক অধিকার বলে কিছুই থাকছে না। ভারতে জাতপাত, ধর্মের নামে যে ট্র্যাডিশনাল বৈষম্য ছিলই, রাষ্ট্র এখন সেটিকেই পুঁজি করে অনেক বেশি করে বৈষম্য তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে। এখন দেশের নাগরিকদের এক গোষ্ঠী অন্য কোনও নাগরিক গোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে দেখলে বরং খুশি হচ্ছে, সমর্থন করছে, রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াচ্ছে। ভারতের মানুষ যেন ভুলে যাচ্ছেন যে জাতি হিসাবে নিজেদের সহ-নাগরিকদের অধিকার, মানবাধিকার নিরাপদ, সুরক্ষিত রাখাটা আমাদের দায়িত্ব। এখন সমাজের মধ্যেই একে অন্যের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ভারতবর্ষে এখনকার এই পরিস্থিতি ‘ইউনিক’।
প্র: সরকার আসে, সরকার যায় – রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায় না। আপনি যেটা বলছেন তা হল ভারতের মানুষের মধ্যেই ভেতর থেকে একটা বদল এসেছে। কেন এই বদল আদপে হচ্ছে?
উঃ আমার কাছে আসল ও প্রধান সমস্যা পুঁজিবাদ, ক্যাপিটালিজম। ক্ষমতাকে হস্তগত করার জন্য পুঁজিবাদ সমাজকে একটা প্রজেক্ট-এর মতো ব্যবহার করছে। জাতপাত, ধর্ম সবকিছুই পুঁজিবাদের হাতে ব্যবহৃত হয়ে যাচ্ছে। মানুষ তো এই সমাজেরই অংশ। ফলে পুঁজিবাদ তাকে যেরকম চালাচ্ছে সে সেইরকমই চলছে। ভারতে রাষ্ট্র এখন পুঁজিবাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তাই মানুষের মধ্যেও একটা অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন চোখে পড়ছে।
প্র: তবু এখনও তো এ দেশে আন্দোলন হয়। হয়তো তাঁরা সংখ্যায় সংখ্যালঘু। আচ্ছা আপনার কী মনে হয়, কেন মানুষের অধিকারের লড়াইগুলো আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ছে না, আরও বেশি মানুষকে ছুঁতে পারছে না?
উঃ তার একটা বড় কারণ আমাদের দেশের ইন্টেলেকচুয়ালদের (বুদ্ধিজীবী) বৃহত্তর জনগণের (মাস) উপর কোনও প্রভাব নেই। তাঁরা কিছু ম্যাগাজিন-এ ইংরেজিতে লিখে দেন, কোনও সেমিনার-এ বক্তৃতা দিয়ে দেন। যুবসমাজ, পড়ুয়া, কিসান, মজদুর, মৎস্যজীবী তাদের কারওর সঙ্গে এদের কোনও সংযোগ তৈরি হয় না। তাঁদের দেখাটা অনেক সীমিত হয়ে গেছে। প্রান্তিক মানুষদের পর্যন্ত তাঁরা আর পৌঁছাতে পারছেন না। জনগনের সংস্কৃতি, তাঁদের লড়াইয়ের ইস্যুগুলির উপর কোনও সাংগঠনিক প্রভাব এই বুদ্ধিজীবিদের আর নেই।
প্র: আগে তো পরিস্থিতি এরকম ছিল না। এটা কি কোনও রাজনৈতিক দল দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে না আসার ফলে হল?
উঃ দেখুন, রাজনৈতিক দল নির্বাচন লড়ে। তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা থাকে। মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরির কাজটা বুদ্ধিজীবীরা করতেন। এখন সেটা আরএসএস করে। স্থানীয় স্তরে রাজনীতি থেকে শুরু করে স্কুল চালানো সবেতেই আরএসএস সবটা দখল করে নিচ্ছে। গ্রামীণ ভারতে তারা যে কীভাবে শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে তা আমরা সকলেই জানি। একটা ভাবাদর্শ প্রচার করার প্রয়োজন ছিল, বৃহত্তর জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য, তাঁদের লড়াইয়ের সঙ্গে থেকে সেগুলো আরও জোরদার করার জন্য। আরএসএস-এর কিসান, মজদুর সবার সংগঠন রয়েছে, তারা প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে ‘ডায়ালগ’ চালিয়ে যাচ্ছে, নিজেদের ভাবাদর্শ প্রচার করছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ এ দেশের প্রগতিশীলরা তা করে উঠতে পারলেন না।
প্র: যখন আপনার কথা হয় তাঁদের সঙ্গে কি বলেন তাঁরা?
উঃ তাঁরা স্বীকার করে নেন। এ কথাও সত্যি তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এই উত্থানে তাঁরা হতাশ এবং কিছুটা ভয়ও পেয়েছেন।
প্র: এই যে আন্দোলনগুলো চলছে এগুলো শহরকেন্দ্রীক হয়ে পড়াটাও কি সংযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কারণ?
উঃ সংযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াটা তো বেশ দৃশ্যমান। তৃণমূলস্তরে আন্দোলন আছে, প্রতিরোধ আছে। প্রতিটি প্রান্তিক গোষ্ঠী নিজেদের অধিকারের জন্য নিরন্তর লড়াই লড়ে চলেছেন। শহুরে নাগরিক সমাজের সঙ্গে সংযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আশার কথা কিছু তরুণ দল বেঁধে কাজ করছে দেশের নানা প্রান্তে প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে নিয়ে। যেমন ধরুন, ডেলিভারি পার্টনারদের নিয়ে, যৌনকর্মীদের নিয়ে ইত্যাদি। কিন্তু এই কাজগুলো এখনও নতুন, ছোট ছোটভাবে হচ্ছে, এঁরাও পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে উঠতে পারছেন না এখনও, একে অপরের প্রতি রাজনৈতিক সংহতিও নেই। ফলে কাজগুলো ছড়াচ্ছে না।
প্র: এ দেশের নারীবাদী আন্দোলনকে, তার দাবি-দাওয়াকে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে প্রান্তিক মহিলাদের লড়াইয়ের সঙ্গে এক রেখায় দেখতে পান? না কি তাও শহরকেন্দ্রীক?
