মূর্খের পাণ্ডিত্য 


  • October 14, 2022
  • (4 Comments)
  • 3183 Views

গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন

 

প্রমথনাথ বিশী একবার এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকতা ও অধ্যাপনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন—মূর্খের পাণ্ডিত্য। আর অধ্যাপনা করতে গিয়ে—পণ্ডিতের মূর্খতা।

 

বহুবার বলা, বহুবার শোনা দুই পেশা সম্পর্কে এই তীক্ষ্ণ, তির্যক মন্তব্যটি আবারও একবার যে বলতে হল, তাঁর কারণ বিশী মহাশয়ের অভিজ্ঞতালব্ধ পর্যবেক্ষণটি আমাদের জীবনেও বার বার ফিরে আসে। এমনটি মনে করার কোনও কারণ নেই যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রথিতযশা অধ্যাপক সকল সাংবাদিক ও অধ্যাপককে একই তুলাদণ্ডে মেপে এমন মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু, ফের বিশী কথিত মুর্খামি কিংবা পাণ্ডিত্যের এক হাতে গরম উদাহরণ মেলার পর বলতে দ্বিধা নেই ‘উহারা’ আজও আছেন।

 

ঘটনাটি হল, মহালয়ায় প্রকাশিত উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকার ‘শারদাঞ্জলি’ ক্রোড়পত্রে সাহিত্যিক তৃপ্তি সান্ত্রা একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সে নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘মাতৃপক্ষ আর গৃহস্থ উঠোন’। সেখানেই তিনি এক জায়গায় লিখলেন, “মাকে পিণ্ডদানের অনুষ্ঠান হয় একমাত্র আমাদের মালদা জেলাতেই। মান্য সংস্কৃতির বাইরে — রাজবংশী, ধানুক, চাঁই, নাগর সহ তথাকথিত বেশ কিছু নীচু জাতের মেয়েদের অনুষ্ঠান এটি। তাঁরা মাতৃতর্পণ করেন, লৌকিক পরম্পরায়, দু’টি ধাপে।”

 

কতিপয় ব্যক্তি সেই সমগ্র নিবন্ধটি থেকে স্রেফ একটি শব্দবন্ধ প্রেক্ষিতহীনভাবে তুলে নিয়ে শোরগোল বাঁধিয়ে দিলেন। অভিযোগ তোলা হল, লেখিকা রাজবংশী সম্প্রদায়কে ‘নীচু জাত’ বলে অপমান করেছেন। সারা জীবন যে মানুষটির নানা লেখালিখির, গল্প, উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য পিছিয়ে থাকা দলিত মানুষ, দরিদ্র শ্রমজীবী মহিলা—তাঁর বিরুদ্ধে এমন এক অভিযোগ শুধু অবিশ্বাস্য নয়, প্রথমেই মনে হয় কোথাও একটি গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে।

 

সে কথায় পরে আসছি। প্রথমেই যা বলা দরকার, তা হল, লেখিকা এই অভিযোগের প্রত্যুত্তরে একটি চিঠি পাঠান। সে চিঠি ছাপা তো হলই না। উল্টে প্রকাশক, অভিযোগকারীদের বিকৃত ও খণ্ডিত উদাহরণটিকে তুলে ধরে ক্ষমা চেয়ে বসলেন। নীচে তৃপ্তি সান্ত্রার পুরো চিঠিটিই দেওয়া গেল।

 

একটি নিবেদন

১৪২৯-এর মহালয়া উপলক্ষে শারদাঞ্জলিতে ‘মাতৃপক্ষ ও আমাদের গৃহস্থ উঠোন’ শিরোনামে আমার লেখা প্রকাশিত হয়। এই লেখা প্রসঙ্গে উত্তরবঙ্গ সংবাদ ৯/১০/২২ তারিখে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে অসতর্কতা বশত কিছু জনগোষ্ঠীকে লেখক “নীচু জাত” বলেছে। গোটা প্রবন্ধটি থেকে এই দুটি শব্দ তুলে এনে আপনারা একটি অভিযোগের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেনে আমার অর্থাৎ লেখকের দিকে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি সোস্যাল মিডিয়ায় ট্রোলিং বলে একটি বিষয় পরিচিত; যারা কোনো লেখা/প্রবন্ধ/বক্তৃতার একটি-দুটি শব্দ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে তুলে আনে (ইংরেজিতে যাকে nitpicking বলে), সেই নিয়ে হইচই পাকায়। আপনাদের বিজ্ঞপ্তিটি ট্রোলদের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন; দুটি শব্দ তুলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেন, এবং আমাকে সোস্যাল মিডিয়ায় ট্রোলেদের হেনস্তার দিকে ঠেলে দিলেন।

 