উঃ আদিবাসী গোষ্ঠীর লড়াইটা একটা জোটবদ্ধ লড়াই, সেখানে নারী, পুরুষ সকলে একসঙ্গে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করেন। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, শহুরে নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে প্রান্তিক মহিলাদের লড়াইগুলো বেশ ভালো রকম সংযোগ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু আমরা সেগুলো বলতে গেলে বলা হয়, পুরুষ হিসাবে আপনারা আমাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে আসবেন না। এরকম শুনলে আমরা নিজেদের আলোচনা থেকে সরিয়ে নিই।
প্র: আপনি সব সময়েই আশাবাদী। এমনকি যখন সুপ্রিম কোর্ট জরিমানা ঘোষণা করে, তখনও তা দেবেন না বলার পাশাপাশি আপনি এই সরকারকে গদি থেকে নামিয়ে এর শেষ দেখে ছাড়বেনও বলেছেন। বিভিন্ন রাজ্যের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল দেখার পর কী বলবেন?
উঃ এটা তো হওয়ারই ছিল। এ দেশে এখন দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটছে। আসল সমস্যাটা যেটা সেটা আগেও বলেছি পুঁজিবাদ, ক্যাপিটালিজম। এর উদ্দেশ্যই হচ্ছে গরীবকে আরও গরীব বানিয়ে দেওয়া, রোজগার খতম করে দেওয়া, সমস্ত সমস্ত শেষ করে দেওয়া – এভাবেই মানুষের মানবাধিকার নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে। হিন্দু, মুসলমানের মধ্যে যে বিদ্বেষ, বিভেদ তা তো রয়েইছে, কিন্তু তারচেয়েও বিপজ্জনক, খতরনাক হল অর্থনৈতিক দক্ষিণপন্থা। পুঁজিবাদী প্রপাগ্যান্ডা-য় কংগ্রেস তো আরও মারাত্মক। আসলে এদিক থেকে দেখলে বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল সবাই এক।
প্র: আমরা কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছচ্ছি – আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা, সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি যে রায় দিয়েছিল আপনাকে নিয়ে, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আপনি নালসা-র সঙ্গে কাজ করেছেন, আদিবাসীদের ন্যায় পাওয়ার লড়াই নানাভাবে বিচারব্যবস্থূাকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু আপনি এ কথাও বলেছেন যে সুপ্রিম কোর্ট, বিচারব্যবস্থাকে কাজ করতে কাজ করতে বাধ্য করতে হবে মানুষের জন্য। কীভাবে সেটা সম্ভব এখন?
উঃ হ্যাঁ আমি বলেছিলাম। এবং আমি বিশ্বাস করি সেটাই একমাত্র পথ। এছাড়া এখন আর উপায় নেই। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি যে অবস্থায় বর্তমানে রয়েছে তাতে আমাদের প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে, মানুষকে রাগিয়ে তুলতে হবে, সংগঠিত করতে হবে ও এই প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে মানুষের জন্য কাজ করার তাদের যে দায়িত্ব তা পালন করার জন্য চাপ তৈরি করে রাখতে হবে। যেমন আমি রুখে দাঁড়িয়ে বলে দিয়েছি যে জরিমানা আমি দেব না।
প্র: একা একজন হিমাংশু কুমার এই কাজটা কতদিন চালিয়ে যেতে পারবেন? ভবিষ্যতে কী করবেন?
উঃ ফিউচার কি হামে জায়দা ফিকর নেহি (ভবিষ্যত নিয়ে আমার বেশি ভাবনা নেই)। ওসব বেশি ভাবতে গেলে অনেক বেশি ক্যালকুলেটিভ হয়ে যেতে হয়। মানুষকে সচেতন করে যেতে হবে, তাদের ঐক্যবদ্ধ করে যেতে হবে। এটাই আমার কাজ।
প্র: শেষ প্রশ্ন, আজকের ভারতে গান্ধীবাদী আদর্শকে কীভাবে দেখেন আপনি?
উঃ আমার কাছে ইডিওলজি (মতাদর্শ) ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যতটা অ্যাকশন (কাজ)। গৌতম বুদ্ধর একটা গল্প বলি – একজন নদী পার হতে গিয়ে লাঠি দিয়ে নৌকা বানালেন, তারপর মাঝনদীতে গিয়ে তার মনে হল, নৌকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তখন সেটাকে মাথায় নিয়ে হেঁটে নদী পার হলেন। গৌতম বুদ্ধর কথা মনে রাখলে আমি মনে করি, ইডিওলজি একটা পরিস্থিতি পার হতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু তাকে মাথায় করে রাখলে হবে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজের পদ্ধতি স্থির করতে হবে। লেফটিস্ট-রা যেমন নিজেদের সংগঠন, পতাকা, ব্যানার এসবের জন্য লড়াই করতে গিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারলেন না, আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হল। আমি আর গান্ধীয়ান, লেফটিস্ট, আম্বেদকারাইট এইসব ভাগ চাই না। আজ এ দেশে সবাইকে একজোট হয়ে পুঁজিবাদী ফ্যাসিজম-এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। সবার নিজেদের মতাদর্শ সঙ্গে থাকুক, কিন্তু তা যেন জোট বাঁধতে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। তবে এই দীর্ঘ লড়াই লড়া যাবে।