পাঠক লক্ষ্য করে দেখবেন মূল প্রবন্ধটিতে “নীচু জাত” শব্দবন্ধের আগে “তথাকথিত” বলে একটি শব্দ রয়েছে। অসতর্কতাবশত নয় সম্পূর্ণ লেখাটির বিষয়বস্তুর প্রয়োজনে “তথাকথিত নীচু জাত” লেখা হয়েছে। উত্তরবঙ্গ সংবাদের সম্পাদকমন্ডলী নিশ্চয় বোঝেন “তথাকথিত” শব্দটি সরিয়ে দেওয়ার অর্থ কি হতে পারে। ভারতে কোনও লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি বা জনগোষ্ঠীকে “নীচু” অভিহিত করা মানবতা বিরোধী ও সংবিধান বিরোধী। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বর্ণবাদ দুষ্ট সমাজ “নীচু জাত” শব্দবন্ধ ব্যবহার করে। সেই দিকে দৃষ্টি রেখেই তথাকথিত শব্দের প্রয়োগ। সেখানে  মননশীল পাঠকমাত্রই বুঝবেন যে “তথাকথিত নীচু জাতি” শব্দবন্ধ ব্যবহার করে আমি বর্ণবাদের উচ্চ-নীচ মনোভাবকে ধিক্কার জানিয়েছি। এই নিবন্ধে সেই বিশ্বাস যথাযথ প্রতিফলিত হয়েছে বলেই মনে করি। আমার দীর্ঘ পাঁচ দশকের সাহিত্য কর্মের সাথে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন যে প্রান্তিক ও নিপীড়িত মানব-মানবীর মর্যাদার স্বীকৃতি আমার নানা লেখার কেন্দ্রীয় বিষয়। তবে বৃহত্তর সমাজ যে আজও তাঁদের যথাযোগ্য সম্মান দেয় না, সাহিত্যিক হিসেবে সেই সত্যটা আমি অস্বীকার করতে পারি না।

তৃপ্তি  সান্ত্রা।

মালদহ।

১১. ১০. ২০২২

 

একটি সংবাদপত্রের প্রকাশক, সংম্পাদকমণ্ডলী বিচার করে দেখবেন না যে, নীচু জাত’ বলা আর ‘তথাকথিত বেশ কিছু নীচু জাত’ শব্দবন্ধের মধ্যে তফাতটি ঠিক কোথায়? প্রকাশক বেমালুম ‘নীচু জাত’ লেখার জন্য ক্ষমা চেয়ে বসলেন। (নীচে দেখুন) তাঁর বা তাঁর সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকমণ্ডলীর এটুকু জানা নেই যে, ‘তথাকথিত’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ, “উক্ত নামে পরিচিত, কিন্তু ওই নামের যোগ্যতা বা যথার্থতা বিষয়ে সন্দেহ আছে।”, অর্থাৎ, লেখিকা বলতে চাইছেন, যাঁরা ‘নীচু জাত’ বলে থাকেন, তাঁদের সঙ্গে তিনি আদৌ একমত নন।

 

এই বিকৃত অভিযোগের মূল পাণ্ডাটি না কি এক রাজবংশী কবি ও অধ্যাপক। এবং তিনি না কি চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অনুগামী। ওই অধ্যাপকও কি জানেন না ‘তথাকথিত’ শব্দটি বাদ দিলে লেখকের বক্তব্যের মূল সুরটিকে বিকৃত করা হয়। সন্দেহ হয়, এই বিকৃতি অভিসন্ধিমূলক।

 

সংবাদপত্রটির তড়িঘড়ি ক্ষমা প্রার্থনা, এবং লেখককে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেওয়াকে চরম মুর্খামি এবং অপরাধ বলেই চিহ্নিত করতে হবে। একইভাবে যে বা যারা এই অভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ডে ইন্ধন জুগিয়েছে এবং সমাজমাধ্যমে এক বর্ষীয়ান, শ্রদ্ধেয় লেখককে চূড়ান্ত হেনস্থা করেছে, তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।

 

 

Share this
Recent Comments
4
  • comments
    By: Gautam Chaudhuri on October 15, 2022

    ভালো লাগলো প্রতিবেদনটি। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেওয়াকে মূর্খামি বলা যায় কি? এ তো deliberate অন্যায়।

  • comments
    By: Sukla Sen on October 15, 2022

    অভিযোগের প্রত্যুত্তরে লেখিকাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন‌ও সুযোগ না দিয়ে পত্রিকাটি তড়িঘরি দুঃখ প্রকাশ করলো এবং তৎপরবর্তীতে লেখিকার জবাব ছাপতে অস্বীকার করলো।
    এটা দৃশ্যতই ঘোর অন্যায়।
    প্রশ্ন হচ্ছে কারণ কি শুধুই ব্যবসায়ী হিসেব-নিকেশ, না তার চাইতে বেশি কিছু?

  • comments
    By: Swapan das on October 16, 2022

    Writing context and realisation of writer very good, published paper shoud discussed regd,protesters.

  • comments
    By: Anal Abedin on October 20, 2022

    লেখক ও লেখার প্রতি এই অসম্মান আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুবাদী উচ্চ ও মধ্য বিত্তের বাইপ্রোডাক্ট।

Leave a Comment